২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর দখলদার ইসরায়েলের ওপর গাযার ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের পক্ষ থেকে তুফানে আকসা নামক এক অভিযান আছড়ে পড়েছিল। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রকল্প হিসেবে গড়ে ওঠা অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর সম্ভবত এটিই ছিল ফিলিস্তিনীদের পক্ষ থেকে নিজেদের ভূমি পুনরুদ্ধারের সবচেয়ে জোরালো প্রচেষ্টা। ফিলিস্তিনীরা প্রথমবার ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে নিজেদের দখলকৃত ভূমির একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিল। তবে তুফানে আকসার যৌক্তিকতা নিয়ে আজও মুসলমানদের মধ্যে কারো কারো সন্দেহ রয়ে গেছে। সামর্থ্য ও বৈশ্বিক সমর্থনে ইসরায়েলের চেয়ে বহু পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও হামাস কেন আক্রমণ করতে গেল? এককথায় জবাব দিলে, হামাস স্বাধীন ফিলিস্তিন ও মাসজিদুল আকসার প্রশ্নকে আরও কয়েকটি দিন জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল।
বলা হয়, সময় আঘাতের দাগ মুছে দেয়। ব্রিটিশদের দ্বারা অবৈধভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আরব ও মুসলিম বিশ্বে যে আঘাত লেগেছিল, মনে হচ্ছে সময় সেই আঘাতের দাগ ভালোভাবেই মুছে দিয়েছে। মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক এক হয়ে ইসরায়েলকে বর্জন করা এবং ইসরায়েলের পেছনে আমেরিকা আছে জেনেও আরব রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে উৎখাত করার সেই প্রচেষ্টাগুলো যেন আজ প্রাচীনযুগের গল্প। সময় সেই আঘাতের দাগ এতটাই মুছে দিয়েছে যে, গায়রতের মাথা খেয়ে আজ মুসলিম বিশ্বের বহু উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র ইসরায়েলকে গোপনে অথবা প্রকাশ্যে মেনে নিয়েছে। কেউ কেউ আমেরিকা-ইসরায়েলের ডিনার টেবিলে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট চেটে খেতেও প্রস্তুত। একে একে তুর্কি, মিশর, জর্ডান ও মৌরিতানিয়া অবৈধ রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যদিও মৌরিতানিয়া ২০১০ সালে পুনরায় সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। ২০২০ সালে তথাকথিত আব্রাহামিক চুক্তির আলোকে মরোক্কো, বাহরাইন, আরব আমিরাত ও সুদান ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নরমালাইজ করেছে। প্রকাশ্যে স্বীকৃতি না দিলেও উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।
তবে মুসলমানদের কাছে উপরোল্লিখিত রাষ্ট্রগুলোর আলাদা কোনো মাহাত্ম্য নেই। আমিরাত বা মরোক্কো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলে কী, আর না দিলেই কী? এমন তো নয় যে, ইসরায়েল ছাড়া অন্য ইস্যুতে এরা উম্মাতের খুব ফায়দা করছে। কিন্তু হারামাইন শরীফাইনের কারণে সৌদি আরবের একটি আলাদা গুরুত্ব মুসলমানদের কাছে আছে। তাই সবাই জানে, সৌদি যদি ইসরায়েলকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়, তাহলে একদিকে অধিকার ও আদর্শের এ দীর্ঘ লড়াইয়ে মুসলমানদের লজ্জাজনক পরাজয় লেখা হয়ে যাবে, অপরদিকে ন্যায়ানুগ ভূমি নিয়ে একটি স্বাধীন, স্বীকৃত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন মরে যাবে। এমন নয় যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৩টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে। কিন্তু এটি কী ধরণের