1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আখলাকে নববীর অনুপম দৃষ্টান্ত: আল্লামা ফুলতলী (র.)
শাইখুল হাদীস আল্লামা হবিবুর রহমান (র.)
  • ৩ জানুয়ারী, ২০২৩

আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক বান্দাদের মধ্যে যাঁদের ওলায়াত বা নৈকট্য দান করেন, তাঁরা মূলত: বহুমুখী গুণাবলী ও বিশেষণে বিশেষিত হয়ে ওঠেন। মকবূল বন্দেগী, উত্তম চরিত্র, মাওলার নিকট নিজেকে নিবেদনের মাধ্যমেই ওলী আল্লাহগণের জীবন সকলের নিকট হয়ে ওঠে গ্রহণীয়। আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ছিলেন সময়ের মহান বুযুর্গ, তরীকতের মুরশিদ, যামানার মুজাদ্দিদ, শাইখুল কুররা, উস্তাযুল মুহাদ্দিসীন ওয়াল মুফাসসিরীন, আদর্শ নবী প্রেমিক ও নায়িবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একই সাথে তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, বাতিলের মুকাবিলায় আপসহীন ব্যক্তিত্ব, মানব দরদী, ইয়াতীম-অনাথের আশ্রয়স্থল এবং সর্বোপরি তিনি ছিলেন সর্ব সাধারণের অনুসরণীয় রাহবার। তাঁর সান্নিধ্য- পরশে সময় সময় দেশ-বিদেশে অসংখ্য মানুষ তরীকতের উচ্চ মাকাম হাসিলের পাশাপাশি নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী অর্জন করে দুনিয়া-আখিরাতের কামিয়াবী অর্জন করেছেন। দেশে বিদেশে তাঁরই দিক নির্দেশনা ও সাহসী ভূমিকায় গড়ে ওঠেছে মসজিদ, মক্তব ও মাদরাসাসমূহ। তিনি ইসলাম-মুসলমান, দেশ-জাতি বিশেষত ইসলামী আন্দোলন ও দীনী শিক্ষার অভিভাবক হিসেবে আজীবন দায়িত্ব আন্জাম দিয়েছেন। এখনও তাঁর নির্দেশিত পথে এ সকল খিদমত পরিচালিত হচ্ছে।
আল্লামা ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর মতো মহান ওলীর সান্নিধ্য পাওয়া, শিষ্যত্ব গ্রহণ, তরীকতের ইজাযত হাসিল এ সবই আমার এবং আরো অনেকের জীবনের পরম প্রাপ্তি। তাঁর জীবন-কর্ম এত ব্যাপক ও প্রসারিত যে, তা কোন এক বা একাধিক ব্যক্তির পক্ষে সীমিত পরিসরে তুলে ধরা সম্ভবপর নয়। তবুও এ মনীষী বুযুর্গ সম্পর্কে সাধারণকে ধারণা দেওয়া সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের কর্তব্য। আর এই কর্তব্যবোধের কারণে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) সম্পর্কে আমার নিজের স্মৃতিচারণ হিসেবে কয়েকটি কথা আলোচনা করার চেষ্টা করলাম।

প্রথম পরিচয়
ছাহেব কিবলাহর বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। চার থেকে সাড়ে চার মাইল হবে। তাই বাল্যকাল হতে দূর থেকে তাঁকে দেখেছি। কিছু পরিচয়ও পেয়েছি। তাঁর সাথে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কও আছে। আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকেই কানাইঘাট থানায় লেখাপড়া করেছি, তাই ছাহেব কিবলাহর খুব একটা সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়নি। আমাদের এলাকায় কোনখানে তিনি তাশরীফ নিলে আমরা জড়ো হতাম। পরিচয় পেয়ে আমাকে কাছে ডেকে বলতেন, কাছে ভিড়ে থাকবে। তখন তাঁর এ কথার গুরুত্ব বুঝে উঠতাম না। ধীরে ধীরে লেখাপড়া সামনে অগ্রসর হলো, গাছবাড়ি মাদরাসায় আলিম শ্রেণিতে গিয়ে ভর্তি হলাম। অল্প দিনের মধ্যেই ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ শিক্ষক হিসেবে গাছবাড়ি মাদরাসায় যোগদান করেন। সে সময়ই আমি তাঁর কাছে অধ্যয়ন করার সুযোগ পাই। আলিম শ্রেণিতে ‘নূরুল আনওয়ার’ তাঁর কাছেই পড়েছি। তিনি যখন কামিল জামাআতে হাদীস পড়াতেন তখন আমি কামিলের ছাত্র ছিলাম না বিধায় ক্লাসে নিয়মিত তাঁর কাছে হাদীস পড়ার সুযোগ হয়নি। সে সময় থেকে ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে। সময়ের ব্যবধানে সে ঘনিষ্টতা কেবল মযবুত হয়েছে।

ছাহেব কিবলাহর উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণ
ছাহেব কিবলাহর বাল্যকালের উস্তাদগণ সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবো না। অবশ্য তিনি জীবিত থাকতে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে এটা জেনে রাখা উচিত ছিল। দুর্ভাগ্যবশত এটা করিনি। ছাহেব কিবলাহ বদরপুরে লেখাপড়া করার সময় তাঁর একজন উস্তাদ ছিলেন গণিপুরী ছাহেব (র.), মরহুম মগফুর মাওলানা হাবিবুর রহমান ছাহেব। আমরাও তাঁকে পেয়েছি। আমার বড় ভাই (মরহুম মাওলানা নজিবুর রহমান) এবং ছোট ভাই (মরহুম মাওলানা খলিলুর রহমান) উভয়ই তাঁর কাছে পড়েছেন। আমি তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পাইনি। একেবারে শেষ জীবন পর্যন্ত আমরা দেখেছি ছাহেব কিবলাহ তাঁকে কদমবুসী করতেন। একবার জকিগঞ্জ থানার শহিদাবাদ গ্রামে মাহফিল ছিল। ছাহেব কিবলাহ আগে তাশরীফ এনেছেন। আমরা তাঁর সাথে আলাপ-আলোচনা করছি। এর মধ্যে কে একজন এসে খবর দিলো গণিপুরী ছাহেব এসেছেন। অমনি ছাহেব কিবলাহ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে গণিপুরী হুজুরের কদমবুসী করতে চাইলে তিনি হাত ধরে আটকে দিলেন আর বলতে লাগলেন, দেখো ফুলতলী ছাহেব আমাকে মানুষের বকুনী খাওয়ানোর জন্যে এসব কি করছেন? ছাহেব কিবলাহ বলতে লাগলেন, হুজুর আমাকে ইজাযত দিন, সবার মুরব্বী হয়ে গেছি। গর্দান ঝোঁকানোর জায়গা নেই। এক দুই জায়গায় গর্দান না ঝোঁকালে শয়তান আমার ঘাড়ে সওয়ার হয়ে যাবে। যা হোক, গণিপুরী ছাহেব হলেন