আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ যেসকল ভাষায় কথা বলেন, বাংলা সে সকল ভাষার তালিকার একদম উপরের দিকেই আছে বলা চলে। আমাদের প্রিয় এই মাতৃভাষা একদিনে কিংবা একদল পণ্ডিতের সুসংগঠিত প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং আর দশটা সাধারণ ও স্বাভাবিক ভাষার মতোই গড়ে উঠেছে ধীরে ধীরে, আর তাতে সময় লেগেছে কয়েক শতাব্দি। আর তাই এ ভাষার উৎপত্তি ঠিক কখন যে হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলাটা বড্ড মুশকিলের বিষয়। তবু পণ্ডিতদের প্রচেষ্টাতো থেমে থাকে না। আর তাই আধুনিক গবেষকগণ বাংলা ভাষার জন্মলগ্ন খোঁজে বের করতে বহু চেষ্টা করেছেন। তাদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদেরও শেষ নাই। তবে শেষ অবধি দুটি মত সবচেয়ে বেশি গ্রাহ্যতা লাভ করেছে বোদ্ধামহলে, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মনে করেন খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকের মাঝামাঝি তথা ৬৫০ সালের আশেপাশে হয়তো বাংলা ভাষার বিকাশ লাভ শুরু হয়েছিল, আর আরেক ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. সুনীতিকুমার মনে করেন আরো কয়েকশ’ বছর পর খ্রিষ্টীয় দশম শতকে বাংলা ভাষার উত্থান শুরু হয়।
তবে তাদের বিশেষজ্ঞ মত যাই হোক না কেন, বাস্তবে সে যুগে যে ভাষা ব্যবহৃত হতো, তা আর যাই হোক আজকের বাংলা ভাষা নয়, বড়জোর আজকের বাংলাভাষার পূর্বপুরুষ বলা যেতে পারে। সে যুগের ভাষার নমুনা বলতে চর্যাপদের কয়েকটি গান ছাড়া বলতে গেলে আর কিছুই পাওয়া যায় না। পণ্ডিতদের টীকা-টিপ্পনীর সহায়তা ছাড়া সেসব গীতিকা বোঝার সাধ্য কোন সাধারণ বাঙালির নাই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ প্রায় সকল গবেষক একমত যে, এই গানগুলো মূলত বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের লেখা। এগুলোর রচনাকাল নিয়ে অবশ্য বেশ খানিকটা বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। মোটামুটি বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল থেকে ১২০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এগুলো রচিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে চর্যাপদ বৌদ্ধদের লেখা, আর বাংলায় বৌদ্ধদের শাসন চলছিল মূলত পাল আমলে, এসব তথ্য মাথায় রাখলে বলা যায়, চর্যাপদ আসলেই যদি বাংলায় রচিত হয়ে থাকে তবে তা বৌদ্ধ পাল আমলেই হয়েছে, কারণ তার পরের সেন রাজবংশ (১০৭০-১২০৩) যে গোড়া হিন্দু এবং বৌদ্ধবিরোধী রাজবংশ ছিল, এ ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত। সেনদের পতনের পর বাংলায় প্রথমবারের মতো উত্থান ঘটে মুসলিম রাজশক্তির, ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতাদের অনেকে বাংলা সাহিত্যের সাথে মুসলিমদের বিরোধ দেখাতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যে ‘অন্ধকার যুগ’ নামে একটি যুগের কথা বলে থাকেন, যেটি ১২০১ সাল থেকে ১৩৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত। ড.