অক্টোবর মাসের শেষ দিক। বাংলাদেশে তখনও শীতের আমেজ নেই। কিন্তু নয়াদিল্লী থেকে উজবেক এয়ারের ফ্লাইটে চড়ে তাসখন্দে পা রাখা মাত্র শীতের এক তীব্র ঝাঁপি এসে শরীরে বিঁধল। নীরবে পড়ে থাকা তাসখন্দের ইসলাম করিমভ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মুসাফিরদের পদচারণায় হঠাৎ সরব হয়ে উঠল। মালয়েশিয়ার ওয়ার্ল্ড সুফি সেন্টারের তত্ত্বাবধানে নকশবন্দী ট্যুরিজম ফ্যাস্টিভাল নামক একটি যিয়ারতের সফরে যোগ দিতে উজবেকিস্তানে এসেছি আমরা। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যুক্ত হয়েছেন শ’দুয়েক মানুষ।
মধ্য এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ উজবেকিস্তান। আয়তনে বাংলাদেশের তিনগুণ হলেও জনসংখ্যা টেনেটুনে ৩ কোটির সামান্য বেশি হবে। এই অঞ্চলে ইসলামের আগমন ঘটেছিল বহু আগে। খ্রিষ্টীয় ৮ম শতাব্দীতে কতিপয় সাহাবা এবং মূলত তাবেয়ীদের হাত ধরে ইসলাম এখানে প্রবেশ করেছিল। পরবর্তীতে ইরানের সামানিয়া নামক সুন্নী রাজবংশ এই এলাকায় ইসলাম প্রচারে বড় ভূমিকা পালন করে। সাহাবীদের কাছে ‘মা ওয়ারাউন নাহর’ বা নদীর ওপাশ নামে পরিচিত তৎকালীন বৃহত্তম খোরাসানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য অংশ আজকের উজবেকিস্তান। আমুদরিয়া এবং সারদরিয়া নদীদ্বয়ের অববাহিকায় অবস্থিত এই মধ্য এশিয়া ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল স্মারক হয়ে আছে। তৎকালীন বৃহত্তর খোরাসান মুসলিম উম্মাহকে উপহার দিয়েছে জগদ্বিখ্যাত সব মুহাদ্দিস, ফুকাহা, মুজাহিদ, আউলিয়া।
গত শতাব্দীর প্রায় ৭৩ বছর কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকাকালীন উজবেক মুসলমানরা বাধ্য হয়েই ইসলাম থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিল। সোভিয়েত সরকার জোরপূর্বক মসজিদ, মাদরাসা ও আউলিয়া-মাশায়িখের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহকে সরাইখানা এবং সরকারি গোদাম বানিয়ে রেখেছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর উজবেকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে এরপরও প্রায় সিকি শতাব্দী সোভিয়েতের ভূত হয়ে উজবেক মুসলমানদের ঘাড়ে চেপে রয়েছিলেন কমিউনিস্ট দর্শনে বিশ্বাসী উজবেকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইসলাম করিমভ। দীর্ঘ পঁচিশ বছর শ্বাসরুদ্ধকর একনায়কতান্ত্রিক শাসনের পর ২০১৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। এ দীর্ঘ শাসনামলে ইসলাম করিমভ যেমন ইসলামকে কোণঠাসা করেছেন, তেমনি নিজের নয়নাভিরাম দেশটিকেও ভ্রমণ পিপাসুদের নাগাল থেকে এক প্রকার আড়াল করেই রেখেছিলেন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট শাভকাত মির্জায়োয়েভ ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতিতে বস ফিরতে শুরু করেছে। ভ্রমণের ওপর আরোপিত অযাচিত কড়াকড়ি খানিকটা শিথিল হতে দেখা যাচ্ছে, মসজিদে মুসল্লিদের আগমন বেড়েছে, জংধরা দরজা খুলে ঐতিহ্যবাহী মাদরাসাগুলোতে শিক্ষার্থীদের গুনগুনানি শোনা যাচ্ছে। মুসলিম ঐতিহ্যকে ধারণ করা চোখধাঁধানো সব স্থাপত্যে নতুন রঙ এসেছে, আউলিয়া-মাশায়িখের মাযারে যিয়ারতকারীদের আনাগোনা শুরু হয়েছে।
প্রতি বছর ওয়ার্ল্ড সুফি সেন্টার উজবেকিস্তানে নকশবন্দী ট্যুরিজম ফ্যাস্টিভালের আয়োজন করে থাকে। উদ্দেশ্য, সিলসিলা নকশবন্দিয়্যার আউলিয়া-মাশায়েখ এবং প্রথিতযশা ইমাম-আইম্মার মাযার যিয়ারত। সাথে অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও ঘুরে দেখানো হয়। এই ট্যুর উজবেক সরকারের সাথে সমন্বয় করে আয়োজন করা হয় বিধায় যিয়ারতকারীরা নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। ২০১৯ সালের এই সফরে আমাদের সাথে ছিলেন ১২টি দেশের প্রায় দুইশ মানুষ।
তাসখন্দ বিমানবন্দরে নেমেই মনে হয়েছিল, এই বিমানবন্দর সচরাচর একসাথে এত মানুষের ভার বহন করতে অভ্যস্ত নয়। দীর্ঘ সময় ধরে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে বাইরে এসে দেখলাম আমাদেরকে অভ্যর্থনাকারী দলের সদস্যরা অপেক্ষমাণ। ওয়ার্ল্ড সুফি সেন্টারের নির্বাহী প্রধান শায়েখ আবদুল করিম সাঈদ খাদাইদ আমাদের সাথে পরিচিত হলেন। নির্ধারিত স্থানে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আমরা চলে গেলাম তাসখন্দ রেলস্টেশনে। গন্তব্য ঐতিহ্যবাহী শহর বোখারা। মধ্যখানে বলে রাখি, উজবেকিস্তানে টয়লেট-যাত্রা আক্ষরিক অর্থেই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তাশখন্দে যে স্থানে আমরা বিশ্রাম নিয়েছিলাম, সেখান থেকে শুরু করে প্রতিটি শহরে, প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে, প্রায় প্রতিটি হোটেলে আমরা পানিবিহীন টয়লেটে এক না-বলা যন্ত্রণার শিকার হয়েছি। আমার জন্য বিষয়টি অভূতপূর্ব ছিল না। ইতিপূর্বে থাইল্যান্ড ও মিশরে আমি এ ধরনের টয়লেট দেখেছি। তবে অনেকের জন্য এটি একেবারেই নতুন। ব্যাপারটি হলো, উজবেকিস্তানের টয়লেটগুলোতে পানি থাকে না। সেটি পুরোনো পলেস্তারাহীন পাবলিক টয়লেট হোক কিংবা পাঁচতারা হোটেলের ঝকঝকে টয়লেট। কমোডের সাথে লাগোয়া যে পুশ শাওয়ার ব্যবহার করে আমরা অভ্যস্ত উজবেকিস্তানে সেটি যেন এক অকল্পনীয় সোনার হরিণ! আমি এর ইতিহাস খুঁজেছি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো কারণ বের করতে পারিনি। আমার কাছে মনে হয়েছে ব্যাপারটি পবিত্রতা অর্জনের ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। আমরা মুসলমানরা যে ধরনের পবিত্রতা অর্জনে অভ্যস্ত অমুসলিমরা সে ধরনের পবিত্রতার ধারণায় অভ্যস্ত নয়। যেহেতু উজবেকিস্তান দীর্ঘ এক শতাব্দী সোভিয়েত কমিউনিস্ট শাসনের অধীন ছিল, একইভাবে মিশর ছিল ব্রিটেন-ফ্রান্সের কলোনি তাই তাঁদের মনমানসিকতার মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর অভ্যাসের ছিটেফোঁটা আজও বাকি রয়ে গেছে। উজবেকরা টিস্যু দিয়ে ইস্তিঞ্জার কাজ সারলেই যথেষ্ট মনে করে। কিন্তু আমাদের মতো ভাতে অভ্যস্ত বাঙালিদের জন্য এ ব্যাপারটি একেবারে অসম্ভব। শুনতেই গা শিরশির করে। তাছাড়া উজবেকিস্তানে টয়লেট ব্যবহার করতে টাকা দেওয়া লাগে। সেটি না হয় দিলাম, কিন্তু টয়লেটে পুশ শাওয়ার রাখবে না, বেসিন রাখবে না, পানির পাত্র রাখবে না, এটি কী করে মানা যায়? আমরা দায়িত্বশীলদেরকে বললাম, টয়লেটে পানি নেই। তাঁরা অবাক হয়ে প্রশ্নটি ফিরিয়ে দিলো, ‘টয়লেটে পানি দিয়ে কী করবে?’ উপায়ন্তর না দেখে আমরা পানির বোতল নিয়ে টয়লেটে যাওয়ার অভ্যাস করে নিলাম। উজবেকিস্তানে থাকাকালীন পানি খাওয়ার পর আমরা সযত্নে বোতলটি রেখে দিতাম। কারণ পরেরবার প্রকৃতির ডাকে এই বোতলই আমার অন্ধের যষ্টি।
