বহুল প্রচলিত সূফী তরীকাগুলোর মধ্যে কাদিরিয়া তরীকা অন্যতম। এই তরীকার প্রতিষ্ঠাতা গাউসুল আযম বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.)। বাগদাদের এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় সূফী মুসলিম বিশ্বের প্রত্যেক প্রান্তে সমানভাবে পরিচিত। তিনি সমসাময়িক মুসলিম সমাজে যেমন বিরাট ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিলেন, তেমনি তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর শিষ্যদের হাতে পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল। নুরুদ্দীন জংগী এবং সালাহুদ্দীন আইয়ুবীগণ যেভাবে ইসলামের সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন, তার পেছনে শাইখ জিলানী (র.) এর অবদান অনেকটাই আজ বিস্মৃত। তাসাউফে তিনি যে মূল্যবোধ তুলে ধরেছিলেন, অর্থাৎ শরীআতের একনিষ্ঠ অনুসরণের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, সেই মূল্যবোধও আজ কাদিরিয়া তরীকার দাবিদার অনেকের ভেতর নেই। এজন্য তাঁর জীবন ও অবদানের পুনর্পাঠ জরুরী।
শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর উপনাম আবূ মুহাম্মদ। ইবন রজব হাম্বলী হাসান ইবন আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার দিকে তাঁর বংশধারা সাব্যস্ত করেছেন। অন্যদিকে সিদ্দীক হাসান খান ভূপালী, মুহাম্মদ ইবন শাকির প্রমুখ তাঁর বংশধারা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর দিকে সাব্যস্ত করেছেন। তবে দু’ধরণের মতের সাথে সমন্বয় করে বলা যায়, বাবার দিক থেকে তিনি হাসানী এবং মায়ের দিক থেকে হুসাইনী ছিলেন। শাইখ জিলানী (র.) তাঁর মা ফাতিমা উম্মুল খাইর বিনতু আব্দুল্লাহ আস সাওমাঈকে নিয়ে নিজেই বলেছেন, ‘আমার মায়ের বংশধারা হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে মিলিত হয়েছে।’
শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইরানের গিলান বা জিলান প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণে অবস্থিত নিফ নামক শহরে ২৯ শাবান, ৪৭০ হি./১৭ মার্চ ১০৭৮ খ্রি. জন্মগ্রহণ করেন। অবশ্য কেউ কেউ ৪৭১ ও ৪৯১ হিজরীর কথাও বলেছেন। গিলান প্রদেশের দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁকে জিলানী, গিলানী, কিলানী ইত্যাদি বলা হয়। ইবনুল আসির, ইবন কাসির, যাহাবিসহ কেউ কেউ জিলানী বা কিলানীর বদলে জিলি বলেছেন। মুহই-উদ-দীন, ইমাম, শাইখুল মাশায়িখ, শাইখুল ইসলাম, গাউসুল আযম, তাজুল আরিফীন, কুতবে বাগদাদ, বাযুল্লাহিল আশহাবসহ বহু উপাধিতে তিনি ভূষিত হয়েছেন।
শাইখ জিলানী (র.) এর পিতা আবূ সালিহ মূসা নিজেও আত্মশুদ্ধি ও নফসের বিরুদ্ধে মুজাহাদার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এজন্য তাঁর একটি উপাধি ছিল মুহিব্বুল জিহাদ।
শাইখ জিলানী (র.) ছিলেন মা-বাবার সর্বশেষ সন্তান। কারণ তাঁর জন্মের কিছুদিন পরেই তাঁর বাবা ইন্তিকাল করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, তখন তাঁর মায়ের বয়সও ছিল ষাটের কোঠায়। বেশি বয়সে সন্তান লাভ করা ছিল কুরাইশ গোত্রের নারীদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যাই হোক, পিতা আবূ সালিহ মূসার ইন্তিকালের পর নানা আব্দুল্লাহ সাওমাঈ তাঁর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে ইবনুস সাওমাঈও বলা হতো। আব্দুল্লাহ এতই ইবাদতগুযার ছিলেন যে, সাওমাঈ (ইবাদতখানা) নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যান। আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এভাবেই বিদূষী মা আর যাহিদ নানার সংস্পর্শে একজন দুনিয়াবিরাগী পুতঃপবিত্র মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠেন।
তাঁর আরও একজন ভাই ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ বাগদাদে রওয়ানা হবার সময় তাঁর মা ফাতিমা বিনতু আব্দুল্লাহ তাঁদের দুজনের মধ্যে সমুদয় সম্পদ ভাগ করে দিয়েছিলেন। শাযারাতুয যাহাবের বর্ণনামতে, এই ভাইয়ের নাম ছিল আব্দুল্লাহ। তিনি বাগদাদেই অল্প বয়সে ইন্তিকাল করেন।
শাইখ জিলানী (র.) এর অসংখ্য কারামত ছোটবেলা থেকেই জাহির হওয়া শুরু হয়েছিল। রামাদান মাসে দিনের বেলায় তিনি দুধ খেতেন না। তাঁর এ কারামত এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, জিলানে কখনও মেঘের জন্য রামাদানের চাঁদ দেখা না গেলে লোকেরা খোঁজ নিত, আবূ সালিহের পুত্র আব্দুল কাদির দুধ খেয়েছেন কি না? এর উপর ভিত্তি করে তাঁরা যে সিদ্ধান্ত নিতেন, পরবর্তীতে সেটাই সত্য বলে প্রমাণিত হতো।