সুনীতিকুমার, ড. সুকুমার থেকে শুরু করে ড. হুমায়ুন আজাদ অবধি অনেকেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে এ অদ্ভুত দাবি করেন। তাদের রচনাবলিতে এ দাবি পড়লে মনে হবে তুর্কি মুসলিমদের আগমনের পূর্বাবধি বাংলা সাহিত্যের বোধহয় স্বর্ণযুগ চলছিল, তুর্কিরা এসেই বাংলা সাহিত্যের সব কিছু শেষ করে দিয়েছে। অথচ ইতিহাসের পাতায় একটুখানি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চোখ বুলালে তাদের এ দাবির অসারতা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চর্যাপদ বাংলা কিনা সে বিতর্ক আপাতত পাশে সরিয়ে রাখা যাক, কারণ চর্যাপদ যদি বাংলা না হয়, তবে তো কথিত ‘অন্ধকার যুগের’ পূর্বাবধি বাংলা সাহিত্যের জন্মই হয়নি! কিন্তু চর্যাপদকে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন মেনে নিলেও অন্ধকার যুগ প্রমাণিত হয়ে যায় না। কেননা চর্যাপদ তো বৌদ্ধদের সাহিত্যচর্চার নমুনা, বৌদ্ধদের পতনের পর ১০৭০ সাল থেকে তুর্কিদের আগমনের পূর্বাবধি যে হিন্দু সেন বংশ শাসন করছিল, তাদের হাতেও তো বাংলা সাহিত্যের কোন বিশেষ শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি। বরং চর্যাপদ যুগের পর যদি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কোন অন্ধকার যুগ থেকে থাকে, তবে সেটি সেন বংশের শাসনামলেই হবে। কারণ মুসলিমদের আগমনের পর কথিত ‘অন্ধকার যুগে’ কিছুটা বিতর্কিত হলেও কতিপয় বাংলা পদ্যের নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু সেন শাসনামলে বাংলা সাহিত্যের চর্চা হয়েছে বলে ইতিহাসে তেমন কোন উল্লেখ নেই। বরং গোড়া হিন্দু সেনদের উত্থানের ফলে বৌদ্ধদেরকে বাংলা ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, আর সে কারণেই বাংলার চর্যাপদ উদ্ধার করতে হয়েছিল নেপালের রাজদরবার থেকে।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বখতিয়ার খিলজী বাংলায় প্রথম মুসলিম রাজশক্তি হলেও তিনি পুরো বাংলা দখল করতে পারেননি। বখতিয়ার খিলজী পরবর্তী বাংলায়ও হিন্দু রাজাদের শাসন চলছিল। আবার বখতিয়ার খিলজী যেসব অঞ্চল দখল করেছিলেন, সেগুলো শাসনের ক্ষেত্রেও তিনি হিন্দুদের উপরই পুরোপুরি নির্ভর করতেন। মোদ্দাকথা, ১৩৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সেই অর্থে কোন উৎকর্ষতা সাধিত হয়নি, একথা সত্যি, তবে তার জন্য মুসলিম শাসকদের উত্থান নয়, বরং গোড়া হিন্দু সেন শাসকদের উত্থানই প্রকৃত দায়ী। কেননা সেকালের হিন্দু শাসক আর ব্রাহ্মণদের চোখে সংস্কৃত ছিল দেবভাষা, আর সংস্কৃত ছিল অস্পৃশ্যদের ভাষা। সত্যিকার অর্থে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উত্থানপর্বের সূচনা ঘটে এ দেশে মুসলিম শাসনের ভিত শক্তিশালী হওয়ার পর থেকে। বাংলা ভাষার সে সময়কার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা যায় দীনেশ চন্দ্র সেনের বর্ণনা থেকে, তিনি লিখেন-
“ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল, তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন।” [তথ্যসূত্র: শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব, ‘সওগাত’, ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত৷]
দীনেশচন্দ্র সেনের ঐ লেখা থেকে জানা যায়, সে সময় মুসলিম সুলতানগণ একদিকে যখন হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থসহ বিভিন্ন সংস্কৃত পুস্তকাদি বাংলায় অনুবাদ করাচ্ছিলেন, অন্যদিকে হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ ধর্মীয় বিধান প্রচার করছিলেন যে রামায়ণ এবং পুরাণ যারা বাংলায় শুনবে তারা রৌরব নামক নরকে যাবে।