উজবেকিস্তানের রেলওয়ে আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত। তবে পুরো দেশটি যেন খাঁ খাঁ করছে। রেলস্টেশনে ভিড় নেই বললেই চলে। ট্রেনেও নেই আমাদের মতো ধাক্কাধাক্কি। যাত্রাপথে বিস্তীর্ণ মরু-হাওর এলাকা জনশূন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে তুলার (Cotton) ক্ষেত চোখে পড়ে। পাশে সাদামাটা কিছু ঘর-বাড়ি। মাঝেমধ্যে একজন ঘোড়সওয়ারকে দেখা যায় মঙ্গোলিয়ান তেজি ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে। ট্রেনযাত্রায় আর তেমন কিছু চোখে না পড়লেও ট্রেনে চড়া উজবেক মানুষদের সাথে পরিচিতিটা বেশ ভালোই হয়েছিল। বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, পরিশ্রমী উজবেকরা দেখা হলেই মন খুলে হাসি দেয়। লম্বা সালাম দিয়ে হাত বাড়ায়। এক শতাব্দীর বজ্রকঠিন শোষণ এদের কাছ থেকে অনেক সম্ভাবনা কেড়ে নিলেও এদের বিনয় ও মনুষ্যত্ববোধ বিন্দুমাত্র কেড়ে নিতে পারেনি।
দুপুরের দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম বোখারায়। বোখারা নামটিতেই কি জানি এক রহস্য লুকিয়ে আছে! একসময়ের বিশ্বখ্যাত বাণিজ্যিক পথ সিল্করোডের একেবারে মধ্যখানে অবস্থিত ছিল বোখারা। হাজারো বণিক পণ্যের বোঝা চাপিয়ে এই বোখারায় আসত। লাখো বণিক পণ্যের ঢের নিয়ে বেরিয়ে পড়ত দুনিয়ার আনাচে-কানাচে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বোখারা শহরের নামটি সোনার হরফে খোদিত আছে। কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যই নয়; জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, কৃষ্টি-কালচারে এই শহরটি মানব সভ্যতাকে যা দিয়েছে, পৃথিবীর খুব কম শহরই তা দিতে পেরেছে। মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল সময়ে বাগদাদের পর বোখারাই ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতির মূল কেন্দ্রবিন্দু। আধুনিক উজবেকিস্তানও মুগ্ধতার উপাদানে ঠাসা। শহরগুলোকে সাজাতে উজবেকরা রুচির পরিচয় দিয়েছে। ঝকঝকে রাস্তা-ঘাট, দুইপাশে নানাপদের গাছ-গাছালি, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, স্থাপত্যে সূক্ষ্ম জ্যামিতিক মারপ্যাঁচের সাথে ইসলামী প্রকৌশল সংস্কৃতির মিশ্রণ- উজবেকিস্তান যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা।
আমরা নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সারলাম। বুফে পদ্ধতির খাবার, তাই প্রচুর আয়োজন। তবে খাবারগুলো লবণ-মরিচাবিহীন, খেতে আলুনি আলুনি লাগে। দেখে মনে হয়, তেলের প্রাচুর্য দিয়ে লবণ-মরিচের অপ্রতুলতাকে শোধবোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। খাওয়ার পর ট্যুরিজম ফ্যাস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো। অনেক আলিম-উলামার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত হলো। পাকিস্তানের নকশবন্দিয়্যা সিলসিলার বুযুর্গ জনাব জুলফিকার আহমদ নকশবন্দীর দুআর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হলো।
প্রথমদিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে আমরা সায়্যিদ শামসুদ্দীন আমির কুলাল (র.) এর মাযার যিয়ারতে গেলাম। সায়্যিদ আমির কুলাল তাসাউফের সোনালি ধারার এক খ্যাতিমান বুযুর্গ এবং সিলসিলা নকশবন্দিয়্যার প্রবর্তক ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বুখারী (র.) এর মুর্শিদ। একইসাথে তিনি মধ্য এশিয়ার জাতীয় বীর আমির তৈমুর লংয়ের মুর্শিদ। যৌবনে আমির কুলাল একজন কুস্তিগির, গোত্রপতি ও খ্যাতিমান আলিমে দীন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মুহাম্মদ বাবা সাম্মাসী (র.) এর কাছে তাসাউফের সবক গ্রহণ করেন। সায়্যিদ আমির কুলালের মাযারে প্রথমবার আমরা ‘উজবেক-সন্ধ্যা’ প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সময় নিয়ে সন্ধ্যা নামে, আমাদের মতো ধুম করে নয়। পড়ন্ত বিকেলের মৃদু আলো ম্লান করে ধীর পায়ে শান্তসন্ধ্যার আগমনী দৃশ্য, তার ভেতরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মাযার কমপ্লেক্সের নীলাভ গম্বুজ এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্ম দিয়েছিল। আমরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।
আমাদের সফরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল তাসাউফের সুপ্রসিদ্ধ সিলসিলা নকশবন্দিয়্যার প্রতিষ্ঠাতা ইমাম সায়্যিদ বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বুখারী (র.) এর কবর যিয়ারত ও ঈসালে সাওয়াব মাহফিল। রাতে আমরা চলে গেলাম বোখারা মূল শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে কাসরে আরিফান নামক গ্রামে, যেখানে শুয়ে আছেন আল্লাহর এ মহান ওলী। ১৩১৮ সালে এই গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ১৩৮৯ সালে এখানেই তাঁর ইন্তেকাল হয়েছিল। যুবক বয়সেই তিনি মধ্য এশিয়ার এক মান্যবর আলিমে দ্বীন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। হজ্জের উদ্দেশ্যে তিনবার মক্কা-মদীনা সফর করেছেন। বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (র.) তৎকালীন মধ্য এশিয়ার প্রখ্যাত বুযুর্গ সায়্যিদ শামসুদ্দীন আমির কুলাল (র.) এর কাছ থেকে তাসাউফের দীক্ষা লাভ করেন। তিনি পূর্বসূরি বুযুর্গদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তাসাউফের সোনালি ধারাকে অধিকতর সহজ করে সালিকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (র.) বলেছেন, ‘আমাদের তরীকার সুদৃঢ় হাতল হচ্ছে সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং সাহাবীদের পথ অনুসরণ করা।’ নকশবন্দিয়্যা-মুজাদ্দেদিয়া সিলসিলার শাজরাহ অনুযায়ী ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বুখারী (র.) রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ১৬তম অধস্তন পুরুষ।
