হাদীসের মূলভাষ্য
عَنْ عُمَرَ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ ، قَالَ: ” بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ، إذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ، شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعْرِ، لَا يُرٰى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ، وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ. حَتَّى جَلَسَ إلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إلٰى رُكْبَتَيْهِ، وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلٰى فَخِذَيْهِ، وَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الْإِسْلَامِ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إلٰهَ إلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إنِ اسْتَطَعْتَ إلَيْهِ سَبِيلًا. قَالَ: صَدَقْتَ. فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ! قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِيمَانِ. قَالَ: أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَتُؤْمِنَ بِالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. قَالَ: صَدَقْتَ. قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِحْسَانِ. قَالَ: أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ. قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ السَّاعَةِ. قَالَ: مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ. قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَاتِهَا؟ قَالَ: أَنْ تَلِدَ الْأَمَةُ رَبَّتَهَا، وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُوْنَ فِي الْبُنْيَانِ. ثُمَّ انْطَلَقَ، فَلَبِثْنَا مَلِيًّا، ثُمَّ قَالَ: يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنِ السَّائِلُ؟. قُلْتُ: اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَعْلَمُ. قَالَ: فَإِنَّهُ جِبْرِيْلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ “. رواه مسلم.
অনুবাদ:
হযরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় ধবধবে সাদা পোশাক পরিহিত ও ঘনকালো চুল বিশিষ্ট একজন লোক আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। তার মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল না, আর আমাদের কেউও তাকে পরিচয় করতে পারছিলেন না। এমনকি তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে বসলেন এবং তার দুই হাঁটুকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুই হাঁটুর সাথে মিলালেন এবং নিজের দুই হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন আর বললেন: হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবগত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম হলো- তুমি একথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, রামাদানের রোযা রাখবে এবং বায়তুল্লাহর হজ্জ করবে, যদি তুমি সেখানে পৌঁছতে সমর্থ হও। (উত্তর শুনে) তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন। তার আচরণে আমরা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম যে তিনি প্রশ্ন করছেন আবার সত্যায়নও করছেন।
অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে অবগত করুন (অর্থাৎ ঈমান কী?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখিরাতের দিনের প্রতি এবং বিশ্বাস করবে তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি। (উত্তর শুনে) তিনি বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন।
অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কে অবগত করুন (অর্থাৎ ইহসান কী?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তাহলে (মনে করবে যে) তিনি তোমাকে দেখছেন।
এরপর তিনি বললেন, আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবগত করুন (অর্থাৎ কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি প্রশ্নকারীর চেয়ে অধিক জানেন না। তখন তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, তাহলে এর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে আমাকে অবগত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দাসী তার মনিবকে জন্ম দিবে এবং নগ্নপদ, উলঙ্গ শরীর, দরিদ্র, মেষ রাখালদের উঁচু দালান নিয়ে গর্ব করতে দেখবে।
অতঃপর ঐ ব্যক্তি (প্রশ্নকারী) চলে গেলে আমরা কিছুক্ষণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে উমর, তুমি কি জানো এই প্রশ্নকারী কে? আমি জবাব দিলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি হলেন জিবরীল (আ.)। তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য তিনি এসেছিলেন। (মুসলিম)
হাদীস প্রাসঙ্গিক কথা
এ হাদীস যেমন সুদীর্ঘ তেমনি এতে ইসলামের মৌলিক বিষয়াদি একত্রে সন্নিবেশিত। এ হাদীসকে উম্মুস সুন্নাহ বা উম্মুল আহাদীস-সকল হাদীসের মূল বলা হয়। আল্লামা ইবনু দাকীক আল ঈদ (র.) লিখেছেন,
هذا حديث عظيم قد اشتمل على جميع وظائف الأعمال الظاهرة والباطنة، وعلوم الشريعة كلها راجعة إليه ومتشعبة منه لما تضمنه من جمعه علم السنة فهو كالأم للسنة كما سميت الفاتحة: أم القرآن لما تضمنته من جمعها معاني القرآن.
-এটি হলো এমন এক মহান হাদীস, যাতে জাহিরী ও বাতিনী সকল আমলের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শরীআতের সকল জ্ঞান এ হাদীসের দিকেই প্রত্যাবর্তিত এবং এ হাদীস থেকেই নির্গত। সুন্নাহর সকল জ্ঞান এতে অন্তর্ভুক্ত। এ হাদীস যেন ‘উম্মুস সুন্নাহ’ তথা সুন্নাহর মূল, যেমন সূরা ফাতিহা হলো উম্মুল কুরআন বা কুরআনের মূল; যেহেতু সূরা ফাতিহার মধ্যে সম্পূর্ণ কুরআনের মর্মার্থ সন্নিবেশিত। (শরহুল আরাবাঈন)
হাদীসে প্রশ্নকারী কে ছিলেন?