তাঁর উস্তাদ। এ সময় বদরপুরে আর কে কে পড়াতেন তা আমি জানি না। রামপুর তাশরীফ নেয়ার পর উস্তাদ তো অনেক ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দু’জন। একজন হচ্ছেন খলিলুল্লাহ রামপুরী ছাহেব। তিনি মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি ছাহেব কিবলাহকে হাদীস পড়িয়েছেন এবং দালাইলুল খাইরাত পড়িয়ে ইজাযত দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া ইজাযতনামা ছাহেব কিবলাহর ঘরে আছে, আমরা তা দেখেছি। অন্যজন হচ্ছেন- প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, ছাহেবে তরীকত মাওলানা ওজীহ উদ্দীন খান রামপুরী ছাহেব। করিমগঞ্জ ও কাছাড় এলাকায় তাঁর অনেক মুরীদ ও খুলাফা আছেন। তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন ছাহেব কিবলাহর সম্পর্ক তাঁর সাথে অটুট ছিল। চিঠিপত্রের যোগাযোগ ছিল। একবার ছাহেব কিবলাহ তাঁকে ফুলতলীতে আনতে চেয়েছিলেন। কথা ছিল বদরপুর এসে তিনি ফুলতলীতে আসবেন। কিন্তু বদরপুর এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন নাকি অন্য কোনো অসুবিধার কারণে আর ফুলতলীতে আসা হয় নি। রামপুরী এই মুহাদ্দিস ছাহেব প্রায়ই ছাহেব কিবলাহকে চিঠি লিখতেন। আমাদেরকে তাঁর এসব চিঠি দেখাতেন এবং পড়াতেন। তিনি এসব চিঠির জবাব লিখে আমাদের দিয়ে পোস্ট করাতেন।

ইলমে কিরাতে ছাহেব কিবলাহর উস্তাদগণ
ছাহেব কিবলাহ তো কারী ছিলেন, (বদরপুরী ছাহেবের কাছে পড়েছেন)। তাঁর কাছ থেকে শুনেছি, বদরপুরী ছাহেব নাকি তাঁকে বলতেন, ‘অনেক লোক আপনার পেছনে ইকতিদা করবে, এছাড়া নামায ভালো হওয়া নির্ভর করে কিরাত ভালো হওয়ার উপর। তাই আপনি কয়েকদিন ‘ভোগার ছাহেব’র কাছে পড়ুন।’ ‘ভোগার ছাহেব’ হচ্ছেন- হাফিয মাওলানা আবদুর রউফ চৌধুরী করমপুরী। তাঁর বাড়ি বড়লেখা থানায়। তিনি মক্কা শরীফে অধ্যয়ন করে এসেছেন। ছাহেব কিবলাহ করমপুরী ছাহেবকে চিঠি দিলেন, আমি অমুক তারিখে আসছি। তারিখ মতো করমপুরী ছাহেব তাঁর সকল ছাত্র নিয়ে রেলস্টেশনে এসেছেন অভ্যর্থনা জানাতে। ছাহেব কিবলাহ বলেছেন, আমার খুবই লজ্জা লাগলো যে, আমি এসেছি পড়তে আর তিনি ছাত্রবৃন্দ নিয়ে এসেছেন আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। যা হোক, ছাহেব কিবলাহ করমপুরী ছাহেবের কাছে পাঠগ্রহণ করেছেন। পরবর্তীতে মক্কা শরীফেও পড়েছেন। মক্কা শরীফে তাঁর উস্তাদ হচ্ছেন শাইখ আহমাদ হিজাযী ছাহেব। তিনি ছিলেন শাইখুল ফিক্হ ও শাইখুল কিরাত। সে যুগে মক্কা শরীফে কিরাতের ইমতিহান লওয়া, বিশেষ করে ইমাম হতে চাইলে ইন্টারভিউতে আহমাদ হিজাযী যার কিরাতের স্বীকৃতি দিতেন তিনিই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেন। ছাহেব কিবলাহ বলেছেন, তিনি পড়তে চাইলে প্রথমে তাঁকে সুযোগ দিতে চাইলেন না। বললেন, হিন্দীগণের (হিন্দুস্থান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশবাসীকে তখন হিন্দী বলা হতো) পড়া সহীহ হয় না, শেষে আমার বদনাম হবে। শেষপর্যন্ত ছাহেব কিবলাহ দু-তিন আয়াত তিলাওয়াত শুনানোর আরয করলে তিনি রাজি হলেন। তিলাওয়াত শুনে নিয়মিত পড়বার খুসুসী ইজাযত দিলেন। দু’বারের হজ্জের সফরে ছাহেব কিবলাহ তাঁকে পুরো কুরআন শরীফ শুনিয়েছেন। তখন হজ্জের সফরে অনেক দিন মক্কা শরীফে থাকার সুযোগ ছিল। শাইখ আহমাদ হিজাযী তাঁকে ইলমে কিরাতের ইজাযত তো দিয়েছেনই, সাথে সাথে বলে দিয়েছেন, আমি ইলমে কিরাতের আমানত আপনার কাছে রাখলাম। যতদিন দুনিয়ায় থাকবেন কুরআন শরীফের খিদমত করবেন।

বাইআত গ্রহণ
আমি কোনদিনও ইলমে তাসাওউফের বা তরীকতের মুনকির ছিলাম না। তবে এসব কে নিষ্প্রয়োজন মনে করতাম। ছাত্রজীবনে ধারণা করতাম, কুরআন-হাদীস পড়লাম; আমল-আখলাক শুধরানোর জন্য আর কারো কাছে যাবার প্রয়োজন নেই। তবে এসবের প্রতি কোন অবহেলা ছিল না। প্রয়োজন মনে করতাম না-এটুকুই। আল্লাহর শুকরিয়া- এ সময় একটি স্বপ্ন দেখলাম, স্বপ্নের তা’বীর যে উস্তাদ করলেন তিনি খ্যাতিমান মু’তাবির (তা’বীরকারী) ছিলেন। স্বপ্নের বিবরণ শুনেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন- সত্যি কথা বলবে, তুমি কি আমাদের পীর-মুরিদী তথা তরীকতের বিষয়াদিকে প্রয়োজনীয় মনে করো না ? উত্তরে আমি তা স্বীকার করলাম। বললেন, তোমার স্বপ্নে মনে হচ্ছে- তুমি কোনো একজন আল্লাহওয়ালার লেখা তাসাওউফ বিষয়ক কোন কিতাব পড়লে মনের অবস্থা পরিবর্তন হবে। তুমিও তরীকতভুক্ত হয়ে যাবে।
ছাহেব কিবলাহর বিশেষ শাগরিদ, মুরীদ এবং খলীফা, আমরা তাঁকে খাদিমানী ছাহেব ডাকতাম। ছাহেব কিবলাহর নামেই তাঁর নাম- মাওলানা কারী আবদুল লতিফ খাদিমানী ছাহেব। বাল্যকাল থেকেই তাঁর সাথে আমার খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তাঁর সাথে এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। আমি যখন কামিল প্রথম বর্ষে পড়ি সে সময় খাদিমানী ছাহেবের সাথে ছাহেব কিবলাহর খিদমতে গেলাম। তখন তিনি রামাদান মাসের শেষ দিকে সিলেট শহরে ই’তিকাফ করতেন এবং কুরআন শরীফ তা’লীম দিতেন। আমি যে বছর গেলাম সে বছর তিনি শেখঘাট মসজিদে ইতিফাক করেন। তাঁর সাথে বারগাত্তী ছাহেব এবং আউশকান্দির ছাহেব (বদরপুরী ছাহেবের দুই খলীফা হযরত মাওলানা শাতির আলী ছাহেব এবং মাওলানা আবদুল ওয়াহাব ছাহেব) ছিলেন। মঞ্জলালী ছাহেবসহ (হযরত মাওলানা আবদুল মুকীত ছাহেব) আরও অনেকে তখন ছাহেব কিবলাহর কাছে কুরআন শরীফ পড়েন। আমিও কিছু কিছু পড়ি। সে সময়ই আমি ছাহেব কিবলাহর কাছে বাইআত করি। আমি যখন বাইআতের জন্য আরয করলাম তখন আমাকে বললেন, ‘তুমি কি এ সম্পর্কে কোন ইস্তিখারা করেছো?’ আমি না বাচক জবাব দিলে ইস্তিখারা করার নির্দেশ দিয়ে ইস্তিখারার একটি সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিও শিখিয়ে দিলেন। আমি এবং খাদিমানী একসাথেই থাকতাম। রাতে ছাহেব কিবলাহর শিখিয়ে দেওয়া ইস্তিখারা করলাম, আল্লাহ আমাকে যা দেখানোর দেখালেন। সকালে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হলে ইস্তিখারা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করেই বললেন, তুমি কি উযূ করে এসেছো? আমি হ্যাঁ বললে তখনই বাইআত করালেন।
অধ্যয়ন
আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুধু গাছবাড়ি মাদরাসায় ছাহেব কিবলাহর কাছে পড়েছি। উসূলে ফিক্হের কিতাব নূরুল আনওয়ার তাঁর কাছে অধ্যয়ন করেছি। এই মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না কেবল আলিম ক্লাসে নূরুল আনওয়ার তাঁর কাছে পড়েছি নাকি আলিম ও ফাযিল উভয় ক্লাসেই অধ্যয়ন করেছি। এ ছাড়া ক্লাসে বসে পড়ার সুযোগ হয়নি। তবে হাদীস শরীফ তাঁর কাছে প্রাইভেট পড়েছি। দু’দিন পড়ার পরই তিনি আমাকে ইজাযত দিয়েছেন। হাদীস পড়ার যে নিয়ম পদ্ধতি- কিরাত, সামাআত ও ইজাযাত এ তিনটি অনুসরণ করেছি। বুখারী শরীফ থেকে ছাহেব কিবলাহ পড়েছেন, আমি শুনেছি। আমি পড়েছি, তিনি শুনেছেন, তারপর ইজাযত দিয়েছেন।

উস্তাদ হিসেবে যেমন ছিলেন
আগেকার যুগের উস্তাদগণের গুণাবলী, শিক্ষাদানের তারয-তরীকা ইত্যাদি বিবেচনায় আনলে তিনি তাঁর যুগে একজন শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ছিলেন। সে যুগে মাদরাসায় শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দু। ছাহেব কিবলাহ হাদীস শরীফ এবং অন্যান্য কিতাব পড়াতে ক্লাসে উর্দু ভাষায় তাকরীর করতেন। ছাহেব কিবলাহ মূলত সপ্তাহে দু’দিন পড়াতেন এবং বাকি দিনগুলো অন্যান্য ব্যস্ততায় কাটাতেন। অথচ পড়াতে বসলে মনে হতো যেন তিনি প্রতিদিন- চব্বিশ ঘণ্টা পাঠ দানকারী উস্তাদ। একজন উস্তাদের যে সকল গুণ থাকা দরকার- অন্য যেকোন উস্তাদের তুলনায় তাঁর মাঝে সেসব গুণ বেশিই ছিল। যেমন একজন উস্তাদের একটি গুণ হলো শাফকাত ফিত তালিম অর্থাৎ ছাত্র বুঝছে কি না সে দিকে লক্ষ্য রাখা। সে গুণটি তাঁর মধ্যে খুবই প্রবল ছিল। এ কারণে কাউকে একটি বিষয় দু-তিন বার করে বুঝিয়ে দিতেন। আল্লাহর শোকর তাঁর মাঝে এসব গুণাবলী ভরপুর ছিল। ছাত্র হিসেবে আমার যে অভিজ্ঞতা, উস্তাদ সবাই লায়েক, সবাই নিয়মিত যতœসহকারে পড়াতেন। কিন্তু ছাহেব কিবলাহ যে বিষয় পড়াতেন, তাঁর তাকরীরের পর ঘরে গিয়ে সে বিষয় আর পড়ার প্রয়োজন হতো না। আমার উপলব্ধি মতে, এ রকম ফায়দা অন্য কোন উস্তাদের দ্বারা হতো না। কোন কোন উস্তাদের দ্বারা সেটা কিছুটা হলেও ছাহেব কিবলাহর মতো হতো না।
দরস দান
দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালের পর দেশে কিছু বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় পর্যন্ত ছাহেব কিবলাহ বদরপুর মাদরাসায় পড়াতেন। দেশ বিভাগ পরবর্তী সময়ে দেশে এসে তিনি জকিগঞ্জ থানার বারগাত্তা গ্রামে পড়াতে শুরু করেন। এখানে একটি মাদরাসাও গড়ে ওঠে। কিছুদিন পর স্থানীয় কিছু সমস্যায় মাদরাসায় বিশৃংখলা শুরু হলে তিনি বাড়িতে ফিরে এসে ফুলতলী মাদরাসায় (ফুলতলী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে) শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে গাছবাড়ী মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাঁকে সেখানে নেয়ার প্রয়োজন উপলব্ধি করে যোগাযোগ করলে তিনি সেখানে যোগদান করেন। সেখানে সপ্তাহে দু’দিন করে নিয়মিত পড়াতেন। গাছবাড়ি থেকে চলে যাবার পর সৎপুর দারুল হাদীস মাদরাসায় পড়াতেন। সপ্তাহে দু’দিন সেখানে হাদীস পড়াতেন। অবশ্য মাঝে-মধ্যে ফাযিল ক্লাসে হিদায়াও পড়াতেন।
১৯৫৯ সালে কামিল পাশ করার পর আমি ইছামতি মাদরাসায় যোগদান করি। মাদরাসায় হাদীস পড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে তা শুরু করি। এর অনেক পর আমি দেশের বাইরে (দুবাই) চলে গেলাম। যাবার সময় ইছামতি মাদরাসায় সময় দেওয়ার জন্য আমি তাঁকে অনুরোধ করি। সদয় সম্মতিপূর্বক এখানেও তিনি সপ্তাহে দুদিন হাদীস পড়াতেন। এরপর ফুলতলী মাদরাসায় কামিল শুরু হলে সেখানে সপ্তাহে দু’দিন নিয়মিত হাদীস পড়াতেন। আজীবন সেটা অব্যাহত রাখেন। এক সময় গঙ্গাজল মাদরাসার (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯০৫ ইং) পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব তাঁর ওপর ছিল। তিনি মাঝে মধ্যে সেখানে যেতেন, তবে পড়াতেন না। সে সময় গঙ্গাজল মাদরাসার দায়িত্বে ছিলেন ছাহেব কিবলাহর উস্তাদ গণিপুরী ছাহেব (র.)। এ সময়ে তিনি বারগাত্তায় সপ্তাহে একদিন, পরবর্তীতে সৎপুরে একদিন, এভাবে বিভিন্ন স্থানে একদিন করে কুরআন শরীফ পড়াতেন।
গাছবাড়ি মাদরাসায় ছাহেব কিবলাহ