একটু বড় হবার পর শষ্যক্ষেত্রে একটি ষাঁড় বড়পীর (র.) কে বলেছিল, ‘কৃষক হবার জন্য তোমাকে সৃষ্টি করা হয়নি।’ এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, তাঁদের একটি কৃষিজমি ছিল। তিনি সেখানে কাজ করতেন এবং তাঁদের কিছু গরু-মহিষও ছিল। ইবরাহীম ইবন আদহামের সাথে ঘোড়ার জীনের কথার মতো এই ষাঁড়ের কথাও তাঁর জন্য বিশেষ ইঙ্গিতবাহী ছিল।
এ ঘটনায় জিলানী (র.) এর জ্ঞানার্জনের স্পৃহা বেড়ে যায়। তখন বাগদাদ ছিল জ্ঞানের শহর হিসেবে বিবেচিত। তিনি বাগদাদ যেতে মনস্থ করলেন।
ইবন হাজার আসকালানী (র.) আবূ মুহাম্মদ আল জুব্বাইয়ের বরাতে উল্লেখ করেছেন, শাইখ জিলানী (র.) বলেছেন, ‘আমার মা আমাকে ইলম অর্জনের জন্য বাগদাদ যেতে বলেছিলেন। তাই ষোলো অথবা আঠারো বছর বয়সে আমি ইলমের সন্ধানে এক শহর থেকে আরেক শহরে চলে গেলাম।’
শাইখ জিলানী (র.) পরিবার পরিজন ছেড়ে এভাবেই একটি কাফেলার সাথে ভাইয়ের সাথে বাগদাদ রওয়ানা হলেন। তাঁর মা আবূ সালিহ মুসা জংগী দোস্তের রেখে যাওয়া আশিটি দিনার দুভাইয়ের মাঝে ভাগ করে দিলেন। পথিমধ্যে ডাকাত দলের হিদায়াত হবার কথা সবাই জানেন। সমস্ত প্রতিকূলতা পেরিয়ে শাইখ জিলানী (র.) এর যখন বাগদাদে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁর বয়স ১৮, সময়টা ৪৮৮ হিজরী। চলছে খলীফা মুসতাযহিরের শাসন (৪৮৭-৫১২ হি:)। একই বছর ইমাম আবূ হামিদ আল গাযালী বাগদাদের নিযামিয়া মাদরাসার শিক্ষকতা ছেড়ে নির্জনবাসের জন্য সিরিয়া ও হিজায সফরে চলে গেলেন। একজন গাযালীর তিরোধানের পর যেন আরেকজন গাযালীর আবির্ভাব হলো বাগদাদে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা আর সংস্কৃতির কিংবদন্তীতুল্য নগরী বাগদাদে শাইখ জিলানী (র.) ৪৮৮ হিজরী থেকে ৫৬১ হিজরীতে ইন্তিকাল পর্যন্ত ৭৩ বছর অবস্থান করেছিলেন। মোটা দাগে তাঁর বাগদাদের জীবনকে দু’ভাবে ভাগ করা যায়:
ক. বাগদাদে প্রবেশ থেকে মাদরাসায় শিক্ষাগ্রহণ কাল (৪৮৮-৫২১ হি:)
খ. শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণ থেকে ইন্তিকাল ( ৫২১- ৫৬১ হি:)
ক. বাগদাদে প্রবেশ থেকে মাদরাসায় শিক্ষাগ্রহণ কাল (৪৮৮-৫২১ হি:)
শাইখ জিলানী (র.) এর আগমনের আগের কয়েকশ বছর ধরেই বাগদাদে চলছে জ্ঞানীগুণীদের আনাগোনা, চারিদিকে তাঁদের অসংখ্য কালোত্তীর্ণ বইয়ের ছড়াছড়ি। যেমন ইমাম গাযালী (৫০৫ হি.) ও তাঁর ইহইয়া, ইমাম রাগিব ইস্পাহানী (মৃ. ৫০২ হি.) ও তাঁর মুফরাদাত, ইমাম কুশাইরী (মৃ. ৪৬৫ হি.) ও তাঁর রিসালা, আল্লামা যামাখশারী (মৃ. ৫৩৭ হি.) ও তাঁর কাশশাফ, আল্লামা মাওয়ার্দী (মৃ. ৪৫০ হি.) ও তাঁর আহকামুস সুলতানিয়্যা, ইমাম আবুল হাসান আল আশআরী (মৃ. ৩২৪ হি.) ও তাঁর মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন, আশ শাইখুর রঈস ইবন সীনা (৪২৮ হি.) ও তাঁর কিতাবুশ শিফা, আল্লামা হারিরী (মৃ. ৫১৭ হি.) ও তাঁর মাকামাত ইত্যাদি। কিন্তু এতসব শাস্ত্রের ভীড়ে তিনি সবার আগে ফিকহ ও হাদীস শাস্ত্রকে বেছে নিলেন। এদিকে পিতৃহীন এই শাইখকে বিরাট অর্থকষ্ট আর অভাবের সম্মুখীন হতে হলো।
বাগদাদের মতো নগরীতে চল্লিশ দীনার খুব বেশি কিছু নয়। তার উপর শাইখ জিলানী (র.) ছিলেন অত্যন্ত দানশীল। মায়ের সেলাই করে দেওয়া সেই দিনারগুলো অচিরেই শেষ হয়ে গেল। কখনও কখনও তাঁর মা লোকজনের মাধ্যমে কিছু টাকাকড়ি পাঠাতেন। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না।
তীব্র অর্থকষ্ট ও অভাবের মধ্যেও তিনি অসংখ্য শাইখের কাছে বিভিন্ন শাস্ত্র নিয়ে জ্ঞানার্জন করেছেন। সবার নাম ইতিহাস সংরক্ষণ করতে না পারলেও বিখ্যাত কয়েকজনের নাম জানা যায়। যেমন তিনি হাদীস শুনেছেন আবূ গালিব মুহাম্মদ ইবন হাসান আল বাকিল্লানী, আবূ বকর আহমদ ইবনুল মুযাফফর, আবুল কাসিম আলী ইবন বাফান আর রাযযায, আবূ মুহাম্মদ জাফর ইবন আহমদ আস সররাজ, আবূ সাদ মুহাম্মদ ইবন খুশাইশ, আবূ তালিব ইবন ইউসুফ প্রমুখের কাছ থেকে। ফিকহ শিক্ষা করেছেন বাগদাদে হাম্বলীদের শাইখ আবুল ওয়াফা আলি ইবন আকীল, আবুল খাত্তাব মাহফুজ ইবন আহমদ হাম্বলী, কাজী আবূ সাদ মুবারক ইবন আলী আল মুখাররিমি, আবুল হাসান মুহাম্মদ ইবনুল কাজী আবূ ইয়ালা আল ফাররা হাম্বলী প্রমুখের কাছ থেকে। শুধু ফিকহে হাম্বলী নয়, ফিকহে শাফেঈর উপরও তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। এছাড়া আবূ যাকারিয়া ইয়াহইয়া আত তিবরিযীর কাছে সাহিত্য, অলঙ্কারশাস্ত্র এবং আবুল ওয়াফা আলী ইবন আকীল ও আবুল খাত্তাব মাহফুযের কাছে কুরআন পঠনরীতি ও তাফসীর সম্পর্কে তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।