হাদীসের প্রথম অংশে প্রশ্নকারীর পরিচয় গোপন থাকলেও শেষে হযরত উমর (রা.) আগ্রহের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ ব তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন যে, তিনি হলেন হযরত জিবরীল (আ.)। হযরত জিবরীল (আ.) মানুষের বেশে রাসূল ব-এর দরবারে এসে প্রশ্ন করেছিলেন। এ কারণে হাদীসটি ‘হাদীসে জিবরীল’ নামে প্রসিদ্ধ।
বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনায় পাওয়া যায় যে হযরত জিবরীল (আ.) মানুষের বেশে রাসূলুল্লাহ ব এর দরবারে আসলে সাধারণত হযরত দাহইয়া কালবী (রা.) এর আকৃতিতে আসতেন। তবে এ হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি একজন অপরিচিত আগন্তুকের বেশে এসেছিলেন। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, চেহারা-সুরত ছিল পরিপাটি।
উল্লেখ্য যে, জিবরীল নামের ক্ষেত্রে জিবরীল এবং জিবরাঈল দুটি লুগাতই সঠিক।
প্রশ্নকারীর সত্যায়ন ও সাহাবায়ে কিরামের প্রতিক্রিয়া
এ হাদীসে অপরিচিত আগন্তুকের বেশে হযরত জিবরাঈল (আ.) প্রশ্ন করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ ব এর জবাব শুনে তা সত্যায়ন করেছেন। এটি ছিল একটি বিরল ঘটনা। ফলে সাহাবায়ে কিরাম এতে আশ্চর্যান্বিত হন, যার বর্ণনা এ হাদীসে রয়েছে। এমনকি বর্ণনাকারী হযরত উমর (রা.) প্রশ্নকারী চলে যাওয়ার পরও তার পরিচয় জানার আগ্রহে দীর্ঘ সময় দরবারে রিসালতে বসা ছিলেন।
হযরত আবূ যর ও আবূ হুরায়রা (রা.) এর বর্ণনায় আছে, আমরা যখন এই ব্যক্তিকে “আপনি ঠিক বলেছেন” বলতে শুনলাম তখন আমরা এরূপ বলা অপছন্দ করলাম (নাসাঈ)। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, সাহাবায়ে কিরাম বলাবলি করলেন, দেখ সে জিজ্ঞাসা করছে আবার সত্যায়নও করছে। সে যেন আল্লাহর রাসূল থেকে বেশি জানে। অন্য বর্ণনায় আছে, তারা বললেন, আমরা তো এরূপ কোনো ব্যক্তি দেখিনি। সে যেন আল্লাহর রাসূলকে শেখাচ্ছে। আর বলছে, আপনি ঠিক বলেছেন, ঠিক বলেছেন!
সারকথা হলো, আগন্তুক প্রশ্নকারীর পরিচয় প্রথমে সাহাবায়ে কিরামের জানা ছিল না। তাই রাসূল ব এর উত্তর সত্যায়ন করাকে তারা ধৃষ্টতা মনে করেছেন বিধায় তারা এরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
হাদীস বর্ণনার কারণ
হাদীসটি বর্ণনার কারণ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, যখন لَا تَرْفَعُوْا اَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ এ আয়াত নাযিল হলো তখন সাহাবায়ে কিরাম (রা.) আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ভয়ে তারা আল্লাহর রাসূলের দরবারে কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেতেন না। এমনকি একান্ত প্রয়োজন থাকলেও তারা প্রশ্ন করতে সাহসী হতেন না। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাআলা সাহাবায়ে কিরামকে আদব-শিষ্টাচার ও প্রশ্ন করার রীতিনীতি ইত্যাদি শিক্ষাদানের জন্য হযরত জিবরাঈল (আ.) কে মানুষের আকৃতিতে প্রেরণ করেন, যাতে সাহাবায়ে কিরাম নিঃসঙ্কোচে রাসূলুল্লাহ ব এর দরবারে প্রশ্ন করে দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয়বলি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। হাদীসের শেষাংশেও এ কথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন, হাদীসের ভাষ্য হলো: أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ -তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য এসেছিলেন।
হাদীসের ব্যাখ্যা
