আমাদের সামনে পবিত্র মাহে রামাদান। মুসলিম মাত্রই এ মাসের প্রতীক্ষায় থাকেন। রামাদান আমলের মাস। যত বেশি আমল করা যায় ততই উত্তম। তবে আমাদের কৃত আমল যেন বরবাদ না হয়। আমল যা-ই করব, কম হোক বেশি হোক, তা যেন কবূল হয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। এজন্য প্রথমে কিছু সাধারণ মূলনীতি উল্লেখ করে কিছু আমলের বিষয়ে আলোচনা করব।
ক. প্রথমেই ইখলাস: আমরা যা কিছুই করব সবই আল্লাহর জন্য। ছোট থেকে ছোট কাজও যেন আল্লাহর জন্য হয়, তাঁর সন্তুষ্টির জন্য হয়। মনে করেন, ইফতার রান্না করবেন বা প্রস্তুত করবেন, নিয়ত যেন থাকে এতে আমাদের রব খুশি হবেন। কাউকে সাহায্য করা, কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলা সবই আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর এসব যদি আল্লাহর বিধান জেনে খুশি মনে পালন করেন তবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করাটাই স্বাভাবিক। আমলের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি জরুরি। অন্য কাউকে খুশি করার জন্য নয়, বাবা-মায়ের আদেশের কারণে নয় বরং এসব আমলে আমার-আপনার রব খুশি হবেন এ নিয়ত রাখবেন। হ্যাঁ, এমন নিয়ত একদিনেই হয়তো আসবে না, কিন্তু যখনই মনে হবে নিজের নিয়তকে ঠিক করে নিন। ইন শা আল্লাহ কিছুদিন পরই আপনার কাজে ইখলাসের দেখা মিলবে। আর ইখলাসের ফলাফল হলো, আপনি ইবাদাত ও আমল করে স্বাদ পাবেন, করতে ভালো লাগবে। এজন্যই তো আমাদের সালাফদের রাতভর আমল আমাদের কাছে রূপকথা মনে হয়। অথচ সাত ঘণ্টার ক্রিকেট খেলা দেখা আমাদের নিকট বাস্তব লাগে।
খ. দ্বিতীয়ত সুন্নাহর অনুসরণ: সব কাজ আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সুন্নাহর অনুসরণে হওয়া চাই। আল্লাহর রাসূল (সা.) যেভাবে করেছেন, আমাদের দ্বারা তো সেভাবে করা সম্ভব নয়, তবে আমলের কাঠামো তো আমরা চেষ্টা করে সেরূপ করতে পারি। তা-ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টার খবর আমাদের চাইতে আল্লাহই ভালো জানেন। হ্যাঁ, যেসব কাজে ইমামগণ ইখতিলাফ করেছেন তাতে আমাদের ইখতিয়ার আছে। আমরা যার যার মাযহাব মেনেই আমল করব। কারণ সুন্নাহর অনুসরণের ক্ষেত্রে আমাদের ইলম আর তাকওয়ার চাইতে ইমামগণের ইলম আর তাকওয়ার উপর নির্ভর করাই মঙ্গলজনক।
গ. লোক দেখানো বা লোক শোনানোর প্রবণতা বাদ দেওয়া: ইখলাসের কথা বলার পর আবার এ কথা বলা জরুরি মনে করছি। কারণ বর্তমানে আমাদের সমাজে এসবের প্রবণতা খুব ব্যাপক। অনেকে ইখলাসের সাথেই কোনো আমল করে, কিন্তু পরে মানুষকে জানানোর লোভ সামলাতে না পেরে আমলটাকে বরবাদ করে দেয়। আপনি হয়ত তাহাজ্জুদ পড়ছেন, দান করছেন, কিন্তু সেসব ফেসবুকে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বলে বেড়ানোর বিষয় নয়। সেটা থাকুক না আপনার আর আপনার রবের কাছেই।
ঘ. নিষ্ঠার সাথে, যথাসম্ভব সুন্দর করে আমল করা: আমলের ক্ষেত্রে পরিমাণের চিন্তা না করে গুণগত মানের চিন্তা করা। অর্থাৎ আমি কত রাকাআত নামায পড়লাম সেটা যেন আমার প্রধান চিন্তা না হয়। বরং আমার নামায কতটুকু সুন্দর হলো, আমার নামায কতটুকু আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নামাযের সদৃশ হলো এই চিন্তা করা উচিত।
