ইতিহাসের পাতা পর্যালোচনা
জেরুযালেম পুরাতন শহরের লাগোয়া ছোট একটি পাহাড়, নাম মাউন্ট যিওন। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের দ্বারা জেরুযালেম থেকে বিতাড়িত এবং ইউরোপে বসবাসরত ইয়াহুদীরা এই পাহাড়কে তাদের ঘরে প্রত্যায়নের প্রতীক মনে করে। এই পাহাড়ের নামানুসারে থিওডর হার্ৎজেল নামক অস্ট্রিয়ার এক ইয়াহুদী নেতা ১৮৯৭ সালে Zionist Movement নামে একটি আন্দোলন শুরু করে, যার প্রতিপাদ্য ছিল ইউরোপে বসবাসরত ইয়াহুদীদের জন্য জেরুযালেমকে কেন্দ্র করে একটি ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। জায়োনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত ইয়াহুদীরা জাতিগতভাবে আশকেনাজি এবং ধর্মীয় দিক থেকে সেক্যুলার। ইয়াহুদীদের মূল আধ্যাত্মিক ধারার সাথে এদের মিল নেই। ইয়াহুদীদের দাবি হচ্ছে, জেরুযালেমসহ নীল থেকে ফোরাত পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গা ইবরাহীম (আ.) এর বংশধরদের জন্য খোদাপ্রদত্ত আবাসভূমি। সামনে এগুনোর পূর্বে এই দাবিকে পর্যালোচনা করে যাচ্ছি। কেন করছি, তার খোলাসা পরে হবে।
প্রথমত, যে ভূমিকে ইয়াহুদীরা ইবরাহীমের সন্তানদের ভূমি বলে দাবি করে, যদি তা সত্য হয়, তবে তাতে কেবল ইবরাহীম (আ.) এর ২য় পুত্র ইসহাক (আ.) এর বংশধর তথা বনী ইসরাঈলের একক অধিকার নয়; ১ম পুত্র ইসমাঈল (আ.) এর বংশধর তথা আরবদেরও সমান অধিকার রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আল্লাহ বনী ইসরাঈলের জন্য যে আবাসভূমির ওয়াদা দিয়েছিলেন, এর হকদার হতে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। মিশর থেকে ফেরার পর মুসা (আ.) তাদেরকে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে বললে তারা সাফ অস্বীকার করেছিল। শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তখন তাদের জন্য পবিত্র ভূমি হারাম করে দিয়েছিলেন। পরে আল্লাহ বাদশাহ তালুত, নবী দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.) এর হাতে ক্ষমতা দান করেন। এরপর বনী ইসরাঈল আবার দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে পড়ে। ফলে ৫৮৬-৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনিয় সম্রাট নেবুচাদনেজারের হাতে আল্লাহ তাদেরকে আযাব দিয়েছিলেন। সেবার ৬ লক্ষ ইয়াহুদী হত্যা ও বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছিল। এরপর চূড়ান্ত সুযোগ হিসেবে আল্লাহ তাদের কাছে বনী ইসরাঈলের শেষ রাসূল ঈসা (আ.)-কে প্রেরণ করেন। তারা ঈসা (আ.)-কে রাসূল তো বিশ্বাস করেনি; উলটো তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। ফলে তাদের ওপর আরেক আযাব আপতিত হয়। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমানদের হামলায় ইয়াহুদীরা পবিত্র ভূমি থেকে চিরতরে বিতাড়িত হয়েছিল। তৃতীয়ত, আল্লাহ পবিত্র ভূমিকে দিয়েছিলেন বনী ইসরাঈলের জন্য; ইয়াহুদীদের জন্য নয়। বনী ইসরাঈল ছিল ওই সময়কার মুসলিম উম্মাহ। কিন্তু তারা আল্লাহর সাথে শিরক করেছে, বাছুরের পূজায় লিপ্ত হয়েছে, নবীদেরকে হত্যা করেছে এবং ইয়াকুব (আ.) এর পুত্র ইয়াহুদার নামে ইয়াহুদী, ধর্ম (Judaism) বানিয়ে আল্লাহর কিতাব তাওরাতকে বিকৃত করেছে। অর্থাৎ, তৎকালীন বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ যে ওয়াদা করেছিলেন, আজকের ইউরোপীয় সেক্যুলার ইয়াহুদীরা কোনোভাবেই সেই ওয়াদার হকদার নয়। আজ তারা ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করেছে সত্য, কিন্তু তা খোদা প্রদত্ত ওয়াদা হিসেবে নয়; বরং ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি হিসেবে। বলা যায়, ইসরায়েল নামক অবৈধ রাষ্ট্রটি ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতার শেষ চিহ্ন।
চলমান আগ্রাসন ও হামাসের ভূমিকা