এ হাদীসে ইসলামের সকল মৌলিক বিষয়ের আলোচনা ও শিক্ষা রয়েছে। প্রথমে জিবরীল (আ.) যে পদ্ধতিতে দরবারে রিসালতে বসেছেন সেটিও একটি শিক্ষা। তিনি কিভাবে বসেছিলেন এ বিষয়ে হাদীসের ভাষ্য হলো- তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে বসলেন এবং তার দুই হাঁটুকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুই হাঁটুর সাথে মিলালেন এবং নিজের দুই হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন। এখানে ‘তাঁর উরু’ বলতে দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, জিবরীল (আ.) নিজের দুই হাত নিজের উরুর উপর রেখেছিলেন। এটিই শিক্ষকের সামনে ছাত্রের বসার পদ্ধতি। আবার কেউ কেউ বলেন, তিনি নিজের দু হাত রাসূলুল্লাহ ব এর উরুর উপর রেখেছিলেন। নাসাঈ শরীফের বর্ণনায়ও এরূপ রয়েছে। আল্লামা মোল্লা আলী কারী বলেন, এভাবে হাঁটুর সাথে সাথে হাঁটু মিলিয়ে কাছাকাছি বসা বিনয় ও আদবের অধিক নিকটবর্তী এবং পরিপূর্ণরূপে শ্রবণ ও মনোযোগ আকর্ষণে পরিপূর্ণতার লক্ষণ। এরূপ বসা থেকে প্রশ্নকারীর হাজত বা প্রয়োজনের আধিক্য বুঝায়। ফলে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি প্রশ্নকারীর হাজত ও আগ্রহের দিক বিবেচনায় দ্রুত জবাব প্রদান করতে এগিয়ে আসেন।
এ হাদীসে রাসূলে পাক ব এর একান্ত মনোযোগ আকর্ষণ করে জিবরীল (আ.) চারটি প্রশ্ন করেছেন। এগুলো হলো-
১. ইসলাম কী?
২. ঈমান বলতে কী বুঝায়?
৩. ইহসান কী?
৪. কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?
ইসলাম এর পরিচয়
ইসলাম শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো আনুগত্য করা, স্বীকৃতি দেওয়া ইত্যাদি। পরিভাষায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব এর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নাম ইসলাম। হাদীসে প্রশ্নকারী হযরত জিবরাঈল (আ.) ইসলাম সম্পর্কে জানতে চাইলে এর জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিষয়ের কথা বলেছেন। এগুলো হলো- ১. ঈমানের ঘোষণা দেওয়া অর্থাৎ তুমি একথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, ২. নামায কায়েম করবে, ৩. যাকাত দিবে, ৪. রামাদানের রোযা রাখবে ৫. সামর্থবান হলে বায়তুল্লাহর হজ্জ করবে। এ পাঁচটি বিষয় মুসলিম জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ ও বাহ্যিক রূপ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব এর আনুগত্যের ভিত্তিতেই এগুলো সম্পাদিত হয়।
ঈমান এর পরিচয়
ঈমান শব্দের অর্থ হলো বিশ্বাস করা বা সত্যায়ন করা, আনুগত্য করা ইত্যাদি। ইমাম আবূ হানীফা (র.) এর মতে ঈমান হলো আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতির নাম। ইমাম গাযালী (র.) এর মতে, নবী করীম ব যা নিয়ে এসেছেন সেসকল বিষয়সহ তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান। আলোচ্য হাদীসে ঈমান কী এ প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ ব কিছু মৌলিক বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলেছেন। এগুলো হলো- ১. আল্লাহর প্রতি বিশ^াস স্থাপন করা, ২. ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস করা, ৩. আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস করা, ৪. রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস করা ৫. আখিরাতের দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ৬. তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি বিশ্বাস করা। এ বিশ্বাসসমূহ হলো অন্তরের বিষয়। মনে-প্রাণে এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে।