ইসলামী শরীআতে গভীর জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতার চর্চাও তিনি সমান গতিতে চালিয়ে গেছেন। আসলে বাগদাদে আগমনের পর থেকে তাঁর পুরো জীবনই ইলমে তাসাওউফ আর ইলমে শরীআত চর্চায় কেটেছে। পরবর্তী জীবনে একদিকে যেমন ফাতওয়া দিয়েছেন, তেমনি আরেক দিকে অসংখ্য সালিকের শাইখের দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় বাগদাদের সংগ্রাম আর দুঃখভরা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেছেন, ‘আমি জ্ঞানচর্চায় মগ্ন হয়ে থাকতাম। এছাড়া আমার অভ্যাস ছিল নেককারদের সাথে দেখা-সাক্ষাত করা। আমি নফসকে মুজাহাদার মাধ্যমে পাকড়াও করেছিলাম। এক পর্যায়ে এক আধ্যাত্মিক অবস্থা আসলো। এমনকি এই অবস্থা মরুভূমিতে দিনরাত হতে লাগলো। এজন্য আমি ঘুরে বেড়াতাম। এক রাতে আমার ভেতর এমন এক আধ্যাত্মিক অবস্থা তৈরী হলো যে, আমি সজোরে চিৎকার করে উঠলাম। কাছাকাছি ঘুরতে থাকা কয়েকজন লোক এতে ভয় পেয়ে গেলো। তারা এসে দেখলো আমি মাটিতে পড়ে আছি। আমাকে চিনে ফেলে বললো, এ তো আব্দুল কাদির। এ পাগল। তুমি যে আমাদের ভয় দেখালে- আল্লাহ যেন কখনও তোমার কল্যাণ না করেন।
এই লোকগুলো ছিনতাই করার জন্য রাতের বাগদাদে ঘুরে বেড়াতো।
তাসাওউফে তাঁর প্রধান শাইখ ছিলেন শাইখ হাম্মাদ ইবন মুসলিম আদ দাব্বাস রাহিমাহুল্লাহ। তিনি ৫২৩ হি./ ১১৩১ খ্রি. ইন্তিকাল করেন। এর আগ পর্যন্ত শাইখ জিলানী (র.) তাঁর সঙ্গলাভ করেছিলেন। শাইখ দাব্বাসের সাথে তাঁর পরিচয়ের ঘটনা অনেকটা নাটকীয়। এ বিষয়ে ইবন হাজার আসকালানী (র.) উল্লেখ করেছেন, শাইখ জিলানী (র.) বলেন,
‘আমার একবার মনে হলো, এত বেশি ফিতনার জন্য বাগদাদ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তাই আমি কাঁধের [ব্যাগে] কুরআন ঝুলিয়ে নিলাম এবং হালাবার তোরণের দিকে এগুলাম। উদ্দেশ্য- বাগদাদ ছেড়ে মরুভূমিতে চলে যাওয়া। হঠাৎ অদৃশ্য কেউ আমাকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছো?’ এরপর সে এত জোরে আমাকে ধাক্কা মারলো যে আমি চিৎ হয়ে পড়ে গেলাম। এরপর কণ্ঠটি বললো, ‘ফিরে যাও। তোমার মাধ্যমে মানুষের উপকার হবে।’ আমি বললাম, ‘লোকের জন্য আমি কী করতে পারি? আমি নিজেই তো আমার দ্বীনের নিরাপত্তা চাই।’
সেই কণ্ঠটি আবার বললো, ‘তুমি আগের জায়গায় ফিরে যাও। তোমার দ্বীনের নিরাপত্তা সেখানেই আছে।’
শাইখ জিলানী (র.) বলেন, ‘এরপর আমার কিছু আধ্যাত্মিক অবস্থা নিয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বললাম, ‘আল্লাহর কাছে আমার আশা- এই অবস্থাগুলো ব্যাখ্যা করার মতো কাউকে যদি তিনি পাঠাতেন!’
পরদিনের কথা। আমি জাফরিয়্যা মহল্লা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক লোক তাঁর ঘরের দরজা খুলে ডাক দিলেন, ‘ওহে আব্দুল কাদির!’ আমি তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, ‘গতকাল কী চেয়েছিলে?’ আমি চুপ করে থাকলাম। কি বলবো- বুঝতে পারছিলাম না। তিনি ভয়ানক রেগে গিয়ে আমার মুখের উপরেই এত জোরে দরজা লাগিয়ে দিলেন যে, চৌকাঠের ধুলো আমার মুখে এসে পড়লো। সেখান থেকে কিছুদূর আসার পর আল্লাহর কাছে আমার সেই প্রার্থনার কথা মনে পড়লো। মনে হলো তিনি নিশ্চই কোন বুযুর্গ হবেন। এরপর আবার ফিরে এসে তাঁর বাসা খুঁজলাম। কিন্তু আর চিনতে পারলাম না। আমি হতাশ হয়ে পড়লাম।
ঐ লোকটি ছিলেন শাইখ হাম্মাদ আদ দাব্বাস। পরে আমি তাঁর সাথে পরিচিত হয়েছিলাম, সাহচর্য লাভ করেছিলাম। যা কিছু আমার কাছে দুর্বোধ্য ছিল, তার সবই তিনি পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন।
আমি যখন জ্ঞানার্জনের জন্য কিছু সময় অনুপস্থিত থাকার পর আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতাম, তিনি বলতেন: আমার কাছে কেন এসেছো? তুমি তো ফকীহ। ফকীহদের কাছেই যাও।’ আমি চুপ করে থাকতাম। এক জুমুআর দিন তিনি একদল সঙ্গী নিয়ে রুসাফা মসজিদে নামায পড়ার জন্য বাগদাদ ছেড়ে বেরুলেন। আমিও তাঁর সঙ্গী হলাম। তখন আবহাওয়া ছিল প্রচ- ঠা-া। কিন্তু আমরা একটি নদীর সেতুতে পৌঁছতেই আচমকা ধাক্কা মেরে আমাকে পানিতে ফেলে দিলেন। আমিও বললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ। জুমুআর গোসল হয়ে গেল।’ তখন আমার গায়ে একটি পশমী জোব্বা ছিল। জোব্বার আস্তিনে কয়েকটি বই ছিল। সেগুলো যাতে না ভেজে, সেজন্য আমি আস্তিন উপরে উঠিয়ে রাখলাম। তিনি আমাকে ফেলে রেখেই মুরীদদের নিয়ে চলে গেলেন। এক সময় আমি পানি থেকে উঠে জামা নিংড়ে আবার পরে নিলাম। সেদিনের ঠা-ায় অনেক কষ্ট হয়েছিল, [স্বাস্থ্যেরও] ক্ষতি হয়েছিল।
শাইখ হাম্মাদ আমাকে ভীষণ কষ্ট দিতেন, মারপিট করতেন। জ্ঞানার্জনের জন্য তাঁর কাছে কিছুক্ষণ অনুপস্থিত থাকার পর আবার যখন আসতাম, তিনি বলতেন, ‘আজকে আমরা অনেক রুটি আর ফালুদা পেয়েছিলাম। সবই আমরা খেয়ে ফেলেছি, তোমার জন্য কিছুই রাখিনি।’ তাঁর এমন রূঢ় আচরণ দেখে তাঁর অন্যান্য সঙ্গীরা আমাকে টিপ্পনী কাটতো। বলতো, ‘তুমি তো ফকীহ। এখানে তোমার কাজ কী? এখানে কেন আসো?’