পরদিন সকালে আমরা গেলাম গুযদোয়ান। সেখানে ইমাম আবদুল খালিক গুযদোয়ানী (র.) এর কবর যিয়ারত করলাম। ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (র.) কর্তৃক সিলসিলা নকশবন্দিয়্যা প্রবর্তনের পূর্বে তাসাউফের এই সোনালি ধারা সিলসিলা-ই-খাজেগান নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এই সিলসিলা-ই-খাজেগানের সূচনা হয়েছিল আবদুল খালিক গুযদোয়ানীর হাতে। পরবর্তীতে সিলসিলা নকশবন্দিয়্যার যে ১১টি মূলনীতি প্রণীত হয়েছিল, তার মূল কৃতিত্ব আবদুল খালিক গুযদোয়ানীর। সিলসিলা নকশবন্দিয়্যার ১১টি মূলনীতি হলো- হুশ দর দাম (শ্বাসপ্রশ্বাসে সচেতনতা), নযর বর কদম (চলাফেরায় দৃষ্টি অবনত রাখা), সফর দর ওয়াত্বান (অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ), খালওয়াত দর আঞ্জুমান (ভিড়ের মাঝে একাকীত্ব), ইয়াদ কার্দ (স্মরণ), বায গাশত (প্রত্যাবর্তন), নিগাহ দাশত (মনোযোগ), ইয়াদ দাশত (ধ্যান), উকুফে যামানী (সময় সচেতনতা), উকুফে আদাদী (সংখ্যার সচেতনতা) এবং উকুফে ক্বালবী (হৃদয়ের সচেতনতা)।
আরও কিছুদূর পরে আবদুল খালিক গুযদোয়ানীর খলিফা খাজা আরিফ রেওগারভী (র.) এর কবর। সেখানেও যিয়ারত করলাম। খাজা আরিফ (র.) এর লিখিত তাসাউফের কিতাব ‘আরিফনামা’ আজও পাকিস্তানের একটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে। এরপর চলে গেলাম আফসোনা। এই আফসোনা গ্রামে ৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক আবূ আলী ইবনে সিনা। এরিস্টটলের দর্শন এবং মৌলিক চিকিৎসাবিদ্যায় ইবনে সিনার অবদান চিরস্মরণীয়। তাঁর লেখা ‘আল কানুন ফিত-ত্বিব’ গ্রন্থটি বহু শতাব্দী এশিয়া ও ইউরোপে চিকিৎসাবিদ্যার মূলপাঠ হিসেবে পঠিত হতো। তাঁর আবাসস্থল ঘুরে দেখলাম। এরপর গেলাম ফারগানা। সেখানে আমরা খাজা আরিফ রেওগারভীর খলিফা খাজা মাহমুদ আনজির ফাগনাভী (র.) এর কবর যিয়ারত করলাম। খাজা মাহমুদ আনজির কেবল একজন সূফি সাধকই নন; বরং তিনি একজন ইসলামী দার্শনিকও ছিলেন। ইসলামী শরীআতের বাস্তবায়ন ও খিলাফত প্রতিষ্ঠার চিন্তায় তিনি বহুদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। এভাবে আউলিয়া-আল্লাহর যিয়ারতে দিনটি কেটে গেল। পথিমধ্যে বিভিন্ন মসজিদে নামাজ আদায় করে নির্ধারিত জায়গায় খাবার সারলাম। তবে দিনশেষে আমাদের জন্য বড় চমক হয়ে থাকল আফসোনায় অবস্থিত ইবনে সিনা জাদুঘর। বহুবিদ্যাজ্ঞ (Polymath) আলবিরুনীর নিজ হাতে আঁকা পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র, সৌরজগতের হিসেব-নিকেশ, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান সম্বন্ধে তাঁর গাণিতিক প্রস্তুত প্রণালি আমাদেরকে মুগ্ধ করেছিল। গর্ব হচ্ছিল, যে যুগে ইউরোপের রাস্তায় বাতি জ্বলত না, সে যুগে মুসলিম বিজ্ঞানীরা নভোম-ল ও ভূম-লের পরিধি মেপেছিলেন।
—
মধ্য এশিয়া, সাবেক রাশিয়ান ও চীনা তুর্কিস্তান এলাকা ও মঙ্গোলিয়ার একটি অংশ নিয়ে যে বিশাল জাতিগোষ্ঠীর অবস্থান ছিল সেই তুর্কী-মঙ্গোল জাতি এক সময় সারা পৃথিবীব্যাপী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। বর্তমান তুরস্কের অধিবাসীদের পূর্বপুরুষ এক সময় এই মধ্য এশিয়া থেকেই এশিয়া মাইনরে চলে গিয়েছিল।
ফারগানা শহরের সাথে কেবল চিকিৎসক-দার্শনিক ইবনে সিনার নামটিই জড়িত নয়। এ জায়গার ইতিহাস আরও সমৃদ্ধ। ১৫২৬ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত ভারত শাসন করা মোঘল রাজবংশের শেকড় এই জায়গার সাথে জড়িয়ে আছে। ১৪৮৩ সালে ফারগানা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব আন্দিজান এলাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবর। সম্রাট বাবর তাঁর পিতার দিক থেকে খোঁড়া পায়ের বিশ্বজয়ী তৈমুর লং-এর বংশধর। মায়ের দিক থেকে মঙ্গোল সম্রাট চেঙ্গিস খাঁ বাবরের পূর্বপুরুষ। ইতিহাসে তৈমুর ও চেঙ্গিস উভয়েই রক্তপিপাসু চরিত্র হিসেবে পরিচিত। ১২৫৮ সালে Fall of Baghdad বা বাগদাদের পতনের মূলে ছিলেন চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খাঁ। বর্বর মঙ্গোলদের হামলায় তখন ১০ লক্ষাধিক মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। ডুবে গিয়েছিল আব্বাসী খেলাফতের ম্রিয়িমাণ সূর্য। মুসলিম উম্মাহ’র রাজনৈতিক কেন্দ্র আরব জাহান থেকে সরে গিয়ে প্রথমে মিশর এবং পরে আনাতোলিয়া বা আধুনিক তুরস্কে স্থানান্তরিত হয়েছিল। সারা পৃথিবীতে ত্রাস সৃষ্টি করা মঙ্গোলদেরকে যখন বিশ্ববাসী অতিমানবীয় শক্তি ভাবতে শুরু করেছিল, তখন এই মুসলিম উম্মাহর হাতেই আটকে গিয়েছিল মঙ্গোলদের অগ্রযাত্রা। ১২৬০ সালে বর্তমান ইসরায়েলের গ্যালিলি হ্রদের তীরবর্তী আইন জালুত যুদ্ধে মঙ্গোল বাহিনীকে প্রথমবার সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত করেছিল সুলতান সাইফুদ্দীন কুতুয ও সেনাপতি যাহির বাইবার্সের নেতৃত্বাধীন মামলুক মুসলিম বাহিনী। মঙ্গোল সাম্রাজ্যের শেষের শুরু নির্ধারণ করে দিয়েছিল এই আইন জালুত যুদ্ধ।
