দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরাশক্তি হচ্ছে ভারত। সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে টিআরএফ নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলা চালিয়ে ২৬ জন বেসামরিক ভারতীয় নাগরিক হত্যা করে। ভারতের দাবি মতে দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট বা টিআরএফ পাকিস্তানের লস্কর-ই-তায়্যিবার একটি প্রক্সি গোষ্ঠী যা ২০১৯ সাল থেকে ভারতে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত। যদিও তারা কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। ভারতের দাবি এই হামলা ঘটিয়েছে পাকিস্তান। তারই জবাবে ভারত আক্রমণ করে পাকিস্তানে। ভারত-পাকিস্তান এই ৪ দিনের যুদ্ধের হিসাবনিকাশ, বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উদীয়মান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থান নিয়ে আলোচনা হবে এই নিবন্ধে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই দুই পারমানবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে বারংবার সংঘাতের সূত্রপাত ঘটেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে মিসাইল হামলা চালায় ভারতীয় বাহিনী। পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ‘অপারেশন বুনয়ান আল মারসুস’ শুরু করলে ৪ দিনব্যাপী একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
লাভ-ক্ষতি কার কত?
যুদ্ধের শুরুতেই দুই দেশের মধ্যে যৌথ চুক্তি বাতিল, আকাশপথ বন্ধ, কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। ভারতের জবাবে পাকিস্তানও পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নেয়। কয়েকদিনের এই যুদ্ধে দুই পক্ষই বেশ কয়েকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেকেন্ডারি আঞ্চলিক পরাশক্তি পাকিস্তানের সাথে লড়তে গিয়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারত। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপে ভারতকে গুনতে হয় অনেক বেশি। ধারণা করা হয়, সামরিক ও অর্থনৈতিক খরচ মিলিয়ে ভারতের হারাতে হয় ১০-৫০ বিলিয়ন ডলার যেখানে পাকিস্তান ৫-১৫ বিলিয়ন ডলার হারায় (রয়টার্স, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, আল জাজিরা, এবং সিএনএন)। ৭ মে যখন পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারত সিরিজ মিসাইল হামলা চালায়, প্রতিরোধে পাকিস্তান ভারতের ফ্রান্স থেকে কেনা অত্যাধুনিক রাফায়েল ও রাশিয়া থেকে কেনা একটি ফাইটার জেট ভূপাতিত করে। ভারতের দাবি তারা পাকিস্তানের ৩০০ এর উপরে ড্রোন ভূপাতিত করে। অন্যদিকে পাকিস্তান দাবি করে তারা ভারতের প্রায় শ’খানেক ড্রোন ভূপাতিত করে (যদিও দাবির পক্ষে তেমন শক্ত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি)। ভারতের ধ্বংস হওয়া ড্রোনের মধ্যে অন্যতম ছিল ইসরায়েল নির্মিত Heron UAV and Harop kamikaze অত্যাধুনিক ড্রোন। যুদ্ধে পাকিস্তানের ১১ সৈন্য ও ভারতের ৫ সৈন্য নিহত হলেও বেশ সংখ্যক বেসামরিক মানুষ মারা যান দুই পক্ষেরই।
দ্বিতীয়ত, ভারতের নিজ দেশের মানুষের নিরাপত্তা রক্ষার্থে ব্যর্থতার প্রমাণ দেয় ভারত। লাইন অব কন্ট্রোলের ২০০ কিঃমিঃ ভিতরে একটি জায়গায় হামলার ঘটনা ঘটে গেলেও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তা প্রতিরোধ করতে পারেনি। এতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ‘র’-এর সুনাম ক্ষুণ্ণ হয়। এতে ভারতের পরাশক্তি মর্যাদায় আঘাত লাগে। পাশাপাশি, পাকিস্তান চীনের থেকে উন্নত ফাইটার জেট ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনে শক্তিশালী হয়ে বসে আছে তা ভারত খবরই রাখতে পারেনি, যার ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় তাদেরকে।
তৃতীয়ত, এমন এক পরিস্থিতিতে যুদ্ধে জড়াতে হয় ভারতকে, যখন চারদিকের প্রতিবেশী দেশে ভারত বিরোধী মনোভাব বাড়ছে। ফলে যুদ্ধে ভারতের অবস্থান তলানিতে ঠেকায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তার সুনামে আঘাত লাগে। তাছাড়া, চীনের সাথে সম্পর্ক পাকিস্তানের সক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে যা ভারতের জন্য শঙ্কার কারণ। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া পাকিস্তানের জন্য অশনিসংকেত। তাছাড়া কাশ্মীর ইস্যু অনেকটা আড়ালে চলে গিয়েছিল। এই ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারও কাশ্মীর ইস্যু আলোচনায় আসা পাকিস্তানের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
যুদ্ধ কেন্দ্রিক বিজেপির রাজনীতি
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে আত্মপরিচয়ের রাজনীতি। অর্থাৎ- আমি কে, আমার পরিচয় কী হবে এই প্রশ্নকেন্দ্রিক ‘আমরা বনাম তারা’ বিভাজন। যার মাধ্যমে সমাজে ঘটে বহুমেরুকরণ, রাজনৈতিক সুবিধা পায় জনতুষ্টিবাদীরা। বিজেপি মূলত এই বিভাজনের রাজনীতিই করে থাকে, যার বর্ধিত সংস্করণ দেখা যায় পেহেলগাম অ্যাটাকের পর। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী সুপিরিওরিটি রাজনীতির অংশ হিসেবে তারা এটা দেখাতে চায় যে হিন্দুদেরকে অন্য ধর্মের মানুষেরা ঘৃণা করে। ফলে হিন্দুদের উচিত নিজেদের স্বার্থে বিজেপিকে ক্ষমতায় রাখা এবং হিন্দুরা বিজেপির আমলেই নিরাপদ। ফলে পেহেলগাম আক্রমণকে কেন্দ্র করে বিজেপি নিজেদের স্বার্থে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন তৈরি করে। যার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে আমরা দেখি এক বিজেপি নেতা ভারতীয় সেনাবাহিনীর মুখপাত্র সোফিয়া কোরেশীকে জঙ্গি পর্যন্ত বলে বসেন।