হযরত ছাহেব কিবলাহ গাছবাড়ি মাদরাসায় মূলত হাদীসই পড়াতেন। পাশাপাশি মুহতামিম (পরে মুহতামিমের বদলে পদটি প্রিন্সিপাল হয়েছে) মাওলানা আবূ ইউসুফ মুহাম্মাদ ইয়াকূব ছাহেবকে মাদরাসা পরিচালনায় সহযোগিতা করতেন। আমরা তাঁকে নায়িবে মুহতামিম (ভাইস প্রিন্সিপাল) হিসেবে জানতাম। মুহতামিম ছাহেব হজ্জে গেলে তিনি ভারপ্রাপ্ত মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তখন তো হজ্জের সফর হতো জাহাজে। দু’তিন মাস লেগে যেত। সে সময়টা আমাদের ছাত্রদের খুবই সতর্কতার সাথে চলতে হয়েছে। বাজারের কাছেই মাদরাসা। অনেক ছাত্র বাজারে চলে যেত, সময়মতো ক্লাসে উপস্থিত হতো না। কিন্তু ছাহেব কিবলাহ যে ক’দিন মাদরাসায় থাকতেন, সেটা হতো না। তাঁর উপস্থিতিতে ছাত্র-শিক্ষক সবাই সতর্ক থাকতেন।

ছাহেব কিবলাহ’র নির্দেশ ও অনুপ্রেরণায় হাদীসের খিদমত
কামিল পরীক্ষার পর আমি খুবই অসুস্থ ছিলাম। পরীক্ষার পর অনেক দিন বাড়িতে অবস্থানের পর কিছুটা সুস্থ হয়েছি। একদিন বিকেলে আমার একজন উস্তাদ হযরত মাওলানা শামসুল হুদা ছাহেব এলেন। গাছবাড়িতে তাঁর কাছে হাদীস পড়েছি। বললেন, ‘তুমি আমার মাদরাসায় (ইছামতি) চলো।’ আমার বাবা তখনো জীবিত আছেন। তাঁর অনুমতি চাইলে তিনি জবাবে বললেন, আমি কি বলবো, আপনারা যে কাজের উপযুক্ত করে গড়েছেন সে কাজে নিয়ে লাগান। আমি মাদরাসায় চলে গেলাম, পড়ানো শুরু হলো। এর মাঝেই সিদ্ধান্ত হলো, হাদীস শরীফ পড়ানো হবে। কারণ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা (মাওলানা মতিউর রহমান চৌধুরী) নাকি হাদীস পড়ানো দিয়ে শুরু করেছিলেন। কিন্তু পরে হাদীস শরীফ পড়ানো বন্ধ হয়ে যায়। আমি তো ইতিপূর্বে হাদীস শরীফ পড়াইনি। এছাড়া পড়ার সময় হাদীস পড়াতে হবে এমন কথা মনে আসেনি কখনো। চলে গেলাম ছাহেব কিবলাহর কাছে। তিনি বললেন, আল্লাহর উপর ভরসা করে পড়াও, হাদীসও পড়াও। আরয করলাম, এখানে ছাত্র আসবে না হাদীস পড়তে। কারণ হাদীস ক্লাসের অনুমোদন নেই। বললেন, যার মুকদ্দরে আছে তোমার কাছ থেকে হাদীস পাবে সে তো আসবে। এ সময় বিলপারী ছাহেব (হাফিয মাওলানা নূরুল হক) গং কে ছাহেব কিবলাহ ইছামতিতে হাদীস পড়তে পাঠান। ছাহেব কিবলাহর ইজাযত অনুসারে পড়াতে শুরু করলাম। প্রথম দিকে নাসাঈ শরীফ, ইবন মাজাহ শরীফ ও তাফসীরে বায়দাভী এসব পড়াতাম। ১৯৬৩ সালের ১১ এপ্রিল ফুলবাড়ি মাদরাসায় যোগদান করি। সেখানে হাদীস জামাআত নেই, ফাযিল পর্যন্ত পড়ালাম। এর সাত মাস পর ছাহেব কিবলাহ জোর করে বললেন, সৎপুর আলিয়া মাদরাসায় আমিই টাইটেল ক্লাস শুরু করিয়েছি। তুমি সেখানেই যাবে। একদিকে অনেক দূর এবং অপরিচিত জায়গায় যেতে আমার কিছুটা পিছুটান ছিল। এ সময় একদিন বড় বেয়াদবি করেছি। আমি তখন কিসমত মাইজভাগ লজিংয়ে ছিলাম। রাস্তার কাছে গাড়ি থামিয়ে ছাহেব কিবলাহ এগিয়ে গিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, তোমার যা কিছু প্রয়োজন তা মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে না, আমি দেবো। তুমি সেখানে চলে যাও। আর পড়ানোতে তোমার সহযোগী হিসেবে গোটারগ্রামী মুহাদ্দিস ছাহেবকে (মরহুম শাইখুল হাদীস আল্লামা আবদুল জব্বার) দিচ্ছি। তিনি তখন গঙ্গাজল মাদরাসায় কর্মরত। তাঁকে হুকুম করলেন, এই শনিবার থেকেই চলে যাও। আর আমি গেলাম এর এক সপ্তাহ পর। ১৯৬৩ সালের ২৩ নভেম্বর যুহরের জামাতের কিছুক্ষণ পর মাদরাসায় গিয়ে পৌঁছি। ছাহেব কিবলাহ (সৎপুর যাওয়ার জন্য) খুব জোর দিলেন। অথচ আমি বড় বেআদবী করেছি, যেতে চাইনি। অল্পদিন পর মাদরাসা গরমের ছুটি হলে বাড়িতে এলাম। খাদিমানীকে বললাম, চলুন ছাহেব কিবলাহকে দেখে আসি। গরমের দিন, দুপুরের খাবারের পর বাইরের ঘরে ছাহেব কিবলাহ আরাম করছেন। আমরা খিদমত করছি। এ সময় আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমাকে জোর করে সৎপুর দিলাম। আসলে আমি বড় পেরেশানিতে পড়েছিলাম। কারণ সেখানে কামিল ক্লাস আমিই শুরু করিয়েছি। মুহতামিম ছাহেব ভাবুক মানুষ। তিনি কাউকে খোঁজ করবেন না। আমাকেই দিতে হবে মুহাদ্দিস। বড় পেরেশানির মধ্যে পড়ে গেলাম। কাকে দেব খুঁজে পাচ্ছি না। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। নিজে কামিল শুরু করিয়েছি; অথচ উস্তাদ যদি দিতে না পারি। একদিন খুবই কাতর মনে বসে আছি। হঠাৎ করে আল্লাহপাক চোখের হিজাব সরিয়ে দিলেন। দেখি হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ রেখেছেন। আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! স্বপ্ন দেখে বড় সাধ করে হাদীসের ক্লাস খুলেছি, পড়ানোর জন্য কাকে দেব খুঁজে পাচ্ছি না। এ সময় আঙুল মুবারক দিয়ে ইশারা করে দেখালেন। আমি পুরা ফিরব কেমনে, বেয়াদবি হবে। আস্তে করে চোখ ফিরিয়ে দেখি তুমি আমার পেছনে বসা। এ কারণেই তোমাকে এতো জোর করলাম। তাৎক্ষণিক আমি কদম শরীফে ধরে আরয করলাম, আমি তখন বুঝিনি, যেতে দেরি করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন। এভাবেই শুরু হলো হাদীস শরীফ পড়ানো।

ছাহেব কিবলাহর অনুমতি ও নির্দেশ পালনে আমার প্রবাস জীবন