ঈমানে মুফাসসাল এর মধ্যে মৌলিক সাতটি বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কথা আমরা পাই। পূর্বোক্ত ছয়টি বিষয় ছাড়া আরেকটি হলো ‘মৃত্যুর পর জীবিত হওয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন’ করা। কিন্তু আলোচ্য হাদীসে এ কথা নেই। তবে আলাদাভাবে না থাকলেও মূলত আখিরাতের দিনের প্রতি বিশ্বাসের মধ্যে এ বিশ্বাসের কথাও লুক্কায়িত রয়েছে। বুখারী শরীফের অন্য বর্ণনায় ‘ঈমান কী?’ এ প্রশ্নের জবাবে ‘মৃত্যুর পর জীবিত হওয়ার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন’ এর বিষয় আছে। হাদীসের কিতাবাদিতে কোনো কোনো বর্ণনায় কেবল আখিরাতের দিনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কথা আছে, আবার কোনো বর্ণনায় কেবল ‘মৃত্যুর পর জীবিত হওয়ার প্রতি বিশ^াস স্থাপন’ এর কথা আছে। ঈমানে মুফাসসালে উভয় বর্ণনার সমন্বয় করা হয়েছে। তাছাড়া কোনো কোনো বর্ণনায় জান্নাত, জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কথাও আছে। এগুলো মূলত মৃত্যু পরবর্তী জীবনের অংশ হিসাবে তা আলাদাভাবে ঈমানে মুফাসসালে সন্নিবেশিত হয়নি।
ঈমান ও ইসলাম এর পার্থক্য
ঈমান ও ইসলাম এক না ভিন্ন বিষয় এ নিয়ে উলামায়ে কিরামের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে। এ হাদীসের বর্ণনাভঙ্গি থেকে উভয়ের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ঈমান হলো অন্তরের বিষয় আর ইসলাম হলো এর বাহ্যিক দিক। একদল উলামায়ে কিরামের মতে, ঈমান ও ইসলাম এক বিষয়। এতদুভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ইবনু হাজার আসকালানী (র.) মতে, ঈমান ও ইসলাম এ দু শব্দ ব্যবহারিক দিক থেকে ফকীর ও মিসকীন শব্দদ্বয়ের মতো। দুটি শব্দ একত্রে আসলে ভিন্ন অর্থ প্রদান করবে আর পৃথকভাবে আসলে একই অর্থ প্রদান করবে।
ইহসান এর পরিচয়
ইহসান শব্দের অর্থ হলো সুন্দর করা, নিষ্ঠার সাথে কাজ করা। পরিভাষায় ইহসান হলো জাহির ও বাতিন উভয়কে সংশোধন করা এবং খুশু-খুযু সহ যাবতীয় শর্ত সহকারে আদবের সাথে আমল করা। আল্লামা খাত্তাবী (র.) বলেন, এখানে ইহসান বলতে ইখলাস উদ্দেশ্য। এটি ঈমান ও ইসলাম উভয়টি বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত। কেউ যদি ঈমানের কালিমা বা বাক্য মুখে উচ্চারণ করে এবং প্রয়োজনীয় আমলও করে কিন্তু তাতে যদি ইখলাস বা একনিষ্ঠতা না থাকে তা হলে সে ‘মুহসিন’ বলে গণ্য হবে না এবং তার ঈমানও শুদ্ধ হবে না। (শরহু মিশকাত লিত তীবী)
এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ঈমান তথা আন্তরিক বিশ্বাস ও ইসলাম তথা বাহ্যিক আমল শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইহসান শর্ত। এই ইহসানের মূল মর্ম হলো নিজের ঈমান, আমল সবকিছুকে আল্লাহর জন্য খালিস করা, সব সময় নিজেকে আল্লাহর দৃষ্টির মধ্যে ও তাঁর সমীপে হাজির মনে করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ ব ‘ইহসান কী?’ এই প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তাকে দেখছ এটি মনে করতে না পার তাহলে মনে করবে তিনি তোমাকে দেখছেন। এটিই ইলমে তাসাওউফের মূলকথা। তাই উলামায়ে কিরাম ইহসান বলতে ইলমে তাসাওউফ বুঝিয়ে থাকেন। সূফিয়ায়ে কিরাম বলেন, কেউ যদি হৃদয়ে এই ধ্যান স্থায়ী করে নিতে পারে যে আল্লাহ তাকে দেখছেন তাহলে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোনো অবস্থাতেই তার পক্ষে কোনো গুনাহ’র কাজে লিপ্ত হওয়া সম্ভব হবে না। কুরআন ও সুন্নাহতে এর অগণিত দলীলও রয়েছে।
এখানে ইহসানের দুটি স্তরের বর্ণনা রয়েছে। একটি হলো নিজে আল্লাহকে দেখার অনুভূতি বা স্তর। উচ্চ পর্যায়ের আরিফগণের অবস্থা এটি। আরেকটি হলো আল্লাহ আমাকে দেখছেন এই অনুভূতি বা স্তর। একজন সাধারণ মুসলমান সদা-সর্বদা এ বিশ্বাস ও ধ্যান হৃদয়ে পোষণ করে নিজের সকল আমলকে সংশোধন ও আল্লাহর ওয়াস্তে খালিস করে নিতে পারে।
কিয়ামতের আলামত
এ হাদীসে হযরত জিবরীল (আ.) এর শেষ প্রশ্ন ছিলো, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? এর জবাবে রাসূলুল্লাহ ব বলেছেন, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি প্রশ্নকারীর চেয়ে অধিক জানেন না। রাসূল ব এ কথা বলেননি যে, আমি জানি না। বরং বলেছেন, প্রশ্নকারীও এ বিষয়ে অধিক জানেন না। এর দ্বারা তিনি বুঝিয়েছেন যে কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে তা কেউই জানেন না। এটি কেবল আল্লাহই ভালো জানেন। যেমন পবিত্র কুরআন মাজীদে এসেছে- اِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ -কিয়ামতের জ্ঞান কেবল আল্লাহর হাতে।