ফারগানা থেকে আমরা ফিরলাম বোখারা মূল শহরে। সন্ধ্যায় চলে গেলাম মসজিদ-ই-কালান পরিদর্শনে। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মসজিদ-ই-কালান দাঁড়িয়ে আছে বোখারার সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপত্যের সাক্ষ্য নিয়ে। এ মসজিদটি মূলত একটি কমপ্লেক্স, যার বিভিন্ন অংশ ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকের সাক্ষী হয়ে আছে। সর্বপ্রথম ৭১৩ সালে এ এলাকায় মসজিদ নির্মাণ শুরু হয়। ১১২১ সালে এ নির্মাণকে গতি দান করেছিলেন কারাখান বংশের শাসন আরসালান খাঁ। মঙ্গোল সম্রাট চেঙ্গিস খাঁ বোখারা আক্রমণ করে বেশিরভাগ মসজিদ পুড়িয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে এগুলো আবার নির্মিত হয়। আজকের মসজিদ-ই-কালান নির্মিত হয়েছিল ১৫১৪ সালে। ২০৮টি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটিতে ২৮৮টি গম্বুজ শোভা পাচ্ছে। মূল নামাযের জায়গা মসজিদের ভেতরে। তবে বাইরের কোর্টইয়ার্ড অনেক প্রশস্ত। ভেতরে প্রবেশ করার আগে মূল তোরণের ওপর চোখে পড়ে সুবিশাল একটি নীলাভ গম্বুজ। এ কমপ্লেক্সটির সৌন্দর্য আমাদের চোখ সহ্য করছিল না। মানুষের রুচি ও সক্ষমতার ওপর নতুন করে শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস জন্মেছিল। প্রায় ৮-৯ তলার সমান উঁচু একেকটি তোরণ এবং মিনারাত। পাথরের ওপর খোদাই করা নিখুঁত কারুকার্য, জ্যামিতিক পরিমাপের ত্রুটিহীন ব্যবহার, ক্যালিগ্রাফিক পদ্ধতিতে অঙ্কিত পবিত্র কুরআনের আয়াত এবং হাদীস, মেজেতে মোজাইক। শুনেছি সোভিয়েত কমিউনিস্ট শাসনামলে এগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। সৃষ্টিশীল উজবেক জাতি তাঁদের ইতিহাসকে পুনরায় নতুন কলমে লিখেছে। বৃহত্তর বোখারা প্রদেশের বেশিরভাগ জায়গা এখন UNESCO ঘোষিত হেরিটেজ।
মসজিদ-ই-কালানকে ছাপিয়ে এ কমপ্লেক্সের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হয়ে আছে কালান মিনারাত। বাকো নামক এক স্থপতির তৈরি এ মিনারাত প্রায় দেড়শ ফিট উঁচু। নিচের দিকে এর প্রশস্ততা প্রায় সাড়ে উনত্রিশ ফিট। ভেতরের দিকে বাঁকানো সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠা যায়। যদিও আমরা সে সুযোগ পাইনি। ইট-পাথর-বালু দিয়ে সে সময় এত বিশাল একটি স্থাপত্য নির্মাণ করা কত কঠিন ছিল, তা সহজেই অনুমেয়। এ মিনারাত যেন স্থাপত্যকলার সব বিস্ময়কে একত্রিত করে মুগ্ধতার আবহ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আরেকটি তথ্য উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হচ্ছে, কালান মিনারাত এক সময় ব্যবহৃত হতো শাস্তি প্রদান করার কাজে। দাগী অপরাধীদেরকে এ মিনারাতের ওপরে তুলে নিচে ছুড়ে ফেলা হতো।
মসজিদ-ই-কালান কমপ্লেক্সের ভেতরেই অবস্থিত ঐতিহাসিক মাদরাসা আরাবিয়া। এ মাদরাসাকে মীর-ই-আরব মাদরাসাও বলা হয়। ১৫৩৬ সালে এ এলাকার শাসক উবায়দুল্লাহ খাঁ এ মাদরাসা তৈরি করেছিলেন। তিনি তিনবার ইরান আক্রমণ করে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন। অর্জিত সম্পদ দিয়ে তিনি একটি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র নির্মাণ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। সে ইচ্ছার ফলশ্রুতিতেই তৈরি হয়েছিল মীর-ই-আরব মাদরাসা। উবায়দুল্লাহ খাঁ তাঁর মুর্শিদ শায়খ আবদুল্লাহ ইয়ামেনীর নামে এ মাদরাসার নামকরণ করেছিলেন। শায়খ আবদুল্লাহ ইয়ামেনী মীর-ই-আরব নামে এ এলাকায় খ্যাতিমান ছিলেন। সোভিয়েত আমলে এ মাদরাসাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে আবার সেটি শুরু হয়েছে।
এ মাদরাসায় অনেক শিক্ষার্থী পেলাম। নিজেদের ভাষা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি দুটিই ভালো জানে। দীর্ঘ সময় ধরে কথা চলল। আকীদার দিক থেকে এরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী। ফিকহের দিক থেকে হানাফী, তরীকার দিক থেকে নকশবন্দী। তাঁদের সিলেবাস আমাদের মাদরাসার সিলেবাসের সাথে অনেকাংশে মিলে। তাঁদের ব্যবহারিক মাধুর্য যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য।
প্রথমদিকে আমার মনে হয়েছিল, উজবেকরা ইসলাম চর্চায় পিছিয়ে আছে। কিন্তু কথাটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। নামাযের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা, ইসলামের মৌলিক বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান অবাক করার মতো। সোভিয়েতের ফাঁসির মঞ্চ থেকে গ্রীবা ছাড়িয়ে উজবেক জাতি আবার ঊষার রঙে নিজেদেরকে রাঙাচ্ছে। প্রাচীন মাদরাসাগুলো আবার ক্বালাল্লাহ এবং ক্বালা ক্বালা রাসূলুল্লাহ সা.-এর শব্দে সজীব হয়ে ওঠছে।
পরদিন আমাদের কর্মসূচিতে ছিল তরীকা নকশবন্দিয়্যাহর দুই খ্যাতিমান বুযুর্গ শায়খ আলী রামিতানী (র.) এবং মুহাম্মদ বাবা সাম্মাসী (র.) এর যিয়ারত। শায়খ আলী রামিতানী ছিলেন খাজা মাহমুদ আনজির ফাগনাভীর খলীফা। ১৩১৫ সালে তিনি ইন্তিকাল করেন। এরপর গেলাম তাঁর খলীফা মুহাম্মদ বাবা সাম্মাসীর কবর যিয়ারতে। শায়খ সাম্মাসী সায়্যিদ আমির কুলালের মুরশিদ, এবং সায়্যিদ আমির কুলাল সায়্যিদ বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বুখারীর মুরশিদ। উল্লেখ্য, তরীকা নকশবন্দিয়্যার এ সিলসিলাকে তাসাউফের সোনালি ধারা (Golden Chain)বলা হয়।
বিকেলে গিয়েছিলাম পুরোনো বোখারা মার্কেটে। ভুবনবিখ্যাত সিল্ক রোডের মধ্যখানে অবস্থিত এই বোখারা শহর সহস্রাব্দের ব্যবসায়িক ইতিহাসকে বুকে ধারণ করে বসে আছে। সময় বদলেছে; বোখারাবাসীর রুচি কিন্তু ওই একই আছে। সেই সিল্ক, সেই কটন, সেই উটের পশমের তৈরি কাপড়, নকশাদার আসবাবপত্র, হাতে আঁকা ছবি, শো পিস, অলংকার। বোখারা এখনও তার রঙ হারায়নি। তবে বাজারগুলো আমাদের মতো সরগরম না। বাকি জায়গাগুলোর মতো বাজারও শূন্য, খাঁ খাঁ করছে। হঠাৎ দু একজনকে দেখতে পাওয়া যায়। মূলত বিদেশী পর্যটকরা খদ্দের হয়ে উজবেকদের সৌখিন ব্যবসাপাতির চরকায় জ্বালানি যুগিয়ে দিচ্ছে।
পরদিন গিয়েছিলাম ইমাম আবূ হাফস আল-কাবীর (র.) এর যিয়ারতে। পুরোনো বোখারা শহর থেকে ৫০০ মিটার উত্তরে তাঁর কবর অবস্থিত। ইমাম আবূ হাফস ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদরিস আশ-শাফিঈ (র.) এর সতীর্থ। তাঁরা দুজন একত্রে ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানী (র.) এর কাছে ইলম অর্জন করেছিলেন। ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানী (র.) ছিলেন ইমাম আবূ হানীফা (র.) এর ছাত্র। ইমাম আবূ হাফস তাঁর যুগের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আলিম ও ফকীহ ছিলেন। মধ্য এশিয়া (তৎকালীন বৃহত্তর খোরাসান) অঞ্চলে যে তিনজন মহান ব্যক্তির হাত ধরে ফিকহে হানাফীর আগমন ও প্রসার ঘটেছিল, ইমাম আবূ হাফস আল-কাবীর তন্মধ্যে একজন। বাকি দুজন হলেন হিদায়াহ গ্রন্থকার ইমাম বুরহান উদ্দীন মুরগিনানী (র.) এবং ইমাম আবুল লাইস সমরকন্দী (র.)। এসব মনীষীদের মহান খিদমতের কাছে আমরা ঋণী হয়ে আছি।