রাষ্ট্র হলো, যাদের নিজের ভূমিতে ইউরোপের অন্য এক জাতি এসে জবরদস্তি করে আরেকটি রাষ্ট্র বানিয়ে নিয়েছে, আর তারা নিজেদের ভূমিতে নিজেরাই ভূমিহীন হয়ে জীবন কাটাচ্ছে? এমনকি জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ফিলিস্তিন ভূমি থেকে একটু একটু করে দখল করে প্রতিদিন ইয়াহুদী সেটলমেন্ট তৈরি করে যাচ্ছে ইসরায়েল। এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনকে প্রকৃত অর্থে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ বলার সুযোগ নেই। তাই গত আট দশক ধরে ফিলিস্তিনীরা নিজেদের ন্যায্য ভূমিতে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এ লড়াইয়ে আরব জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার সংগঠন (PLO) যেমন আছে, আছে ইসলামী মূল্যবোধে দীক্ষিত হামাসও।
শুরু থেকে নিয়ে বর্তমান বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় বসা পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের নৈতিক অবস্থান খুব পরিষ্কার ছিল বলা যায়। কিন্তু সেই নৈতিক অবস্থানে উলটো স্রোত বইল, যখন সালমানের পুত্র মুহাম্মদ বিন সালমান (পশ্চিমা বিশ্বে MBS নামে পরিচিত) সৌদি আরবের ক্ষমতার কেন্দ্রে আরোহন করলেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, (এমবিএস) আরব মুলুকে পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে উপযোগী প্রোডাক্ট। ক্ষমতায় বসেই এমবিএস তার পিতাকে আক্ষরিক অর্থে ‘বুড়ো বাদশাহ’ বানিয়ে যেভাবে সৌদি আরবকে আধুনিকায়নের নামে বি-ইসলামীকরণ করে যাচ্ছেন, তা পৃথিবীর চোখে লুকানো কিছু নয়। সৌদির তথাকথিত আধুনিকায়নে এমবিএসের স্বপ্নের প্রকল্পের নাম ভিশন-২০৩০, যার দ্বারা তিনি তার দেশে একটি ‘প্রাণবন্ত সমাজ’, ‘সমৃদ্ধ অর্থনীতি’ এবং ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী জাতি’ বিনির্মাণ করতে চান। এসব বিলাসী শব্দগুচ্ছ আমার বানানো নয়। তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে আমি এই শব্দগুলো নিয়েছি। আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে Neom সিটির মতো অযৌক্তিক ও অসম্ভবপ্রায় প্রকল্প যেমন আছে, সাথে কিছু সামরিক প্রকল্পও আছে। রয়টার্সের ২০২৩ ও ২৪-এর দুটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এমবিএস আমেরিকার সাথে ন্যাটো-স্টাইলের একটি সামরিক চুক্তি করতে চান, যেন কেউ সৌদিতে আক্রমণ করলে এই চুক্তির আলোকে আমেরিকা সৌদির পক্ষ হয়ে যুদ্ধে নামে। আরেকটি হচ্ছে, এমবিএস সৌদি আরবে বেসামরিক পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু করার জন্য আমেরিকার সহায়তা চান। আমেরিকার সাথে তার এসব চুক্তির পেছনে মূল লক্ষ্য হচ্ছে সৌদিকে ইরানের সম্ভাব্য টার্গেট হওয়া থেকে রক্ষা করা। এমবিএসের এই ভয় কিছুটা যৌক্তিকও বটে। ইরান সুন্নীদের জন্য একটি পরীক্ষিত আপদ। সামান্য সুযোগ পেলে ইরান সুন্নী রাষ্ট্রগুলোতে কতটুকু বিশৃঙ্খলা ও রক্তপাত ঘটাতে পারে, সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননে তারা তা করে দেখিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের জন্য দরদী ইরান উম্মাহর সম্মিলিত সাফল্যের চেয়ে ‘শিয়া বলয়’ তৈরি করাকে সবসময়ই প্রাধান্য দিয়েছে।