এরপর জিবরীল (আ.) কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসূলুল্লাহ ব বিশেষভাবে দুটি আলামতের কথা উল্লেখ করেন।
এক. দাসী তার মনিবকে জন্ম দিবে। এর ব্যাখ্যা নিয়ে মুহাদ্দিসীনে কিরামের বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়। আল্লামা আইনী (র.) বলেন, যুদ্ধে ব্যাপক সংখ্যক নারী দাসী হয়ে আসবে। এরপর মালিকের সাথে সহবাসে সন্তান জন্ম দিবে। মালিকের মৃত্যুর পর সন্তান তার তার মায়ের মালিকের মতো হবে।
কেউ কেউ এর দ্বারা আমানতের খেয়ানত ও অপাত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। যেমন অন্য হাদীসে আছে, এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে প্রশ্ন করলেন, কিয়ামত কখন হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাৎক্ষণিক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পূর্বের আলোচনা অব্যাহত রাখলেন। পরে প্রশ্নকারীকে খুঁজে বললেন, فَاِذَا ضُيِّعَتِ الْاَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ -যখন আমানত নষ্ট হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। তখন প্রশ্নকারী আবার বললেন, আমানত নষ্ট হওয়া মানে কী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন اِذَا وُسِّدَ الْاَمْرُ اِلٰى غَيْرِ اَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ –যখন যোগ্য নয় এমন ব্যক্তির নিকট ক্ষমতা প্রদান করা হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। (বুখারী)
দুই. নগ্নপদ, উলঙ্গ শরীর, দরিদ্র, মেষ রাখালদের উঁচু দালান নিয়ে গর্ব করতে দেখবে। অর্থাৎ যারা একেবারে নিঃস্ব তারা অঢেল সম্পদের অধিকারী হবে এবং উঁচু বাড়ি-ঘর ও দালান নির্মাণে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। অথচ তাদের না ছিলো জুতা পরার সামর্থ্য, না ছিলো কাপড় কেনার সামর্থ্য। বরং মেষ রাখালী করে তারা জীবন কাটাতো।
এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাত্র দুটি আলামতের কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের সমাজে এ দুটি আলামত চাক্ষুষ দৃশ্যমান। কিয়ামতের আরো অনেক আলামত বা নিদর্শন রয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে এসবের বর্ণনা রয়েছে।
হাদীসের শিক্ষা
এ হাদীস থেকে আমরা অনেক শিক্ষা পাই। এর মধ্যে রয়েছে-
১. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ হলো সাহাবায়ে কিরামের সাথে উঠাবসা করা। এটি তাঁর উত্তম চরিত্রের একটি দিক। সুতরাং আমাদের জন্য উচিত হলো সমাজের মানুষের সাথে মিলে মিশে থাকা। কেননা মানুষের সংশ্রব দ্বীনের জন্য ক্ষতিকর না হলে একাকী থাকার চেয়ে সকলের সাথে মিলেমিশে থাকা উত্তম। তবে মানুষের সংশ্রব দ¦ীনের জন্য ক্ষতিকর হলে একাকী থাকাই উত্তম।
২. কোনো বিষয় জানা না থাকলে জানার উদ্দেশ্যে জ্ঞানী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করা উচিত। পবিত্র কুরআনেও এর নির্দেশ রয়েছে।
৩. আলিম-উলামা, মর্যাদাবান মানুষ ও রাজা-বাদশাহ’র দরবারে সুন্দর পোশাকে পরিপাটি ও পরিচ্ছন্নরূপে যাওয়া উচিত। এ থেকে এ দলীলও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, ইবাদত-বন্দেগীর উদ্দেশ্যে আল্লাহর সমীপে হাজির হওয়ার সময় সুন্দর পোশাক পরিধান করা উত্তম।
৪. উলামায়ে কিরাম ও বুযুর্গানে দ্বীনের সামনে আদবের সাথে বসা উচিত।
৫. সর্বোপরি নিজের ঈমান, আমল সবকিছুকে আল্লাহর জন্য খালিস করা এবং সব সময় নিজেকে আল্লাহর সমীপে হাজির মনে করার ধ্যান হৃদয়ে জাগ্রত করা একান্ত জরুরী।