সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের পালনকর্তা। অশেষ সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উপর। মুসলমান হিসেবে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করা আমাদের প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক। জ্ঞানার্জন ব্যতিরেকে যে কাউকেই অন্ধকারে জীবন যাপন করতে হবে। মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে জ্ঞান অর্জনকারীর পুরস্কার বর্ণনা করে ইরশাদ করেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদের মর্যাদা আল্লাহ উন্নীত করবেন। বস্তুত, আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত।” (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-১১)
বিষয়টি বুখারী শরীফের অত্যন্ত সুন্দর একটি হাদীস দ্বারা সমর্থন করা হয় যেমনটি আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ যদি কারো মঙ্গল চান, তাহলে তিনি তাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করেন। (সহীহ বুখারী)
ইনশাআল্লাহ, আমি একজন অমুসলিমের সাথে আমার নিজ কথোপকথনের একটি অভিজ্ঞতা এবং ইসলামী জ্ঞান অনুসন্ধানের গুরুত্ব তারা কতটুকু অনুভব করে, তা উল্লেখ করছি।
আমার উপর মহান আল্লাহর অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে তাঁর মহান গ্রন্থ কুরআন মাজীদের ছাত্র হিসেবে কবূল করেছেন, যার ফলে তাঁরই অসীম করুণায় আমি অন্যদেরও কুরআন শিক্ষা দিয়ে থাকি। ব্রিটিশ মুসলিমদের (বিশেষত বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতদের) সাধারণ একটি রীতি হচ্ছে, তারা তাদের সন্তানদেরকে স্কুল থেকে আসার পর সন্ধ্যায় স্থানীয় মসজিদে আল্লাহর দ্বীন (ইসলামী জ্ঞান) শিখতে পাঠান। সারাদিন স্কুলে বিভিন্ন সেক্যুলার বিষয়াবলি যেমন- ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটিং ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা শেষে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে ইসলামী জ্ঞান শেখানোরও প্রয়োজন মনে করেন। তাই তারা সন্ধ্যায় তাদের সন্তানদেরকে মক্তব অথবা মসজিদে পাঠান।
আলহামদুলিল্লাহ, যুক্তরাজ্যে আমাদের অনেক মসজিদ আছে, যেগুলো শুধুমাত্র দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই নয় বরং সপ্তাহান্তে ও সন্ধ্যায় চমৎকার এবং মূল্যবান সম্পূরক বিদ্যালয় হিসেবেও কাজ করে।
আগে যেমনটি বলেছিলাম, আল্লাহ আমাকে তাঁর মহিমান্বিত গ্রন্থের শিক্ষক হিসেবে কবূল করেছেন। তাঁরই অশেষ কৃপায় আমি লন্ডনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মসজিদ ‘ব্রিকলেন জামে মসজিদে’ কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিচ্ছি।
একজন শিক্ষক হিসেবে শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দেওয়াই নয়, বরং বাস্তব জীবনেও এর প্রয়োগ শেখানো আবশ্যক।
একদিন পাঠদানের সময় নিকটবর্তী হচ্ছিল, এবং আমরা ছাত্রদের মসজিদে আসার অপেক্ষা করছিলাম। ইতোমধ্যে ছাত্রদের অনেকেই তাদের নির্ধারিত শ্রেণিকক্ষে এসে পৌঁছেছেন। এমন সময় একজন মা তার ছেলেকে ভর্তি করতে আসেন এবং এ নিয়ে তিনি শিক্ষকের সাথে কথা বলতে চান। যেহেতু ক্লাস শুরুর অনেক সময় তখনো বাকী ছিল এবং অনেকেই এখনো আসেনি। তাই আমি আমার সাধ্যমত সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম।
আমি নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কোনো সাহায্য করতে পারি কী? তিনি জানতে চাইলেন, তার ছেলে এ সন্ধ্যাকালীন মাদরাসায় এসে কী শিখবে? আমি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলাম, আমাদের মাদরাসায় কী শেখানো হয়, এখানে কয়টি স্তর আছে এবং একজন ছাত্র ক্লাসে কতক্ষণ ব্যয় করে ইত্যাদি। সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার পর ছেলেটির মা গভীরভাবে বোঝার জন্য বিভিন্ন পাঠ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমি এর জবাবে সিলেবাস সম্পর্কে আরো স্পষ্ট ধারণা দিলাম এবং ছাত্ররা এটা কীভাবে সম্পন্ন করবে সেটাও তুলে ধরলাম।