এ পর্যায়ে উজবেকদের খাবার-দাবার সম্পর্কে একটু বলতে হয়। উজবেকিস্তানে যে খাবারগুলো আমরা খেয়েছি, বেশিরভাগই তৈলাক্ত, ঝালহীন, সেদ্ধ সেদ্ধ। লবণ মরিচ নেই বললেই চলে। প্রথম তিন দিন ধরে তাঁরা আমাদেরকে একই রেস্টুরেন্টে প্রায় একই খাবার পরিবেশন করেছে। এটির নাম ছিল আফসানা রেস্টুরেন্ট। বুফে, তাই হরেক পদের খাবার। কিন্তু এসব কত খাওয়া যায়! প্লাভ (পোলাও), ভেড়ার মাংস, সেদ্ধ সবজি আর ক্রিকেট বলের সাইজের মুরগির টুকরো খেতে খেতে মুখে অরুচি ধরে গেছে। স্যুপও লবণ-মরিচবিহীন। আমাদের এক সফরসঙ্গী তো এক পর্যায়ে বলেই ফেললেন, “এই স্যুপে তো দেখি কোনো মাসলা-মাসায়িল (মসলা) নেই।” একেক বেলা বাস এসে আফসানা রেস্টুরেন্টের সামনে থামত, আর আমরা হতাশ হতাম। আবার একই জিনিস খেতে হবে! একবার তো আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছিলাম, “হায় আল্লাহ, আবার আফসানা? ইসলামি চিন্তাবিদ, লেখক ও গবেষক মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী হেসে বললেন, “আফসানা (কাহিনী) তো সেটি, যা বারবার ফিরে আসে।
তবে মূল খাবারের পর মিষ্টান্নভোজ ছিল মনে রাখার মতো। নানা পদের মিষ্টি, কেক, ফলমূল এখনও মুখে লেগে আছে। পরদিন আমরা বোখারা ত্যাগ করলাম। এবার আমাদের যাত্রা সমরকন্দ। বিশাল বাসের বহরে আমরা চললাম সমরকন্দের উদ্দেশ্যে। সমরকন্দ, যে শহরকে বলা হয় Gem of the East বা প্রাচ্যের রত্ন। খোঁড়া পায়ের বিশ্ববিজয়ী সেনাপতি তৈমুর লং-এর শহর এ সমরকন্দ। শহরটি অনিন্দ্য সুন্দর। বোখারার চেয়েও সুন্দর। কথার কথা বলছি না, সত্যিই এই শহরটি জীবন্ত রত্ম। তবে প্রাচ্যের রত্ন সমরকন্দ এবং সমরকন্দের রত্নরাজির গল্প আসবে পরবর্তী পর্বে।
—
সমরকন্দ আসার পথে আমাদের কর্মসূচীতে ছিল খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার (র.) এর কবর যিয়ারত। খাজা উবায়দুল্লাহ আহরার ছিলেন ‘তানাম ফারসুদা’ কাসীদার বিখ্যাত কবি আবদুর রহমান জামী (র.) এর মুরশিদ। এ নিয়ে আমরা নকশবন্দী সিলসিলার মোট ৮ জন শায়খের কবর যিয়ারত করলাম।
সমরকন্দ শহরে প্রবেশ করার পূর্বে খরতংক গ্রামে আমরা ৪ ঘণ্টা বিরতি দিয়েছি। এ খরতংক গ্রামেই শুয়ে আছেন উম্মতে মুহাম্মাদীর জনম জনমের গর্ব, আমিরুল মু’মিনীন ফিল হাদীস, ইমাম আবূ আবদিল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীম ইবনে মুগিরা ইবনে বারদিযবা আল-জুফী আল-বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। ১৯৪ হিজরির ১৩ই শাওয়াল তৎকালীন খোরাসানের বুখারা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ইমাম বুখারী। ২৫৬ হিজরীতে ঈদ-উল-ফিতরের রাত সমরকন্দের খরতংক গ্রামে তিনি ইন্তিকাল করেছেন। আল-জামি আস-সহীহ, যাকে আমরা সহীহ বুখারী বলি, সংকলন করে ইমাম বুখারী উম্মতে মুহাম্মদীর চোখের তাঁরা হয়ে আছেন। যুহরের নামায পড়ে বাইরে থেকে যিয়ারত করেছি। পরে ভারতের শায়খ সায়্যিদ তালহা কাসিমের সাথে একেবারে কবরের পাশে (ভেতরে) গিয়েছিলাম। সেখানে হাদীসের অমর গ্রন্থ সহীহ বুখারীর প্রথম ও শেষ হাদীসের দারস হয়েছিল। এরপর শায়খ আমাদেরকে নিয়ে দুআ করেছেন। আল্লাহর শপথ, ওই রূহানী অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তাআলার দরবারে কতো অযুত-নিযুত শুকরিয়া আদায় করলে শুকরিয়া জ্ঞাপনের হক আদায় হবে, তা আমি জানিনা।
বুখারা, সমরকন্দ সংক্রান্ত আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। এই এলাকার শিশুরা দেখতে অনিন্দ্য সুন্দর, একদম পাঁকা আপেলের মতো। মনে হয় এইমাত্র কেঁদে ফেলবে। কাছে এসে মুসাফাহা করে। আমরা সাথে সাথে কোলে নিয়ে নেই। হাদিয়া দিতে চাইলেও নেয়না। ইংরেজি বা আরবি জানেনা, তাই কথা বলার সুযোগ নেই। খরতংক থেকে আমরা চললাম সমরকন্দ শহরের দিকে।
সমরকন্দ শহরকে বলা হয় Gem of the East বা প্রাচ্যের রত্ন। এটি কেবল কথার কথা নয়। সত্যিই এই শহরটি জীবন্ত রত্ন। খোঁড়া পায়ের বিশ্ববিজয়ী তৈমুর লং-এর শহর এ সমরকন্দ। শহরটি অনিন্দ্য সুন্দর। বুখারার চেয়েও সুন্দর। ২,৭৫০ বছরের পুরনো সমরকন্দ প্রত্যক্ষ করেছে ইতিহাসের নানা পট পরিবর্তন। সাক্ষী হয়েছে বিশ্ববিজয়ীদের উত্থান-পতনের। মুসলমানদের অগ্রাভিযানের সময় অনেক মুসলিম বীরের পদধূলিতেও ধন্য হয়েছে সমরকন্দের মাটি। এজন্যই সমরকন্দের সংস্কৃতিতে ইরানি, ভারতীয়, মঙ্গোলিয়সহ প্রাচ্য ও খানিকটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। এছাড়া বিখ্যাত সিল্করোডের কেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূত্রেও সমরকন্দের সংস্কৃতি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। কিংবদন্তীতুল্য এই নগরী কতবার ধ্বংস, আর কতবার পুনর্জাগরণের সম্মুখীন হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এক শাসক সমরকন্দকে ধ্বংস করেছেন তো আরেক শাসক একে গড়েছেন। প্রতিবার শহরটি হয়ে উঠেছে আরো সুন্দর, আরো মনোরম। আজকের সমরকন্দকে প্রাচীনত্বের অনন্য আধার বলা যেতে পারে। সমরকন্দের গৌরবজ্জ্বল অতীত আর চোখধাঁধানো স্থাপত্যসম্ভার, সেই সাথে আধুনিক যুগের জাঁকজমকপূর্ণ এবং সুসজ্জিত নগরায়নের ফলে এ শহরে আগমন ঘটেছে পর্যটকদের, কবিদের, ঐতিহাসিকদের। এ শহর সব ধরনের মানুষকে আকর্ষণ করার বিস্ময়কর ক্ষমতা রাখে।
সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থান, অনুকূল জলবায়ু, প্রাকৃতিক ঝর্ণা ও সুস্বাদু পানির প্রাচুর্য, নিকটবর্তী পর্বতে খাবারের জন্য শিকারের সহজলভ্যতা এবং বিশেষত জারাফশান নদীর কারণে সমরকন্দে সেই প্রাচীন যুগেই বসতি স্থাপিত হয়েছিল। সমরকন্দ ঠিক কখন স্থাপিত হয়েছিল তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে প্রত্মতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে ধারণা করা হয়, এটি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম বা সপ্তম শতকে স্থাপিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৯ অব্দে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট সমরকন্দ জয় করেন। আলেকজান্ডারের আক্রমণের ফলে প্রাথমিকভাবে কিছু ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও গ্রিকদের তত্তাবধানে দ্রুতই শহরটি সমৃদ্ধির শিখরে আরোহণ করে।