শাইখ যখন দেখতেন, তারা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে, তখন আবার আমার জন্য আত্মমর্যাদাবোধ করতেন। তাদেরকে বলতেন, ‘ওহে কুকুরের দল! কেন ওকে কষ্ট দিচ্ছো? আল্লাহর কসম! তোমারা কেউ ওর মতো নও। আমি তো শুধু তাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছি। এরপর তাকে অটল পাহাড়ের মতো পেয়েছি।’
শাইখ দাব্বাস (র.) জিলানী (র.) এর সাথে অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করলেও এটা তাঁর উচ্চতর আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণেরই একটি অংশ ছিল। তাঁর সাথে তিনি যে আচরণ করছিলেন, অন্য মুরীদদের সাথে তেমন করেননি। উপরন্তু তাদেরকে কুকুর বলে সম্বোধন করেছেন। এর কারণ কেবল এটাই হতে পারে যে, তিনি চেয়েছিলেন, শাইখ জিলানী (র.) কে সবধরণের মানবীয় কলুষতা থেকে মুক্ত করা। পরবর্তীতে তিনি যেন গাউসুল আযম ও কুতবুল আকতাব হতে পারেন, সেই পথ প্রশস্ত করা।
ফুতুহুল গাইব’র ব্যাখ্যাগ্রন্থে ইবন তাইমিয়া এভাবে শাইখ দাব্বাসের প্রশংসা করেছেন, ‘শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী ও তাঁর শাইখ হাম্মাদ আদ দাব্বাসসহ হিদায়াতের উপর অবিচল অন্যান্য শাইখগণের নির্দেশনা অনুযায়ী সালিক কখনও কোনো [ব্যক্তিগত] উদ্দিষ্টের ইচ্ছা করবে না। আল্লাহর ইচ্ছার সাথে তাঁর ইচ্ছা ছাড়া নিজের কোনো ইচ্ছা থাকবে না, বরং আল্লাহর কর্মধারা তার মধ্যে প্রবাহিত হবে। এভাবে সে আল্লাহর মুরাদে (ঈপ্সিত) পরিণত হবে…।’
এছাড়া আবূ সাদ বা আবূ সাঈদ মুবারক ইবন আলী ইবন হুসাইন আল মুখাররিমীর (মৃ. ৫২৮ হি.) কাছ থেকে শাইখ জিলানী (র.) এর ফিকহ শিক্ষার পাশাপাশি তাসাওউফের খিরকাও লাভ করেছেন। আমাদের দেশে বড়পীর জিলানী (র.) এর শাইখের নামের শেষে মুখাররিমীর বদলে ‘মাখযুমী’ বলা হয়। এটি একটি উচ্চারণগত ভুল।
সমসাময়িক আলী ইবনুল হাইতি, আবু সাঈদ আল কাইলুবি প্রমুখের মতো বিখ্যাত সুফি শাইখগণ তাঁর খানকার দরজায় এসে বসে থাকতেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতেন না। বাগদাদে কোন শাযখ আসলে, তিনি যত বড় মাপের বুযুর্গই হোন না কেন, শাইখ জিলানী (র.) এর সাহচর্য, তাঁর মজলিসে একটুখানি হাযিরা না দিয়ে যেতেন না। হজ্জের সফর সহ বিভিন্ন সময় বাকা ইবন বাত্তু, আদি ইবন মুসাফির, মুসা আয যাওলী, শাইখ আহমদ আর রেফাঈ, কুযায়ব আলবান, হায়াত ইবন কাইস, শাইখ আবূ মাদয়ান, শাইখ উসমান ইবন মারযুক, রাসলান আদ দিমাশকী প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত সুফী শাইখগণ তাঁর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন।
জীবনীকারগণ তাঁর একাধিক আধ্যাত্মিক সিলসিলার কথা বলেছেন। আমরা ইবনুল মুলাক্কিনের বর্ণনানুসারে একটি সিলসিলা উল্লেখ করছি:
মহানবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আলী ইবন আবী তালিব কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু
হাসান আল বাসরী (র.)
হাবীব আল আযমী (র.)
দাউদ আত তাঈ (র.)
মারুফ আল কারখী (র.)
সারি আস সাকাতী (র.)
জুনাইদ আল বাগদাদী (র.)
শিবলী (র.)
ইযযুদ্দীন (র.)
আব্দুল ওয়াহিদ ইবন আব্দুল আযীয আত তামিমী (র.)
আবুল ফারাজ আব্দুর রহমান ইবন আব্দুল্লাহ আত তারসুসী (র.)
আবুল হাসান আলী ইবন মুহাম্মদ আল কুরাশী (র.)
আবূ সাঈদ মুবারক ইবন আলী আল মুখাররিমী (র.)
শাইখ আবূ মুহাম্মদ আব্দুল কাদির জিলানী (র.)