উদাহরণস্বরূপ, যখন একজন ছাত্র কোনো পূর্ববর্তী শিক্ষা ছাড়াই মসজিদে তার প্রাথমিক ইসলামী শিক্ষা শুরু করে, তখন কায়দা অনুসারে তাকে আরবী বর্ণমালা শেখানো হয়। এটা সাধারণত ‘লেভেল ওয়ান’ (প্রথম স্তর) নামে পরিচিত। এ স্তরে আরবী বর্ণমালা শেখার পাশাপাশি তারা কিছু দুআও শেখে, যেগুলো তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত এবং সাথে তাদেরকে ইসলামী আদব, আখলাকও শেখানো হয়।
আমি আরো ব্যাখ্যা করলাম, আরবি বর্ণমালা শেখার পর ছাত্রদেরকে বিভিন্ন হরকত (যের, যবর, পেশ) দিয়ে বর্ণমালা পড়ানো হয়; এরপর শুরু হয় পবিত্র কুরআন মাজীদের আমপারা (আমপারা) পড়ানো, যা ‘লেভেল টু’ (দ্বিতীয় স্তর) হিসেবে পরিচিত। আমপারা পড়ানোর পাশাপাশি এই লেভেলেই নামাযের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মাসআলা-মাসাঈল, আকীদা ও ইসলামী ইতিহাস সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়। আমপারা শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের কুরআন মাজীদ বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াতে দক্ষ করা হয় যার জন্য মূলত তারা মাদরাসায় এসেছিল। তাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায, যা একজন মুসলমানের জন্য আবশ্যক ও নামাযের জন্য প্রয়োজনীয় সূরা শিক্ষা দেওয়া হয়।
ছাত্ররা যখন কুরআন মাজীদ পড়া শুরু করে, যা সাধারণত লেভেল থ্রি (তৃতীয় স্তর) হিসেবে পরিচিত; তখন তাদেরকে তাজবীদের নিয়ম-কানুন পড়ানো হয়, যাতে তারা সঠিক ও শুদ্ধভাবে তারতীলের সাথে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতসহ তাদের পূর্ববর্তী বিষয়গুলোর দুআ, আকীদা, ফিকহ, ইসলামী ইতিহাস, হিফয শিখন অব্যাহত রাখে। প্রতিটি স্তরেই ছাত্রদের সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে পাঠদান ক্রমাগত অগ্রসর হয়।
আমাদের কথোপকথন শেষে তিনি অনেকটা হতবাক চোখে সন্তুষ্টচিত্তে মূল বিষয়টি স্পষ্ট করলেন, যেজন্য তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন যে, তিনি একজন খ্রিষ্টান। যদিও একজন মুসলমানকে বিবাহ করেছেন এবং তাদের একটি পুত্র সন্তান জন্ম হওয়ার পর বুঝতে পারলেন, সন্তানের জন্য অল্প বয়স থেকেই ইসলামী জ্ঞানার্জন জরুরী। তারপর তিনি জানতে পারলেন, এই উদ্যোগটি অন্য কোনো ধর্মের দ্বারা করা হয় না, অথচ তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, তার পুত্র ধর্ম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন করবে।
যদিও এই অভিভাবক আমাদের ধর্মের নয়, তবুও তার আগ্রহ আমাকে অভিভূত করেছে। সে নিজে ইসলামের অনুসারী না হলেও আমাদের ধর্মের শিক্ষা ও চর্চা তার সন্তানের বেড়ে ওঠা ও উন্নতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা ঠিকই তিনি অনুধাবন করেন। আর এজন্যই তিনি ইসলামী শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক মনে করে তার সন্তানকে মাদরাসায় পাঠাতে চান।
আমি এই বিষয়টি সবার নজরে আনতে চাই যে, দুর্ভাগ্যবশত অনেক ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত মুসলিম তাদের কর্তব্য এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলা করছেন। যেমন- আল্লাহর কিতাব পড়া ও শেখা, প্রয়োজনীয় দুআ শেখা এবং ইসলামের মৌলিক জ্ঞানার্জন সম্পর্কে সচেতন থাকার বিষয়ে অবহেলা করছেন। অথচ এক্ষেত্রে অনেক অমুসলিম আছেন, যারা আমাদের ধর্মাবলম্বী না হলেও, আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন।
আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে প্রয়োজনীয় মূল্যবান জ্ঞান দান করুন, যা আমাদেরকে দুনিয়াও আখিরাতে সাহায্য করবে। আল্লাহ আমাদের প্রত্যেককে তার দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন এবং হিদায়াত দিন। আমীন।