মূলত চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি ইলিয়াস শাহী রাজবংশ প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলা সালতানাত কায়িম করার পর থেকে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়, এবং এসময় মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সব ধর্মের বাঙালি সাহিত্যিকগণ ধর্মীয় এবং অন্যান্য ধারার সাহিত্যচর্চা করতে থাকেন। এভাবে মুসলিম শাসকদের হাত ধরে বাংলা ভাষা ‘ইতরের ভাষা’ থেকে ‘রাজকীয় ভাষার’ মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়।
এখানে লক্ষণীয় যে, বাংলা ভাষার এই উত্থানপর্বে বাংলার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায় সংস্কৃত ভাষা। ব্রাহ্মণগণ সংস্কৃত ভাষাকেই সভ্য মানুষের ভাষা মনে করতেন, অন্যদিকে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মনির্বিশেষে বাঙালি সাহিত্যিকগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন করছিলেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের সংস্পর্শে এ পর্যায়ে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দ প্রবিষ্ট হয়। এসকল শব্দ জোর করে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করেনি, বরং ভাষার স্বাভাবিক ধর্ম মেনে নিত্যদিনের ব্যবহারের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। এ সময়ের বাংলা ভাষায় সংস্কৃত থেকে আগত তৎসম শব্দ যেমন ছিল, তেমনি ছিল আরবী-ফারসী শব্দও। কিন্তু কোনভাবেই সে সময়ের বাংলা ভাষা জনবিচ্ছিন্ন ছিল না। বরং বাংলা ভাষা রাজ দরবার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সকলের নিকটই সমানভাবে গৃহীত ছিল।
বাংলা ভাষার রাজানুকূল্য লাভের ইতিহাসের সূচনা যদিও ইতিবাচক, কিন্তু পরবর্তীতে নেতিবাচক রাজানুকূল্যও ঘটেছে এ ভাষার কপালে। নেতিবাচকতার সূচনা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে। এ সময় ব্রিটিশ শাসকদের দরকার ছিল সরলিকৃত বাংলা ভাষা, যা তারা সহজেই আয়ত্ত করে। শত শত বছর ধরে স্বকীয় সমৃদ্ধি নিয়ে বাংলা যে অবস্থানে তখন দাঁড়িয়েছিল, ব্রিটিশদের পক্ষে সে সমৃদ্ধ ভাষা শিক্ষা খুব সহজ ছিল না। আর তখনো বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচিত না হওয়ায় বাংলা ভাষা শিক্ষা বিদেশিদের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে মুসলিম শাসকদের মতো ব্রিটিশরা এদেশকে আপন করে নিতে চায়ওনি। ফলে তাদের পক্ষে স্বাভাবিক উপায়েও বাংলা ভাষা শিক্ষা করা সম্ভব ছিল না। আর তাই তারা আশ্রয় গ্রহণ করে সংস্কৃত পণ্ডিতদের। সেই সংস্কৃত পণ্ডিতবৃন্দ, যারা কিনা বাংলাকে মনে করতেন ‘ইতরের ভাষা’! এই সুযোগে তারা চাইলেন বাংলাকে নিজেদের মতো করে সভ্য করে তুলতে। তাদের হাত ধরে শুরু হলো বাংলা ভাষার জনবিচ্ছিন্নতার।
প্রথমে হ্যালহেড, তারপর উইলিয়াম ক্যারি প্রমুখ অবাঙালিরা সংস্কৃত পণ্ডিতদের সহায়তায় সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের ছাঁচে নতুন এক বাংলা ভাষা তৈরির প্রকল্প হাতে নেন। তাদের এ বাংলা ভাষায় মানুষের মুখের বাংলাকে অশুদ্ধ আর সংস্কৃত ছাঁচের বাংলাকে শুদ্ধ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা এতোটাই হাস্যকর পর্যায়ে পৌছায় যে, বাংলা ভাষায় ‘নিঃশ্বাস’ শব্দটির উচ্চারণ nishshash (নিশ্শাস) হলেও ক্যারি সাহেব শব্দটির সঠিক উচ্চারণ নির্ধারণ করেন nishwash (নিশওয়াস), যা আদতে কোন বাঙালিই উচ্চারণ করে না।
