হযরত মাওলানা ছালিক আহমদ একজন নিভৃতচারী আলিমে দ্বীন, প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস ও আশিকে রাসূল। সৃষ্টির চিরায়ত নিয়মে গত ২৪ জুন, ২০২১ বৃহস্পতিবার তিনি মাওলায়ে হাকীকীর সান্নিধ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলাধীন লামাকাজী ইউনিয়নের ভূরকী (পীর বাড়ী) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারে ১৯৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা পীর আবুল লেইছ ছিলেন এলাকার একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব।
গ্রামের মসজিদের মক্তবে হযরত মাওলানা ছালিক আহমদ (র.) এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর পার্শ্ববর্তী কাজীবাড়ি মাদরাসায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি ভর্তি হন সৎপুর টাইটেল মাদরাসায়। তিনি এ মাদরাসা থেকে পর্যায়ক্রমে দাখিল, আলিম ও ফাযিল পাশ করে ১৯৯০ সালে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে কামিল জামাত সমাপন করেন। ফাযিল-কামিল অধ্যয়নকালে বিভিন্ন সময় তিনি মাদরাসার খ-কালীন শিক্ষক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে প্রথম বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
১৯৯০ সালে কামিল পাশ করার পর ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সিলেটের জকিগঞ্জ সিনিয়র ফাযিল মাদরাসা ও ইছামতি কামিল মাদরাসায় ২ বছর শিক্ষকতার পর তিনি নিজ প্রতিষ্ঠান সৎপুর কামিল মাদরাসায় ১৯৯৩ সালের ২ মে আরবী প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি পর্যায়ক্রমে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক ও মুহাদ্দিস, সর্বশেষ ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত উপাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রথিতযশা এ আলিমে দ্বীন ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামিল শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর একজন সুযোগ্য অনুসারী ও অনুগামী। তাঁর নিকটই তিনি ইলমে তাসাওউফের দীক্ষা গ্রহণ করেন। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর কাছ থেকে তিনি একাধারে ইলমে কিরাত, ইলমে হাদীস ও দালাইলুল খাইরাত শরীফের সনদ লাভে ধন্য হন। শাইখুল হাদীস আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী’র নিকট থেকেও তিনি ইলমে হাদীস ও দালাইলুল খাইরাত শরীফের সনদ লাভ করেন। তাছাড়া শাইখুল হাদীস হযরত আল্লামা হবিবুর রহমান ছাহেব (মুহাদ্দিস ছাহেব, রারাই) এর কাছ থেকেও ইলমে হাদীসের সনদ লাভ করেছেন। তাঁর হাদীসের উল্লেখযোগ্য উস্তাযগণের মধ্যে রয়েছেন, হযরত মাওলানা আব্দুল হাই ছাতকী, হযরত আল্লামা রইছ উদ্দিন হামজাপুরী (র.) ও হযরত মাওলানা শফিকুর রহমান পাকিছিরী প্রমুখ।
মাওলানা ছালিক আহমদ (র.) সারা জীবন ইলমে দ্বীনের খিদমতে কাটিয়েছেন। তাঁর হাদীসের দরসগুলো ছিল পা-িত্যপূর্ণ। হাদীসের প্রতি তাঁর এতো অনুরাগ ছিল যে, তাঁর ধ্যানে, মন-মননে সবসময় ছিল হাদীসে নববী। তাঁর এক বর্ণনায় জানা যায়, একবার হজ্জের সফরে মসজিদে নববীতে চল্লিশ ওয়াক্ত নামাযের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসের সনদের সবলতা ও দুর্বলতা নিয়ে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগলে রাত্রে স্বপ্নে দেয়ালে সনদসহ হাদীসখানা দেখতে পেয়ে তিনি প্রশান্ত হন। একদিন সৎপুর মাদরাসায় কামিল জামাতের হাদীসের দরসে হুযুরের মধ্যে হঠাৎ একটু কাঁদো কাঁদো ভাব আসে, ছাত্ররা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে বললেন, এটা মুসালসাল বিষয়। সব শাইখগণ এরকম করতেন। সহীহ বুখারীর প্রতি তাঁর এমন অগাধ আস্থা ছিল যে, তিনি বলেছেন, বুখারী শরীফের খতমের বদৌলতে তিনি কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেছিলেন।
হাদীসে নববীর খিদমতের পাশাপাশি দ্বীনের একজন দাঈ-মুবাল্লিগ হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর তালীম-তরবিয়ত, বয়ান-নসীহত ছিল দালিলিক এবং মাধুর্যপূর্ণ। যে কাউকে তার বয়ান মুগ্ধ করত। এক্ষেত্রে তাঁর পথিকৃৎ ছিলেন হযরত আল্লামা রইছ উদ্দিন হামজাপুরী (র.)।
ইলমে কিরাতের খিদমতেও তিনি আজীবন নিবেদিত ছিলেন। তিনি ১৯৮১ সালে হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের খিদমতে নিজেকে আজীবন নিয়োজিত রেখেছিলেন। ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) ছাড়াও তিনি আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী, আল্লামা নজমুদ্দীন চৌধুরী ও আল্লামা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর কাছে কিরাতের তালীম ও বিশেষ সান্নিধ্য লাভ করেন। তিনি দারুল কিরাতের ভূরকী হাবিবিয়া হাফিজিয়া দাখিল মাদরাসা শাখার দীর্ঘদিনের প্রধান কারী ও নাযিম এবং ট্রাস্টের পরিদর্শক ও প্রধান কেন্দ্রের পরীক্ষক হিসেবে জীবনের শেষ অবধি কাজ করে গেছেন। ইন্তিকালের আগের সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি ট্রাস্টের প্রধানকেন্দ্র ফুলতলী ছাহেব বাড়ি’র ছাদিছ জামাতের পরীক্ষা গ্রহণে নিয়োজিত ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি তাঁর মুহাব্বাত এত বেশি ছিল যে, সকল কাজেই তিনি সুন্নতে রাসূলের অনুসরণ করতেন। সবসময় তাকে বিভিন্ন দুরুদ শরীফের আমল করতে দেখা যেত এবং তিনি তাঁর প্রতিটি বয়ানেই দুরূদ শরীফের ফযীলতের বিষয়টি রাখতেন। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি আশিকে রাসূল। দীদারে মুস্তফা তাঁর নসীব হয়েছিল কয়েকবার। হযরত খিজির (আ.) এর দীদারও পেয়েছিলেন তিনি।
তিনি একজন সফল সংগঠকও ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর কেন্দ্রীয় সদস্য ও লতিফিয়া কারী সোসাইটি বিশ্বনাথ উত্তর উপজেলা শাখার দীর্ঘদিনের সফল সভাপতি হিসেবে ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি ছিলেন একজন সুলেখক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, স্মারক, ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর লেখাগুলো পড়লে এবং তাঁর জীবন ও কর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তিনি কতটা সব্যসাচী ছিলেন। ইন্তিকালের চার/পাঁচ দিন আগে মাসিক পরওয়ানায় পাঠানো স্বহস্তে লিখিত ২৩ পৃষ্ঠার প্রবন্ধটি ছিল তাঁর সর্বশেষ গবেষণাকর্ম (পরওয়ানা বর্তমান সংখ্যা, জুলাই ২০২১-এ মুদ্রিত)। তাঁর হস্তলিপি এত সুন্দর এবং নিখুঁত ছিল যে, দেখলে যে কারো চোখ জুড়াতো।
ক্ষণজন্মা এ মনীষী আমাদের থেকে চলে গেলেও তাঁর রেখে যাওয়া ইলিম-আখলাক সিনায় সিনায় প্রবহমান থাকবে কিয়ামত অবধি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।