আমার এক আত্মীয় (মাওলানা জামিল রিদওয়ান, মাথিউরা, বিয়ানীবাজার) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই দুবাই থাকতেন। তাঁর সাথে আত্মীয়তা হওয়ার পূর্ব থেকেই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তিনি চিঠি লিখলেন দুবাই যাওয়ার জন্যে। আমি তখন ছাহেব কিবলাহর অনুমতি চাইলাম। তিনি আমাকে অনুমতি দিতে দেরি করলেন। ছাহেব কিবলাহর সাধারণ অভ্যাস (আমার ব্যাপারে) জানা ছিল, গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানতে চাইলে জবাব দিতে দেরি করতেন। আমিও জবাব পাওয়ার জন্যে চাপাচাপি করতাম না। কিছুদিন পর আমাদের ইছামতি মাদরাসার এনামী জলসায় ছাহেব কিবলাহ তাশরীফ আনলেন। সেদিন না চাইতেই তিনি বলতে শুরু করলেন, তোমাকে একবার বিদেশ যেতে দেওয়া দরকার। কারণ হিজরতও হলো একটি জরুরী কাজ। হিজরতের অর্থ কেবল মেরে দেশ থেকে তাড়ানো নয়। আসলে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে কিছুদিন একা থাকার মাঝে তরীকতের এক রহস্য নিহিত আছে। তুমি ব্যবস্থা করে দুবাই চলে যাও। তারপর ব্যবস্থা হলো, আমি দুবাই চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে চাকরি নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। যে চাকরির আশা ছিল (আদালতে) সেটা হচ্ছে না। অনুসন্ধান করে জানা গেল মূলত আমি হানাফী মাযহাবের অনুসারী বিধায় আমার চাকরি হচ্ছে না। দুবাইয়ে যে এলাকায় আমি থাকতাম সেখানে স্থানীয় কেউ হানাফী মাযহাবের নেই। বেশিরভাগ হাম্বলী আর সামান্য অংশ মালিকী। বহিরাগতরা হানাফী। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া থেকে আগতরা প্রায় হানাফী। অবশ্য ইন্ডিয়ার মালেবার এবং কেরালার লোকজন শাফিঈ। এ অবস্থায় ছাহেব কিবলাহর কাছে চিঠি লিখলাম। তখন তো ফোনের যোগাযোগ বর্তমানের মতো ছিল না। লিখলাম আমি হানাফী, কেবল এই কারণেই আমার চাকরি হচ্ছে না। ছাহেব কিবলাহ চিঠির জবাব দিলেন (চিঠিখানা এখনো আছে, আমার ঘরে খোঁজ নিলে পাওয়া যাবে) যে, ‘তুমি প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দাও। উত্তীর্ণ হবে। এ কারণে চাকরি না হবার কথা নয় ইনশাআল্লাহ। হযরত ইমাম আযম আবূ হানীফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে আল্লাহপাক কী এনায়াত করেছেন তুমি দেখতে পাবে। পরবর্তী ইন্টারভিউ দেবার দু’রাত আগে স্বপ্ন দেখলাম (প্রয়োজনে বলতে হচ্ছে, নতুবা এসব স্বপ্নের কথা না বলাই ভালো)। দেখলাম- ইমাম আযম হেঁটে যাচ্ছেন, তাঁর পেছনে ছাহেব কিবলাহ। আমি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে অতিক্রম করার সময় ছাহেব কিবলাহ ইমাম আযমকে লক্ষ্য করে আমাকে দেখিয়ে বললেন- এই বাচ্চার কথাই বলেছিলাম আপনাকে। এরপর খুব সহজেই চাকরি হয়ে গেল।
দু’বছর পর ছুটিতে দেশে এলাম। আমার ইচ্ছা আর দুবাইতে ফিরবো না। ইছামতি মাদরাসার জলসা ছিল, ইরাদা ছিল সেখানেই ছাহেব কিবলাহর অনুমতি চাইব। কিন্তু তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় জলসায় আসতে পারলেন না। পরদিন বাদ ফজর ফুলতলীতে চলে গেলাম। গিয়ে জানতে পারলাম এখনো তাঁর অবস্থা তেমন ভালো নয়। বেশি কথাবার্তা বলতে ডাক্তার নিষেধ করেছেন। আমি এসেছি শুনে অন্দর মহলে ডেকে নিলেন। আমি জিজ্ঞেস করার পূর্বেই বললেন, তোমার কিছু দুর্বলতার কারণে আমার যে উদ্দেশ্য ছিল, তা পূর্ণ হয়নি। তুমি আরো কিছুদিনের জন্য দুবাই চলে যাও। তোমাকে আমি যখন বলবো তখন ফিরে আসবে। আর যারা (তখনকার ছাত্র) আমার কাছে হাদীস শরীফ পড়তে আগ্রহী ছিল, যেমন- জকিগঞ্জ মাদরাসার বর্তমান প্রিন্সিপাল মাওলানা নূরুল ইসলাম প্রমুখ তাঁদেরকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে বললেন, উনাকে আবার বিদেশে না পাঠালে হচ্ছে না। দৌলতের জন্যে নয়। দৌলত দেশেও আছে, বিদেশেও আছে। আসলে আমার একটা গরজের জন্যে তাকে বিদেশে পাঠিয়েছিলাম। এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। তাই আবার যাওয়া দরকার। তোমরা মনে নারাজি আনবে না। পড়া চালিয়ে যাও, তিনি দেশে ফিরে এলে তাঁর কাছে হাদীস পড়বে।
এখানে কিছু কথা বলা দরকার। মূলত আমি দুবাই গিয়েছিলাম ভ্রমণ ভিসায়। চাকরি করবো বা সেখানে থাকবো সে রকম পরিকল্পনা প্রথমে ছিল না। ইচ্ছা ছিল সেখান থেকে হজ্জে যাব, তারপর দেশে ফিরে আসবো। কিন্তু সেখান থেকে হজ্জে যেতে আইনী সমস্যা দেখা দিলো। এক বছর সেখানে কাজ নিয়ে না থাকলে হজ্জের ভিসা পাওয়া যায় না। ছাহেব কিবলাহর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, তুমি কিছু একটা কাজ নিয়ে সেখানেই থাকো। আগামী বছর আমিও হজ্জে আসবো। আমার সাথে হজ্জ করবে। ছাহেব কিবলাহর এই পরামর্শ মতোই দুবাইয়ে অবস্থান করার পরিকল্পনা। যা হোক, প্রথমে একটি মসজিদে ইমাম হিসেবে যোগ দেই। পরবর্তীতে আগে যে চাকরির কথা বলেছি, অর্থাৎ কোর্টে যোগদান করি। কোর্টের কাযী সাহেবের সাথে আসলে পূর্ব থেকেই সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। কোর্টে যোগদানের ব্যাপারে তিনিই আমাকে উৎসাহিত করেন এবং বিশেষ সহযোগিতা করেন। কাযী সাহেবের মুসাঈদ বা সহযোগী হিসেবে কোর্টে যোগদান করি। মাঝে মাঝে মুতার জিমের কাজও করতে হতো। এছাড়া কিছুদিনের মধ্যে কোর্টের কুতুবখানা আমার দায়িত্বে দেওয়া হয়। আসলে হানাফী মাযহাবের অনুসারী বাঙালী, পাকিস্তানী এবং ইয়ামানী লোকদের মামলার রায় প্রদানে হাম্বলী কাযী সাহেবকে সহযোগিতা করতে হতো। তখন ব্যাপকভাবে কিতাব ঘেটে হানাফীয়্যাত রক্ষা করে রায় তৈরি করতে হতো। এ ছাড়া প্রথমে যে মসজিদে ইমামতীতে ছিলাম, সেখানকার মুসল্লিয়ান ছাড়তে চাইল না। তাই খতীব হিসেবে সেখানেও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।