৭ই অক্টোবর গাযার ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ইসরায়েলে রকেট হামলা করেছিল এবং সেটিই চলমান ইসরায়েলী আগ্রাসনের কারণ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। পশ্চিমা মিডিয়ার দেখাদেখি অনেক মুসলমানও এ ব্যাপারে সন্দিহান যে, হামাস কেন প্রথমে হামলা করেছিল! আসলে, একটি ঘটনাকে এর পূর্বাপর প্রেক্ষাপট সামনে নিয়ে মূল্যায়ন করতে হয়। সীরাতের পাঠকরা জানেন যে, বদর যুদ্ধ মক্কার কাফিররা শুরু করেনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে শুরু করেছিলেন। মদীনায় হিজরতের ছয় মাস পর থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো নিজে, কখনো সাহাবা পাঠিয়ে মক্কাবাসীর ব্যবসায়িক পথগুলো অবরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন। সাহাবীরা বুআস, আবওয়া, যুল উশাইরা ও ওয়াদিয়ে নাখলা নামক এলাকাতে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। এসব অভিযান কুরাইশদের উৎকণ্ঠিত করেছিল এবং বদর যুদ্ধে আসতে বাধ্য করেছিল। যদি প্রশ্ন আসে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটি কেন করেছিলেন, তবে তার আগে এই প্রশ্ন করতে হবে যে, মক্কার মুহাজিরদেরকে মক্কা ছেড়ে মদীনায় আসতে হয়েছিল কেন? কেন শহীদ করা হয়েছিল সুমাইয়া ও ইয়াসিরকে? কেন রক্ত ঝরেছিল আম্মার, বিলাল, খাব্বাব, ইবন মাসউদের? কেন মুসলমানদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে হয়েছিল? কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, বাধ্য করা হয়েছিল মক্কা ত্যাগ করতে? কেন সাহাবীদের সহায়-সম্পত্তি কেড়ে রেখেছিল মক্কাবাসী? মক্কার ১৩ বছরের ওই প্রেক্ষাপটকে বাদ দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। একইভাবে, হামাস কেন হামলা করেছে, এই প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য প্রথমে খুঁজতে হবে, কেন ফিলিস্তিনের বাসিন্দাদেরকে ৭৫ বছর ধরে নিজদেশে পরবাসী করে রাখা হয়েছে? কোন অধিকারে ব্রিটেন ফিলিস্তিনী মুসলমানদের জমি ইউরোপের ইয়াহুদীদেরকে দিয়ে দিয়েছিল? কোন অধিকারে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ওপর ইয়াহুদীদের জবরদখলকে ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল? কেন প্রতিনিয়ত হত্যা করা হচ্ছে শত শত ফিলিস্তিনীকে? ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর গণহত্যার বিরুদ্ধে মানবজাতি যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, মুসলমানদের বেলায় তা কেন ভুলে গেল? কেন পশ্চিম তীরে ইয়াহুদী বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে? ১৬টি বছর ধরে গাজা কেন অবরুদ্ধ? প্রকৃতপক্ষে, War এবং Battle এক জিনিস নয়। Battle একদিনে বা একবারে হয়। যেমন, বদর যুদ্ধ হয়েছিল ২য় হিজরীর ১৭ রামাদান। কিন্তু কুরাইশ ও মুসলমানদের মধ্যে War বা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল এর আগ থেকে এবং সেই যুদ্ধাবস্থা শুরু করেছিল মক্কাবাসী। এভাবে গাজায় চলমান Battle শুরু হয়েছে ৭ অক্টোবর। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে ইয়াহুদীদের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে গত শতকের ৩০ এর দশক থেকে এবং এই যুদ্ধাবস্থা শুরু করেছে ব্রিটিশ ও জায়োনিস্টরা। প্রায় এক শতাব্দী ধরে চলমান অনাচার ও আরব বিশ্বের শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে আজ হামাসের এই প্রতিরোধকে আপনারা কীভাবে দোষারোপ করবেন? বহু আগ থেকেই আরব নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিনকে বিকিয়ে দিয়ে দখলদারদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত। ২০২০ সালে আরব আমিরাত ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করল। তাতে সঙ্গী হলো বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। বিনিময়ে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে ইয়াহুদী বসতি নির্মাণ বন্ধ করবে বললেও আজ পর্যন্ত তা করেনি। এমন নয় যে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে পছন্দ করে। বরং এখানে সবার ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছে। শোনা যাচ্ছিল, ফিলিস্তিন নিয়েও দর কষাকষি হচ্ছে। যদিও এটি স্পষ্ট যে, বিন সালমান ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিনিময়ে আমেরিকার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি ও বেসামরিক নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের অনুমতি চাচ্ছেন। তার কাছে আকসা কিংবা ফিলিস্তিন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু আলোচনা চলছিল। অথচ চলতি বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে দেওয়া বক্তৃতায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নতুন মধ্যপ্রাচ্যের এক মানচিত্র প্রদর্শন করেন, যেখানে ফিলিস্তিনের অস্তিত্বই নেই! আবার জাতিসংঘ সম্মেলন চলাকালে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান প্রথমবারের মতো নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠক করেন। এতে নতুন সম্পর্কের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জর্ডান ও মিশর বহু আগে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তাই ফিলিস্তিনের পক্ষে কাতারের অনস্বীকার্য অবদান থাকলেও ইরান ও লেবাননের হিজবুল্লাহ ছাড়া ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়ার আগ্রহ কেউ দেখাচ্ছে না। এবার গাযার অবস্থা চিন্তা করুন। মাত্র সাড়ে তিনশ কিলোমিটারের এই জনপদে ২৩ লাখ মানুষের বসবাস, যার অর্ধেকই শিশু। মিশরের সাথে লাগোয়া রাফাহ সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাযাবাসী খাদ্য, পানীয়, বিদ্যুৎ সবকিছুর জন্য ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। ২০০৭ থেকে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল। পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। একদিকে পশ্চিম তীরের ক্ষমতাসীন সেক্যুলার দল ফাতাহ ফিলিস্তিন রক্ষায় কিছুই করতে পারছে না। অপরদিকে ইসরায়েল গাজাকে নিশ্চিহ্ন করতে চাইছে। হামাস এবার কী করবে? চোখের সামনে অস্তিত্ব বিলীন হতে দেখবে? মাসজিদুল আকসার অধিকার ছেড়ে দেবে? অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুসংবাদ দিয়েছেন, “আমার উম্মাতের একটি দল সর্বদা হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। ওরা শত্রুর জন্য হবে অপ্রতিরোধ্য। বিরোধিতাকারীদের বিরোধিতা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি আল্লাহর আদেশ (ঈসা আ. এর অবতরণ) হওয়া পর্যন্ত তারা এই অবস্থায় থাকবে। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন, ওরা কোথায় থাকবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বাইতুল মাকদিসে এবং এর আশেপাশে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-২২৩১৯)
আধুনিক সমররীতি
আজকের যুগে যেকোন যুদ্ধ চারটি স্তরে সংঘটিত হয়। প্রথম ও সবচেয়ে ভাসমান স্তর হচ্ছে ন্যারেটিভ তথা বয়ানের যুদ্ধ। এই স্তরে যুদ্ধরত উভয় পক্ষ যার যার ন্যারেটিভ তুলে ধরে এবং বিরোধীপক্ষের ন্যারেটিভ খণ্ডন করে। একে Psychological warfare বা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও বলা হয়। এ কাজটি মূলত মিডিয়ার মাধ্যমে হয় এবং এর দ্বারা জনমত গঠন ও বৈশ্বিক সমর্থন আদায় করা হয়। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে অস্ত্রের যুদ্ধ, যেখানে সৈন্যরা অস্ত্র হাতে লড়াই করে। তৃতীয় স্তর হচ্ছে রাজনৈতিক যুদ্ধ, যা উভয় পক্ষের নেতারা আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং দ্বি বা বহুপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে করে থাকেন। মাঠের যুদ্ধ কোনদিকে যাবে, তা নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক যুদ্ধের মাধ্যমে। চতুর্থ ও সবচেয়ে গভীর স্তর হচ্ছে অর্থের যুদ্ধ। প্রতিটি যুদ্ধে এক বা একাধিক পক্ষের কিছু আর্থিক স্বার্থ ও জোর থাকে, যা যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখে।