খ. শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণ থেকে ইন্তিকাল ( ৫২১- ৫৬১ হি:)
শিক্ষাগ্রহণ ও আধ্যাত্মিকতা চর্চায় পরম উৎকর্ষের পর শাইখ জিলানী (র.) যখন শিক্ষাদান ও ওয়াযের জন্য জনসম্মুখে আসলেন, ততদিনে তাঁর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। কিন্তু অতি অল্প সময়ের ভেতরেই তাঁর খ্যাতি পুরো মুসলিম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। বিদেশ এমনকি ভিন্ন মহাদেশ থেকেও তাঁর কাছে হিদায়াতপ্রত্যাশী মানুষেরা আসা শুরু করলো। উসতায আবূ সাদ মুখাররামীর ইন্তিকালের পর জিলানী (র.) তাঁর মাদরাসার দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। কিন্তু লোকজনের ভীড়ে মাত্র সাত বছর পরেই ৫২৮ হিজরীতে সেই মাদরাসা আরও বৃহৎ পরিসরে নির্মাণ করতে হলো। কিন্তু এটাও লোকের ভীড় সামলানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি শহরের একটি ময়দানে প্রতি বুধবার সমবেত মানুষের উদ্দেশ্যে আলোচনা শুরু করলেন। এতেও যখন স্থান সংকুলান হলো না, তিনি শহরের বাইরে একটি বড় ময়দানে আলোচনা শুরু করলেন। এটা পর্যায়ক্রমে মুসাফিরখানায় পরিণত হলো।
সূফীবাদের নামে কিছু ভ্রান্ত আকীদা অনেকে পোষণ করত। কেউ কেউ মনে করত, সূফী উচ্চস্তরে পৌঁছলে তার আর শরীআতের বিধিনিষেধ পালন করার প্রয়োজন নেই। এজন্য স্থানীয় হাম্বলীগণ সূফীদের মারাত্মক বিরোধী ছিলেন। এরা মূলধারার সূফীদের প্রতিনিধিত্ব করতো না; এদের সংখ্যাও ছিল কম। কিন্তু সূফীদের সমালোচনার পেছনে এদের অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। এমন দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে শাইখ জিলানী (র.) বক্তৃতা, লেখনি ও শিক্ষায় শরীআতের সাথে আধ্যাত্মিকতার এক গভীর মেলবন্ধন তুলে ধরলেন। তিনি সরাসরি বললেন, তুমি হাকীকতের অবস্থায় থাকলে- যা প্রকৃতপক্ষে ওয়ালায়াতের অবস্থা; তোমার প্রবৃত্তির বিরোধিতা করো এবং সমস্ত আদেশ পালন করো…। (ফুতুহুল গাইব)
যুগশ্রেষ্ঠ আলিমদের কাছে তিনি যা কিছু শিখেছিলেন, সবই এবার মানবকল্যাণে উৎসর্গ করলেন। শষ্যক্ষেত্রের সেই ষাঁড়ের কথা এবার সত্য হলো। তিনি শরীআত-তরীকত উভয়দিক থেকে সমানভাবে শিক্ষাদান করতে লাগলেন। শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন- এমন সমস্ত শাস্ত্রই তিনি শেখাতেন। ইমাম আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রানী লিখেছেন,
‘শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী রাহিমাহুল্লাহ পাঠদানে গভীর নিষ্ঠাবান ছিলেন। আলিম হিসেবেও অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের ছিলেন। মোট তেরোটি শাস্ত্র নিয়ে তিনি বক্তৃতা দিতেন। শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে তাফসীর, হাদীস, বিভিন্ন মাযহাব, ইখতিলাফ ইত্যাদি নিয়ে পড়তো। তিনি সকাল-সন্ধ্যায় তাফসীর, বিভিন্ন মাযহাবের জ্ঞান, ইখতিলাফ, ধর্মতত্ত্ব ও আরবী ব্যাকরণ এবং যোহরের পর বিভিন্ন পঠনরীতিতে কুরআন শিক্ষাদান করতেন। ইমাম আহমদ ও ইমাম শাফিঈ রাহিমাহুমাল্লাহ- উভয়ের মাযহাব অনুসারে তিনি ফাতওয়া দিতেন। তাঁর ফাতওয়াগুলো ইরাকের আলিমদের কাছে পাঠানো হতো। তাঁরা বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হয়ে যেতেন।’
তাঁর অসাধারণ বক্তৃতামালা ফুতুহুল গাইব ও আল ফাতহুর রাব্বানীতে সংকলিত হয়েছে। মুসলিম মনীষীর জীবনীগ্রন্থগুলোতে তাঁর অসংখ্য বাণী পাওয়া যায়।
তিনি সপ্তাহে মোট তিনদিন ভাষণ দিতেন। ঈদগাহে শুক্রবার সকালে, নিজের মাদরাসায় মঙ্গলবার রাতে এবং মুসাফিরখানায় বুধবার সকালে। তাঁর আলোচনা-সভা অন্যান্য সুফী শাইখের মতো ছিল না। কারণ তাঁর মজলিসে কেবল মুরীদেরা নয়, দেশ-বিদেশের সাধারণ মানুষও অংশ নিতেন। তাতে ফকীহগণ যেমন থাকতেন, তেমনি নিরক্ষর মানুষও থাকতেন। এমনকি অমুসলিমরাও অংশ নিত। শাইখ জিলানী (র.) এর হাতে অসংখ্য মানুষের তাওবার কথা ইমাম যাহাবী আল্লামা ইবনুল জাওযীর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
শাইখ জিলানীর ওয়াযের মজলিসের প্রতি মানুষের এত আকর্ষণ ছিল যে, গভীর রাতে মোমবাতি নিয়েও অনেক মানুষ চলে আসতো। এমনকি জিনেরাও তাঁর মজলিসে অংশগ্রহণ করতো। মানুষের মতো বহু জিন তাঁর হাতে মুসলমান হয়েছিল, তাওবা করেছিল।
তাঁর আলোচনার তীব্র প্রভাবে কখনও কখনও শ্রোতাদের অনেকে ইন্তিকালও করতো। একবার আলোচনার মাঝখানে অজান্তেই তাঁর পাগড়ির এক কোণা খুলে গেল। এটা দেখে তাঁর অনুসরণে শ্রোতারাও নিজেদের অজান্তে পাগড়ি খুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল।’
শাইখ জুব্বায়ী বলেন, শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.) বলেছেন, ‘ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থায় আমাকে আদেশ দেওয়া হতো, নিষেধ করা হতো। মনের ভেতর অনেক কথা ভীড় করতো, প্রবল হয়ে উঠত। এমনকি শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হতো। আমি চুপ থাকতে পারতাম না। প্রথম দিকে আমার কাছে দুজন বা তিনজন মানুষ বসতো। ধীরে ধীরে লোকেরা আমার কথা জানতে পারলো। তখন লোকদের ভীড় বেড়ে গেল। এমনকি একেক মজলিসে প্রায় সত্তর হাজার মানুষ উপস্থিত হতে লাগল।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘আমার ইচ্ছা হতো, আমি আবারও মরুচারী হই; তখন আমিও কাউকে দেখতাম না, তারাও আমাকে দেখতো না। অবশ্য আল্লাহ চেয়েছিলেন, আমার মাধ্যমে মানুষের উপকার হোক। আমার হাতে পাঁচশোরও বেশি মানুষ মুসলমান হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ তাওবা করেছে। এটা একটা বিরাট কল্যাণ ছিল।’