নফল নামায
মাহে রামাদানের বিশেষ ফযীলত হচ্ছে এ মাসে একটি নফল অন্য মাসের একটি ফরযের সমতুল্য সাওয়াব নিয়ে আসে। সুতরাং এ মাসই হচ্ছে নফল নামাযের সর্বোত্তম সময়। এছাড়াও রামাদানে আমরা দুইটি বিষয় খুব গুরুত্ব সহকারে আদায় করব।
এক. প্রতি ওয়াক্তের নামাযের সুন্নাত নামায। আমাদের অনেকে বর্তমান সময়ে সুন্নাত নামাযের গুরুত্ব দিতে চান না। এসব সুন্নাত নামায হচ্ছে প্রতি ওয়াক্তের অলংকার। সুন্নাত ছাড়া শুধু ফরয নামায যেন তেল-নুনবিহীন তরকারী। আমরা অন্তত এ মাসে চেষ্টা করব এসব সুন্নাত নামায যেন না ছুটে যায়।
দুই. তারাবীহ নামায। এক্ষেত্রেও অনেকে অলসতা করেন। আবার কেউ ৮ রাকাআত পড়ার পক্ষপাতী। এটা না করে আমরা তারাবীহ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আদায় করব। তারাবীহ না পড়লে রোযার হয়তো কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু রামাদান মাসের পূর্ণ ফযীলত পেতে হলে তারাবীহ না পড়লে হবে না। তারাবীহ তো শুধু এ মাসেরই আমল। রোযা আপনি অন্য মাসেও রাখতে পারেন, কিন্তু তারাবীহ? রামাদান ছাড়া তারাবীহ নেই। অতএব রামাদানের পূর্ণ বরকত হাসিল করতে চাইলে তারাবীহ আমরা পূর্ণরূপেই পড়ব ইন শা আল্লাহ।
আমি আট বা বিশ এ তর্কে যাচ্ছি না। তবে একথা বলতে চাই, আমরা চেষ্টা করব বিশ রাকাআতই পড়তে। কেননা তাতে নামায বেশি পড়ার সাওয়াব তো আমরা পাচ্ছিই। হ্যাঁ, যদি শারঈ ওজর (সফর, অসুস্থতা) থাকে তাহলে সুবিধামতো যতটুকু পারেন ততটুকুই পড়বেন, তা চার হোক বা আট বা ষোল। একটা কথা মনে রাখবেন, কতটুকু নামায পড়ছেন এবং কেন পড়ছেন তার খবর আপনি যেমন জানেন। তার চাইতে বেশি জানেন আপনার মালিক। যদি অলসতার কারণে বা প্রবৃত্তির অনুসরণে আপনি আট রাকাআতের সমর্থক হয়ে যান, তাহলে জেনে রাখবেন আপনার আট রাকাআতও কবূল হওয়ার সম্ভাবনা কম। কেননা আপনার নিয়ত প্রবৃত্তির কাছেই বাঁধা।
আর যারা নিয়মিত বিভিন্ন সময়ের নামায (ইশরাক, চাশত, আওয়াবীন) আদায় করেন সেগুলোও আদায় অব্যাহত রাখা উচিত। আমরা যারা এসবে নিয়মিত নই, তারাও চেষ্টা করতে পারি এগুলো আদায়ের। তবে কিছু আমল আমরা করতেই পারি। যেমন- ক. তাহাজ্জুদ পড়া। সাহরী খাওয়ার সময় দুই রাকাআত, চার রাকাআত বা আট রাকাআত যতটুকু সম্ভব পড়ে নেওয়া। ঘুম থেকে উঠেই যদি মুখ ধোয়ার সময় উযূ করে ফেলি তো দু’চার রাকাআত নামায পড়তে অসুবিধা হওয়ার কথা না। নফল সালাতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে তাহাজ্জুদ। আর রাত্রির এ সময় আল্লাহ তাআলা এমনিতেই বান্দাহ’র জন্য তাঁর রহমতের দ্বার খুলে দেন। রামাদান মাসে আমরা এমনিতেই এ সময় উঠি। এমতাবস্থায় যদি রহমত না নিতে পারি তাহলে দুর্ভাগ্যের দায় আর কে নেবে। এটা তো এমন যে, ঘরে ঘরে এসে কেউ গিফট দিয়ে যাচ্ছে আর আমরা ঘরের দরজাই খুলছি না।
দান সাদকাহ