এতদিন সবগুলো স্তরে জায়োনিস্টদের একক কর্তৃত্ব ছিল। ইসরায়েলের ওপর যত আন্তর্জাতিক চাপ আসুক না কেন, আমেরিকা সব সময় ইসরায়েলের শক অবজারভার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সব চাপ প্রশমিত করেছে। এর কারণ জায়োনিস্টদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যা দিয়ে তারা আমেরিকার পুরো অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে৷ এমনকি ইসরায়েল প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের সহায়তার পেছনেও অর্থের ভূমিকা ছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ফতুর হয়ে যাওয়া ব্রিটেনকে জায়োনিস্টরা এত টাকা দিয়েছিল যে, ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেন ফিলিস্তিনে ইয়াহুদী বসতির অনুমতি দিয়েছে। এটিই অর্থের যুদ্ধ এবং এই স্তরে জায়োনিস্টরা সব সময় জয়লাভ করে আসছে। অথচ এই স্তরে মুসলমানদের জয় অসম্ভব ছিল না। আরব বিশ্বের কাছে যে তেল আছে, তা দিয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে ইউরোপ-আমেরিকার ওপর চাপ তৈরি করতে পারত। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ১৯৭৩ সালের তেল নিষেধাজ্ঞা। সৌদি বাদশা ফয়সাল ১৯৭৩ সালে ঘোষণা দেন, ইসরায়েলকে সমর্থনকারী দেশগুলোতে আরবের কোনো দেশ (OPEC) তেল রপ্তানি করবে না। মূহুর্তের মধ্যে তেলের দাম ৩০০ গুণ বেড়ে যায় এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে ধ্বস নামে। এক বছর আলোচনার পর তা উঠিয়ে নেওয়া হয়। যদিও এর ফলে পরবর্তীতে বাদশা ফয়সালকে তাঁর প্রাণ খোয়াতে হয়েছিল, কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা আরবদের অর্থের সক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছিল। এর পরে এটি আর কখনও হয়নি। তৃতীয় স্তর তথা রাজনৈতিক যুদ্ধে জায়োনিস্টদের ব্যাকআপ হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ ও জাতিসংঘ। আজ পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি রেজ্যুলিউশনও পাশ হয়নি কেবল আমেরিকার ভেটোর জন্য। চলমান যুদ্ধে জাতিসংঘে যতবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠেছে, ততবার আমেরিকা ভেটো দিয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অগণিত অভিযোগ থাকার পরও তাদেরকে কখনও আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া লাগেনি। অথচ মুসলিম বিশ্বের হাতে OIC ও আরব লীগের মতো সংস্থা ছিল। OIC সদস্যদের শক্ত অবস্থান ফিলিস্তিনের পক্ষে জোরদার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু অকর্মণ্যতার অদ্বিতীয় নযীর সৃষ্টি করে OIC জীবিত অবস্থায়ই একটি ‘মরহুম’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরদোয়ানের তুর্কির ওপর মুসলমানদের যে ভরসা ছিল, তাও কেবল হাকডাকের মাঝে সীমিত হয়ে গেছে। অথচ এটি তুর্কির জন্য ইসরায়েলের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মোক্ষম সুযোগ ছিল। দ্বিতীয় স্তর তথা অস্ত্রের যুদ্ধে ইসরায়েল বরাবরই এগিয়ে। কারণ তাদের উদ্ভাবনী মানসিকতা ও মার্কিন সহায়তা। আরবদের মতো ইসরায়েল কেবল মার্কিন অস্ত্রের ওপর ভরসা না করে নিজেরাই পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী বিমান বাহিনী ও পারমাণবিক অস্ত্র গড়ে