মুহাম্মদ আইনী তাঁর ‘আবদুল কাদির আল কিলানী’ নামক বইয়ে লিখেছেন, ‘বাগদাদে তাঁর মাদরাসা ও খানকা থেকে প্রতিবছর তিন হাজারের মতো ছাত্র ও মুরিদ ফারেগ হতেন। এ হিসেবে তেত্রিশ বছরের শিক্ষকতায় তাঁর কাছ থেকে আনুমানিক এক লক্ষ মুরিদ ও ছাত্র বেরিয়েছেন।’ এরা শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেই পৃথিবীর নানান প্রান্তে দাওয়াতী কাজে ছড়িয়ে পড়তেন। এজন্য তাঁদের সবার নাম সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁদের মধে কয়েকজন বিখ্যাত ছাত্রের নাম বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আমরা কয়েকজনের নাম উল্লেখ করছি:
১. মুওয়াফফিকুদ্দীন ইবন কুদামা। তিনি বিখ্যাত ‘আল মুগনী’ কিতাবের লেখক। তাঁকে তাঁর বাবা শাইখ জিলানী (র.) এর কাছে পড়তে পাঠান। তাঁর সাথে তাঁর খালাতো ভাই হাফিয আব্দুল গণী ইবন আব্দুল ওয়াহিদ আল মাকদিসীও ছিলেন। ইবন কুদামা বলেছেন, ‘শাইখুল ইসলাম আব্দুল কাদিরের কাছ থেকে আমি ও হাফিয আব্দুল গণী একই সময় খিরকা গ্রহণ করেছি। তাঁর কাছে আমরা ফিকহ শিখেছি, হাদীস শুনেছি এবং তাঁর সুহবতে উপকৃত হয়েছি।’
২. আবুল ফাতাহ নাসর ইবনুল মুনা। ইনি শাইখ জিলানী (র.) এর ইন্তিকালের পর হাম্বলীদের ইমাম হয়েছিলেন।
৩. হামিদ ইবন মাহমুদ আল হাররানী। ইনি পরবর্তীতে নুরুদ্দীন জংগী (র.) এর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। নুরুদ্দীন তাঁকে হাররানের গভর্নর বানিয়েছিলেন।
৪. যাইনুদ্দীন ইবন ইবরাহীম ইবন নাজা আল আনসারী আদ দিমাশকী। তিনি শাইখ জিলানী (র.) এর কাছে বাগদাদে শিক্ষাগ্রহণ করার পর দামেস্ক ও মিশর ভ্রমণ করেন। এক সময় তিনি সালাহুদ্দীন আইয়ুবী (র.) এর খাস পরামর্শদাতায় পরিণত হন।
৫. ইমাম আবূ আমর উসমান। তিনি স্বীয় যুগের শাফিঈ নামে পরিচিত ছিলেন।
৬. মুহাদ্দিসে খুরাসান নামে প্রসিদ্ধ ‘কিতাবুল আনসাব’র লেখক ইমাম হাফিয আব্দুল করিম ইবন মুহাম্মদ আস সামআনী।
দেখা যাচ্ছে, নুরুদ্দীন জংগী ও সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর কয়েকজন বিশিষ্ট উপদেষ্টা ও সহচর সরাসরি শাইখ জিলানী (র.) এর শিষ্য ছিলেন। এছাড়া তাঁর অসংখ্য ছাত্রদের অনেকেই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজস্ব মাদরাসা গড়ে তোলেন। তাঁরা পার্থিব লালসা থেকে বিরত থেকে আত্মিক ও পরলৌকিক উন্নতির দিকে জোর দিতেন। এসব মাদরাসার ফারিগগণ পরবর্তীতে সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর উত্থান, সেনাবাহিনী গঠন ও বাইতুল আকসা মুক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ প্রসঙ্গে মাজিদ কিলানী ‘হাকাযা যাহারা জিলু সালাহুদ্দীন ওয়া হাকাযা আদাত আল কুদস’ বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
বড়পীর (র.) এর ভয়াবহ অর্থকষ্ট ও জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে মানুষ হয়েছিলেন। আমরা এখন এর তাৎপর্য কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি। এর মধ্যদিয়ে তিনি জীবনের উদ্দেশ্য ও মর্মার্থ উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘পৃথিবী বিভিন্ন রূপ ধরে এসে আমাকে প্রতারিত করতে চেয়েছে। প্রতিবার আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। শয়তানও বিভিন্ন সুরতে আমাকে ধোঁকা দিতে চেয়েছে। প্রতিবার আল্লাহর সাহায্যে আমি রক্ষা পেয়েছি।’ আসলে সোনাকে যেমন বারবার আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করা হয়, আল্লাহ যেন তাঁকে সেভাবেই নিষ্কলুষ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। নফসে আম্মারা বিনাশে এসব বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। পার্থিব ধন-সম্পদ একসময় তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনি আগের জীবনধারাই বজায় রেখেছিলেন।
তাঁর দেহ সৌষ্ঠবের বর্ণনা দিতে গিয়ে শাইখ মুহাম্মদ আইনী বলেছেন, ‘তিনি কিছুটা লম্বাটে ছিলেন। আভিজাত্য আর দৃঢ়তার ছাপ টিকরে বেরুতো। গায়ের রঙ ছিল হালকা তামাটে। প্রশস্ত মুখম-ল, চওড়া কাঁধ আর সুবিন্যস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল শ্রুতিমধুর ও সুউচ্চ- আলাপচারিতার ধরণও ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। তাঁর দৃষ্টি এমন তীক্ষè আর উজ্জ্বল ছিল যে, তাঁর সঙ্গীরাও তাঁর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারতেন না। তাঁর দাড়ি ছিল লম্বা এবং মাঝারি ধরণের ঘন।’
ইবনুন নাজ্জার বলেছেন, আবূ মুহাম্মদ আল আখফাশকে আমি বলতে শুনেছি, আমি প্রায়ই তীব্র ঠা-া আর শীতের ভেতর শাইখ জিলানী (র.) এর কাছে এসে দেখতাম, তিনি কেবল একটি টুপি আর জামা পরা। এরপরও দরদর করে ঘামছেন। প্রচ- গরমে যেমন করা হয়, সেভাবে লোকজন হাতপাখা নিয়ে তাঁর চারপাশে বাতাস করছে।’
তিনি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্রের পরিপূর্ণ অনুসরণে সচেষ্ট ছিলেন। এজন্য তাকওয়া, আমানতদারিতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, মহানুভবতা ইত্যাদির দুর্লভ সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর ভেতর। ইমাম শারানী তাঁর তাবাকাতে বলেছেন, ‘এত বিরাট মর্যাদার অধিকারী হয়েও তিনি ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সাথে সময় কাটাতেন, ফকীরদের সাথে বসে তাঁদের কাপড়ের উকুন বেছে দিতেন। [অন্যদিকে এত বিনয়ী হবার পরও] তিনি কোনো গণ্যমান্য ও রাষ্ট্রীয় পদস্থ মানুষের সম্মানে দাঁড়াতেন না, কোনো মন্ত্রী বা শাসকের দরজায় ধরনা দিতেন না।’
মুহাম্মদ ইবন খিদর তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমি ত্রিশ বছর শাইখের খিদমত করেছিলাম। এটকু সময়ে আমি কখনও তাঁকে থুথু ফেলতে অথবা নাক ঝাড়তে অথবা তাঁর শরীরে কোন মাছি বসতে দেখিনি। তিনি কখনও কারও সম্মানে দাঁড়াননি, রাজা-বাদশার সঙ্গে বসেননি, তাদের খাবারও খাননি। তিনি খলীফাকে চিঠি লিখলে এভাবে লিখতেন-