রামাদান, সহমর্মিতা ও সহযোগিতারও মাস। পারস্পরিক সৌহার্দ্য এ মাসে বৃদ্ধি পায়। ছোটবেলায় দেখতাম প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোন প্রতিবেশির ঘর থেকে ইফতার আসত। আমরাও অন্যের ঘরে নিয়ে যেতাম। নিজের ঘরে ভালো ইফতার থাকার পরও অন্যের ইফতারের প্রতি যে অন্যরকম এক আকর্ষণ ছিল, তা আজও যায়নি। আমাদের সে সংস্কৃতি আজ নেই বললেই চলে। অথচ রামাদানের একটি শিক্ষা এমনই।
প্রিয় পাঠক, এবারের রামাদান যেন হয় আমাদের সত্যিকারের সংযমের রামাদান। যথাসম্ভব দান ও সাদাকার হাত আমরা বাড়িয়ে দেব, লোকদের ইফতার ও সাহরী করানোর চেষ্টা করব। বিশেষ করে আমাদের অধীন যারা আছেন, যেমন বাড়ির দারোয়ান-কেয়ারটেকার তাঁদের খেয়াল রাখব। আমরা অনেকে রামাদান মাসে যাকাত দিয়ে থাকি। আর যারা অন্য সময় দিয়ে থাকি, তারাও এবারের দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে রামাদানেই তা আদায় করতে পারি। পাশাপাশি উশর বা ফসলের যাকাতও আদায় করে দিলে ভালো হয়।
রামাদানের মূল শিক্ষা তাকওয়া হাসিলের কথা আমরা সকলেই জানি। তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহর ভয়। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আপনার যত মজবুত আপনার তাকওয়া ততই বেশি হবে। জেনে রাখবেন, অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় যাকাত ও দান-সাদকায় ঈমানের প্রকাশ সবচেয়ে বেশি হয়। কেননা নামায-রোযায় শারীরিক পরিশ্রম হয়। আরেকটি কারণেও দান সাদকার পরিমাণ এ মাসে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। দান-সাদকা বালা-মুসীবত দূর করে। বর্তমানের চেয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষ আগে কখনোও ছিল না, অন্তত আমাদের সময়ে। হয়তো আমাদের দান সাদকার কারণে আল্লাহ তাআলা এ মুসীবত আমাদের থেকে দূর করে দেবেন। যদি সামগ্রিকভাবে এ বিপদ দূর নাও হয়, দানকারীকে হয়ত আল্লাহ তাআলা রক্ষা করবেন।
দান-সাদকার ক্ষেত্রে সালাফদের একটি আমল আমরা ভুলেই গেছি। তাঁরা পকেটে যা থাকত সবই দিয়ে দিতেন, বা দানের সময় গণনা করতেন না। আমরাও এমন করার চেষ্টা করতে পারি। প্রথমে না হয়, পকেটে গণনা না করে অল্প কিছুই রাখি, যাতে দেওয়ার সময় সব দিয়ে দেওয়া যায়। এভাবে একসময় হয়তো সালাফদের মত আমাদের দানের হাতও লম্বা হবে। দানের ক্ষেত্রে পরিমাণ বা কত দিলাম তা ধর্তব্য নয়। কেননা সকলের সামর্থ্য সমান নয়। ১০০ টাকা থেকে ২ টাকা দেওয়া ব্যক্তির সাওয়াব তাঁর চাইতে বেশি হতে পারে যে ১০০ টাকা দান করেছে তার এক লক্ষ টাকা থেকে। এখানে অনুপাত নয়, বরং নিজের ত্যাগের দিকটাই প্রাধান্য পাবে। আমি বলছি না, আজ থেকেই আমরা সালাফদের মত নিজেরা না খেয়ে অন্যদের দিতে থাকব। আমরা শুরু করি, অল্প অল্প দান করে অভ্যস্ত হই। হয়তো একসময় আল্লাহ আমাদের এসব দানে খুশি হয়ে উত্তম দান করার জন্য আমাদের কবূল করবেন।
ইস্তিগফার ও তাওবা
