1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
ইসলামী জ্ঞানতাত্ত্বিক ঐতিহ্যে আযমতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, প্রতিতুলনায় সমসাময়িক স্খলনচিত্র ও এর উৎস সন্ধান
মুহাম্মাদ সায়ীদ
  • ৮ নভেম্বর, ২০২৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তিনি সকল নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আদম সন্তানদের সরদার। সম্মান-মর্যাদার দিক থেকে সৃষ্টির মধ্যে তাঁর অবস্থান সবৌর্ধ্বে এবং তাঁর সর্বোচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ইসলামে স্বতঃসিদ্ধ, প্রমাণিত। কুরআন ও হাদীস সূত্রে প্রমাণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদার ব্যাপারে মুসলমানের নিঃশর্ত স্বীকৃতির সহস্র বছরেরও দীর্ঘকালের পরম্পরায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আযমত ও আফদালিয়্যাত দুনিয়ার সকল মুমিনের নিকট অলঙ্ঘ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -ই নন বরং ইসলামী আকাইদ অনুসারে সকল নবী-রাসূলের উপর ঈমান আনা আবশ্যক, এবং তারা সবাই সম্মানীয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের নিকট সকল নবী নিষ্পাপ হওয়ার বিষয়টিও বহুল স্বীকৃত আকীদাহ। তাছাড়া নবী-রাসূলগণের সমালোচনায় লিপ্ত হওয়া কারো জন্য অনুমোদিত নয়, এমনকি নবী-রাসূলগণের ব্যাপারে বর্ণিত বাহ্যিক বিচ্যুতিগুলো নিয়েও সমালোচনা করা বাঞ্ছনীয় নয়। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী র. (৫৪৪ হি.-৬০৬ হি.) বলেছেন-
ما سمعنا عن أحد منهم أنه ناقش النبي الله في كيف أكل آدم من الشجرة وكيف عصى ربه؟ وهذا القصص الذي هو أصرح شيء في وصف المعصية، ولا ناقشوا الرسول الله في غير آدم من الأنبياء على هذا المنحى الذى نحاه المتأخرون. (عصمة الأنبياء)
-সাহাবীদের কারো ব্যাপারে আমরা এমন শুনিনি যে, হযরত আদম (আ.) কীভাবে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে গাছটির ফল খেয়েছেন, এ বিষয়ে তাদের কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আলোচনা করেছেন। অথচ معصية বা অবাধ্যতার আলোচনা করতে হলে এই ঘটনাটি এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সুস্পষ্ট। আদম (আ.) ছাড়া অন্যান্য নবীদের ব্যাপারেও এ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাহাবীরা এরকম আলোচনা করেননি, যেরকম পরবর্তীরা করে থাকেন। (ইসমাতুল আম্বিয়া)
ইসলামে সকল নবী-রাসূল সম্মানিত, তবুও স্তর বিবেচনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা সুউচ্চ ও অতুলনীয়। মর্যাদার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিশিষ্টতা দিয়েছেন, এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মুমিনদেরকে বিশেষ রীতি ও ধারায় অভিগমন (Approach) করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
لَّا تَجْعَلُوا دُعَاءَ الرَّسُولِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُم بَعْضًا
-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহবানকে তোমরা তোমাদের একে অপরকে আহŸানের মত গণ্য করো না। (সূরা আন নূর, আয়াত- ৬৩)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুতাকাদ্দিমীন মুফাসসিরগণের বড় অংশের মত হচ্ছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সাধারণের মত يا محمد বলে ডাকা যাবে না। বরং يا رسول الله، يا نبي الله، بأبي أنت وأمي বলে সম্বোধন করতে হবে। (موسوعة التفسير المأثور)
কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
ولا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ.
-তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত-২)
তাফসীরে তাবারীতে ইমাম আবূ জাফর তাবারী (র.) (৩১০ হি.-৪২২ হি.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় নিজের মাফহুম উল্লেখ করেছেন-
ولا تنادوه كما ينادي بعضكم بعضا باسمه؛ يا محمد، يا محمد. [ولكن قولا لينا وخطابا حسنا، بتعظيم له وتوقير وإجلال]؛ يا نبي اللَّه، يا رسول اللَّه. (تفسير الطبري)
-আর যেভাবে তোমরা একে অপরকে নাম ধরে ডাকো, তাঁকে সেভাবে ‘হে মুহাম্মদ’, ‘ওহে মুহাম্মদ’, বলে ডেকো না। বরং তাঁকে তাঁর সম্মান, গাম্ভীর্য, মর্যাদা দানপূর্বক মৃদু ভাষায় এবং উত্তম সম্বোধনে ‘হে আল্লাহর নবী’, ‘হে আল্লাহর রাসূল’ বলে ডাকো। (তাফসীরে তাবারী)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যেকোনো দিক থেকে বেমানান হতে পারে, এমন কোন কিছু তাঁর শানে প্রয়োগ করাকে নাকচ করে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انظُرْنَا وَاسْمَعُوا.