“আব্দুল কাদির তোমাকে এটা করতে আদেশ করছে। তাঁর আদেশ তোমাকে অবশ্যই মানতে হবে।”
খলীফা এই চিঠি পড়ে কেঁদে ফেলতেন। বলতেন, ‘তিনি সত্য বলেছেন।’
শাইখ জিলানী (র.) বাগদাদে অবস্থানকালীন সময়ে মোট পাঁচ জন খলীফাকে পেয়েছিলেন। তিনি কারোরই বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করতেন না। এমনকি খলীফারা তাঁকে রাজদরবারে ডাকলেও যেতেন না। আবুল ফিদা বলেছেন, একবার খলীফা আল মুকতাফী লি আমরিল্লাহ (৫৩০-৫৫৫ হি.) তাঁর উযীরকে বললেন বাগদাদের সমস্ত আলিমকে ডেকে পাঠাতে। সবাই আসার পর খলীফা উযিরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই কি এসেছে?’ উযীর বললেন, ‘শাইখ আব্দুল কাদির আর আদি ইবন মুসাফির ছাড়া সবাই এসেছেন।’ তখন ইরাকের মুফতী হিসেবে খ্যাত মুহিউদ্দীন আল বাগদাদী মন্তব্য করলেন, ‘শাইখ আব্দুল কাদির অশ্লীলতা থেকে সবচেয়ে দূরের আর হকের দিকে সবচেয়ে কাছের মানুষ। আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘিত হলে তিনি সবচেয়ে কঠোর হয়ে পড়েন। তিনি নিজের জন্য রাগ করেন না, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্য প্রতিশোধ নেন না।’
আরেকদিন খলীফা উযীর জাফর ইয়াহইয়া ইবন হুবাইরার কাছে অভিযোগ করলেন, শাইখ জিলানী তাকে নিয়ে অবজ্ঞাভরে ঠাট্টা করেন। ঘটনা হলো, জিলানী (র.) এর খানকায় একটি খেজুর গাছ ছিল। তিনি প্রায়ই সেটার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ওহে খেজুর গাছ! বেশি বাড় বেড়ো না। তোমার মাথা কিন্তু কেটে ফেলবো!’ তিনি আসলে খলীফাকে উদ্দেশ্য করে এসব কথা বলেন। তখন উযীর শাইখ আবুল হাসান ইবন আরাবিয়্যাকে শাইখ জিলানী (র.) এর কাছে পাঠালেন। অনুরোধ করলেন, তিনি যেন এভাবে খলীফার সমালোচনা না করেন।
ইবন আরাবিয়্যা বলেন, ‘আমি গিয়ে দেখলাম, শাইখের চারপাশে অনেক মানুষ। ভাবলাম, সবাই চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তখন শাইখ বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ। আমি তার মাথাটা কেটেই ফেলবো!’ বুঝতে পারলাম, কথাটা আসলে আমার উদ্দেশ্যেই বলা। তাই চুপচাপ উঠে চলে আসলাম। উযীর পরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাইখকে বলেছো?’ আমি তখন এ ঘটনার কথা বললাম। উযীর তখন কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘তিনিই যে সঠিক পথে আছেন, তাতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই।’
খলীফাগণ নিজেরাই তাঁর দরবারে আসতেন। তাঁদের উপহার উপঢৌকন তিনি গ্রহণ করতেন না। একবার খলীফা মুসতানজিদ বিল্লাহ (মৃ. ১১৭১ খ্রি.) তাঁর কাছে এসে দশ ব্যাগ স্বর্ণমুদ্রা উপহার দিলেন। সেগুলো এতই ভারী ছিল যে, দশ জন লোককে বয়ে আনতে হলো। শাইখ বরাবরের মতোই গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। খলীফা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। শাইখ জিলানী তখন দুহাতে দুটি ব্যাগ নিয়ে চাপ দিলেন। দীনারগুলো থেকে ঝরঝর করে তাজা রক্ত পড়তে লাগলো। শাইখ তাঁকে বললেন, ‘আল্লাহর কাছে কি এতটুকু লজ্জা করো না? মানুষের রক্ত নিজে খাও, আবার আমার কাছেও হাদিয়ার জন্য নিয়ে আসো!’ খলীফা এ ঘটনা দেখে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন।
খলীফা মুসতানজিদ আরেকদিন এসে বললেন, আমাকে একটি কারামত দেখান। শাইখ জিলানী (র.) বললেন, ‘এই মুহূর্তে তুমি কী চাও?’ খলীফা আপেলের কথা বললেন। তখন শাইখ বাতাসে হাত বাড়িয়ে দুটি আপেল আনলেন। একটি আপেল দিলেন খলীফাকে। শাইখের হাতের আপেল থেকে মিশকের ঘ্রাণ বের হলেও খলীফার আপেলের ভেতরে পাওয়া গেল একটি পোকা। তিনি বললেন, ‘এটা কেন?’ শাইখ তখনই জবাব দিলেন, ‘আপেলটি পোকা-ধরা; কারণ একজন অত্যাচারীর হাত সেটাকে স্পর্শ করেছে।’
সিয়ারু আলামিন নুবালায় ইমাম যাহাবী তাঁর বেশ কিছু কারামত সনদসহ উল্লেখ করেছেন। সাধারণত ওলীগণের কারামতের ক্ষেত্রে সনদ পাওয়া যায় না। এদিক থেকে শাইখ জিলানী (র.) এর কারামতগুলো ব্যতিক্রম।
ইমাম যাহাবী লিখেছেন, হাফিয সাইফুদ্দীন ইবনুল মাজদের হস্তাক্ষরে লেখা দেখেছি, আমি মুহাম্মদ ইবন মাহমুদ আল মারাতিবীকে বলতে শুনেছি, শাইখ আবূ বকর আল ইমাদ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘একবার আমি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। হঠাৎ আমার মনের মধ্যে খটকা তৈরী হলো। ভাবলাম শাইখ আবদুল কাদিরের মজলিসে যাই। শুনেছিলাম তিনি মনের ওয়াসওয়াসা নিয়ে আলোচনা করেন। আমি তাঁর দরবারে গেলাম। তিনি আলোচনা করছিলেন। তিনি তখন বলে উঠলেন, ‘আমাদের আকীদা হলো সালফে সালিহীন ও সাহাবীগণের আকীদা।’ ভাবলাম, তিনি বোধহয় কথাটা কাকতালীয়ভাবে বলেছেন। তিনি এবার সরাসরি আমি যেদিকে বসেছি, সেদিকে তাকিয়ে একই কথা বললেন। মনে মনে বললাম, একজন আলোচক তো [চারিদিকে] তাকাবেনই। এবার তিনি সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে নাম ধরে বললেন, ‘ওহে আবূ বকর! আমাদের আকীদা হল সালফে সালিহীন ও সাহাবীগণের আকীদা।’ এরপর বললেন, ‘তোমার বাবা চলে এসেছেন।’ আমার বাবা তখন শহরে ছিলেন না। আমি দ্রুত বাসায় আসলাম। এসে দেখি তিনি আসলেই এসেছেন।’
ইমাম যাহাবী বলেন, আমাকে বলেছেন, ফকীহ আবুল কাসিম ইবন মুহাম্মদ, তিনি শাইখ জামালুদ্দীন ইয়াহইয়া আস সাইরাফী থেকে বর্ণনা করেন, আবুল বাকা আন নাহওয়ী বলেন, ‘আমি একদিন শাইখ আবদুল কাদিরের মজলিসে আসলাম। উপস্থিত লোকেরা তাঁর সামনে অশুদ্ধ তিলাওয়াত করছিলো। মনে মনে বললাম, ‘শাইখ এটা নিয়ে আপত্তি না করে থাকছেন কীভাবে?’
