আল্লাহ তাআলা যে পাঁচজন নবীকে ‘উলুল আযম মিনার রুসূল’ তথা দৃঢ়প্রত্যয়ী রাসূল বলেছেন তাদের মধ্যে হযরত নূহ (আ.) অন্যতম। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রেরিত প্রথম রাসূল। যে জাতির নিকট তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন তারা শয়তানের ধোকায় পড়ে তৎকালীন সময়ের বুযুর্গদের মূর্তি বানিয়েছিল। এবং ধীরে ধীরে তারা সেইসব বুযুর্গদের মূর্তিকে কেন্দ্র করে শিরকে লিপ্ত হয়। এভাবেই পৃথিবীতে শিরকের সূচনা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,আর তারা বলে তোমরা তোমাদের পূর্ব পুরুষদের পূজিত উপাস্য ওয়াদ,সুওয়া,ইয়াগূস,ইয়াঊক ও নাসর-কে কখনোই পরিত্যাগ করবে না। (এভাবে) তারা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করে। (সূরা নূহ: ২৩-২৪) । বুখারী শরীফের বর্ণনামতে,এ আয়াতে যে ক’টি নাম এসেছে এগুলো নূহ (আ.) এর কওমের বুযুর্গ লোকদের নাম। তাদের মৃত্যুর পর নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকদেরকে শয়তান প্ররোচিত করল,তারা যেন ওইসব বুযর্গদের প্রতিমা বানিয়ে রাখে এবং তাদের নামে এগুলোর নামকরণ করে। তারা তা-ই করল। ক্রমান্বয়ে এগুলোর উপাসনা ও পূজা শুরু হতে লাগলো। হযরত নূহ (আ.) তখন তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে বললেন,আমি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল! কোনো ফেরেশতা নই;আমি একজন মানুষ। আমাকে আল্লাহ তাআলা মুজিযা দিয়ে শক্তিশালী করেছেন। আমি তোমাদের হিদায়াতের জন্য এসেছি। তাই আমি তোমাদেরকে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদাত করার জন্য আহ্বান করছি। এই আহ্বানে যে সাড়া দেবে সে পরকালে মুক্তি পাবে। আর যদি তোমরা আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে তোমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ভয়াবহ আযাব আসবে। আমি দাওয়াতী এই কাজের বিনিময়ে কারো কাছে কোনো প্রকার পারিশ্রমিক চাই না। নূহ (আ.) সুদীর্ঘ ৯৫০ বছর তার জাতিকে এক আল্লাহর পথে এভাবেই দাওয়াত দিয়েছিলেন কিন্তু খুব কম মানুষই তাঁর ডাকে সাড়া দেয়। কুরআনে এসেছে— নূহ (আ.) বলেছিলেন,আমি তো তোমাদের জন্য এক স্পষ্ট সতর্ককারী। তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। (সূরা নূহ,আয়াত ২-৩) কিন্তু শিরক,পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনে লিপ্ত সম্প্রদায় এই আহ্বান তো মেনে নিলো-ই না বরং তারা নূহ (আ.)-কে নিয়ে উপহাস করতে লাগলো। তারা বললো,তুমি আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বাকবিতণ্ডা করে ফেলেছ,তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে তুমি যে আযাবের কথা বলতেছ,পারলে তা আনয়ন করো। (সূরা হুদ: আয়াত ৩২)। হযরত নূহ (আ.) দীর্ঘ সময় ধরে তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া পাচ্ছিলেন না বরং তারা ধৃষ্টতার সাথে আল্লাহর আযাব দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করছিল। তাদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে নূহ (আ.) তাদের জন্য বদদুআ করলেন—হে আমার রব,পৃথিবীতে কাফিরগণের কোনো গৃহবাসীকেও তোমার আযাব থেকে রেহাই দিও না। (সূরা নূহ: আয়াত ২৬-২৮) আল্লাহ তাআলা তখন নূহ (আ.) একটি নৌকা বানানোর জন্য আদেশ দিয়ে বললেন, তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার আদেশ অনুযায়ী নৌকা নির্মাণ করো এবং যারা সীমালঙ্ঘন করেছে তাদের সম্পর্কে তুমি আমাকে কিছু বলো না,তারা তো নিমজ্জিত হবেই। (সূরা হুদ আয়াত ৩৭)