এরপর সমরকন্দ পারস্যের সাসানি সম্রাটদের হস্তগত হয়। মুসলিম বিশ্বে উমাইয়া শাসনামলে আরব মুসলমানরা বীর সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিমের নেতৃত্বে সমরকন্দ অধিকার করেন। কুতাইবা ইবনে মুসলিম ছিলেন একজন তাবিঈ। এ সময়ে সমরকন্দ পরিণত হয় বৈচিত্র্যময় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মিলনস্থলে। তবে অনেকেই আরবদের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করেন। এরপর ১২২০ সালে সমরকন্দ দেখেছে চেঙ্গিস খানের নির্মম, নির্দয় ধ্বংসযজ্ঞ। তেজী ঘোড়া, শানিত তরবারি আর লেলিহান আগুনের শিখায় চেঙ্গিস খা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে সাজানো গোছানো সমরকন্দ। ১৩৭০ সালে সমরকন্দ বিশ্ববিখ্যাত বীর তৈমুর লং-এর রাজধানীতে পরিণত হয়। তিনি সমরকন্দকে পুননির্মাণ করেন এবং শহরটির সৌন্দর্যবর্ধন করেন। তৈমুর মানুষ হিসেবে নিষ্ঠুর ছিলেন সত্য, কিন্তু শিল্পের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ও আকর্ষণ প্রশংসার দাবি রাখে। শৈল্পিক স্থাপত্য দিয়ে তিনি তাঁর রাজধানীকে সাজাতে কুণ্ঠিত হননি। তৈমুরের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধররা সমরকন্দ শাসন করেন। তৈমুরের নাতি উলুগবেগ প্রায় ৪০ বছর সমরকন্দের শাসক ছিলেন।
তিনিই সম্ভবত সমরকন্দের ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় শাসক ছিলেন। চৌদ্দ থেকে পনের শতককে বলা যায় সমরকন্দের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। এ সময় নগরীর বেশিরভাগ শক্তিশালী দুর্গ, রাস্তাঘাট, সুদৃশ্য গম্বুজ আচ্ছাদিত ভবন গড়ে ওঠে। ১৫১০ সালে উজবেকরা সমরকন্দ দখল করে। তারপর সমরকন্দ রাশিয়ান জারদের দখলে চলে যায়। ১৯৯১ সালে উজবেকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর এটি উজবেকিস্তানের ভেতরে এ আসে এবং ঐতিহাসিক এ নগরীটি উজবেকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।
সমরকন্দে আসতে রাত ঘনিয়ে গেল। সকালে উঠে প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম ইমাম আবূ মনসুর আল-মাতুরিদী (র.) এর কবর যিয়ারতে। ইমাম মাতুরিদী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার ইমাম ছিলেন। হানাফি মাযহাবের অনুসারীরা মূলত মাতুরিদী আকীদায় বিশ্বাসী। ৯৪৪ সালে ইমাম মাতুরিদী সমরকন্দে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে এখানেই কবরস্থ করা হয়।
ওখান থেকে গেলাম উলুগবেগ অবজার্ভেটরিতে। সম্রাট তৈমুরের নাতি মির্জা উলুগবেগ (১৩৯৪-১৪৪৯) একইসাথে একজন শাসক, মহাকাশবিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ ছিলেন। ১৪২০ সালের দিকে তিনি মধ্য এশিয়ার প্রথম অবজার্ভেটরি (মানমন্দির) তৈরি করেছিলেন। ভেতরে গিয়ে দেখি একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড! হাতে লেখা গাণিতিক যুক্তিতর্কের বই-পুস্তক থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্র অবলোকন করার জন্য মেরিডিয়ান আর্ক তৈরি করা হয়েছে। ওখানকার মিউজিয়ামে মির্জা উলুগবেগের নিজের হাতে লেখা একটি বই দেখেছি, যেখানে তিনি ১০১৮টি তারকার অবস্থান ও গতি-প্রকৃতি নির্ণয় করে লিখে রেখেছেন। বিষয়টি সহজে হজম করার মতো নয়। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, কোপারনিকাস প্রমুখ যখন জ্ঞানের দুনিয়া কাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তখন মুসলিম বিজ্ঞানীরাও নিজেদের সগর্ব পদচিহ্ন পৃথিবীপৃষ্ঠে অঙ্কন করেছেন। সে পদচিহ্ন আজও ইতিহাসের পাতায় পাতায় জাজ্বল্যমান।
এরপর গেলাম উজবেকিস্তানের জাতীয় বীর, খোঁড়া পায়ের বিশ্ববিজয়ী সেনাপতি তৈমুর লং-এর (১৩৩৬-১৪০৫) সমাধিসৌধ গোর-এ-আমিরে। গোর-এ-আমির তৈমুর লং এবং তাঁর উত্তরসূরীদের কবরের উপর নির্মিত স্মৃতিসৌধ। প্রথমদিকে এটি ছিল তৈমুরের নাতি মুহাম্মাদ সুলতানের মাদরাসা। তার মৃত্যুর পর শোকাহত তৈমুর নাতির মৃতদেহকে মাদরাসার এককোণে সমাহিত করেন এবং তার ওপর তিসৌধ নির্মাণ করেন। পরে তৈমুর, তৈমুরের দুই পুত্র এবং নাতি উলুগবেগকেও এখানে শায়িত করা হয়। স্মৃতিসৌধের উজ্জ্বল নীল গম্বুজ এবং নীল টাইলসের কারুকার্য সত্যি আকর্ষণীয়।
উজবেকরা তৈমুরকে সম্মান করে ‘এমির তিমুর’ নামে ডাকে। কিছুটা ক্ষ্যাপাটে, প্রচ- দুর্ধর্ষ এই তুর্কী-মোঙ্গল সেনাপতি মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত তাঁর সম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। তুর্কী-মোঙ্গল সেনাধ্যক্ষ তৈমুর লং ছিলেন তিমুরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১৩৭০ থেকে ১৪০৫ সাল পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ বছর ছিলো তাঁর রাজত্ব। আজকের দিনের তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ তথা কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, পাকিস্তান, ভারত, এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৩৬০ সালে তৈমুর সেনা অধ্যক্ষ হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তিতে ১৩৬৯ সালে সমরকন্দের সিংহাসনে আরোহন করেন। ১৩৯৮ সালে তৈমুর দিল্লি সুলতানাত আক্রমণ করেন এবং মাত্র কয়েকমাসের মধ্যে দিল্লি জয় করেন। এখানে তিনি এক লক্ষ যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করেন। তিনি অটোমান সাম্রাজ্য, মিশর, সিরিয়া, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া প্রমুখ দেশেও সামরিক অভিযান চালান। সব জায়গাতেই ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় ও অনেক জনপদ বিরান করে ফেলা হয়। তাঁর সেনারা যে স্থানই জয় করত সেখানেই ধ্বংসযজ্ঞের প্রলয় তুলত।