এমবিএসের খায়েশ আমেরিকার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল না। আমেরিকা বরং একটি গড়পড়তা সামরিক চুক্তিতেই থেমে থাকতে চাইছিল। ওদিকে ইসরায়েলের সাথে এমবিএসের গোপন প্রেম চলছিল। কারণ সৌদির আধুনিকায়ন প্রকল্পে তিনি ইয়াহুদীদের বিনিয়োগ চান। এ অবস্থায় আমেরিকার জন্য সুযোগ আসলো নিরাপত্তা চুক্তি ও ভিশন-২০৩০ প্রকল্পে আমেরিকার বিনিয়োগের টোপ দেখিয়ে ইসরায়েলের সাথে সৌদির সম্পর্ক নরমালাইজ করার। শুরু হলো সৌদি-ইসরায়েল নরমালাইজেশন প্রক্রিয়া। এমবিএস যে বাধ্য হয়ে এটি করছিলেন তা নয়। তিনি আগে থেকেই এ স্বপ্ন বুনছিলেন। নরমালাইজেশন প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করার জন্য ডোনাল্ট ট্রাম্পের ইয়াহুদী জামাই জ্যারেড কুশনার নিয়মিত রিয়াদে আসা-যাওয়া শুরু করলেন। ট্রাম্পের পর বাইডেনের কাছেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। ২০২২ ও ২৩ সালে কয়েকটি ইয়াহুদী ডেলিগেশন সৌদি সফর করল। বুঝতে বাকি রইল না যে, হারামাইনের খাদিম দাবি করা সৌদ খান্দান উম্মাহর জঘন্যতম দুষমনকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে। The Times of Israel-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে সৌদি সরকারের আমন্ত্রণে ইসরায়েলী ব্যবসায়ী আভি জোরিশের নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি ইয়াহুদী প্রতিনিধিদল ইসরায়েলের বার্তা নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় গিয়েছিল। ফিরে এসে একজন বলেছিল, “It felt like we were engineering history.” Middle East Monitor-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ইয়াহুদী ব্যাংকার রিক সোফেরের নেতৃত্বে আরেকদল ইয়াহুদী মদীনা মুনাওয়ারায় গিয়েছিল। সৌদি-ইসরায়েল বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ তারা মদীনায় একটি খেজুর গাছ রোপণ করে বলেছিল, “১৪শ বছর আগে ইয়াহুদীরা এখানে শেষবার খেজুর গাছ রোপণ করেছিল। আজ আমরা একই কাজ আবার করলাম।” প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইয়াহুদীরা ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন নিয়ে এগুচ্ছে, তাতে মদীনাকেও তারা ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়।
প্রসঙ্গত এও বলে দেই, রাসূলুল্লাহ ﷺ জাযিরাতুল আরব থেকে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বিতাড়িত করার ইচ্ছাপোষণ করেছেন। এই ভূমি শুধু ইসলামের জন্য নির্ধারিত (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১৭৬৭)। আর ওরা ইয়াহুদীদেরকে মদীনা মুনাওয়ারাতে ডেকে এনেছে। রাসূলুল্লাহ ﷺ জাযিরাতুল আরব থেকে মুশরিকদের বের করার নির্দেশ দিয়েছেন (সহীহ বুখারী, হাদীস-৪৪৩১)। ওরা আবুধাবিতে মন্দির বানিয়ে আরবের যমিনে মূর্তিপূজা ফিরিয়ে এনেছে। আমিরাত, ওমান ও বাহরাইনে আগে থেকেই কিছু ছোট মন্দির ছিল, যেহেতু ওসব দেশে প্রচুর হিন্দু বাস করে। তবে ২০২৪ সালে ২৭ একর জায়গাজুড়ে আবুধাবিতে যে বিশাল মন্দির বানানো হয়েছে এবং হিন্দুত্ববাদের শিরোমণি নরেন্দ্র মোদিকে ডেকে এনে যে জাঁকজমকপূর্ণভাবে তা উদ্বোধন করা হয়েছে, তাতে বিশ্বাস হয় না, ওই ভূমিতে তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য সাহাবায়ে কিরাম একদা ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। আরবদের ‘আধুনিকায়ন’ এখানেই শেষ নয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, যেসব জায়গায় পূর্ববর্তী জাতির ওপর আল্লাহর আযাব এসেছে, ক্রন্দনরত অবস্থা ব্যতীত সেসব জায়গায় যেও না। হয়তো একই আযাব তোমাদের ওপরও আসতে পারে (সহীহ বুখারী, হাদীস-৪৩৩)। এরকম