-হে মুমিনগণ! তোমরা ‘রায়িনা’ বলো না, ‘উনযুরনা’ বল এবং যা বলা হয় তা শোনো। (সূরা বাকারা, আয়াত-১০৪)
আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে রায়িনা বলে সম্বোধন করতে নিষেধ করেছেন, কারণ রায়িনা শব্দটি নেতিবাচক বা অপমানজনক অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আয়াতের নির্দেশনা হতে প্রতীয়মান হয়- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে শব্দপ্রয়োগের বেলায় নেতিবাচকতার সম্ভাবনা আছে এমন কোন শব্দ প্রয়োগ হতে বিরত থাকতে হবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বিশেষ সম্মান দানের জন্য মানুষের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত যে নির্দেশনা কুরআনে পাওয়া যায়, এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলামী বিদ্যায়তনিক পরিসরে (Islamic Academia) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে তাঁর ইয্যত-হুরমতের ব্যাপারে সতর্কতা ও সংবেদনশীলতার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ঐতিহ্য সহস্র বছরেরও দীর্ঘ সময়ে ধরে অলঙ্ঘিত, এবং ব্যাপকভাবে অনুসৃত। এরই ধারাবাহিকতায় উম্মাহর ইমামগণ কুরআনের তাফসীর, হাদীসের ব্যাখ্যা, কালাম-আকাইদের তত্ত¡কথা, সীরাত ও ফিকহ সংক্রান্ত রচনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে শব্দপ্রয়োগের বেলায় তাঁর আযমাত ও আফদালিয়্যাতের ব্যাপারে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। ইসলামী জ্ঞানতত্তে¡র মৌলিক উৎস থেকে নেয়া যেকোন টেক্সটের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যখনই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করার প্রয়োজন হয়েছে, সাহাবা-তাবিঈন, সালফে সালিহীন ও ইমামগণ সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদার আসনকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত যতœশীলতা অবলম্বন করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সাহাবীদের সতর্কতা ও শিষ্টাচারের নমুনা ছিলো অবিস্মরণীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান-মর্যাদা রক্ষায় তাদের যে নিখুঁত মনোনিবেশ, এ ব্যাপারে ধারণা নেয়ার জন্য নিম্নোক্ত রিওয়ায়াতগুলো দেখা যেতে পারে-
আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইনে বর্ণিত হয়েছে-
سئل العباس: ্রأيكما أكبر، أنت أم رسول الله، قال: هو أكبر مني، وأنا ولدت قبله (المستدرك على الصحيحين)
-আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি বড় নাকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড়? আব্বাস (রা.) জবাব দিলেন- তিঁনি ‘বড়’, তবে আমি তাঁর জন্মের পূর্বে জন্মগ্রহণ করেছি। (আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন)
কুবাস ইবন আশইয়ামকে ও উসমান ইবন আফফান (রা.) এর কথোপকথনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিশেষ শিষ্টাচার প্রদর্শনের ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে-
وَسَأَلَ عُثْمَانُ بْنُ عَفَّانَ قُبَاثَ بْنَ أَشْيَمَ أَخَا بَنِي يَعْمُرَ بْنِ لَيْثٍ أَأَنْتَ أَكْبَرُ أَمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَكْبَرُ مِنِّي وَأَنَا أَقْدَمُ مِنْهُ فِي الْمِيلاَدِ. (سنن الترمذي)
-ইয়াসার ইবন লাইস গোত্রীয় কুবাস ইবন আশইয়ামকে উসমান ইবন আফফান (রা.) প্রশ্ন করেন, আপনি ‘বড়’ নাকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম? তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার চাইতে ‘অনেক বড়’ তবে আমি তার আগে জন্মগ্রহণ করি। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৬১৯)