এরপর আমরা গেলাম উজবেকিস্তানের শাহে যিন্দাখ্যাত মুকুটহীন বাদশা, প্রখ্যাত সাহাবি সায়্যিদুনা কুসাম ইবনে আব্বাস (قثم بن العباس) (রা.) এর যিয়ারতে। কুসাম ইবনে আব্বাস (রা.) ছিলেন আহলে বায়তের একজন সদস্য। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচাতো ভাই। তাঁর চেহারা ও আখলাক ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেহারা ও আখলালের অনুকরণে। তিনি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গোসল দিয়েছিলেন এবং কবর শরীফে নামিয়েছিলেন। তাবিঈ কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে তিনি এই দূরদেশে এসেছিলেন আল্লাহর দ্বীন কায়িম করার উদ্দেশ্যে। আল্লাহ তাঁর ত্যাগকে কবূল করেছেন। তিনি যুদ্ধরত অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেছেন।
উমাইয়া শাসনামলে ৮৬ হিজরিতে কুতাইবা ইবনে মুসলিমকে খোরাসানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। ৮৯ হিজরিতে কুতাইবা বুখারার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি আমুদরিয়া অতিক্রম করেন। সিফলি অঞ্চলে শত্রুবাহিনীর সাথে তাঁর লড়াই হয়। কুতাইবা এই বাহিনীকে পরাজিত করে বুখারায় পৌঁছেন। বুখারায় প্রথমদিকে মুসলিম বাহিনী পরাজিত হয়। দ্বিতীয়বারের প্রচেষ্টায় কুতাইবা বুখারা বিজয় করেন। ৯৩ হিজরিতে কুতাইবা খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য আক্রমণ করলে খাওয়ারিজমের শাসক মুসলমানদের সাথে সন্ধি করে নেয়। যুদ্ধ ছাড়াই এ অঞ্চল মুসলমানদের হাতে আসে। এরপর কুতাইবা সমরকন্দ বিজয়ের ইচ্ছা করেন। প্রথমে তিনি তাঁর ভাই আবদুর রহমানকে সমরকন্দে প্রেরণ করেন। কয়েকদিন পর একটি বাহিনী নিয়ে তিনিও সমরকন্দের পথে রওনা হন। শহরবাসী মুসলিম বাহিনীর দেখা পেয়ে শহরের ফটক বন্ধ করে দেয়। তারা কেল্লাবন্দী হয়ে বসে থাকে। মুসলিম বাহিনী প্রায় এক মাস শহর অবরোধ করে রাখে। শহরবাসী পত্র মারফত চীন ও ফারগানার শাসকের সাহায্য কামনা করে। পত্র পেয়ে আশপাশের শাসকরা সমরকন্দের সাহায্যে এগিয়ে আসে। চীন সম্রাট তার পুত্রকে বিশাল বাহিনী দিয়ে কুতাইবার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কুতাইবা এ বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য সালেহ ইবনে মুসলিমের নেতৃত্বে ৬০০ সেনার একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। মধ্যরাতে মুসলিম বাহিনী শত্রুপক্ষের ওপর গেরিলা হামলা চালায়। আচমকা আক্রমণের জন্য শত্রুরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। রাতের আচমকা হামলার ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই তাদের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবর্তে পালাতে থাকে। এদের পরাজয়ের সংবাদ শুনে সমরকন্দবাসীর মনোবল ভেঙে যায়। এদিকে কুতাইবা তখন মিনজানিকের মাধ্যমে শহরের প্রাচীরে গোলাবর্ষণ করছিলেন। শহরের প্রাচীরের একাংশ ভেঙে যায়। বাধ্য হয়ে শহরের বাসিন্দারা আত্মসমর্পণ করে।
এরপর আমরা গিয়েছিলাম বিশ্বখ্যাত রেগিস্তান স্কয়ারে। রেগিস্তান স্কয়ার সমরকন্দ শহরের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রাচ্যের চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন হিসেবে এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। এ চত্বরটির তিনপাশে রয়েছে কেন্দ্রের দিকে মুখ করা তিনটি মাদরাসা। মাদরাসাগুলোর দু’পাশে নীল রঙের সুদৃশ্য উঁচু মিনার। তৈমুরি বংশের শাসনামলে তৈরি করা তিনটি মাদরাসার সমন্বয়ে এ জায়গাটি পৃথিবীর অন্যতম মনোমুগ্ধকর স্থান। ভবনের ছাদে থাকা দৃষ্টিনন্দন নীল মিনার সহজেই পর্যটকের দৃষ্টি কাড়ে। অনন্যসাধারণ এ স্থাপত্যের নির্মাণশৈলী দেখে প্রাচীন নির্মাতাদের প্রতি নিজের অজান্তেই মনের ভেতর গভীর শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও স্থাপত্যশৈলীর কারণে ২০০১ সালে ইউনেস্কো রেগিস্তান চত্বরকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ বলে ঘোষণা করে।
‘রেগিস্তান’ শব্দের অর্থ বালুময় প্রান্তর। এক সময় এখানে ভবনবেষ্টিত চত্বর ছিল না, ছিল খোলা মাঠ। রাজকীয় ফরমান শোনার জন্য আগে এখানে লোকজন জমায়েত হতো। যেকোনো জাতীয় উৎসবও পালন করা হতো এ চত্বরে। আজকের উজবেকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নে পরিণত হয়েছে রেগিস্তান স্কয়ার। নিজের চোখ না দেখলে এ চত্বরের সৌন্দর্য অনুধাবন করা সম্ভব নয়।
—
প্রাচ্যে রত্ন সমরকন্দে আমাদের অবস্থানের পালা শেষ হলো। আমাদের যাত্রা এবার তিরমিয শহরে। সকাল ৮টায় গাড়িতে চড়লাম। প্রায় সারাদিন কেটে গেল গাড়িতে। প্রশস্ত রাস্তাঘাট, খানাখন্দ নেই বললেই চলে, ট্রাফিক জ্যামও দেখা যায় না। তবুও গাড়িগুলো চলে শামুকের গতিতে। বসতে বসতে ক্লান্ত হয়ে একেকবার উঠে দাঁড়াই। ওমনি সাথে থাকা ট্যুর গাইড দৌঁড়ে আসে। বলে, বসে পড়। তোমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমি কালকে গাইডকে বললাম, শুনো আমরা সেই জাতি, যারা প্রয়োজনমতো পুরো দেশের মানুষ একটি রেলগাড়িতে চড়ে বসতে পারি। এই বিছানার মতো রাস্তায় শামুকের গতিতে চলা গাড়িতে আমার দেশের দুই বছরের বাচ্চা ফুটবল খেলতে পারবে।
সত্যিই আমাদের পুরো সফরে গাড়িগুলোর স্পিড কখনও ৬০-এর ওপরে উঠেনি। তার ওপর চারটি বাস, চারটি মাইক্রোবাস, দুটি কার, একটি এম্বুলেন্স এবং আগে পিছে পুলিশের এস্কোর্ট। একজন যাত্রী হাঁচি দিলেই পুরো বহর থেমে যায়। সবাই বাস থেকে নামে, কী হয়েছে দেখার জন্য। এদের সবাইকে জড়ো করে আবার বাসে তুলতে আরও আধঘণ্টা সময় চলে যায়। বাস ছেড়ে দেওয়ার পর দেখা যায় দুই-তিনজন কোথা থেকে দৌঁড়ে আসছেন। চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়, এরা বাঙালি।
দুপুরে পৌঁছালাম কাশকাদারিয়া। উরঘুদ পর্বতমালা দিয়ে ঘেরা তাজিকিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা এই কাশকাদারিয়া। সবুজ তৃণভূমির ওপর পাহাড়ের নীলাভ ছায়া পড়ে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। মনে হয়, পরিচিত পৃথিবী নয়; অন্য কোথাও চলে এসেছি। ভাবি, এই দুরদেশে কারা বসবাস করে? কী তাদের পরিচয়? এক মানবজাতি, আর কত বৈচিত্র তাদের মধ্যে!
