[আল্লাহপ্রাপ্তির উপায়, পার্থিব জীবনের হাকীকত, শরীআত অনুযায়ী জীবনযাপনের গুরুত্ব, আল্লাহর ফয়সালায় আত্মসমর্পন করা, তাওয়াক্কুল, খাউফ, রিদার মর্মার্থ, নফস ও প্রবৃত্তির মুকাবিলাসহ বিভিন্ন বিষয়ে শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর ৮০টি বক্তব্যের এক অনবদ্য সংকলন ফুতুহুল গাইব। শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর একজন মুরীদ শাইখ যাইনুদ্দীন মারসফী আস সাইয়াদ এ গ্রন্থটির মূল সংকলক। শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহিমাহুল্লাহ মক্কায় হজ্জ করতে গিয়ে শাইখ আলী মুত্তাকীর কাছে বইটি পেয়ে একটি কপি সাথে করে নিয়ে আসেন। উপমহাদেশে তখন থেকেই অত্যন্ত উপকারী এ গ্রন্থটি বিপুল জনপ্রিয়। হিন্দুস্তানে কাদিরিয়া তরীকার বিশিষ্ট বুযুর্গ শাহ আবুল মাআলী আল কাদিরীর (মৃ. ১০২৪ হি.) নির্দেশক্রমে শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী ফুতুহুল গাইবের ব্যাখ্যা এবং মিশকাতুল মাসাবীহের ব্যাখ্যা (আশিয়্যাতুল লুমআত) রচনা করেন। আমরা ফুতুহুল গাইবের অনুবাদের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় স্থানে সংক্ষিপ্তভাবে শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভীর ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছি।- অনুবাদক]
(দ্বিতীয় পর্ব)
পরিচ্ছেদ- ৩ (বালা-মুসিবতে বান্দার উত্তরোত্তর উন্নতি প্রসঙ্গে)
সাধারণ মানুষের স্বভাব হলো বান্দা কোনো বালা-মুসিবতের পরীক্ষায় পড়লে (সেটা থেকে মুক্তি পেতে) প্রথমেই নিজে নিজে চেষ্টা করে। এরপরও যদি মুক্তি না মিলে, তাহলে অন্য কারও সহায়তা নেয়। যেমন রাজা-বাদশা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, দুনিয়াদার, সম্পদশালী এবং রোগ-যন্ত্রণার ক্ষেত্রে চিকিৎসক ব্যক্তিবর্গ। এরপরও যদি মুক্তি না মিলে তাহলে প্রার্থনা, কাকুতিমিনতি আর প্রশংসা করার মাধ্যমে তার প্রতিপালকের দিকে ফিরে আসে।
(মানুষের অবস্থা হলো) যতক্ষণ নিজ থেকে (মুক্তি পেতে) সাহায্য পায়, অন্য মানুষের দ্বারস্থ হয় না। আবার যতক্ষণ অন্যদের কাছ থেকে সহায়তা পায়, স্রষ্টার দ্বারস্থ হয় না।
এরপর আল্লাহর কাছ থেকেও যদি সাহায্য না পায়, তাহলে তাঁর দরবারে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলবে, তাঁর প্রতি যুগপৎ ভয় আর আশা নিয়ে অনবরত যাঞ্চা আর দুআ করতে থাকবে; কাকুতিমিনতি আর তাঁর স্তুতি করতে থাকবে, (তাঁর প্রতি নিজের) মুখাপেক্ষিতা তুলে ধরবে।
কিন্তু আল্লাহ এরপর তাকে দুআ করতেও অক্ষম করে দেন, তার ডাকে সাড়া দেন না। অবশেষে সে (মুসিবত থেকে মুক্তির) যাবতীয় উপকরণ (আসবাব) থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন তার উপর ভাগ্য কার্যকর হয়, জারি হয় (আল্লাহর) কর্মধারা। বান্দা তখন তার যাবতীয় উপকরণ আর প্রচেষ্টা থেকে ফানা হয়ে যায় – সে অবশিষ্ট থাকে কেবল রুহ হিসেবে।
এখন সে যেহেতু মহান আল্লাহর কর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখে না, তাই সে আবশ্যকীয়ভাবে, নিশ্চিতভাবে একত্ববাদী হয়ে যায়। সে নিশ্চিতভাবে জেনে নেয় যে, বাস্তবিক অর্থে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো কর্তা নেই, আল্লাহ ছাড়া কোনো স্থিরকারী বা সঞ্চালনকারী নেই; সকল ভালো-মন্দ, উপকার-ক্ষতি, দান-বঞ্চনা, উন্মোচন-আবদ্ধকরণ, জীবন-মৃত্যু, সম্মান-লাঞ্ছনা, দরিদ্রতা-ধনাঢ্যতা সবই আল্লাহর অধীন। সে তখন তাকদীরের মধ্যে দুধমার কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশু, গোসলদাতার হাতে মরদেহ আর ঘোড়সওয়ার পোলো খেলোয়াড়ের লাঠির সামনে বলের মতো হয়ে যায়, যাকে কেবলই ঘোরানো-ফেরানো হয়, পরিবর্তন করানো হয়, পরিবর্ধন করানো হয়, বানানো হয়; আর সেই (বল) নিজ থেকে যেমন নড়তে পারে না, তেমনি অন্য কিছুকেও নাড়াতে পারে না।
ব্যক্তি তখন তার মাওলার কর্মধারায় মগ্ন হয়ে আত্মবিস্মৃত হয়। তাই মাওলা আর তার কর্মধারা ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ে না। কেবল তাঁর কাছ থেকেই সে শোনে, কেবল তাঁর কাছ থেকেই উপলব্ধি করে। সে কিছু শুনলে আর জানলে, কেবল আল্লাহর কালাম শোনে, তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে জানে, তাঁর নিয়ামতে প্রাচুর্যম-িত হয়, তাঁর নৈকট্যে সৌভাগ্যবান হয়, তাঁর নৈকট্যদানের মাধ্যমে সৌন্দর্যম-িত হয়, সম্মানিত হয়, তাঁর ওয়াদায় সে আনন্দিত আর নিশ্চিন্ত হয়। তাঁকে নিয়েই সে প্রশান্তি লাভ করে, তাঁর কথায় সে অন্তরঙ্গ হয় আর অন্যদের থেকে দূরে সরে যায়, পালিয়ে যায়। তাঁর যিকরে আশ্রয় নেয়, যিকরের প্রতি আকৃষ্ট হয়। মহান আল্লাহর উপরই সে আস্থা রাখে, তাঁর উপর নির্ভর করে, তাঁর মারেফাতের নূরে সে যেমন সুপথপ্রাপ্ত হয়, তেমনি এতেই আবৃত হয় জামা আর তহবন্দের মতো। আল্লাহ তায়ালার অনেক দুর্লভ জ্ঞান সে অবগত হয়, তাঁর কুদরতের অনেক রহস্য জানতে পারে। মহান আল্লাহর কাছ থেকেই সে শোনে এবং মনে রাখে। এরপর এসবের জন্য তাঁর প্রশংসা-গুণকীর্তন করে, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়, তাঁর কাছে প্রার্থনা করে। (চলবে)