Logo
কতিপয় আয়াতে আল্লাহর ধমকসদৃশ নির্দেশনা : রাসূল (সা.) ভুল করেছিলেন?
মুহাম্মাদ সায়ীদ
  • ১০ নভেম্বর, ২০২৫

আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলগণকে নির্বাচন করে নবুওয়াত-রিসালাতের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাদেরকে এই দায়িত্বের জন্য যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলেন। কোন মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় নবুওয়াত-রিসালাতের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে না। এগুলো অর্জনযোগ্য বিষয় নয়।
আল্লাহ যেহেতু নবী-রাসূলদেরকে এই বিশেষ দায়িত্বের জন্য বাছাই করে থাকেন, তাই তিনি তাদেরকে যেকোনো ধরণের বিপথগামীতা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। এতে করে তাদের দাওয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে অস্বীকৃতি জানানোর কোন ছুতো মানুষের কাছে থাকে না। সকল নবীদেরকেই আল্লাহ তায়ালা এভাবে হিফাযত করেন। একে ইসমতে আম্বিয়া (عصمة الأنبياء) বলে।
কুরআনে কিছু আয়াতে কারীমা এসেছে, যেগুলোতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বিভিন্ন বিষয়ে কঠোর ভাষায় কোন কিছু ইরশাদ (عتاب) করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিবিধ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে এসব আয়াতের মাধ্যমে উত্তম নয়, সর্বোত্তম কোনকিছু অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর যে কাজটির কারণে আল্লাহ তাআলা ধমকসদৃশ আয়াত নাযিল করেছেন, এর অর্থ মোটেই এ নয় যে, রাসূল (সা.) কোন গুনাহ বা ভুল কাজ করেছেন। বরং এর অর্থ হলো– রাসূল (সা.) কোন কার্য সম্পাদন বা পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ (أفضل) এর বদলে ভালো (خير), শুদ্ধতম (أصح) এর বদলে শুদ্ধ (صحيح) কে গ্রহণ করেছেন। ফলে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করে তাঁকে পথনির্দেশ করেছেন, যেন তিনি শ্রেষ্ঠ (أفضل) ও শুদ্ধতম (أصح) বিষয়কে গ্রহণ করেন।
এ সংক্রান্ত কিছু আয়াতে কারীমা ও সেগুলো নাযিলের প্রেক্ষাপট এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) এর দৃষ্টিভঙ্গি ও এর বিপরীতে আল্লাহর পথনির্দেশ বা ইরশাদাত দেখলে আমরা উপরোক্ত দাবির শুদ্ধতা অনুধাবন করতে সক্ষম হবো।
সূরা আবাসায় আল্লাহ তাআলা রাসূলের উদ্দেশ্যে ইরশাদ করেছেন–
عَبَسَ وَتَوَلَّىٰ ‎﴿١﴾‏ أَن جَاءَهُ الْأَعْمَىٰ ‎﴿٢﴾‏ وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّىٰ ‎﴿٣﴾‏ أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ الذِّكْرَىٰ ‎﴿٤﴾‏ أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَىٰ ‎﴿٥﴾‏ فَأَنتَ لَهُ تَصَدَّىٰ ‎﴿٦﴾‏ وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّىٰ ‎﴿٧﴾‏ وَأَمَّا مَن جَاءَكَ يَسْعَىٰ ‎﴿٨﴾‏ وَهُوَ يَخْشَىٰ ‎﴿٩﴾‏ فَأَنتَ عَنْهُ تَلَهَّىٰ ‎﴿١٠﴾‏ كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ ‎﴿١١﴾‏ فَمَن شَاءَ ذَكَرَهُ ‎﴿١٢﴾‏ فِي صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ ‎﴿١٣﴾‏ مَّرْفُوعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ ‎﴿١٤﴾‏ بِأَيْدِي سَفَرَةٍ ‎﴿١٥﴾‏ كِرَامٍ بَرَرَةٍ ‎﴿١٦﴾‏
–তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। (১) কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। (২) আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত। (৩) অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হত। (৪) পরন্তু যে বেপরোয়া। (৫) আপনি তার চিন্তায় মশগুল। (৬) সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোন দোষ নেই। (৭) যে আপনার কাছে দৌড়ে আসলো (৮) এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে। (৯) আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। (১০) কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবাণী। (১১) অতএব, যে ইচ্ছা করবে, সে একে গ্রহণ করবে। (১২) এটা লিখিত আছে সম্মানিত, (১৩) উচ্চ পবিত্র পত্রসমূহে (১৪) লিপিকারের হস্তে। (১৫) যারা মহৎ, পূত চরিত্র। (১৬)
