1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আধুনিক যুগের তাফসীর শাস্ত্রের দিকপাল আল্লামা সাবুনী
মিফতাহুল ইসলাম তালহা
  • ৭ এপ্রিল, ২০২১

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল ভূখণ্ডের জন্য বিশেষভাবে দুআ করেছেন, শাম তথা আধুনিক সিরিয়া তন্মধ্যে অন্যতম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুআর বরকতে এ অঞ্চলে যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেছেন ইসলামের ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। আধুনিক যুগে এরকম এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন আল্লামা মুহাম্মাদ আলী আস সাবুনী। ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। বিশেষত তাফসীর শাস্ত্রে তাঁর অবদান কিংবদন্তিতুল্য। তাঁর জনপ্রিয় কিতাব ‘সাফওয়াতুত তাফাসীর’ আধুনিক যুগের অন্যতম বহুলপঠিত তাফসীরের কিতাব হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯৩০ সালে সিরিয়ার ঐতিহাসিক আলেপ্পো শহরে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর পিতা ছিলেন সে যুগে সিরিয়ার শীর্ষস্থানীয় আলিম শায়খ জামিল সাবুনী। ইসলামি ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণের সুবাদে আলিম পিতার নিকটই তাঁর লেখাপড়া শুরু হয়। শৈশবে স্থানীয় মক্তবে পবিত্র কুরআন মাজীদ হিফয করেন। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি সিরিয়ার বিখ্যাত আলিমগণের নিকট থেকে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা ও সনদ অর্জন করেন। এরপর সিরিয়ার ধর্মমন্ত্রণালয় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য তাঁকে মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করে। আল আযহারের শরীআহ অনুষদ থেকে ১৯৫২ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন, এবং ১৯৫৪ সালে আল কাদ্বা আশ শারঈ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে সাবুনী সিরিয়ায় ফিরে এসে ১৯৫৫ সালে শিক্ষকতায় আত্মনিয়োগ করেন। সত্তরের দশকে সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিলে সৌদি সরকার সিরিয়ার নিকট সহযোগিতা কামনা করে। ১৯৬২ সালে সৌদি সরকারের অনুরোধে সিরিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয় মুহাম্মদ আলী আস সাবুনীকে সৌদিতে প্রেরণ করে। তিনি সেখানে মক্কা শরীফে অবস্থিত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীআহ অনুষদে প্রভাষক পদে যোগদান করেন, পাশাপাশি তিনি কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা অনুষদেও শিক্ষকতা করেন। দীর্ঘ তিন দশক তিনি উম্মুল কুরায় শিক্ষকতা করেন,  এরপর রাবেতা আল-আলাম আল-ইসলামীর উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। পবিত্র মক্কা মুকাররামায় অবস্থানকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা ছাড়াও তিনি সাধারণ মানুষের জন্য হারাম শরীফে প্রতিদিন তাফসীরের দারস প্রদান করতেন এবং জেদ্দার একটি মসজিদে সপ্তাহে একদিন দারস প্রদান করতেন। এছাড়া টেলিভিশনে প্রচারের জন্য তাঁর তাফসীরের দারস রেকর্ড করা হয়, এরকম প্রায় ছয় শতাধিক রেকর্ডিং রয়েছে। ২০০৭ সালে তিনি দুবাই ইন্টারন্যাশনাল কুরআন অ্যাওয়ার্ড কর্তৃক বর্ষসেরা ইসলামি ব্যক্তিত্ব মনোনীত হন।