তুলেছে। সেইসাথে আমেরিকা প্রতিবছর ইসরায়েলকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে (CRS Report 2022)। অথচ মুসলিম বিশ্বও অস্ত্রের দিক থেকে দুর্বল নয়। কিন্তু এক ইরান ছাড়া ফিলিস্তিনে অস্ত্র সহায়তা দিতে কারও মধ্যে গরজ দেখা যায় না। এবার আসি প্রথম স্তর তথা ন্যারেটিভ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে। এই স্তরেও জায়োনিস্টদের একক আধিপত্য ছিল। পশ্চিমা মিডিয়া বিবেকের শেষটুকু বিক্রি করে অন্ধের মতো জায়োনিস্টদের মাউথপিস হিসেবে কাজ করছে। যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ঘৃণ্যতম বর্ণবাদী (Apartheid) আচরণ করে যাওয়ার পরও পশ্চিমা মিডিয়া একবারও ইসরায়েলের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ বা বর্ণবাদ শব্দের প্রয়োগ করে না। ইউক্রেনের লোকেরা রাশিয়ার হামলা প্রতিহত করলে তারা বীর, আর ফিলিস্তিনীরা ইসরায়েলের হামলা প্রতিহত করলে তারা হয় ‘সন্ত্রাসী’। খেয়াল করে দেখবেন, এবারের আগ্রাসনকে তারা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ না বলে ‘হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ’ বলছে। কারণ ফিলিস্তিনে অনেক সেক্যুলার, বাম ও গণতান্ত্রিক ধারার সংগঠন আছে। এরা যখন ‘ফিলিস্তিন’ বলে, তখন একটি ‘সেক্যুলার আরব জাতীয়তাবাদী’ রাষ্ট্রের ছবি ফুটে উঠে। এদের লড়াইকে ‘জাতীয়তাবাদের লড়াই’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যেভাবে মিশর ও সিরিয়া এক সময় আরব জাতীয়তাবাদের স্লোগান দিয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়েছিল। তাই জায়োনিস্টরা এদেরকে সন্ত্রাসী’ বলতে পারে না। ওদিকে হামাস পুরোদস্তুর একটি ইসলামী আন্দোলন, যারা কেবল ভূমির জন্য লড়ছে না; বরং উম্মাতের পক্ষ থেকে দখলকৃত আল আকসার জন্য জিহাদের ফরযে কিফায়াহ আদায় করে যাচ্ছে। তাই হামাসকে সন্ত্রাসী’ বলে প্রচার করা যায়। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, হামাস ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্ব করে না। অথচ হামাস গাজার জন-নির্বাচিত দল এবং পশ্চিম তীরে নির্বাচন হলে সেখানেও হামাস জিতবে। কিন্তু ইসলামপন্থী হওয়ার কারণে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া হামাসকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে। এখানে পাঠকের মনে রাখা উচিত যে, আমাদের কাছে একটি ‘আরব জাতীয়তাবাদী’ ফিলিস্তিনের চেয়ে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের মুক্তি, আল কুদসের সম্মান ও ইসলামী আদর্শের মাহাত্ম্য অনেক বেশি। তাই ফাতাহকে আমরা সেভাবে সমর্থন দিতে পারি না, যেভাবে হামাস বা এরকম ইসলামী আন্দোলনকে সমর্থন দেই। এজন্য পশ্চিমারা হামাসকে Savage (হিংস্র) বলে এটি বুঝাতে চায় যে, এরা মানুষ নয়। ইসরায়েলের এক মন্ত্রী গাযার জনগণকে Human animal বলেছে। এ ধরণের শব্দ প্রয়োগকে বলা হয় Dehumanization বা অমানবীকরণ। অর্থাৎ, গাযা কোনো মানুষের বসতি নয়। সুতরাং গাযায় মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নও আসে না। পশ্চিমাদের এই Dehumanization অবশ্য নতুন নয়। অতীতে এভাবেই তারা আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের হত্যা করেছে এবং আফ্রিকা থেকে কালো মানুষকে দাস বানিয়ে নিয়ে গেছে। বলেছে, এরা মানুষ নয়! আজ তারা এই শব্দ প্রয়োগ করছে ফিলিস্তিনীদের জন্য। