কয়েক বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে শুনা আকসা প্রাঙ্গণে এক ফিলিস্তিনী বৃদ্ধের হৃদয় নিংড়ানো কিছু কথা আজকাল খুব কানে ভাসে। তিনি বলেছিলেন, ‘হে মুসলিম যুবক! একথা কোন দিন ভুলে যেয়োনা যে আকসা তোমাকে প্রতিনিয়ত ডাকে। তারা চায় তুমি এ ডাক না শোনো, তারা চায় তুমি ভুলে যাও। তোমাকে আর তোমার শাসকদের আটকে রাখতে দুনিয়ার মায়াজাল বিছানোর সকল কাজই তারা শেষ করেছে। তবু তোমাকে বলি, তুমি একবার আসো, আকসায় সিজদা দেওয়ার তৃপ্তি নিয়ে যাও। যদি ভিতরে আসতে না দেয় অন্তত আম্মানের কোন অট্টালিকা থেকে, মৃত সাগরের ওপার থেকে, জর্ডান নদীর তীর থেকে তুমি বুকভরা নিঃশ্বাসের সাথে আকসার ঘ্রাণ নিয়ো। যদি তাও না পারো তবে তোমার ভোগ বিলাসের মাঝে অন্তত আকসার কথা স্মরণ রেখো। যেদিন তুমি আকসার কথা বিস্মৃত হবে সেদিন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।’
আল আকসার প্রাঙ্গণে নামাজ আদায়ের স্বপ্ন এখন বহির্বিশ্বের কোন মুসলিম আদৌ দেখে কি না তা গবেষণার বিষয়। জর্ডান থেকে ফিলিস্তিনের ঘ্রাণ নেওয়ার মতো বিলাসী ঈমানদার মুসলমানও ফিলিস্তিনের বাইরে কতোজন অবিশিষ্ট আছেন তাও নিশ্চিত নয়। তবে একটি বিষয়ে ফিলিস্তিনিরা নিশ্চিত ছিলেন- আর তা হলো পৃথিবীর সকল প্রান্তে তাদের ভাইয়েরা আক্বসার কথা স্মরণ করেন, তাদের কথা স্মরণ করেন।
তাদের এই ভ্রম ভাঙে গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবশনে যখন দখলদার ইসরায়েলী প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু পুরো ফিলিস্তিনের মানচিত্রকে ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করে প্রদর্শন করে। শুধু আকসা নয় বরং এর আশেপাশের সকল জনপদকে যখন দখলদারদের নেতা তাদের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করে সেই বিশ্বমঞ্চে সকল বিশ্বনেতাই উপস্থিত ছিলেন। কেউ কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ করেনি, সারা দুনিয়ার মুসলমান নেতানিয়াহুর এই ঔদ্ধত্য দেখেছে কিন্তু কারোর উপরই কোন প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় নি। ঠিক এই সময়ে এসে ফিলিস্তিনিরা বুঝে গিয়েছিলেন যে আসলে তাদের সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। ৭ই অক্টোবর গাযা উপত্যকা থেকে শুরু হওয়া তুফান আকসা ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলনের নিজে থেকে শুরু করা যুদ্ধ হিসেবেই দেখছেন অনেকে। আমরা সবাই-ই জানি অবরোধ যুদ্ধেরই একটি অংশ আর গাযা উপত্যকায় বছরের পর বছর ধরে দখলদারদের অবরোধ চলমান রয়েছে। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় গাযা উপত্যকা থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিন (ইসরায়েল)-এর দিকে কোন রকেট ছোড়া হোক বা না হোক এখানে যুদ্ধাবস্থা আগে থেকেই বিদ্যমান। একথা বুঝার পরও ‘উলামাদের’ কোন অংশ যখন হামাসের হামলার সমালোচনা করেন তখন একজন সাধারণ মুসলমান হিসাবে আমার হৃদয় চুরমার হয়ে যায়। আমি জানি না আবু উবাইদা, ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহইয়া সিনাওয়ার এবং তাদের অনুসারীরা নিজেদের ভাইদের থেকে এসব কথা কীভাবে সহ্য করেন!