এই আয়াত অবতীর্ণের প্রেক্ষাপটের ব্যাপারে তাফসীর গ্রন্থগুলোতে এসেছে- একদিন আবদুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূম (রা.) রাসূল (সা.) এর কাছে এলেন। রাসূল (সা.) তখন কুরাইশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন। এসব নেতাদের মধ্যে উতবা ইবন রাবীআহ, আবূ জাহল ইবন হিশাম, আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিব, উবাই ইবন খালাফ এবং উমাইয়া ইবন খালাফ প্রমুখ ছিলেন বলে কোন কোন বর্ণনায় জানা যায়। রাসূল (সা.) তাদেরকে আল্লাহ তাআলার দ্বীনের দিকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন। তাঁর আশা ছিলো, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে।
এসময় আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূম (রা.) বলতে লাগলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে যা শিখিয়েছেন তা থেকে আমাকে শিক্ষা দিন। আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূম (রা.) বারবার ডাকতে লাগলেন। তিনি ছিলেন অন্ধ সাহাবী। তিনি বুঝছিলেন না যে রাসূল (সা.) অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত রয়েছেন। এসময় রাসূল (সা.) এর মুখমণ্ডলে অসন্তুষ্টির ছাপ প্রকাশ পেল, কারণ তাঁর আলোচনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) মুখ কুঁচকালেন এবং তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি যাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাদের দিকেই মনোযোগ দিলেন। তখনই আল্লাহ তাআলা এই আয়াতগুলো নাযিল করেছেন। (তাফসীরে তাবারী, ৩০/৬৫, আদ-দুররুল মানসূর, ৮/৪১৬, আসবাবুন নুযুল লিল ওয়াহিদী, পৃ ২৫৪)
এখানে রাসূল (সা.) কুরাইশের এক বা একাধিক কাফির নেতার সঙ্গে বসে আলোচনা করছিলেন। তিনি তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে তারা কিছুটা আগ্রহ দেখাচ্ছে, তাই আরও উৎসাহ নিয়ে বুঝাতে লাগলেন। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ ভরে দাওয়াত দিচ্ছিলেন। কারণ তাঁর আশা ছিলো, তারা ইসলাম গ্রহণ করবে।
অন্যদিকে আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতূম (রা.) ইতোপূর্বে মুসলিম হয়ে গেছেন। তিনি যখন এসে কোন কিছু জানতে চাচ্ছেন, তখন রাসূল (সা.) এর কাছে তাকে সময় দেওয়ার চেয়ে অগ্রাধিকার ছিলো ঐ নেতাগোছের লোকেদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া। রাসূল (সা.) ভেবেছিলেন, এই লোকগুলো নেতৃস্থানীয় বিধায় তারা ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের গোত্রভুক্ত আরও বিশাল সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করবে। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ ইবন মাকতুম (রা.) কে পরেও সময় দেওয়া যাবে।
আর আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুমের মাধ্যমে যেহেতু রাসূল (সা.) এর আলোচনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো, তাই স্বভাবিকভাবেই তিনি বিরক্ত হয়ে থাকবেন। তিনি বিরক্ত হয়ে ভ্রুকুঞ্চিত করেছিলেন। আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম অন্ধ হওয়ায় তা দেখবেন না। বিধায় এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) মনোযোগ দেননি।