একটি জায়গা হচ্ছে হিজর, যা সৌদি আরবের আল-উলা শহরে অবস্থিত। সেখানে নবী সালিহ (আ.) এর কউমের ওপর আল্লাহর ভয়াবহ আযাব এসেছিল। তাবূক যুদ্ধে যাওয়ার সময় রাসূল ﷺ নিজের শির মুবারক চাদর দিয়ে ঢেকে ইস্তিগফার পড়তে পড়তে দ্রুত ওই জায়গা অতিক্রম করেছেন। সাহাবীদেরকে এক মুহূর্ত সেই এলাকায় থাকতে দেননি। সৌদির আধুনিকায়নের আলোকে আল-উলা এখন ট্যুরিস্ট স্পট। থিম পার্ক বানিয়ে আল-উলায় প্রতিনিয়ত উদোম কনসার্ট করা হচ্ছে৷ এ যেন রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ফরমানের সাথে টিটকারি করা!
ফিরে যাই আগের কথায়। ইসরায়েল ভাবছিল সৌদির সাথে সম্পর্ক নরমালাইজ করা শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু এমবিএসের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ বাকি ছিল। তা হলো, অন্য কোনো মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নরমালাইজ করলে কেউ খেয়ালই করবে না। কিন্তু হারামাইনের কারণে সৌদি আরব মুসলিম উম্মাহর ওপর এক ধরণের প্রচ্ছন্ন কর্তৃত্ব রাখে। এ অবস্থায় কোনো দৃশ্যমান বিনিময় ব্যতীত সৌদি যদি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়, তাহলে এমবিএসের নিজের দেশেই আক্রোশের দানা বাঁধবে। রাজা-বাদশাহরা বিক্রি হয়ে গেলেও সাধারণের মধ্যে তো ফিলিস্তিনের জন্য দরদ বাকি আছে। তাই স্বাধীন ফিলিস্তিন না হোক, অন্তত আল-আকসার ব্যাপারে ইসরায়েলকে একটি সিদ্ধান্তে নিয়ে আসতে এমবিএস আমেরিকার কাছে আকুতি করেন। যেন তিনি দেখাতে পারেন, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে তিনি কিছু একটা নিয়ে এসেছেন। ট্রাম্প-বাইডেন উভয়েই নেতানিয়াহুকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে রাজি করাতে পারেননি। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু স্বাধীন ফিলিস্তিন বা আল-আকসার প্রশ্নে কোনো কথা বলতেও রাজি নয়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় নেতানিয়াহু ভবিষ্যত মধ্যপ্রাচ্যের একটি মানচিত্র প্রদর্শন করে। সেই মানচিত্রে ফিলিস্তিনের চিহ্নটিও ছিল না। অর্থাৎ ইসরায়েলের পরিকল্পনা হচ্ছে, মুসলমানদেরকে যেভাবেই হোক বিদায় করে ফিলিস্তিনের পুরো ভূমি দখল করা। ওদিকে এমবিএস নেতানিয়াহুর এই ঔদ্ধত্যের পরও সম্পর্ক নরমালাইজ করতে পিছপা হচ্ছিলেন না। ঠিক এ সময়, ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর অবরুদ্ধ গাযা থেকে হামাসের মুক্তিযোদ্ধারা ইসরায়েলে অভিযান পরিচালনা করে। তাৎক্ষণিক এর দুটি ফলাফল দেখা যায়। প্রথমত, ইসরায়েল বহু আগেই গাযাকে মুসলিম-মুক্ত করার পরিকল্পনা করছিল, তবে সময় ও প্রস্তুতি নিয়ে। কিন্তু হামাসের অভিযানের জবাব দিতে গিয়ে রাজনৈতিক ও কূটনীতিকভাবে অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায়ই নেতানিয়াহুকে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নামতে হয়। দ্বিতীয়ত, গাযায় ইসরায়েলের হামলা শুরু হলে ১৪ অক্টোবর সৌদি-ইসরায়েল নরমালাইজেশন প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। তবে স্থগিত হলেও সেটি বাতিল হয়নি। গাযায় আগ্রাসন শুরুর পর বাইডেন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন সৌদি সফর করে এমবিএসকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন আরবের সাধারণ মানুষকে শান্ত রাখেন। এমবিএস তার তুরুপের তাস শাইখ আব্দুর রহমান আস-সুদাইসকে কাজে লাগান। Middle East