দুবাই থাকাকালীন ছাহেব কিবলাহর সাথে চিঠিপত্রের মাধ্যমেই যোগাযোগ হতো। প্রয়োজনমত ছাহেব কিবলাহর কাছে চিঠি লিখলে তিনি উত্তর দিতেন। একবার এমনিতেই ছাহেব কিবলাহ আমাকে একটি চিঠি দিলেন। তিনি লিখেছিলেন, আমি শুনেছি তুমি যা বেতন পাও প্রায় সবই বণ্টন করে ফেলো। এখন থেকে তা আর করবে না। বাড়িতে টাকার দরকার আছে। কিছু বিত্তের প্রয়োজনও রয়েছে। এখন থেকে এভাবে বণ্টন বন্ধ করবে, না হয় আরেক চিঠিতে লিখবো বেতন পেয়ে পকেট খরচের টাকা রেখে বাকিটা আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে। যা হোক, মূলত চিঠি মারফত যোগাযোগ হতো সব সময়।
প্রকৃতপক্ষে দুবাই থাকার সময়টা নির্ভর করে ছাহেব কিবলাহর নির্দেশের উপর। কেননা, আমি তো দু’বছর পরই দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ছাহেব কিবলাহ আমাকে বলে দিলেন- কখন ফিরে আসবে তা আমি বলে দেব। জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুরের ঘটনার পর ছাহেব কিবলাহ লন্ডন সফর করেন। তখন আমাকে চিঠি লেখেন। চিঠির সারকথা- আমি বেঁচে থাকতে একবার লন্ডন চলে এসো। আমার সম্পর্কিতদের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। আগামীতে ইসলামের কাজ করতে সুবিধা হবে। এ চিঠি পেয়ে (দুবাই থেকে) ব্যবস্থা করে লন্ডন আসি। লন্ডন আসার পরের রাতে ছাহেব কিবলাহ আমাকে কাছে বসিয়ে বললেন, তুমি এবার দেশে চলে এসো। আল্লাহ যা দেবার দিয়েছেন। মানুষের মালামত আর সহ্য হচ্ছে না। শিঙ্গাইকুড়ির ছাহেবের সাথে (হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান চৌধুরী ছাহেব) দেখা হলেই বলেন- তোমাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে। এই হুকুমের পর তিন-চার মাসের মধ্যেই আমি দেশে ফিরে আসি।

হযরত ছাহেব কিবলাহর নির্দেশে লন্ডন সফর
সৈয়দপুরের মর্মান্তিক ঘটনার কিছুদিন পরই ছাহেব কিবলাহ লন্ডন সফরে আসেন। এ সফরে তিনি দীর্ঘ সময় লন্ডনে অবস্থান করেন। আগেই বলেছি, ছাহেব কিবলাহর চিঠি পেয়েই আমি লন্ডন সফর করি। আসলে সেটা ছিল তৃতীয় চিঠি। এর আগে আরো দুটি চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে লিখেছিলেন, তোমার মন চাইলে লন্ডন বেড়িয়ে যেতে পারো। তখন আমার মন চায়নি, তাই লন্ডন যাইনি। তৃতীয় চিঠিতে গুরুত্ব দিয়ে লিখলেন। বিশেষ করে লিখলেন, লন্ডন এলে তো আমাকেও দেখে যেতে পারবে। সৈয়দপুরের ঘটনার পর তাঁকে দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল। সব মিলিয়ে তখনই লন্ডন যাই। লন্ডন গিয়ে দেখলাম ছাহেব কিবলাহ ছাহেবানীসহ হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে আমাকে লন্ডনে রেখে যাবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু আমি আসার পরের দিনই নাকি ছাহেবানী ছাহেব কিবলাহকে বললেন- উনাকেও সাথে নিন। একবার আরাফায় উনি ছিলেন, খুব ভালো লেগেছিল। ছাহেব কিবলাহ নাকি বলেছিলেন, পয়সার যোগাড় কিভাবে হবে? শুনেছি, ছাহেবানী বলেছেন, আমার সন্তান হিসেবে আমি দেব পঞ্চাশ পাউ-। ঘরের অন্যরুমে বসা হাজী বশির মিয়া সাহেব, হাজী রজব আলী সাহেব এবং যার ঘরে আমরা বসা ছিলাম জয়নাল আবেদীন খান সাহেব। সেটা ছিল জনস্কার হাউস। সেদিন ছিল শুক্রবার। ছাহেব কিবলাহ ঐদিন ওয়াকিং শাহজাহান মসজিদে জুমুআ আদায় করেছিলেন। জুমুআর পর ঘরে ফিরে ছাহেব কিবলাহ ও ছাহেবানীর মধ্যে উল্লিখিত আলাপ হয়। যে রুমে আমি বসা ছিলাম, সেখানে ছাহেব কিবলাহ তাশরীফ আনলেন। আমাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, বিবি চাচ্ছেন মুহাদ্দিস ছাহেবকে সাথে নিতে। তিনি দিয়েছেন পঞ্চাশ পাউন্ড আর আমি দেবো দুই’শ পাউ-। একথা শুনেই বশির মিয়া সাহেব বলে উঠলেন, ছাহেব বাকি যা খরচ লাগে আমি দেবো। বশির মিয়া সাহেবের কথা শুনে ছাহেব কিবলাহ বললেন, তুমি তো এ কাজে খুব আগুয়ান। এতো পয়সা কোথায় পাবে? (তখন বশির মিয়া সাহেবের নিজস্ব কোন ব্যবসা ছিলো না)। যা হোক, পয়সার ব্যবস্থা হয়ে গেল। সেদিন ছিল সৌদি এম্বেসিতে কাগজ জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। তাৎক্ষণিক ছবি তোলা হলো। ছাহেব কিবলাহ পরামর্শ দিলেন, তুমি নিজে সাথে যাও, প্রয়োজনে তাদের সাথে কথা বলবে। তাদের ইচ্ছা হলে ভিসা দেবে। জয়নাল আবেদীন খান সাহেব (মরহুম) আমাকে নিয়ে গেলেন। আমার মনে হলো ভিসা পেয়ে যাবো। এর কারণ, যে দিন লন্ডন আসি সেদিনই রাতে ছাহেব কিবলাহ আমাকে বললেন, কাসীদায়ে নুমান তো সাথে আনিনি। রাওদা শরীফের কাছে গিয়ে তা পড়ার ইচ্ছা। তাই ইয়াদ থেকে লিখেছি। তুমিও এটা কপি করে রাখো। তখন পর্যন্ত আমার হজ্জে যাবার ইরাদা নেই, পরিকল্পনাও ছিল না। তিনি আমাকে কিছু খাবার জিনিস দিয়ে বললেন, এদেশে রাত দীর্ঘ, খিদে লাগবে। এটা খেয়ো এবং কাসীদা লিখে রাখো। এ কারণেই আমার মনে হলো যে ভিসা পেয়ে যাব। এম্বেসিতে গিয়ে দেখা গেলো শনি ও রবিবার তো এমনিতেই বন্ধের দিন। কিন্তু ঐদিন শুক্রবার হওয়ায় দিবস বাকি থাকতেই তারা বন্ধ করে দিয়েছে। কাউন্টারে বসা লোকটি বললো- এখন তো অফিসের সময় নেই, ফিনিশ। দেখতে পেলাম অফিসার গোছের আরেকজন অন্যত্র বসা। দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন স্থান থেকে কাগজপত্র তাঁর টেবিলেই যাচ্ছে। আমি কাউন্টারে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি উনার সাথে দেখা করতে পারি? লোকটি বললো, অসুবিধা নেই, যান। আমি ঐ অফিসারের কাছে গিয়ে সালাম দিতেই জবাবে বললেন, আইয়্যুল খিদমাহ, কি সাহায্য করতে পারি? উত্তরে বললাম, আমি এ দেশে ভ্রমণে এসেছি। এখানে যারা আমার মেজবান তারা সবাই হজ্জে যাচ্ছেন। তাদের দেখাদেখি আমারও শখ হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি করেন? বললাম, দুবাই কোর্টে চাকরি করি। কাগজ বের করে দেখালাম। বললেন, ফটো সাথে আছে? বললাম, আছে, আজ শেষদিন জেনেই এসেছি। তিনি বললেন, আমাদের কাগজের বান্ডিল প্রস্তুত, এখনি পাঠিয়ে দেব। আপনি ফরম পূরণ করে ফটো ও ফি জমা দিন। আমি তাই করলাম। কাউন্টারে জিজ্ঞেস করলাম, কোনদিন আসবো? ঐ ব্যক্তি বললেন, আর তো দিন নেই। আপনি তিন ঘণ্টা পর এসে ভিসা নিয়ে যাবেন। আমরা তাই করলাম।

ইলমে কিরাতে ছাহেব কিবলাহ (র.) এর খিদমত
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ সারাজীবন কুরআন শরীফের খিদমত করেছেন। তিনি ‘দারুল কিরাত’ শুরু করার পেছনে যে কারণ বলেছেন- তা হলো, তিনি তখন বদরপুর পড়াতেন। একদিন ক্লাসে এসে বসে পড়েছেন গড়কাপনী ছাহেব (মাওলানা আবদুন নূর ছাহেব)। তিনি বড়ই উঁচু মর্যাদার বুযুর্গ ছিলেন। ক্লাস শেষে বললেন, আমি কিছু কাজে এসেছি। আমি আপনার কাছে কিরাত পড়তে চাই। ছাহেব কিবলাহ বলেছেন- একে তো প্রাত্যহিক ব্যস্ততা, এছাড়া মর্যাদাবান একজন বয়স্ক বুযুর্গ, তাঁর অনেক মুরীদ, কেমনে তাঁকে পড়াবো? প্রথম দফা তাঁকে না করে দিলাম। পরেরদিন তিনি আবার এলেন এবং একই অনুরোধ করলেন। আমিও তাঁকে ওযর পেশ করলাম। তখন বললেন, আমি আপনার কাছে এমনি আসিনি, বড় জায়গার আদেশ পেয়ে এসেছি। জানতে চাইলাম, বদরপুরী ছাহেবের আদেশ কি না? বললেন, আরো বড় জায়গার আদেশ। তিনি বলেন, ‘স্বপ্নে দেখলাম হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ রেখেছেন। আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কুরআন শরীফের তিলাওয়াত শুনতে চাই। তখন তিনি সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করলেন। আবার আরয করলাম, এরকম তিলাওয়াত কিভাবে শিখবো? তখন আপনার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন। ছাহেব কিবলাহ বলেছেন, তাঁর স্বপ্ন-বৃত্তান্ত শুনে আমি রাজি হলাম। সময় ঠিক হলো প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ যুহর আদমখাকীর মোকামে বসে পড়া হবে। এখানে অনেক বুযুর্গ আলিম ব্যক্তি ছাহেব কিবলাহর কাছে অধ্যয়ন করেছেন। এরপর তো আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সপ্তাহে একদিন বারগাত্তায় পড়াতেন। সৎপুরও একদিন পড়াতেন। বারগাত্তায় যখন পাঠদান করতেন, তখন আমরা ছোট ছিলাম। দেখেছি পুরো এলাকার ইমাম ছাহেবগণ তাঁর কাছে পড়তে যেতেন।
ছাহেব কিবলাহ (র.) যখন বাড়িতে কিরাত পড়ানো শুরু করেন তখন বর্তমান বাড়িতে এটা ছিল না বরং পুরাতন বাড়িতে ছিল। এ সময় ছাহেবানী অসুস্থ ছিলেন। রান্নাঘরে কাজ করার মতো শারীরিক অবস্থা তখন তাঁর ছিলো না। ছাহেব কিবলাহ তারাবীর নামাযের পর একটি দীর্ঘ মশক দিয়ে ভেতর বাড়িতে গিয়ে (ছাত্রদের জন্যে) খাবার রান্না করতেন। সে সময় একদিন তাঁর হাত পুড়ে গিয়েছিল। শেষ জীবন পর্যন্ত তাঁর হাতে কালো দাগ ছিল। একবার আমি বলেছিলাম, ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে দেখি এ দাগের জন্য কোনো ঔষধ পাওয়া যায় কি না। বললেন, না বাবা, এটা আমার এক চিহ্ন। কুরআন শরীফ পড়তে আসা লোকদের খিদমতের জন্য হাত পুড়েছে। ডান হাতের আঙুলের উপর দিকে কালো সে দাগ ছিল। আমি তখন সাহায্যকারী হিসেবে পাশে পাশে থাকতাম। রান্না শেষ হলে বলতেন, যাও, চার রাকাত নামায (তাহাজ্জুদের নামায) আদায় করো। সবাইকে জাগিয়ে দাও, সেহরীর খাবার প্রস্তুত হয়ে গেছে। সবাই খাবার খেতেন। ধীরে ধীরে ছাত্র সংখ্যা বাড়তে শুরু হলো। নতুন বাড়িতে ছাপড়া ঘর বানিয়ে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো। তখন কিন্তু পড়ানোর সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না। একা একা সারাদিন পড়াতেন।
আমি যে বছর কুরআন শরীফ (কিরাত) পড়ি তখন সৎপুরে মুহাদ্দিসে আউয়াল বা শাইখুল হাদীস হিসেবে কর্মরত ছিলাম। রামাদানের তিন-চার দিন আগে গিয়েছি। মাদরাসা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকে বললেন, এবার কুরআন শরীফ পড়তে হবে। রোযার আগের দিনের আগের দিন বললেন, যারা কুরআন শরীফ পড়বে, নিজ নিজ বাড়িতে গিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এসো। বাড়ি থেকে কোনো মৃত্যুসংবাদ এলে ছুটি পাবে, নতুবা ২৭ রামাদানের আগে কোন ছুটি নেই। আমাদের এ ব্যাচে বড় ছাহেবজাদা ও মেজো ছাহেবজাদাও ছিলেন। এ ছাড়া হাইদ্রাবন্দের মাওলানা আজিজুর রাহমান ছাহেব, বালাউটের মাওলানা শুয়াইবুর রাহমান ছাহেব, দেওয়ান আবদুল বছির ছাহেব মরহুম। সবার নাম মনে পড়ছে না। ছাহেব কিবলাহ এই জামাতের নাম দিয়েছিলেন খুসুসী জামাত। কোন নির্দিষ্ট রুটিন ছিল না। যখন ডাকতেন তখনই ক্লাস শুরু। প্রতিদিন তিন-চার বার করে সবক শুনতেন। ডাক দিলেই আমি গিয়ে বড় ছাহেব ও মেজো ছাহেবের দরজায় নক করতাম। তারাও তড়িঘড়ি করে আসতেন।