রাসূল (সা.) দাওয়াতের প্রয়োজনে কুরাইশ নেতাদেরকে সময় দেওয়ার চিন্তা করেছেন। তাঁর বিবেচনায় এটা ছিলো ভালো কাজ। কিন্তু আল্লাহ আয়াত নাযিল করে তাঁকে আরও উত্তম কিছুর দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা কর্তৃক রাসূল (সা.) এর উদ্দেশ্যে অনুরূপ কঠোর হুঁশিয়ারি সূরা আনফালের নিম্নোক্ত আয়াতে পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُ أَسْرَىٰ حَتَّىٰ يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِۚ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ-‏ لَّوْلَا كِتَابٌ مِّنَ اللَّهِ سَبَقَ لَمَسَّكُمْ فِيمَا أَخَذْتُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ-‏ فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًاۚ وَاتَّقُوا اللَّهَۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ-‏
-নবীর পক্ষে উচিত নয় বন্দিদেরকে নিজের কাছে রাখা, যতক্ষণ না দেশময় প্রচুর রক্তপাত ঘটাবে। তোমরা পার্থিব সম্পদ কামনা কর, অথচ আল্লাহ চান আখিরাত। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী হিকমতওয়ালা। যদি একটি বিষয় না হত যা পূর্ব থেকেই আল্লাহ লিখে রেখেছেন, তাহলে তোমরা যা গ্রহণ করছ সেজন্য বিরাট আযাব এসে পৌঁছাত। সুতরাং তোমরা খাও গনীমত হিসেবে তোমরা যে পরিচ্ছন্ন ও হালাল বস্তু অর্জন করেছ তা থেকে। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (সূরা আনফাল, আয়াত-৬৭-৬৯)
সহীহ মুসলিমের বর্ণনা ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের বিবরণ অনুযায়ী আয়াতটি বদরের যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়। বদরের যুদ্ধের ৭০ জন যুদ্ধবন্দির ব্যাপারে রাসূল (সা.) বড় বড় সাহাবীদের সাথে পরামর্শে বসেছিলেন। তখন বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দেওয়ায়, সিদ্ধান্ত নেয়া জটিল হয়ে পড়েছিল।
রাসূল (সা.) আবূ বকর (রা.) ও উমর (রা.) এর কাছে বন্দিদের বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। আবূ বকর প্রস্তাব করলেন, বন্দিদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নেওয়া হোক। এতে মুসলমানরা সম্পদের দিক থেকে লাভবান হবে এবং হতে পারে আল্লাহ তাআলা পরবর্তীতে তাদেরকে হিদায়াত দান করবেন। পক্ষান্তরে হযরত উমর (রা.) বললেন, এসব কাফির নেতাদের হত্যা করা উচিৎ।
উপস্থিত সাহাবীদের অনেকে আবূ বকর (রা.) এর সিদ্ধান্তের সমর্থন করলেন। রাসূলও এই সিদ্ধান্তকে উপযুক্ত মনে করে মুক্তিপণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন। পরে আল্লাহ তাআলা সূরা আনফালের উপরোক্ত আয়াতগুলো নাযিল করেছেন। আয়াতগুলোতে রাসূলকে কঠোর ভাষায় পথনির্দেশ (إرشاد) দেয়া হয়েছে।
এই আয়াতে, প্রথমত, আল্লাহ তাআলা সরাসরি রাসূলকে عتاب বা ধমকসদৃশ কিছু বলেননি, বরং রাসূল (সা.) এর সম্মানে তিনি صيغة الغائب ব্যাবহার করেছেন। তবে মুমিনদেরকে সরাসরি عتاب ধমকের স্বরে নির্দেশনা দিয়েছেন।
এখানে রাসূল (সা.) কী আসলে ভুল করেছিলেন? উত্তর: না। কারণ বদর যুদ্ধ ছিলো প্রথম যুদ্ধ। এবং তখন যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে আল্লাহর কোন নির্দেশনাও ছিলো না। যেকোন ব্যাপারে সকলের সাথে পরামর্শ করার জন্য আল্লাহ তাআলার নির্দেশনা ছিলো। আল্লাহ বলেছেন, وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ -রাসূল, আপনি কাজেকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৫৯)