Eye-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সুদাইস ফাতওয়া দেন, গাযা হচ্ছে একটি ফিতনা। এই ফিতনা যেন মুসলমানদেরকে উলুল আমরের (এমবিএস) আনুগত্য থেকে দূর না করে। গাযার ব্যাপারে সৌদির অবস্থান বুঝার জন্য এটিই যথেষ্ট যে, যেদিন গাযায় ইসরায়েলের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান হামলা চলছিল, সেই ২৮ অক্টোবর রিয়াদের একটি কনসার্টে উদ্দাম নেচে যাচ্ছিল পশ্চিমা এক নারী পপস্টার। প্রথমদিকে হারামাইনে গাযার জন্য দুআ করাও নিষিদ্ধ ছিল। পরে দুআ করার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে সেটি মূলত আকসার জন্য। হারামাইনের ইমামরা গাযার নামটি পর্যন্ত মুখে নেন না। এই হচ্ছে ৭ই অক্টোবরের আগে ও পরে আলে সৌদ, বিশেষত এমবিএসের কারনামা।
প্রশ্ন আসে, এই পুরো দৃশ্যকল্পে হামাসের কৃতিত্ব বা তুফানে আকসা অভিযানের যৌক্তিকতা কী? বেশ কয়টি জবাব আছে। প্রথমত, এর দ্বারা সৌদি-ইসরায়েল নরমালাইজেশন আপাতত স্থগিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল এর আগেও গাযায় আগ্রাসন চালিয়েছে। তবে এবারের গণহত্যার প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনের পক্ষে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তা এর আগে হয়নি। কে ভাবতে পেরেছিল, ইউরোপ-আমেরিকার শহরে-বন্দরে লাখ-লাখ মানুষ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নেমে আসবে? গাযা আগ্রাসন চলাকালে গত দু’বছরে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, মেক্সিকোসহ ১০টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফ্রান্স চলতি বছর স্বীকৃতি দেবে বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এতো বেশি রেজুলেশন উত্থাপিত হয়েছে যে, আমেরিকা ভেটো না দিলে এতদিনে ইসরায়েল একঘরে হয়ে যেত। International Court of Justice ইসরায়েলের দখলদারিমূলক কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলা চলছে। দুঃখের বিষয় হলো, কোনো আরব রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে মামলা করেনি। করেছে বহুদূরের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। হয়তো এসবের তেমন কোনো প্রভাব ইসরায়েলের ওপর পড়বে না। তবে অন্যায়ে ভরা এই বিশ্ব-বাস্তবতায় এটুকুও উল্লেখযোগ্য। তৃতীয়ত, এবারের আগ্রাসনে মুসলিম বিশ্বে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তাতে অন্তত বুঝা যায়, ফিলিস্তিন ও আল-আকসার প্রশ্নটি বিভক্ত এই উম্মাহকে আজও এক করার ক্ষমতা রাখে। ওরা ফিলিস্তিন ও আকসার প্রশ্নকে মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিন ও আকসা আমাদের প্রজন্ম পার করে পরের প্রজন্মের হৃদয়েও স্থান করে নিয়েছে। যে শিশু-কিশোররা আজ গাযার দৃশ্যগুলো দেখছে, তারা জীবনভর এটি ভুলবে না। পথ দেখালে এই শোক একদিন বিপুল শক্তিতে পরিণত হবে। এই সবকিছুর কৃতিত্ব ওই হামাস যোদ্ধাদের, যারা প্রাণের ওপর ঈমান ও ইযযতকে স্থান দিয়েছে। যারা বলেন, হামাস যুদ্ধে যাওয়ার আগে মুসলিম বিশ্বের অনুমতি নেয়নি, তারা এসি রুম, লম্বা বেতন, পডকাস্টের মাইক্রোফোন ও নিরাপদ মিম্বার ছেড়ে একদিনের জন্য গাযায় বাস করে দেখান। দীর্ঘ ১৬টি বছর ধরে অবরুদ্ধ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা জেলখানা এই গাযা। জীবনের নিরাপত্তা নেই, নেই নাগরিক সুবিধা। সেই আবদ্ধ ভূমিতে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য দেশে-দেশে ঘুরে অনুমতি নেবে?