অন্যদিকে, ওয়াকফ বিল নিয়ে ভারতীয় মুসলিমরা যে আন্দোলন শুরু করেন তা পুরোটা ভেস্তে যায় এই আক্রমণের পর। ভারতীয় মুসলিমদের ন্যায্য আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে মুসলিমরা যে বঞ্চিত হয়েছেন সেই ন্যারেটিভ থেকে মুসলিমরা পাকিস্তান সাপোর্ট করে এই ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করে বিজেপি। রাতারাতি মুসলিমদের ন্যায্য দাবির আন্দোলন রেখে আগে প্রমাণ করতে হয় যে সে যুদ্ধে ভারতের পক্ষে, পাকিস্তানের পক্ষে নয়। পাশাপাশি পাকিস্তান সাপোর্টার বলে অনেক জায়গায় বিজেপি মব মুসলিমদের উপর নির্দয় হামলা করে।
তাছাড়া, কাশ্মীর পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেয় ৩৭০ আর্টিকেল বাতিলের মধ্য দিয়ে। তখন থেকেই কাশ্মীরের সামরিক নিয়ন্ত্রণ বেড়েই চলছে। পেহেলগাম হামলার ফলে বিজেপি একটি ইস্যু পেয়ে গেল। ফলে বিজেপি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের নামে কাশ্মীরে আরো বেশি সামরিক নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করবে। যার ফলে ভোগান্তি বাড়বে নিরীহ কাশ্মীরের জনগণের উপর।
বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান
বনে আগুন লাগলে যেমন পাখির বাসাও রক্ষা পায় না, তেমনি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে প্রতিবেশী তা এড়িয়ে যেতে পারে না। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশেও যুদ্ধের প্রভাব পড়তে পারে। দক্ষিণ এশিয়া শান্তিকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ভারতের বিজেপি ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী সরকার আসার পর, একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী দেশ হিসেবে ভারতের উত্থান প্রতিবেশী দেশ ও অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছেন অনেকেই। একটি দীর্ঘ সময় কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালীন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ থাকলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে আবার ভাবার সময় এসেছে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় শক্তিধর দেশ হিসেবে এই অঞ্চলের স্থিতিবস্থা নষ্ট করার দায় ভারত এড়াতে পারে না।
২০১৯ সালের এনআরসি আইন পাশ হওয়ার পর ভারতের মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণের স্বীকার হয়। বিজেপি আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের অনেক মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে আদতে তাদের রাষ্ট্রহীন করে দেয়। ফলে এইসময়ে মুসলিমদের বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যা দেয়। ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের মতো ভারত মুসলিমদের বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করতে পারে। যার দরুন বাংলাদেশ বর্তমানে শঙ্কায় রয়েছে বলা যায়। তাছাড়া গত বছরের ৫ আগস্টের পর ভারত বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে যা বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
কৌটিল্যের মতে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু কিংবা চিরস্থায়ী শত্রু বলে কিছু হয় না। এক সময়ের বন্ধু এক পর্যায়ে গিয়ে শত্রু হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু এই ধারণাও কৌটিল্যের দেওয়া। অর্থাৎ শত্রুর শত্রুর সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হবে সেটাও কাম্য। এই সূত্রগুলো মূলত একটি রাষ্ট্র অনুসরণ করবে যখন অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে। বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত বর্তমানে উগ্র হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির জন্য বাংলাদেশের জন্য হুমকি। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত হবে পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করা।
শেখ মুজিবুর রহমান যখন ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান যান, তখন তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ভাই-ভাই ঝগড়া লাগতেই পারে, তাই বলে ভাই কখনো পর হয়ে যায় না। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ দর্শনের বিকল্পও নেই। তাছাড়া, বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী চীন। চীনের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হচ্ছে “শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু”। চীনের কাছ থেকে আসা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প (যেমন তিস্তা বহুমুখী প্রকল্প) ভারতের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করা। তাতে ভারত বার্তা পাবে যে- বাংলাদেশ তার শত্রু হয়ে যাবে যদি সে দেশের উন্নয়নে বাধা তৈরি করে। তাতে ভারত আমাদের শত্রু হবে না, বাংলাদেশও তার কৌশলগত সুবিধাও পাবে। সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না।