অতএব রাসূল (সা.) পরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পন্থা অবলম্বন করেছেন। যেহেতু আবূ বকর (রা.) এর সিদ্ধান্তের সাথে সাহাবীদের মতামতের মিল ছিলো। তাই পরামর্শের ফলাফল হিসেবে রাসূল (সা.) মুক্তিপণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এখানে আবূ বকর (রা.) এর প্রস্তাবিত মুক্তিপণ নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক এবং যৌক্তিক। এতে কোমলতা ছিলো এবং মুসলমানের অর্থনৈতিক ফায়দা ছিলো। ফলে রাসূল (সা.) কর্তৃক এই পরামর্শ গ্রহণের অবস্থানও সঠিক ছিল। তবে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ও সঠিক মত উমর (রা.) এর মত; বন্দিদের হত্যা করা। এটি এই পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত হতো। তাই, আল্লাহ তাআলা তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেবল শুদ্ধ ও সঠিক নয়, বরং শুদ্ধতম ও সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করার কারণে ধমকের স্বরে নির্দেশনা দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা রাসূল (সা.) কে মুআতাবা (معاتبة) তথা রূঢ়ভাবে কোন কিছু বলার আরেকটি উদাহরণ সূরা কাহাফের নিম্নোক্ত আয়াতগুলোতে দেখা যায়। আল্লাহ বলেছেন,
سَيَقُولُونَ ثَلَاثَةٌ رَّابِعُهُمْ كَلْبُهُمْ وَيَقُولُونَ خَمْسَةٌ سَادِسُهُمْ كَلْبُهُمْ رَجْمًا بِالْغَيْبِ ۖ وَيَقُولُونَ سَبْعَةٌ وَثَامِنُهُمْ كَلْبُهُمْ ۚ قُل رَّبِّي أَعْلَمُ بِعِدَّتِهِم مَّا يَعْلَمُهُمْ إِلَّا قَلِيلٌ ۗ فَلَا تُمَارِ فِيهِمْ إِلَّا مِرَاءً ظَاهِرًا وَلَا تَسْتَفْتِ فِيهِم مِّنْهُمْ أَحَدًا-‏ وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَٰلِكَ غَدًا -‏ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ ۚ وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَىٰ أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَٰذَا رَشَدًا.
–অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে তারা বলবে, তারা (আসহাবে কাহাফ) ছিল তিন জন। তাদের চতুর্থটি ছিলো তাদের কুকুর। একথাও বলবে, তারা পাঁচ জন। তাদের ষষ্ঠটি ছিল তাদের কুকুর। আরও বলবে, তারা ছিল সাত জন। তাদের অষ্টমটি ছিল তাদের কুকুর। বলুন, আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভাল জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। সাধারণ আলোচনা ছাড়া আপনি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবেন না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদও করবেন না। আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামীকাল করব। ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে’ বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুন, আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন। (সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২২-২৪)
এই আয়াত এর প্রেক্ষাপটের ব্যাপারে ইবন ইসহাক হযরত ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, মক্কার কুরাইশরা মদীনার ইয়াহুদী আলিমদের (আহবার) কাছে লোক পাঠিয়ে রাসূল (সা.) এর সত্যতা যাচাই করতে চাইল। ইয়াহুদীরা যেহেতু পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে জানত। তাই কুরাইশরা আন-নদর ইবন হারিস ও উকবা ইবন আবী মুইতকে মদীনায় থাকা ইয়াহুদী আলিমদের কাছে পাঠাল। তারা সেখানে গিয়ে রাসূলের ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনা করলো।
ইয়াহুদী আলিমরা এই দুজনকে শিখিয়ে দিলো, তোমরা তাকে তিনটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করো সেই যুবকদের ব্যাপারে, যারা বহু আগে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ ‘আসহাবে কাহফ’ এর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করো।
সেই ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো, যিনি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে ভ্রমণ করেছিলেন, অর্থাৎ যুলকারনাইন এর ব্যাপারে। রূহ (আত্মা) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কর– এটি কী?