তখন তিনি বলে উঠলেন, ‘ফিকহ নিয়ে পড়াশোনা করা একজন লোক এসেছে। সে অপছন্দ করছে।’ মনে মনে বললাম, ‘তিনি সম্ভবত অন্য কারও কথা বলছেন।’ তিনি আবার বললেন, ‘আমি তোমার কথাই বলছি।’ আমি মনে মনে এমন নেতিবাচক ভাবনার জন্য তওবা করলাম। তিনি এবার বললেন, ‘আল্লাহ তোমার তাওবা কবূল করেছেন।’
ইমাম যাহাবী বলেন, আমাকে বলেছেন ইমাম আবুল আব্বাস আহমদ ইবন আব্দুল হালিম ইবন তাইমিয়া, তিনি শাইখ ইযযুদ্দীন আল ফারুসী থেকে বর্ণনা করেন, শাইখ শিহাবুদ্দীন উমর সুহরাওয়ার্দী বলেন, ‘আমি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবো বলে ভাবছিলাম। মনে মনে ভাবলাম, শাইখ আবদুল কাদিরের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করবো। তাঁর কাছে আসার পর কিছু বলার আগেই তিনি বলে উঠলেন, ‘উমর! সেটা তো কবরের পাথেয় নয়। উমর! সেটা তো কবরের পাথেয় নয়।’
তাঁর কারামত এত বেশি প্রকাশিত হতো যে, শাহযাদা দারা শুকোহ’র মতে, ‘কারামতগুলো এক করলে বিশাল একটি গ্রন্থেও সবগুলোর জায়গা হবে না।’ এরপরও আল্লাহর প্রতি তাঁর বিন¤্রতা ও আনুগত্য এতটুকু হ্রাস পায়নি, বরং প্রতিটি মুহুর্তে তা বেড়েই চলেছিল। এটাকেই যদি তাঁর সর্বশ্রেষ্ট কারামত ধরা হয়, তবে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না। শাইখ সাদী তাঁর গুলিস্তাঁয় লিখেছেন, ‘একবার শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.)কে দেখা গেল কাবা চত্বরে সিজদায় পড়ে বলছেন, হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি যদি শাস্তি অবধারিত করেই ফেলেন, তাহলে কিয়ামতের দিন আমাকে অন্ধ বানিয়ে উঠাবেন- নেককারদের চেহারা দেখে আমাকে যাতে লজ্জায় মিশে যেতে না হয়।
তাকওয়া, ধৈর্য, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি ছাড়াও অসাধারণ মানবতাবোধ ছিল তাঁর আজন্ম লালিত গুণ। মহানুভবতা ও অপরকে প্রাধান্য দেওয়া ছিল তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি বলতেন, ‘আমি সবধরণের নেককাজ যাচাই করেছি। কিন্তু অপরকে খাওয়ানোর মতো উত্তম আর কিছুই পাইনি। আমি আশা করি, পুরো দুনিয়াটা যদি আমার হাতে থাকতো আর আমি সবাইকে আপ্যায়ন করতাম!’
তিনি আরও বলেছেন, যদি আমার কাছে কোনোদিন এক হাজার স্বর্ণমুদ্রাও আসে, আমি সেটা রাত পর্যন্ত জমিয়ে রাখবো না।’
শরীআত ও তরীকতের এই মহান সাধক ১১ রবিউস সানী ৫৬১ হি:/২১ ফেব্রুয়ারি ১১৬৬ খ্রি. মঙ্গলবার সকালে হঠাৎ করেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
অবশেষে বিকেলে একানব্বই বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন। উপমহাদেশে এই দিন গিয়ারভী শরীফ নামে পরিচিত। এদিনে তাঁর রূহের প্রতি ইসালে সাওয়াবের মাহফিলকে ফাতিহা ই ইয়াজদাহম বলা হয়। অবশ্য আল্লামা ইবনুল জাওযী আল মুনতাযাম গ্রন্থে বলেন, ‘শাইখ আব্দুল কাদির আল কিলানী (র.) ৮ রবিউস সানী, ৫৬১ হি. শনিবারের রাতে ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর নব্বই বছর বয়স।’ তাঁর ছেলে শাইখ আব্দুল ওয়াহহাব তাঁর জানাযার নামায পড়ান। এরপর তাঁর মাদরাসা প্রাঙ্গণে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।
শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী (র.)কে আল্লাহ যে গভীর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব ও সুবিশাল মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাঁর প্রভাব আজও বিদ্যমান। তাঁর জীবনচরিত পড়ে, তাঁর আলোচনার বর্ণনা ও কিতাবগুলো পড়ে, তাঁর উপদেশ অনুসারে আমল করে, তাঁর তরীকাবন্দি, তাঁর ফায়িয-তাওয়াজ্জুহ লাভ করে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজও হিদায়াত পাচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী (র.) এর ফায়িয ও তাওয়াজ্জুহ দান করুন। আমীন।