আমি একদিন ছুটি পেয়েছিলাম। একটি স্বপ্ন দেখলাম, বড় আজব (আশ্চর্যজনক)। ছাহেব কিবলাহকে একা পাওয়ার সুযোগ নেই। তখন বাইরের ঘরে কারী আলতাফুর রহমান ছাহেব (ছাহেব কিবলাহর সেক্রেটারি) যে রুমে থাকতেন সেই রুমে থাকি। আসরের পর রুমে বসে রয়েছি, এ সময় অন্যরা একটু হাঁটাহাঁটি করছেন, কেউবা টুকিটাকি কেনার জন্য দোকানে গেছেন। অমনি সময় হঠাৎ করে ছাহেব কিবলাহ রুমে এসে উপস্থিত। জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি কিছু বলবে? আমি স্বপ্নের কথা বললাম। স্বপ্ন বৃত্তান্ত শুনে বললেনÑ তা’বীর আমি করবো না। তুমি আগামীকাল সবক শুনিয়ে চলে যাও গণিপুর। আমার হুযূরের কাছে গিয়ে স্বপ্ন বলে আসবে। আসার পথে রাত হয়ে যাবে, বাড়িতে থাকবে। এই একরাতের ছুটি পেয়েছিলাম। প্রসঙ্গত এই রামাদান শরীফের ৯ দিন আগে আমার রুসুমাত হয়েছে, আক্দ আগেই হয়েছিল। এ বছরই ছাহেব কিবলাহর কাছে কুরআন শরীফ আউয়াল আখের শুনিয়েছি। বড় দুই ছাহেবজাদাও আমাদের সহপাঠি ছিলেন। এরপরের বছর থেকে তারা উভয়ই একটু একটু করে ছাহেব কিবলাহকে পড়ানোতে সহযোগিতা শুরু করেন। আমাকেও তখন থাকতে হতো সহযোগিতার জন্য। এর অনেক বছর পর সিলেট শহরের সুবহানীঘাটে দারুল কিরাত শুরু হলে আমাকে দায়িত্ব দিয়ে সেখানে পাঠান।

ছাহেব কিবলাহ (র.)-এর মানবপ্রেম
ছাহেব কিবলাহর সাথে চলেছি, (এসব) কত যে দেখেছি কোনটি বলবো। কত ঘটনা! ছোট ছোট হলেও এসব ঘটনার পরিমাণ যথেষ্ট। গাছবাড়িতে ছাহেব কিবলাহ যখন পড়াতেন, তখনো আমাদের জকিগঞ্জী রাস্তায় গাড়ি চলতো না, রাস্তার কাজ পুরো হয়নি। যে বৃহস্পতিবারে বাড়িতে যেতাম ছাহেব কিবলাহর নৌকা আসতো, তাতেই যেতাম। দেখতাম, মরিচ বাটার পাটা- পুতাইল (শিলনোড়া) আরো অন্যান্য জিনিসপত্র প্রায়ই কিনতেন। যাবার সময় বলতেন, এগুলো নৌকায় তুলো। আমি মনে মনে বলতাম, ছাহেব কিবলাহর বাড়ির কাজের মেয়েরা এতো তাড়াতাড়ি পাটা-পুতাইল (শিলনোড়া) নষ্ট করে ফেলে? প্রায় প্রত্যেক বৃহস্পতিবার এগুলো কিনতে হয়? পরে জানলাম আসল ঘটনা অন্যরকম। দেখা যেত, সকালে বসেছেন এবং কাজের লোকদের ডেকে একেকটা একেকজনের জন্য পাঠাচ্ছেন। সিলেট থেকে যাকাতের কাপড়ও কিনে নিয়ে এভাবে বণ্টন করে দিতেন। তিনি যে মানুষের খিদমত কিভাবে করতেন তা কতো বলবো। বহু ঘটনা দেখেছি। মানুষের প্রতি দরদ আল্লাহ পাক তাঁর দিলে ঢেলে দিয়েছিলেন। প্রায়ই তিনি এক শের বলতেন-
‘তরীকত বজুয খিদমতে খালকে নেস্ত
বসুজ্জাদা তাসবীহ ও দালকে নেস্ত।’
-হাতে তসবীহ, কাঁধে মুসাল্লা আর পুরনো ছেঁড়া কাপড় পরে তরীকত হাসিল হয় না। আল্লাহর মখলুকের খিদমত করতে হয়।
একদিনের ঘটনা। তখন তিনি সৎপুর মাদরাসায় পাঠদান করেন। মাগরিবের নামায শেষ করে ছাহেব কিবলাহ তাঁর রুমে চলে গেছেন। আমি গিয়েছি ইস্তেঞ্জা করতে। দেখি একটি বিড়ালছানা ঢাকনাবিহীন একটি সেনেটারী ট্যাংকিতে পড়ে আছে। কিভাবে এটাকে তুলবো পথ পাচ্ছি না। ইতোমধ্যে ছাহেব কিবলাহ আমাকে খোঁজ করলেন। হাযির হয়ে আরয করলাম, একটি বিড়ালের ছানা ট্যাংকিতে পড়ে গেছে। বেশি সময় গেলে মরে যেতে পারে। বললেন, তাড়াতাড়ি যাও। যেভাবে পারো দ্রুত এটাকে উদ্ধার করো। আরেক সহযোগীর সাথে অনেক কৌশলে বাঁশের দুটো টুকরো দিয়ে বিড়াল ছানাটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করি, কিন্তু পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ময়লার মধ্যে নিজের হাত ঢুকিয়ে বিড়াল ছানাটিকে বের করি। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত পরিষ্কার করে ছাহেব কিবলাহর খিদমতে হাযির হতেই জিজ্ঞেস করলেন, তুলতে পেরেছো তো? মরে যায়নি তো? বাচ্চাটি সুস্থ আছে তো? কিভাবে তুললে? তারপর বিস্তারিত শুনে বললেন, আজ একটি বড় খিদমত করেছো। আল্লাহ তোমাকে এগিয়ে দেবেন। সেদিন আমি উপলব্ধি করলাম যে, শুধু মানুষই নয়, একটা জন্তুর জন্যে তাঁর কতো দরদ! এ রকম কতো কি যে দেখেছি! ছাহেব কিবলাহ যতদিন দুনিয়ায় ছিলেন, সৃষ্টির প্রতি তাঁর এসব ভালোবাসাই দেখলাম জীবনভর।
ছাহেব কিবলাহ আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে প্রায়ই হাদীস শুনাতেন যে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘আমাকে হুকুম করা হয়েছে, মানুষের মর্যাদামতো যেন তাদের সাথে ব্যবহার করি।’
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ ছাড়া আর কে আদেশ করতে পারে? সুতরাং আল্লাহপাক নবীজিকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন মানুষের মানযিল, মরতবা, মর্যাদা বুঝে ব্যবহার করেন। ছাহেব কিবলাহর আচার-আচরণে, মানুষের সাথে ব্যবহারে ঠিক এই হাদীস শরীফের পরিস্ফুটন ঘটতো। মাঝে-মধ্যে এই হাদীস পড়তেন আমাদেরকে শেখানোর জন্যে। তাঁর আচরণও ছিল ঠিক হাদীসের অনুরূপ। কাউকে ধমক দিলেও তার মর্যাদা মতো, আদর করলেও তার মর্যাদা মতো করতেন। এমনকি মেহমানদারী করলেও মর্যাদা রক্ষা করতেন বরাবর। মানুষের মর্যাদা, বয়স ও স্তর বুঝে কথা বলতেন এবং আচরণও করতেন ঠিক সেভাবে।
আমার জানামতে মসলকের দিক দিয়ে বিরোধী আলিমগণের মধ্যে ইনসাফ-পছন্দ কেউ কেউ বলতেন, ফুলতলী ছাহেবের মাঝে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আখলাক পাওয়া যায়। মসলকের দিক থেকে ইখতিলাফ পোষণ করলেও এটা স্বীকার করতেন যে, আখলাকে নববীর এক অনুপম দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ফুলতলী ছাহেব।

ফেইসবুকে আমরা...