গাযায় বর্তমান সহিংসতা হামাসের আক্রমণের (তুফান আকসা) মাধ্যমেই যেহেতু সূচনা হয়েছে সুতরাং অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে হামাসের সামরিক বা রাজনৈতিক শাখা তো জানতো এরকম হামলাকে জায়নিস্টরা একটি গণহত্যার হাতিয়ার হিসাবে নিতে পারে, তারপরও কেন হামাস এই ঝুঁকি নিলো। এতো বিধ্বংসী অবস্থায় পড়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও হামাসের এই আক্রমণ আমাদেরকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে ফিলিস্তিনের মুজাহিদরা তার জীবন, ইযযত, সম্পদ সকল কিছুর বিনিময়ে হলেও আকসার দাবি অক্ষয় রাখতে চান, স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগ্রত রাখতে চান যা আরবদের অতি সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে ফিকে হওয়া শুরু করেছিলো। ২০২০ সালে আব্রাহাম একর্ডের মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে একে একে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান, মরক্কো ইত্যাদি আরব মুসলিম রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এ ইংগিতই দিচ্ছিলো যে এসব রাষ্ট্র নিজেদের সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় অথবা ব্যক্তি স্বার্থে ফিলিস্তিনের অজস্র আরব মুসলিমের স্বাধীনতা বিক্রি করে দিচ্ছে, আল আকসার স্বত্ত্ব বিসর্জন দিচ্ছে। সর্বশেষ নেতানিয়াহু’র ভাষণ থেকে এও স্পষ্ট হয় সৌদি আরবও ইসরায়েলের সাথে ‘ফিলিস্তিনের বিনিময়ে শান্তি’ পদ্ধতি অনুসরণ করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে এগুচ্ছে। আকসা যে আরবদের কাছে বিনিময়যোগ্য সম্পদে পরিণত হয়েছে তা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিলো ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেরুযালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি এবং সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের নির্দেশনার মাধ্যমে। এই নির্দেশের পরেও কোন আরব রাষ্ট্রের সাথেই যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের তেমন কোন দৃশ্যমান টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায়নি। গত এক শতাব্দি ধরে আরবদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বা পশ্চিমাদের সম্পর্কের প্রধান নিয়ামক হিসাবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে মোটাদাগে চিহ্নিত করা যায়। গুপ্ত অথবা ব্যক্ত আরো অনেক নিয়ামক থাকলেও অন্তত আরব রাষ্ট্রনেতাদের হাবভাবে, কথাবার্তায় তারা জেরুযালেম তথা ফিলিস্তিনের বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দেন বলেই সবার মনে হতো। তবে গত এক দশকে ফিলিস্তিনের স্বার্থ বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের পরেও আরবদের নিশ্চুপ ভূমিকা সবার কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেয় যে আরব পররাষ্ট্রনীতিতে জেরুযালেম এখন খুবই গৌন উপাদান অথবা আদতে কোন উপাদানই নয়। এমন পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের মুজাহিদদের পক্ষ থেকে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়া, আরবদের ভণ্ডামি প্রমাণ করা এবং আকসার ভালোবাসা উম্মাহর মাঝে পুনর্জাগরণের জন্য এবারের তোফান আকসার কোন বিকল্প ছিলো বলে মনে হয় না।
অনেক মুসলিম তাত্ত্বিকের মুখে এ বয়ানও পাওয়া যায় যে, যেহেতু ইসরায়েলীরা সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে গেছে সুতরাং এখন অস্ত্র ত্যাগ করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের অধিকার আদায়ে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের এসব বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে মুসলমানদের দখলে থাকা ফিলিস্তিনের দুই অংশে তথা গাযা এবং পশ্চিম তীরের মধ্যে ইসরায়েলী দখলদারিত্বের প্রায় পুরোটাই হয়েছে প্যালস্টাইন অথরিটির নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম তীরে। পশ্চিম তীরের ক্ষমতায় যারা আছে তারা তো ১৯৯৩ সাল থেকে অস্ত্র ত্যাগ করে ইসরায়েলের সমর্থনেই ক্ষমতায় আছে। তাহলে এখানেই কেন সব দখলদারিত্ব চলে? এর উত্তর খুব সহজ। ১৯৯৩ এর পূর্বে ফিলিস্তিনের প্রতি ইঞ্চি ভূমি দখলের জন্য ইসরায়েলীদের যুদ্ধ করতে হয়েছে। এখন তারা তা যখন ইচ্ছা দখল করতে পারে। অপরদিকে হামাসের ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’ নীতির ফলে বছরের পর বছর অবরোধ করে রেখেও গাযা উপত্যকায় ভূমি দস্যুতার সাহস পায়নি ইসরায়েল। ইতিহাস সাক্ষী, বনী ইসরায়েলীরা আদিকাল থেকেই শক্তের ভক্ত, নরমের যম।
