ভাষার জন্য আত্মদানকারী প্রথম জাতি বাঙালি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা। সেই স্মৃতি নিয়ে প্রতি বছর আসে গৌরবোজ্জ্বল একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশের পথ পরিক্রমায়ই প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, বাংলাদেশ। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। সুতরাং বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর জন্য এ দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
ভাষার লড়াই হয়েছে যুগে যুগে দেশে দেশে। ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজে হিন্দিকে শিক্ষার ভাষা হিসেবে চালু করতে আইনসভায় আইন পাশ করার চেষ্টা করে আচারিয়া সরকার। মাদ্রাজের অধিবাসীর ৭০ শতাংশ তামিলভাষী এর বিরোধিতা শুরু করে। শুরু হয় উপমহাদেশের প্রথম ভাষা আন্দোলন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নারী-পুরুষ কারাবরণ করেন।
দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ‘উর্দু’ হওয়ার ঘোষণা আসে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫২ সালে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান রফিক, সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বার। আহত হন আরো ১৭ জন। ভাষার জন্য আত্মদানের এই সূচনা। পরদিনে আবার হয় প্রতিবাদ মিছিল। গুলিতে প্রাণ হারান শফিউর রহমান, আউয়াল ও এক কিশোর। এই আত্মদানের ফলে ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
১৯৬০ সালে ভারতের আসাম প্রদেশে কংগ্রেস সরকার অসমিয়াকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এখানে বরাক উপত্যকার বাংলাভাষীরা প্রতিবাদে নামেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। ঘটনাস্থলে মারা যান ৯ জন। দুজন পরে মারা যান। মারা যান কমলা ভট্টাচার্য নামীয় এক ছাত্রী। যিনি ভাষা আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ। এ ঘটনায় আসাম সরকার বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
এদিকে ভারতের সংবিধান কার্যকর হলে হিন্দি প্রধান হিসেবে গৃহীত হলে আবারো মাদ্রাজে হিন্দি বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হয়। ১৯৫৮ সালে তামিলদের উদ্দেশ্যে নেহেরুর তির্যক মন্তব্যে রক্তক্ষয়ী প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ৩০০ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়। ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগের দিন দুজন স্কুলছাত্র শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহুতি দেন। শুরু হয় হিন্দি বিরোধী তুমুল আন্দোলন। ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক সপ্তাহে ভাষার জন্য ১৫০ জন তামিলভাষী মানুষ নিহত হন।
একই আন্দোলনে ১৯৯৩ সালে ১৫ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সক্রিয় আন্দোলন দ্বিতীয়টি আর নেই। অবশেষে ২০০৪ সালে রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালাম ইতিহাসের প্রথম তামিলকে ধ্রুপদি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
বঙ্গভঙ্গ রদের পর বাংলাভাষী অধ্যুষিত মানভূম ভোলোকে বিহার-উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু হয়। দেশ বিভাগের পর বিহারে প্রশাসনিক ভাষা হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আবার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৫১ সালে সত্যাগ্রহ এবং ১৯৫৪ সালে এটা টুসু আন্দোলন নাম ধারণ করে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলনে ৯৬৫ জন কারাবরণ করেন। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কেবল যে বাংলা ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে তা নয়, বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদেও আন্দোলন হয়েছে। ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের সব স্কুলে বাংলা শেখানো বাধ্যতামূলক করে। এর প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দার্জিলিং এর সংখ্যাগরিষ্ট নেপালি ভাষী গোর্খা জনগণ। এ ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হন। দার্জিলিংকে পৃথক গোর্খাল্যান্ড ঘোষণার দাবি আবার সরব হয়ে ওঠে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৭৬ সালে হয় তুমুল আন্দোলন। ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন ভাষার দাবিতে সোয়াটা শহরে ৭০০ জন স্কুল ছাত্র প্রাণ হারান। সরকারি হিসেবে যা ১৭৬। যার ফলে আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ১৬ জুন বিশ্বের ভাষা আন্দোলনে সর্বাধিক রক্তাক্ত দিন।
চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে কাজাখ ভাষী উইঘুর মুসলমানদের ওপর চলছে নিষ্ঠুর নির্যাতন। ২০১৬ সালে চীনে খোলা হয় বিশেষ বন্দি শিবির। সেখানে ২০ লাখ উইঘুরকে বন্দি রাখা হয়। তাদেরকে মান্দারিন ভাষা শিক্ষার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। চলছে শারীরিক নির্যাতন। হাতের আঙ্গুলে সূচ প্রবেশ করানোর মতো নিষ্ঠুর কর্মকা- চলছে। রাষ্ট্রীয় আয়োজনে জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২৬ লাখ মানুষকে নির্যাতন করা হচ্ছে। যা এখন অব্যাহত রয়েছে।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের মূলে রয়েছে ভাষার সুতা। মায়ানমারের রাখাইনের অধিবাসীদের ভাষা রোয়াইঙ্গা। এ ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। সম্পূর্ণ কথ্য ভাষা। বাংলা ভাষা বা বর্ণের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষার সাথে কিছুটা মিল রয়েছে। যার ফলে বাঙালি হিসেবে অপবাদ আসে। মায়ানমারে ১৩৫ জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি থাকলেও ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি ও নাগরিকত্ব হরণ করা হয়। শুরু হয় নির্যাতন। বাকিটুকু উল্লেখ করাই বাহুল্য। যার ভুক্তভোগী আমরা।
১৯৫২ সালের আত্মদানে প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দান করে । ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮ দেশে দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতে শুরু হয়। ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ দিনটিকে স্বীকৃতি দান করে। ভাষা আন্দোলন যেমন আমাদের অহঙ্কার, এই স্বীকৃতিও তেমন গৌরবের। অনাগত বিশ্বের কোনো জাতি যেন তার মাতৃভাষার জন্য নিপীড়িত না হয়, এই প্রত্যাশা।