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বেন শ্যাপিরো বলেছেন, “ইসরায়েলের উচিত যত বেশি সম্ভব কুত্তার বাচ্চা হত্যা করা।” আরেক বুদ্ধিজীবী জর্ডান পেটারসন গাযার জনগণের ব্যাপারে বলেছেন, “নেতানিয়াহু, ওদেরকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দাও।” এর ফলে কী হয়েছে দেখুন। ১৪ অক্টোবর আমেরিকার ইলিনয় অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত ৬ বছর বয়সী একটি ফিলিস্তিনী বংশোদ্ভূত শিশুকে ২৬ বার কুপিয়ে হত্যা করেছে এক বৃদ্ধ। কিছুদিন আগেও বৃদ্ধ লোকটি ওই শিশুটির সাথে খেলত। তার ভাষ্যমতে, আমেরিকার কনজার্ভেটিভ নিউজ চ্যানেল ও টিভি শো দেখে সে জেনেছে, মুসলমানরা Savage এবং তাদেরকে হত্যা করা উচিত! তাই সে এ কাজ করেছে। ইদানিং হিন্দুত্ববাদী ইন্ডিয়ান মিডিয়া জায়োনিস্টদের পক্ষে কোমর বেঁধে প্রচারে নেমেছে। যে দেশের ৪৯.৮ শতাংশ লোক এখনও ঘরের বাইরে খোলা মাঠে পায়খানা করে (Brainly 2023), সে দেশের লোকেরা মুসলমানদের খতম করার জন্য ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধে শরীক হওয়ার মনোকামনা ব্যক্ত করছে! এমন কৌতুক সচরাচর চোখে পড়ে না।
স্রোতের পরিবর্তন ও জায়োনিস্টদের পরাজয়ের ইঙ্গিত
২০২১ সাল থেকে স্রোতের পরিবর্তন হয়েছে। ন্যারেটিভ ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে মুসলমানরা যেভাবে তাঁদের বয়ান (Alternative Narrative) তুলে ধরছেন, তাতে জায়োনিস্ট ও পশ্চিমা তথ্যসন্ত্রাস অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা শিক্ষা ও মিডিয়ার। ফিলিস্তিনে তরুণদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৯৫.৪ শতাংশ (UNICEF)। আরব দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্বোচ্চ। বিপুল সংখ্যক তরুণ শিক্ষিত হয়ে গড়ে ওঠছে। কুরআন এদের হৃদয়ে, উম্মাহর বীরত্বের গাঁথা এদের মনে-মস্তিষ্কে, আধুনিক প্রযুক্তিতে এদের শখ ও দক্ষতা অসাধারণ, ইংরেজিতে এরা সাবলীল। মিডিয়া এদের সামনে মাইক ধরে যা ইচ্ছা তা বলাতে পারে না। এক সময় জায়োনিস্টদের মিথ্যাচারকে পশ্চিমারা সত্য বলে ধরে নিত। আজ ফিলিস্তিনীরা ভিডিও করে প্রকৃত অবস্থা দেখিয়ে দিচ্ছে। গাযার অকুতোভয় ফটোগ্রাফার মু’তায আযাইযা ইসরায়েলী আগ্রাসনকে ক্যামেরাবন্দী করে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন। Al Jazeera, Middle East Eye, TRT World প্রমুখ মিডিয়া ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বকে ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে যাচ্ছে। ২৫ অক্টোবর ইসরায়েলের হামলায় আল জাযিরা রিপোর্টার ওয়ায়েল দাহদৌহ-এর পুরো পরিবার শহীদ হয়েছে। এই বীর সাংবাদিক পরিবারকে কবরস্থ করেই নিজ দায়িত্বে ফিরে এসেছেন। মুসলিম মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও উলামায়ে কিরাম পশ্চিমাদের টিভি শো এবং নিজ নিজ পডকাস্টে জায়োনিস্টদের ন্যারেটিভ খণ্ডন করে ফিলিস্তিনের পক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি করছেন। দুনিয়াজুড়ে মানুষ তাঁদের কথা শুনছে। লেখকরা আকসা ও ফিলিস্তিনের কথা লিখে যাচ্ছেন। এতে পাঠকদের মনে এই লড়াই যিন্দা থাকছে এবং অমুসলিমরা সত্য জানার সুযোগ পাচ্ছে। নিবন্ধের শুরুতে ‘ইতিহাসের পাতা পর্যালোচনা’ নামে আমি যে কথাগুলো লিখেছি, তা মূলত ইয়াহুদীদের ন্যারেটিভকে খণ্ডন করার জন্য। ওরা ফিলিস্তিনকে ইয়াহুদীদের জন্য খোদা প্রদত্ত আবাসভূমি বলে অনেক মুসলমানের মনে সংশয় সৃষ্টি করে। তাই জবাব দেওয়া জরুরি ছিল।
ইসলামপন্থী মিডিয়া ছাড়াও বড় প্রভাব ফেলছে অনলাইন প্রচারণা ও বিক্ষোভ। ইরাক, জর্ডান, তুর্কি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশসহ ইউরোপ ও আমেরিকায় মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষ ইসরায়েলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন। ২৮ অক্টোবর লন্ডনে কয়েক লক্ষ মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে র্যালি নিয়ে বেরিয়েছেন। আমেরিকার ইয়াহুদী সম্প্রদায়ের একটি অংশ কয়েকটি শহরে ইসরায়েলী নৃশংসতার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করেছে। রাস্তা-ঘাট, স্টেশন, ফুটবল মাঠ, ইউনিভার্সিটি, এমনকি সংসদেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবার খোলাখুলি ইসরায়েলের নিন্দা করছেন, যা আগে দেখা যেত না। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ সামী হামদী ও পাকিস্তানী নিরাপত্তা বিশ্লেষক সালীম বাটের মতে, ফিলিস্তিনের পক্ষে মুসলমানদের অনলাইন কার্যক্রম এবং বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ আরব নেতাদের ইসরায়েলঘেষা মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন করতে বাধ্য করছে। ফিলিস্তিনের পক্ষে এত টুইট, ফেইসবুক পোস্ট, কমেন্ট ও ভিডিও শেয়ারিং হচ্ছে যে, এগুলো শক্ত জনমত গড়ে তুলেছে। আরব নেতারা যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছুটা কথা বলছেন, সেটি করতে তাদেরকে বাধ্য করছে সাধারণ মুসলমানদের দৃঢ় অবস্থান। মুসলমানদের এই জনমতকে দমন করতে আরব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য চলমান আগ্রাসন শুরুর পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন ৬টি আরব রাষ্ট্র সফর করেছেন। ২০২১ সালে শেখ জাররাহতে আগ্রাসন চলাকালে ইসরায়েলের মন্ত্রী বেনি গান্টজ ফেইসবুক ও টিকটকের সাথে বৈঠক করে এই অনুরোধ করেন, যেন ফিলিস্তিন সংক্রান্ত অনলাইন এক্টিভিটিকে দমিয়ে দেওয়া হয় (INN, 14 May 2021)। কারণ সত্যের এই মুক্ত প্রকাশকে জায়োনিস্টরা ভয় পায়। তাই যে ইসরায়েল এক সময় ফিলিস্তিনিদের ওপর নিশ্চিন্তে বোমা মেরেছে, আজ তাদেরকে বোমা হামলার পর হামাসের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজেদেরকে রোষানল থেকে বাঁচাতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঠের অসম লড়াইয়ে ইসরায়েলের পাল্লা অনেক ভারী হলেও জনমতের যুদ্ধে হামাস জিতে গেছে। হামাস আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের মধ্যকার সুসম্পর্ককে যে ধাক্কা দিতে চেয়েছিল, অতিমাত্রায় আগ্রাসী হতে গিয়ে ইসরায়েল সেই ফাঁদে পা দিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, হামাসের হামলা ৭৫ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর ইসরায়েলী দখলদারিত্বের ফল (DW, 28 Oct 2023)। ১ নভেম্বর পর্যন্ত বলিভিয়া, চিলি ও কলোম্বিয়া ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল ইসরায়েলী গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বলা যায়, হামাস এতদিনের একচোখা বিশ্বকে দুইভাগে ভাগ করার কাজে শতভাগ সফল হয়েছে। হামাস ও গাযাবাসীকে অনেক বড় কুরবানী দিতে হচ্ছে সত্য, কিন্তু ফাতাহকে পেছনে ফেলে আজ হামাস ফিলিস্তিনী সংগ্রামের প্রতিক হয়ে ওঠেছে। বয়ানের যুদ্ধের সাথে আছে বয়কটের যুদ্ধ। প্রবাসী ফিলিস্তিনীদের সংগঠন BDS Movement ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক ইয়াহুদী লবিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। তারা ইসরায়েলের বাণিজ্যিক কোম্পানি এবং ফিলিস্তিনের ভূমি দখলকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে জনসমর্থন গড়ে তুলে। BDS এর প্রচারণার ফলে প্রতিবছর ইসরায়েলে দেড় বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আটকে যায় (Lawfare 2005)। BDS এর তালিকায় আছে ইসরায়েলী সামরিক পণ্য। ইসরায়েলকে সাহায্যকারী কোম্পানির মধ্যে রয়েছে Ahava, Sabra, AXA, Pampers, HP, Siemens, SodaStream, G4S, Pillsbury, Puma, US Caterpillar, Hyundai Heavy Industries, Airbnb ইত্যাদি। সেইসাথে, আন্তর্জাতিক ত্রাণের পাশাপাশি তুর্কি ও কাতারে অবস্থিত কিছু সংস্থা আর্থিকভাবে গাযা ও আল কুদসের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ইস্তাম্বুলস্থ Palestine Scholars Association এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত ভূমিকা রাখছে, যেখানে মুসলমানরা আর্থিকভাবে শরীক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