মাহে রামাদান এই উম্মতের জন্য একটি বিশেষ নিআমত। বিশেষ করে নিজের গুনাহ মাফের সবচেয়ে উত্তম সময়। রামাদান পাওয়ার পরও যদি আমরা গুনাহগার হিসেবেই ঈদের মাঠে উপস্থিত হই তাহলে আমাদের চাইতে বড় দুর্ভাগা আর কেউ নেই। এমনিতেই আল্লাহ তাআলা ওসীলাহ খুঁজেন বান্দাকে মাফ করে দেওয়ার জন্য। তার উপর রামাদানের অবারিত রহমত ও মাগফিরাতের সুযোগ বিরাট গাধা ছাড়া আর কেউ অবহেলা করার কথা না। রোযাদারদের ক্ষমা প্রার্থনা আল্লাহ কবূল করেন। আমাদের মালিক শুধু অপেক্ষায় আছেন কখন আমরা তাঁর দিকে ফিরে যাব, তাঁর কাছে কৃত পাপের ক্ষমা চাইব। বিশ্বাস করুন, আপনার ক্ষমা চাইতে সময় লাগতে পারে, কিন্তু আল্লাহ তাআলার ক্ষমার ঘোষণা আসতে দেরি হয় না, যদি আন্তরিকভাবে ক্ষমা চান।
রামাদানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও আমল হচ্ছে তাওবা ও ইস্তিগফার। নিজের প্রতিটি পাপের কথা স্মরণ করে ক্ষমা চান, শেষ রাতে জায়নামাযে কান্নাকাটি করুন, দেখবেন স্বর্গীয় অনুভূতি কাকে বলে। অনেক জায়গাতেই তো স্বর্গীয় অনুভূতির কথা শুনেছেন, পড়েছেন; কিন্তু অনুভব করা আমাদের অনেকেরই হয়নি। খালিস তাওবা ও ইস্তিগফার করার পর আপনি সে অনুভূতি লাভ করবেন। রামাদানে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে নয়, বরং সদাসর্বদাই ইস্তিগফারের আমল করা উচিত। উঠতে, বসতে, দাঁড়ানো শোয়া সব অবস্থাতেই ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। কখন আল্লাহ তাআলা কবূল করে নেবেন তা তিনিই ভালো জানেন। তাছাড়া আমাদের দীলের যে অবস্থা, সত্যিকারের তাওবা বা ইস্তিগফার কয়জনের নসীব হয় তা বলা কঠিন। দুনিয়ার মহব্বতে আমাদের অন্তর এতই গাফিল যে, এই দুর্যোগেও আমরা লম্বা জীবনের আশা করি, ভেবে বসে আছি, আরেকটু বয়স হোক তারপর না হয় তাওবা করা যাবে। মনে রাখবেন আমাদের প্রিয়নবী (স) দৈনিক ৭০ বারেরও অধিক ইস্তিগফার করতেন। আর আমরা? একবার বলতেও ভয় পাই। আমাদের তো ৭০ কোটি বার ইস্তিগফার করলেও তা যথেষ্ট হওয়ার কথা না। তাছাড়া এক পাপের জন্য ৭০ বার তাওবা ও ইস্তিগফার করার কথাও এসেছে। সুতরাং আমরা তাওবা ও ইস্তিগফারের সুযোগ কেন ছাড়ব?
আরো একটি কথা, অনেকে ভাবি- তাওবা বা ইস্তিগফার করে কী লাভ? আমার মনে তো আর সে আন্তরিকতা নেই। তবুও করুন। কেননা বছরের পর বছর ধরে যে মন নষ্ট হয়েছে, তা একদিনে ঠিক হবে না। তবে ইস্তিগফারের ব্যাপার ভিন্ন। আপনি যতই করবেন ততই আপনার লাভ, তাতে আপনি একনিষ্ঠ হতে পারুন আর না-ই পারুন। মেহেরবানী করে আল্লাহ তাআলা যদি আপনার কোন একটি ইস্তিগফারও কবূল করে নেন, তাহলে সম্ভবত এই রামাদানে আপনি সৌভাগ্যবানদের দলেই যোগ দিলেন।
সুতরাং রামাদানের রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও নাজাত লাভের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা উচিত। ভালো আমল হচ্ছে সে প্রস্তুতি। অতএব, আন্তরিকতা ও এখলাছের মাধ্যমে রামাদানে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। শুধু মনে রাখবেন এই রামাদান যেন আমাদেরকে গুনাহ থেকে মুক্ত না করে চলে না যায়। এবার কীভাবে নিজেকে আল্লাহর দরবারে মাফ করাবেন তা আপনি আমার চাইতে ভালোই জানেন।