মুহাম্মদ ইবন ইসহাক তাওরাত হতে উল্লেখ করেন যে,আল্লাহ তাআলা নূহ (আ.) কে সেগুন কাঠ দ্বারা আশি হাত দৈর্ঘ্য ও পঞ্চাশ হাত প্রস্থের একটি নৌকা নির্মাণ করে ভিতরে বাহিরে আলকাতরা লাগানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাতাদাহ (র.) এর মতে,নৌকাটি দৈর্ঘ্যে তিনশত হাত ও প্রস্থে পঞ্চাশ হাত ছিল। ইবন আব্বাস (রা.) এর মতে নৌকার দৈর্ঘ্য ছিল বারোশত হাত ও প্রস্থ ছিল ছয়শত হাত। এভাবে বিভিন্নজন বিভিন্ন মত দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে নূহ (আ.) এর নৌকা ছিল তিনতলা বিশিষ্ট। প্রত্যেক তলা দশ হাত করে নৌকার মোট উচ্চতা ছিল ত্রিশ হাত। (সঠিক তথ্য আল্লাহ-ই ভালো জানেন) যাইহোক,নূহ (আ.) যখন নৌকা নির্মাণের কাজে ব্যস্ত থাকতেন তখন তার সম্প্রদায়ের লোকেরা তা দেখে হাসাহাসি করতো;ঠাট্টা বিদ্রুপ করতো। নূহ (আ.) তখন জবাবে বলতেন,তোমরা আমাকে নিয়ে উপহাস করছ? আমিও একদিন তোমাদের নিয়ে উপহাস করব। আর খুব শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কার উপর আসবে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি আর কার উপর আপতিত হবে স্থায়ী শাস্তি। (সূরা হুদ: আয়াত ৩৮-৩৯) অবশেষে একদিন হঠাৎ আগুনের উনুন বা চুলা হতে পানি উথলে উঠতে আরম্ভ করলো। শুরু হলো আকাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টিবর্ষণ। চোখের সামনে থৈথৈ করে পানি বাড়তে লাগলো। আল্লাহ তাআলা বলেন,অতঃপর আমি আকাশের দরজা উন্মুক্ত করে দিলাম প্রচণ্ড বর্ষণের জন্য এবং আমি ভূমি থেকে উদ্গীরণ করলাম ঝর্ণাসমূহ। (সূরা কামার: 11-12) আল্লাহ তাআলা তখন নূহ (আ.) কে প্রত্যেক প্রাণীর একজোড়া করে ও ঈমানদারদেরকে নৌকায় উঠানোর জন্য নির্দেশ দিলেন। (সূরা হুদ: আয়াত ৪০) আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক নূহ (আ.) সকল প্রকার প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় উঠালেন এবং তার অনুসারীদেরকে নৌকায় তুলে নিলেন। ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে,নারী-পুরুষসহ নূহ (আ.) অনুসারী ছিল মাত্র আশি জন। কাব আহবারের মতে বাহাত্তর জন। নূহ (আ.) আল্লাহর নাম নিয়ে নৌকায় আরোহন করলেন। নূহ (আ.) এর চারজন পুত্র ছিল। সাম,হাম,ইয়াফিস ও ইয়াম বা কেনআন। তন্মধ্যে কেনআন ঈমান আনেনি। যখন মহাপ্লাবন শুরু হলো তখন নূহ (আ.) তাকে ঈমান আনার জন্য আবারও আহ্বান করলেন। সে বললো,পানি আর কতটুকুই বা হবে? আমি পর্বতের উপর আশ্রয় নেব যা আমাকে প্লাবন থেকে রক্ষা করবে। তখন নূহ (আ.) বললেন,আজ আল্লাহ ছাড়া কেউ রক্ষা করতে পারবে না। (সূরা হূদ আয়াত ৪২-৪৩) আল্লাহ তাআলার শাস্তি এতোটাই প্রকট যে,পানির উচ্চতা পাহাড়ের উপরে ওঠে গিয়েছিল। ফলে,নূহ (আ.) এর পুত্র কেনআনসহ সকল অবিশ্বাসী পানিতে ডুবে মারা যায়। প্রায় একশত পঞ্চাশ দিন নূহ (আ.) এর নৌকা পানিতে ভাসতে থাকে। এরপর জুদী পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে নৌকাটি স্থির হয়। আস্তে আস্তে পানি কমতে শুরু করে। আল্লাহ তাআলা আদেশ দিয়েছিলেন, হে পৃথিবী! তোমার পানি শুষে নাও এবং হে আকাশ! থেমে যাও। পানি হ্রাস পেল এবং আদেশ কার্যকর হলো এবং জাহাজটি জুদী পর্বতের ওপর থেমে গেল। (সূরা হুদ: 44) আল্লাহর হুকুমে যমীন সমস্ত পানি শুষে নেয়। পৃথিবীর স্থলভাগ শুকিয়ে যায়। যমীনের অবস্থা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নূহ (আ.) একটি কবুতরকে পাঠালেন, সে যয়তুন গাছের পাতা ও পায়ে কাদামাটি নিয়ে ফেরত আসলো। নূহ (আ.) তখন তার অনুসারীদের নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং সেখানে সম্পূর্ণ নতুন একটি জনপদ স্থাপন করেন।