চলমান গণহত্যায় গাযার ষাট হাজারের মতো মুসলমান শহীদ হয়েছেন। তবে হামাসের অভিযান না হলেও এই হত্যাকাণ্ড ঘটত, অন্য কোনো ছুতোয়। ইসরায়েল গাযাকে মুসলিম-মুক্ত করতে বহুদিন ধরে মরিয়া হয়ে আছে, আমেরিকাও তাতে রাজি। আমেরিকা মিশরকে চাপ দিচ্ছে গাযাবাসীকে গ্রহণ করার জন্য, যেভাবে জর্ডান পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনীদের একটি বিশাল অংশকে গ্রহণ করেছে৷ ইসরায়েল চাচ্ছিল সময় ও প্রস্তুতি নিয়ে গাযায় ধীরে ধীরে হামলা করতে। হামলায় কিছু মানুষ মরল, বাকিদেরকে মিশরের সিনাই উপত্যকায় ঠেলে দেওয়া গেল। যদি এরকম না করে সময় নিয়ে তা করতে পারত, তবে বিশ্বজুড়ে এতটা হাউকাউ হতো না। কিন্তু হামাস সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে।
আমি গাযাবাসীর শাহাদাতকে আল্লাহ তাআলার এক মহাপরিকল্পনার অংশ মনে করি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মুসলমানদের মধ্যে তিনটি ভাগ হয়ে যাবে। একভাগ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করবে এবং তারা আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ শহীদ বলে গণ্য হবে। আরেকভাগ যুদ্ধ ছেড়ে পালিয়ে যাবে, যাদের তাওবাকে আল্লাহ কখনও কবুল করবেন না। আরেকভাগ ইমাম মাহদীর সাথে টিকে রইবে এবং শেষপর্যন্ত বিজয়ী হয়ে ঘরে ফিরবে (সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৮৯৭)। হয়তো মাহদীর আগমণের পূর্বেই এই বাছাইপর্ব শুরু হয়ে গেছে। উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে কিছু পাক রূহকে তিনি শহীদ হিসেবে কবুল করছেন। যারা জীবিত আছে, তাদের মধ্যেও দুটি ভাগ দেখা যাচ্ছে। কেউ তার সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে আওয়াজ তুলে, কলম চালিয়ে, সাহায্য পাঠিয়ে, যালিমের পণ্য বয়কট করে মুমিনের কাতারে টিকে থাকতে চাইছে। আর যারা শুধু কূটনীতিক চেষ্টার দ্বারাই মাযলুমকে রক্ষা করতে পারত, তারা ঠুনকো দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য বোবা শয়তান হয়ে পলায়নকারীদের কাতারে শামিল হচ্ছে। অবশ্য এটি আমার নিজের চিন্তা। কিন্তু এটি তো সত্য যে, গাযা এই উম্মাহর সম্মিলিত ব্যর্থতা এবং সম্ভাব্য ঐক্যের প্রতীক হয়ে গেছে। হতে পারে, বুকভাঙা এই মুহূর্তগুলো আমাদের ভবিষ্যত গড়ে দিচ্ছে।