ইয়াহুদী আহবার আরও বলে দিলো, যদি তিনি এই ৩টি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন, তবে তিনি সত্য নবী। আর যদি না পারেন, তবে তিনি মিথ্যাবাদী।
কুরাইশরা ফিরে এসে রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞাসা করল। রাসূল (সা.) জবাবে বললেন যে আমি তোমাদেরকে আগামীকাল জানাব।
তবে রাসূল (সা.) আগামীকাল জানাবেন বলার সাথে “ইনশাআল্লাহ” (যদি আল্লাহ চান) বলতে ভুলে গেলেন। এরপর পনের দিন চলে যায়, কিন্তু কোন ওহী আসেনি। ফলে রাসূল (সা.) লজ্জায় পড়ে যান। তিনি ওহীও পাচ্ছিলেন না, জবাবও দিতে পারছিলেন না।
মক্কার লোকেরা রাসূল (সা.) কে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগল। এতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হলেন।
অবশেষে জিবরাইল (আ.) সূরা কাহাফ নিয়ে অবতীর্ণ হলেন, যাতে আল্লাহ তাআলা রাসূল (সা.) কে সৌম্য ভর্ৎসনা (মুআতাবা) করেছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা কাহাফের মাধ্যমে রাসূলকে আসহাবে কাহাফ ও যুলকারনাইন এর ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। আর সূরা ইসরায় রূহ সম্পর্কে বলেছেন– তারা তোমাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো: রূহ আমার প্রতিপালকের আদেশ, আর তোমাদেরকে জ্ঞানের দিক থেকে অল্পই দেওয়া হয়েছে। (সূরা ইসরা, আয়াত: ৮৫) (তাফসীরে তাবারী, ১৫/২২০-২২১)
রাসূল (সা.) কথা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইনশাআল্লাহ বলতে বিস্মৃত হওয়ায় আল্লাহ তাআলা ওহী নাযিল ১৫ দিন স্থগিত করেছেন। এরপর সূরা কাহাফের উল্লিখিত আয়াতগুলো নাযিল করে এই বিস্মৃতির (نسيان) ব্যাপারে মুআতাবা তথা রূঢ় বাক্যালাপে তাঁকে নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে, রাসূল (সা.) আল্লাহকে জানার ও বোঝার ব্যাপারে সৃষ্টির মধ্যে সর্বাগ্রে। আল্লাহ না চাইলে কোন কিছু হওয়া সম্ভব নয়– এটা রাসূলের অজানা নয়। তা সত্ত্বেও তিনি ইনশাআল্লাহ না বলার কারণ ছিলো তাঁর বিস্মৃতি (نسيان)। এমন বিস্মৃতির ঘটনা অন্যান্য নবীদের বেলায়ও ঘটেছে। আদম (আ.) নিষিদ্ধ গাছের ব্যাপারে, মূসা (আ.) খাদির (আ.) কে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বিস্মৃতির স্বীকার হয়েছেন। সুলাইমান (আ.) কর্তৃক ইনশাআল্লাহ বলা ব্যতিরেকে এক রাতে ৭০ জন স্ত্রীর সাথে মিলনের মাধ্যমে ৭০ জন সাহসী-যোদ্ধা-সন্তান লাভের আশা প্রকাশের ক্ষেত্রেও বিস্মৃতির স্বীকার হয়েছেন। আলোচ্য ঘটনায় যে রাসূলও বিস্মৃতির স্বীকার, তা আল্লাহ তাআলা আয়াতে বলে দিয়েছেন– আপনি কোন কাজের বিষয়ে বলবেন না যে, সেটি আমি আগামীকাল করব। ‘ইনশাআল্লাহ’ বলা ব্যতিরেকে। যখন ভুলে যান, তখন আপনার পালনকর্তাকে স্মরণ করুন এবং বলুন, আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চাইতেও নিকটতম সত্যের পথ নির্দেশ করবেন।
আয়াতের ভাষাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তাআলা এখানে বিস্মৃতির কথা যুক্ত করে, রূঢ় নির্দেশনা (মুআতাবা) সত্ত্বেও রাসূলকে অনেকটা দায়মুক্তি (تبرئة) দিয়ে দিয়েছেন। কারণ আল্লাহ তাআলা নিজেই কুরআনে শিখিয়ে দিয়েছেন–
رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِن نَّسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
–হে আমাদের রব, যদি আমরা বিস্মৃত হয়ে যাই কিংবা ভুল করি, তবে আমাদেরকে পাকড়াও করো না।
সুতরাং বিস্মৃতির স্বীকার হয়ে রাসূল (সা.) এর ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলা, এটা অপরাধ নয়। তবে, এমন বিস্মৃতিও যেন না ঘটে, তাই আল্লাহ তাঁকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন। (চলবে)

ফেইসবুকে আমরা...