কথিত আধুনিক বাংলাচর্চার সূচনা হয় এমনই হাস্যকর উপায়ে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকেন্দ্রিক যে বাংলা গদ্য সে সময় প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতে শব্দ, বাক্যগঠন থেকে শুরু করে ভাষার সব ক্ষেত্রেই সংস্কৃত ভাষার ছাঁচ অনুসরণ করা হয় খুব শক্তভাবে। তার ফলে ভাষাসমূহের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা ঘটে, বাংলা ভাষার সাধু আর চলিত নামে দুটি পৃথক সংস্করণের আবির্ভাব ঘটে। সাধারণত প্রতিটি ভাষার লেখ্য আর কথ্য রূপের মধ্যে কিছুটা বেশকম থাকলেও বাংলা সাধু ভাষা আর কথ্য ভাষার মতো এতো প্রকট পার্থক্য খুব কম ভাষাতেই দেখা যায়। সে সময় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতেরা যে অদ্ভুত বাংলা ভাষার জন্ম দিয়েছিলেন, তা একজন সাধারণ বাঙালির পক্ষে শুনে বুঝা প্রায় অসম্ভব ছিল। অথচ এর আগে মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছিল, তা প্রতিটি বাঙালির নিজের ভাষাই ছিল, কোন কৃত্রিমতা সে ভাষায় ছিল না। ঔপনিবেশিক আমলে মুসলিমদের হাত থেকে বাংলা ভাষার নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা মূলত জনবিচ্ছিন্ন পাণ্ডিত্যপ্রদর্শনের ভাষায় পরিণত হয়, কিংবা বলা চলে সংস্কৃত ভাষারই আধুনিক সংস্করণ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, ব্রিটিশ-ব্রাহ্মণ যৌথ প্রযোজনায়।
এ সময়ের পণ্ডিতদের অন্যতম প্রধান প্রচেষ্টা ছিল বাংলা ভাষাকে যথাসম্ভব সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের অধীনে নিয়ে আসা এবং আরবী-ফারসী প্রভাব থেকে মুক্ত করা। তাদের সে প্রচেষ্টার ফলে কৃত্রিম সাধুভাষা তৈরি হয় বটে, কিন্তু তা কখনোই গণপরিসরে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। সে সময়েই শ্যামাচরণ গাঙ্গুলিসহ অনেকেই এমন হাস্যকর প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছিলেন, কালক্রমে তাদের সে বিরোধিতাই যৌক্তিক বলে প্রমাণিত হয়। বাংলা ভাষা সাধুভাষায় আটকে থাকেনি, অপ্রয়োজনীয় সংস্কৃত প্রভাবও যে খুব বেশি টিকতে পেরেছে তা নয় (যদিও এখনো ব্যাকরণে বহু অপ্রয়োজনীয় সংস্কৃত নিয়ম-কানুন রয়ে গেছে), কিন্তু এর মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, তা বলাই বাহুল্য।
বাংলা ভাষা এখন আবার গণমানুষের ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও ঔপনিবেশিক প্রভাব থেকে বাংলা পুরোপুরি মুক্তি পায়নি এখনো। সে মুক্তির জন্য যে পরিসরে কাজ দরকার, তাত্তিক দিক থেকে এখনো সে পর্যায়ের কার্যক্রম যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাংলা ব্যাকরণ এখনো সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-নীতির ভারে পিষ্ট হচ্ছে। তবে ব্যবহারিক দিক থেকে লেখক-সাহিত্যিকদের অনেকেই বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের যাতাকল থেকে মুক্ত করতে, মুখের ভাষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে লিখে গেছেন সারা জীবন, অনেকে লিখে যাচ্ছেন এখনো। তাদের প্রচেষ্টায় বাংলা পুনরায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে নিজের স্বকীয়তাকে বজায় রেখেই।