তবে বিপরীত চিত্রও আছে। গাযায় চলমান গণহত্যার মধ্যেও আরব আমিরাত ইসরায়েলের সাথে তাদের সুসম্পর্কের অঙ্গীকার পুনরায় ব্যক্ত করেছে। সৌদি আরবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বসেছে Riyadh Season 2023 কনসার্ট। গত ২৮ অক্টোবর রাতে গাযার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দখলদার ইসরায়েল যখন নির্বিচারে বিমান হামলা করে যাচ্ছিল, মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’ চুপচাপ বসে তামাশা দেখছিল, আর সৌদি আরব তখন মেতে উঠেছিল পশ্চিমা তারকাদের উদ্বেল নৃত্যে। এটি জানা কথা যে, কোনো মুসলিম রাষ্ট্র একা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়তে যাবে না। গিয়ে কুলিয়েও উঠতে পারবে না। তবু উত্তরদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলকে ভালোভাবেই ব্যতিব্যস্ত রেখেছে। মৌখিকভাবে হলেও তুর্কিয়ে ও ইরান ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে। কাতার চলমান আগ্রাসন থামাতে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো ওমান কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাকি আরব শাসকরা চায়, হামাস নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। কারণ তাদের পশ্চিমীকরণ ও আধুনিকীকরণের পথে হামাসের মতো ইসলামী আন্দোলনগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সুযোগে ইসরায়েল গাযায় ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, আর তাতে সমর্থন দিচ্ছে আমেরিকা। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত গণহত্যা চলছে। গাযায় যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ, চিকিৎসা-সেবা পুরোপুরি বিপর্যস্ত, ন্যুনতম খাদ্য-পানীয় নেই। একটি অবরুদ্ধ ভূমিতে রক্তমাখা শিশুদের কান্নায় মানবতা কলঙ্কিত হচ্ছে। অথচ এই সভ্য পৃথিবীতে কারও কোনো বিকার নেই। শুহাদার সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ৩১ অক্টোবর গাযার শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের সমাপ্তি ঘোষণা করেছে। কারণ স্কুলে যাওয়ার মতো কোনো শিক্ষার্থী বেঁচে নেই। ভূমিতে অনেকটা প্রতিরোধ করলেও আকাশপথে ইসরায়েলকে আটকানোর শক্তি হামাস বা ইসলামিক জিহাদ প্রমুখ সংগঠনের নেই। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এই আগ্রাসন একইসাথে মুসলমানদের অনৈক্য, আরবদের সীমাহীন দৈন্যতা এবং এক শতাব্দীর ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উঠে আসা নতুন একটি প্রজন্মের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণের চেতনাকে ইঙ্গিত করছে– ফিলিস্তিনে এবং বিশ্বব্যাপী। এরা জানে, আপোসে খাইবার বিজয় হয়নি, আপোসে আল কুদসও বিজয় হবে না। বিজয় লড়েই ছিনিয়ে আনতে হয়। আরব বিশ্বের গায়রতহীন রাজা-বাদশারা এই মযলুম উম্মাহর সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও রাজাধিরাজ মহান আরশের অধিপতি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। মুসলমানদের কান্নাভেজা মুনাজাতে আল কুদস ও ফিলিস্তিনীরা সবসময় উপস্থিত আছে। ফিলিস্তিনীদের সাথে পরোক্ষভাবে লড়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তাঁদের কোটি কোটি ভাইবোন। কারণ আল কুদস এই উম্মাহর ঐক্য ও পুনর্জাগরণের প্রতিক। যেদিন আল কুদস মুক্ত হবে, সেদিন উইঘুর, কাশ্মীর, সিরিয়া, ইয়ামান থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত দুনিয়ার তামাম মযলুম মুক্ত হবে। আকাশে সেদিন নতুন চাঁদ উঠবে, বাতাসে ভাসবে তাকবীর ধ্বনি, মুমিনের ললাটে চমকাবে সিজদার নূর। সেদিন আকসার মিম্বরে দাঁড়িয়ে উম্মাতের ইমাম বিজয়ের খুতবা শুনাবেন। সময় সাক্ষ্য দিচ্ছে, সে দিনটি খুব দূরে নয়।