উল্লিখিত বর্ণনাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, হযরত আব্বাস (রা.) ও হযরত কুবাস ইবন আশইয়াম (রা.) বয়সে কে বড়- এই প্রশ্নের উত্তরে নিজেরা বয়সে বড় হওয়া সত্তে¡ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিপরীতে নিজেদেরকে বড় না বলে, ব্যতিক্রমী ধরণের বাক্যশৈলী প্রয়োগ করে উত্তর দিয়েছেন। এভাবেই তারা অত্যন্ত সূক্ষ¥তরভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে আদবের অনুশীলন করছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে আমাদের পূর্বসূরীদের এধরণের অনির্বচনীয় শ্রদ্ধাবোধ থেকে পাঠ গ্রহণ করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম উম্মাহর একাডেমিয়া সামন পানে এগিয়েছে এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মান-মর্যাদা সংরক্ষণে আদবসম্মত জ্ঞানতাত্তি¡ক ঐতিহ্য উন্নয়ন করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইয্যত-সম্মানের প্রশ্নে সাহাবা-তাবিঈনসহ আমাদের পূর্বসূরিগণের এই যে সর্বাত্মক সূক্ষ্মদৃষ্টির অবতারণা, এগুলো কোন বিরল দৃষ্টান্ত নয়। রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শান ও আদব রক্ষার ক্ষেত্রে উপরোল্লিখিত উদাহরণগুলো সালাফে সালিহীনের অবস্থানের প্রতিনিধিস্থানীয় চিত্র, এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পৃক্ত যে কোন আলোচনা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে পদ্ধতি বিবেচনায় এটাই ইসলামের মূলধারার ইলমী তুরাস বা ঐতিহ্য আহরিত নির্দেশনা। এর বিপরীত চিত্র তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে লাগামহীনভাবে অসংলগ্ন কথা বলা ও সতর্কতা পরিহার করে প্রগলভ শব্দপ্রয়োগ- বিচ্ছিন্নতা ও অর্বাচীনতা। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা আমাদের দেশের সমসাময়িক ওয়াইয বা তথাকথিত দাঈদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছ থেকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে এমন বিচ্ছিন্নতা ও অর্বাচীনতারই পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখি। কোন ধরণের ইলমী ভিত্তির দ্বারা সমর্থিত নয়- এমন কথাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানের বিরুদ্ধে তারা বাগাড়ম্বরভাবে প্রচার করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বপ্নে দেখলে জান্নাতী হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে এসংক্রান্ত হাদীসগুলো থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে কেউ একজন বলেছেন- সরাসরি দেখেও তো জান্নাতী হওয়া যায়নি, স্বপ্নে দেখলে কীভাবে হবে? শিরকের ব্যাপারে অপ্রয়োজনীয় সন্দেহপরায়ণতার কারণে কেউ বলেছেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিয়ে ওয়াসীলা করা যাবে না, আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অনুসরণের গুরুত্ব দিতে গিয়ে এদের একজনকে বলতে শোনা গেছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসার কথা কুরআন হাদীসের কোথাও বলা হয়নি! কেউ আবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শারীরিক সৌন্দর্য্যরে বর্ণনা দিতে গিয়ে সীমালঙ্ঘন করে বলেছেন- নবীজির পেটটা ছিলো চাপা, সিক্স প্যাক, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মীয়্যতকে অস্মানসূচক শব্দে বর্ণনা করে বলতে শোনা যায়- নবীজি ছিলেন ইল্লিটারেট! এবং হাদীস দ্বারা সমর্থিত ও উম্মতের গভীর আবেগে গ্রথিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রাওদা শরীফকে ‘রাওদা’ বলতে আপত্তি জানিয়ে কেউ বলেছেন- হাদীসের কোথাও নবীজির রাওদা শরীফকে ‘রাওদা’ বলা হয়নি, কবর বলতে হবে। তারা এখানে ক্ষান্ত না হয়ে পূর্ববর্তী নবীদের ব্যাপারেও যাচ্ছেতাই বলে চলেছেন। উসওয়ায়ে হাসানাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে বলা হয়েছে, অন্য কোন নবীর মধ্যে উসওয়ায়ে হাসানা থাকার কথা বলা হয়নি- এটি উল্লেখিত ওয়াইযদেরই একজনের বক্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে এমন বক্তব্য স্পষ্টভাবেই বেয়াদবী।
রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে কথা বলার সময় শিষ্টাচার রক্ষার ন্যূনতম ইলমী ঐতিহ্যগত যে প্রতিশ্রুতি একজন আলিমের থাকা দরকার, এর বিপরীতে উল্লিখিত বক্তাদের এমন বক্তব্য নিঃসন্দেহে স্খলন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য অমার্যাদাকর ও তাঁর সুউচ্চ শানের সাথে বেমানান এমন কথার ছড়াছড়ি ঈমানদার মুসলমানের কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক, বিরক্তিকর ও অনভিপ্রেত। এসব বক্তব্যের কিছু কিছু ভুল কিংবা অসতর্কতাবশত হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পুনরাবৃত্তভাবে ও অকুন্ঠচিত্তে যখন এ ধরণের ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয় এবং এটি যখন একটি প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়, তখন এটিকে কেবল কতিপয় ব্যক্তিবিশেষের বিভ্রান্তি বলে এ ব্যাপারে অধিকতর বিস্তৃত পর্যালোচনাকে এড়িয়ে যাওয়া হলে এই সমস্যাটির মূল অনির্ণীত থেকে যাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষেত্রে শব্দচয়নের বেলায় এমন খামখেয়ালিপনার প্রেরণা কিসে, কেন উম্মাহর স্কলারদের হাজার বছরের অনুসৃত নীতিকে না মেনে বারবার অশোভন শব্দ/বাক্য প্রয়োগ করা হয় নবী-রাসূলদের বেলায়- এ ব্যাপারে সম্যক অনুসন্ধান এই সমস্যার শিকড় আবিষ্কারে সহায়ক হতে পারে।
এ দেশের সমসাময়িক ওয়াইয বা বক্তাদের যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে কথা বলার সময় আদবের প্রতি কদাচিৎ ভ্রæক্ষেপ করে ইসলামী জ্ঞান-ঐতিহ্যের শাসনসীমা লঙ্ঘন করে কথা বলে থাকেন, তাদের কেউ কেউ সালাফী-নজদী হলেও এদের একটি বড় অংশ ভারতীয় ইসলামচিন্তক মরহুম সাইয়িদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩খ্রি.-১৯৭৯খ্রি.) এর অনুসারী। মওদূদী সাহেব তার লেখায় নবী-রাসূলগণের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে বেপরোয়াভাবে খড়গহস্ত হয়েছেন ও তাদেরকে কোন কোন বিশেষ সময়ে গুনাহমগ্ন কিংবা পথভ্রষ্ট হিসেবেও দেখাতে চেয়েছেন। এজন্য আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকাইদের অনুসারী উলামায়ে কিরাম তার ইসমতে আম্বিয়া (আ.) সংশ্লিষ্ট আকাইদবিরুদ্ধ বিভ্রান্তিকর বক্তব্যগুলোর ব্যাপারে আপত্তি করেছেন এবং এসবের ইলমী খÐনও করেছেন। মরহুম মওদূদী সাহেবের ভ্রান্তিপূর্ণ অবস্থানের ব্যাপারে ধারণা নেয়ার জন্য তার কিছু বক্তব্যের অংশ নিম্নে উদ্ধৃত হলো-
হযরত নূহ (আ.) চিন্তাধারার দিক থেকে দ্বীনের চাহিদা হতে দূরে সরে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে জাহিলিয়্যাতের জযবা স্থান পেয়েছিল (তাফহীমুল কুরআন)। হযরত দাঊদ (আ.) এর কাজের মধ্যে নফস ও আভ্যন্তরীণ কুপ্রবৃত্তির কিছুটা দখল ছিল। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের সাথেও তার কিছুটা সম্পর্ক ছিল। আর তা ছিল এমন ধরণের কাজ, যা হক পন্থায় শাসনকারী কোন মানুষের পক্ষেই শোভা পায় না (তাফহীমুল কুরআন)। নবী হওয়ার পূর্বে মূসা (আ.) এর দ্বারা একটি গুনাহ হয়েছিল। তিনি এক ব্যক্তিকে কাতল করেছিলেন (রাসায়েল ও মাসায়েল)। নবীর আদত (অভ্যাস), আখলাককে (চরিত্র) সুন্নত বলা হয় এবং তা অনুসরণে জোর দেওয়া আমার মতে সাংঘাতিক ধরণের বিদাআত (রাসায়েলে ও মাসায়েল)। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে মনগড়া কথা বলেছেন এবং নিজের কথায় নিজেই সন্দেহ পোষণ করেছেন (তরজমানুল কুরআন)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের ঊর্ধ্বে নন এবং মানবীয় দূর্বলতা থেকেও মুক্ত নন (তরজমানুল কুরআন)।
সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদীর উপরোল্লিখিত বক্তব্যমালা ছাড়াও তার চিন্তার একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশই প্রকৃতপক্ষে মুসলিম উম্মাহর জ্ঞানতাত্তি¡ক ঐতিহ্য সমর্থিত বৌদ্ধিক-কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক একটি ধারা বা ঘরানার বিবর্তন ঘটিয়েছে। তার চিন্তাপ্রভাবিত এই ঘরানায় সবসময় তিনি মান্যবর হিসেবে বিবেচিত ও গৃহীত। কোন একটি ঘরানার শীর্ষ তাত্তি¡কের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য ও চিন্তার উৎপাদন ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই এটির প্রভাব এর অনুসারীদের উপর পড়ে। মওদূদী-চিন্তার অনুসারী এই ঘরানাটির বেলায় সম্ভবত এটিই ঘটেছে। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে কথা বলা, তাঁর বর্ণনা দান কিংবা তাঁর শানে শব্দপ্রয়োগের বেলায় আদবের ব্যাপারে নির্বিকার শিথিলতা প্রদর্শন করতে বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ করেন না, যেন তারা কোন এক বিশেষ কর্তৃত্ব থেকে এসবের জন্য অনুমোদিত।
অথচ মুসলিম উম্মাহর আবহমান জ্ঞানতাত্তি¡ক ধারা আমাদেরকে বিপরীত নযীর সরবরাহ করে। উম্মাহর ইমামগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে যে কোন বাক্য বা শব্দ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে কোনরূপ উদাসীনতা ও অবহেলাকে প্রশ্রয় দেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মুবারক শানের জন্য মানানসই নয় এমন যাবতীয় কিছুকে তারা কঠোরভাবে তিরস্কার করেছেন। ইমাম কাযী ইয়ায (র.) (৪৭৬ হি. -৫৪৪ হি.) তার ‘আশ শিফা বি তারীফি হুকূকিল মুস্তাফা’ গ্রন্থে বলেছেন-
…ألحق به نقصا في نفسه أو نسبه أو دينه أو خصلة من خصاله أو عرض به أو شبهه بشيء على طريق السب له أو الإزراء عليه أو التصغير لشأنه أو الغض منه والعيب له فهو ساب له.(الشفا بتعريف حقوق المصطفى)
-…যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে, তাঁর বংশ বা তাঁর দ্বীনের ব্যাপারে অথবা তাঁর কোনো বৈশিষ্ট্যের সাথে কমতি তথা নুকসানিয়াতকে যুক্ত করে কিংবা এরকম কিছুর ইঙ্গিত করে, অথবা গালি, অপমান, হেয়, অবজ্ঞা ও কলঙ্ক সদৃশ কোন কিছুর সাথে তাঁকে তুলনা করে- সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালি দাতা বলে বিবেচিত হবে। (আশ শিফা) আমাদের পূর্বসূরি ইমামগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে কথা বলার ক্ষেত্রে ও তাঁর জন্য শব্দচয়নের বেলায় ইসলামী আকাইদ অনুসরণের পাশাপাশি ঈমানী প্রেরণাজাত আবেগকে সাড়া দেওয়ার দ্বিমাত্রিকতা অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণভাবে বজায় রেখেছেন। প্রকৃতপক্ষে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে নিরবচ্ছিন্ন ও গভীর আত্মিক যোগাযোগ থেকেই তাঁরা এর প্রেরণা পেয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শ্রেষ্ঠত্বে যেকোন ধরণের ঘাটতির বহিঃপ্রকাশ ঘটার দূরতম সম্ভাবনা রাখে এমন কিছুও তাঁর শানে বলা বা লেখা ঈমানের মেজাজবিরুদ্ধ, গর্হিত কাজ। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে কথা বলা বা লেখালেখির ক্ষেত্রে সালফে সালিহীন ও উম্মাহ স্বীকৃত ইমামদের বক্তব্য ও লেখনীরীতিতে আদবের আবহে নির্মিত ও সৌষ্ঠবমণ্ডিত যে উত্তরাধিকার, এর অনুসরণ আমাদের জন্য হতে পারে কলম ও যবানকে স্খলন থেকে হিফাযতের রক্ষাকবচ।

ফেইসবুকে আমরা...