আল্লামা সাবুনী বিভিন্ন বিষয়ে অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন সাফওয়াতুত তাফাসীর নামক তাফসীর গ্রন্থের জন্য। আধুনিক যুগে রচিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য তাফসীরগ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি অন্যতম। সহজবোধ্য ভাষা এ গ্রন্থটির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। তিনি এ গ্রন্থে পূর্ববর্তী সকল গুরুত্বপূর্ণ তাফসীরগ্রন্থের সারনির্যাস সাবলীল ভাষায় সাধারণ পাঠকদের উপযোগী করে উপস্থাপন করেন। এ গ্রন্থে তিনি কুরআন মাজীদের শাব্দিক বিশ্লেষণ, পূর্ববর্তী আয়াতের সাথে পরবর্তী আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা, আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট, আয়াতের ব্যাখ্যা, আয়াতসমূহের অলঙ্কার বিশ্লেষণ, আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় ইত্যাদি সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করেন, কিন্তু এরপরও কিতাবটি সাধারণ পাঠকের জন্য একটুও কঠিন হয়নি। এছাড়া রাওয়াইউল বায়ান নামক তাঁর আরেকটি তাফসীরগ্রন্থ অত্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। বাংলাদেশের মাদরাসাসমূহেও এ গ্রন্থটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে রয়েছে।

তার আরো দুটি অনবদ্য কীর্তি হলো উম্মুত তাফাসীর খ্যাত তাফসীর শাস্ত্রের আদিগ্রন্ত তাফসীরে তাবারী ও তাফসীরে ইবন কাসীরের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। তাফসীর শাস্ত্রের মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিদগ্ধজনের নিকট এ দুটি কিতাব অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করলেও রচনাশৈলীর কারণে সাধারণ পাঠকদের জন্য কিতাব দু’টি সহজপাঠ্য নয়। ফলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি এসকল কিতাবের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ রচনা করেছেন। তবে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুসারে আল্লামা সাবুনীর লেখা সংক্ষিপ্ত সংস্করণই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। তিনি তাবারী ও ইবনে কাসীরের রচিত তাফসীরের সনদসমূহ সংক্ষিপ্ত করেন, যাতে সাধারণ মানুষ পাঠের আগ্রহ ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এছাড়া ভাষাগত জটিলতা দূর করে মূল কিতাবের কঠিন ইবারতকে সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন।

আল্লামা সাবুনী তাঁর প্রতিটি তাফসীর গ্রন্থে আহলুস সুন্নাহ তথা আশআরী-মাতুরীদী ধারার আকীদা অনুসরণ করেছেন। এসকল তাফসীরকে কেন্দ্র করে নজদী মতবাদের অনুসারী (কথিত সালাফী) শীর্ষস্থানীয় শায়খদের সাথে তাঁর চরম মতবিরোধ দেখা দেয়। নজদী ধারার শীর্ষস্থানীয় শায়খ সৌদী গ্র্যান্ড মুফতী ইবন বায, শায়খ আলবানীসহ আরো অনেকেই আল্লামা সাবুনীর বিরুদ্ধে ফতওয়া প্রদান ও বই রচনা করেন। এমনকি গ্র্যান্ড মুফতী ইবন বাযের প্রচেষ্টায় সৌদিতে তাঁর লেখা জগদ্বিখ্যাত মকবুল তাফসীরের কিতাব সাফওয়াতুত তাফাসীর নিষিদ্ধও হয়েছিল। আশআরী-মাতুরীদী আকীদার পক্ষাবলম্বনের কারণে সৌদি আরবে আল্লামা সাবুনী বিভিন্ন রকমের সমস্যায় পড়েন। এসব কারণে তিনি সৌদি থেকে তুরস্কে চলে যান, এবং সেখানেই শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। তুরস্কে অবস্থানরত আরেক সিরীয় অধ্যাপক ড. আব্দুল কাদের আল হুসাইনের বর্ণনামতে, আল্লামা সাবুনী তুরস্কের প্রখ্যাত নবশবন্দী তরীকার বুযুর্গ শায়খ মাহমুদ এফেন্দী (রহ.) এর নিকট থেকে তরীকতের জ্ঞান অর্জন করেন।

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের এই মহান মুফাসসির গত মার্চ মাসের ১৯ তারিখ তুরস্কের ইয়ালোভা শহরে ৯১ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালে সমগ্র মুসলিম জাহানে শোকের ছায়া নেমে আসে।

ফেইসবুকে আমরা...