এবারের এ যুদ্ধ থেকে হামাস তথা গাযাবাসীর লাভ বা লোকসান কী হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে এটুক নিশ্চিতভাবে বলা যায় মুসলমানের হৃদয়ে আবার ফিলিস্তিনের নামাঙ্কিত করার কাজে হামাস যুদ্ধারা শতভাগ সফল হয়েছেন, বিশ্বরাজনীতিতে ফিলিস্তিনকে আবারো প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন, আরবদের তথা মুসলমানদের কাছে তাদের নেতাদের ভণ্ডামি আবার প্রমাণ করেছেন। তবে আরব-ইসরায়েল নরমালাইজেশনের যে দূষিত বাতাস বইছিলো তা বন্ধ হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত বলা যাবে না, কারণ আরব শাসকরা ঠিক কোন স্তরের চাটুকারে পরিণত হয়েছে তার কোন সঠিক মানদণ্ড আমাদের হাতে নেই। তারপরও আশা করা যায় এবার ইসরায়েলের গাযা জেনোসাইডের পরে চক্ষুলজ্জার জন্য হলেও আগামী কয়েক বছর নরমালাইজেশনের এই প্রক্রিয়া স্থগিত থাকতে পারে। এসব কিছুর বাইরে এবারের আকসা তুফানের সবচেয়ে বড় সফলতা মনে হয় এটাই যে এবারের যুদ্ধের মাধ্যমে ইসরায়েলে বসবাসরত সেটলারদের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে- তেল আবিব, গাযা সংলগ্ন গিলাফ, আসকালান, জেরুযালেম তথা অধিকৃত ফিলিস্তিনের যেখানেই থাকো তোমরা নিজেকে নিরাপদ ভেবো না। এই ভূখণ্ডে থাকতে হলে সর্বদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থেকো। এই বার্তার ফলে ইসরায়েলীদের মধ্যে রিভার্স ইমিগ্রেশনের প্রবণতা বাড়ছে বলে বিভিন্ন রিপোর্টে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ অনেক ইসরায়েলী এখন অন্য ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রতে ফিরে যাচ্ছে। এভাবেও আল্লাহ একদিন ফিলিস্তিনের বিজয় দান করতে পারেন।
তুফান আকসার ফলে গাযা উপত্যকা তথ্য ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষকে যে কুরবানী দিতে হয়েছে তা প্রত্যক্ষ করে যেকোন হৃদয়বান মানুষেরই চোখ ভিজে যাবে নিশ্চিত। তবে আমার মনে হয় তাদের জন্য দুঃখ নয় বরং গর্ব করা উচিত। এই উপত্যকায় জীবিত অথবা শহীদ কোন মা, শিশু, বয়স্ক লোকই সাধারণ মানুষ নন বরং আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত দ্বীনের মুজাহিদ। এজন্য সন্তান হারানো মায়ের মুখে আমরা শুনি ‘মুজাহিদরা যতক্ষণ যুদ্ধের মাঠে আছে ততক্ষণ আমার কোন কষ্ট নেই। তারা ভালো থাকলে আমিও ভালো আছি।’ এজন্য আমরা দেখি মাথার উপর দিয়ে ইসরায়েলী বোমারু বিমানকে উপেক্ষা করে খোলা আকাশের মাঝে তারা সকালের নাশতা করেন, হামাসের রকেট ছুঁড়াতে তাকবির দিয়ে ওঠেন। যুদ্ধে বিধ্বস্ত গাযার কোন শিশুকে দেখে আপনি বা আমি যখন শিউরে উঠি তখন সে শিশুর মা তার বাকি সন্তানদেরও আকসার জন্য কবূল করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। এই মানসিকতাই দখলদারদের বিরুদ্ধে শতবছর ধরে ফিলিস্তিনকে টিকিয়ে রেখেছে।
ফিলিস্তিন সংকটের শুরু থেকেই জায়নবাদীরা মুসলমানদের থেকে সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ ছিলো, এখনো আছে। প্রথম থেকেই মুসলমানদের কাছে এই যুদ্ধ ছিলো মানসিক শক্তি প্রদর্শনের যুদ্ধ। গত ৭৫ বছরে ভোগে মত্ত আরবরা এ শক্তি তিলে তিলে বিসর্জন দিয়ে এখন গোলামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু গাযার মুসলমানরা এখনো মানসিক শক্তিতে ইসরায়েলীদের প্রতিনিয়ত হারিয়ে দেন। এজন্য কয়েকটা রকেটের বিস্ফোরণ দেখেই মাত্র দুইশত ইসরায়েলী বন্দির বিনিময়ে প্রায় আট হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে ইসরায়েলে মিছিল হয়, কিন্তু টানা ত্রিশ দিন দুটি পারমাণবিক বোমার সমান আঘাতে লণ্ডভণ্ড হলেও কোন গাযাবাসী থেকে এ দাবি উঠতে দেখিনা যে আমাদের জীবন বাঁচাতে দুইশত ইসরায়েলীকে ছেড়ে দাও। তাদের এই ঈমানী জযবা দেখেই বিশ্বাস হয় ইসরায়েলী দখলদারদের বিরুদ্ধে ইন্ডগেইমের সূচনা এইসব বীর মায়েদের বীর সন্তানরাই করবেন অথবা হয়তো ইন্ডগেমের সূচনা হয়েই গেছে। তাই হামাসের স্ট্রাটেজির সমালোচনা করে যারা গাযার সিভিলিয়ানদের জন্য মায়াকান্না করেন তাদের বলি, আপনি নিজে এবং আপনি যাদের ইক্তিদা করেন তারা বহু আগেই এই মানসিক যুদ্ধ হেরে বসে আছেন, দয়া করে এখন তাদেরকেও হারতে বাধ্য করবেন না। পারলে হামাসকে নিজেদের অংশ বলে বুক ফুলিয়ে বলুন, না হলে চুপ করে থাকুন। সাধারণ মানুষের জন্য মায়াকান্না করে স্বাধীনতাকামী মুজাহিদদের সমালোচনা করা ভণ্ডামি, মুনাফিকী। আল্লাহ আমাদের এই ভণ্ডামি থেকে রক্ষা করুন, জায়নিস্টদের উপর ঈমানদারদের বিজয়ী করুন, আকসার সৌরভ সারা বিশ্বের মুসলমানের জন্য নসীব করুন।