যুহরের নামায শেষে ইমাম আবু মুঈন আন-নাসাফী (র.) এর কবর যিয়ারত করলাম। তিনি আকাইদে নাসাফীর লেখক নন; তিনি অন্যজন। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হলো একটি ধাবার মতো জায়গায়। উজবেক প্লাভ (পোলাও), সাথে ভেড়ার মাংস। নানা দেশের নানা ভাষার নানা বর্ণের মানুষ একত্রে বসে খেলাম। কেউ ব্রিটিশ, কেউ আরব, কেউ ফ্রেঞ্চ, কেউ ফিলিপিনীয়, আবার কেউ উপমহাদেশের। ইসলাম সবাইকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে। খাওয়া যতটা না আনন্দের, তার চেয়ে বেশি আনন্দ ছিল ওই মেলবন্ধনে।
খাওয়া শেষে আবার গাড়িতে চড়লাম। পাহাড়ের চূড়াঘেষা পথ ভেঙ্গে টানা পথ চললাম দক্ষিণ দিকে। রাত ১১টায় এসে পৌছালাম সুনান আত-তিরমিযীর সংকলক ইমাম আবূ ঈসা আত-তিরমিযী (র.) এর কবরে। তাঁর কবর তিরমিয শহরে নয়। তিরমিয থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে, শেরোবদ নামক এলাকায়। সত্যি কথা বলতে, আমরা তখন এতো বেশি ক্লান্ত ছিলাম যে, যিয়ারতের আবেগ মরে গিয়েছিল। কিন্তু ইমাম তিরমিযীর কবরের পাশে দাঁড়ানো মাত্র ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। এতদিন ধরে যার পরিশ্রমের ফসল ভোগ করেছি, আজ এসে দাঁড়িয়েছি সেই মহাত্মার সামনে। হৃদয়টি শ্রদ্ধায় ভরে গেল। ক্লান্তি, ক্ষুধা সব ছাপিয়ে মনের কোণে জমে থাকা সীমাহীন কৃতজ্ঞতা অশ্রুর রূপ ধারণ করে চোখ বেয়ে বেরিয়ে এলো।
২০৯ হিজরীতে ইমাম তিরমিযী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৭০ বছর বয়সে, ২৭৯ হিজরীতে ইলমুল হাদীস ও আরবী ভাষাবিজ্ঞানের এ মহান ইমাম বুগ পল্লীতে ইন্তিকাল করেন। ইমাম তিরমিযী ছিলেন অসাধারণ এবং বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। এ বিষয়ে শাহ আবদুল আযীয দেহলভী ‘বুসতানুল মুহাদ্দিসীন’ কিতাবে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী কোনো এক মুহাদ্দিসের কাছ থেকে ইযাযতস্বরূপ হাদিসের দুটি পা-ুলিপি লাভ করেছিলেন। অর্থাৎ ওই মুহাদ্দিস তাঁকে পা-ুলিপি দুটিতে লিপিবদ্ধ হাদীসগুলো বর্ণনা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম তিরমিযীর আকাক্সক্ষা ছিল পা-ুলিপি দুটির বিষয়ে সরাসরি উস্তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া। একবার এক সফরে ওই উস্তাদের সঙ্গে ইমাম তিরমিযীর সাক্ষাৎ হলে তিনি নিজের বাসনার কথা তাঁকে জানান। উস্তাদ বললেন, ঠিক আছে পা-ুলিপি দুটি নিয়ে এসো। ইমাম তিরমিযী নিজ বাসস্থানে গিয়ে তালাশ করে পাণ্ডুলিপি পেলেন না। তিনি বুঝতে পারলেন হাদীসের পা-ুলিপি বাড়িতে রয়ে গেছে, তার পরিবর্তে তিনি সাদা কাগজ নিয়ে এসেছেন। তিনি খুবই পেরেশান হলেন। অতপর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি পাণ্ডুলিপি সদৃশ সাদা কাগজ নিয়ে উস্তাদের সামনে বসে গেলেন। উস্তাদ হাদীস পড়তে লাগলেন আর তিনি ওই কাগজের ওপর এমনভাবে চোখ ঘোরাতে লাগলেন, যেন তিনি উস্তাদের পঠিত হাদীসের সঙ্গে পাণ্ডুলিপি মিলিয়ে নিচ্ছেন। একসময় উস্তাদ বিষয়টি বুঝতে পারলেন। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে মশকরা করছ? ইমাম তিরমিযী অত্যন্ত আদবের সঙ্গে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে বললেন, আপনার পঠিত সব হাদীসই আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে। আমি মুখস্থ করে নিয়েছি। উস্তাদ তখন তাঁকে হাদীসগুলো শোনাতে বললেন। তখন তিনি সবগুলো হাদীস নির্ভুলভাবে শুনিয়ে দিলেন। অতঃপর উস্তাদ তাঁকে পরীক্ষা করার জন্য অতিরিক্ত আরো ৪০টি হাদীস শুনালেন। ইমাম তিরমিযী সেগুলোও হুবহু শুনিয়ে দিলেন। উস্তাদ আশ্চর্য হয়ে বললেন, তোমার মতো আর কাউকে আমি কোনো দিন দেখিনি। ইমাম তিরমিযী ইলমে হাদীসের যে বিশাল জ্ঞানভা-ার আত্মস্থ করেছিলেন, তা দিয়ে তিনি অসংখ্য যোগ্য মুহাদ্দিস তৈরি করে রেখে গেছেন। একই সময়ে তাঁর হাদীসের দারসে হাজারো উচ্চতর জ্ঞানপিপাসু উলামায়ে কিরাম উপস্থিত হতেন। এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর কাছ থেকে ৯০ হাজার মুহাদ্দিস ইলমে হাদীসের শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
এরপর আবার বাসে চড়লাম সুরখান্দারিয়া প্রদেশের উদ্দেশ্যে। রাত ২টায় এসে পৌঁছালাম সুরখান্দারিয়া প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত তিরমিয শহরে। এ শহরটি একেবারে আফগানিস্তান সীমান্তে। রাস্তায় একবার গাড়ি বহর থেমেছিল। নেমে আমরা কয়েকজন গ্রাম্য (পাহাড়ি) লোকদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। যদিও কেউ কারও কথা বুঝতে পারিনি, তবে মনের ভাব প্রকাশে তেমন সমস্যাও হয়নি। তিরমিয এলাকার মানুষজন দেখতে অনেকটাই আফগানদের মতো। লম্বাটে গড়ন, মাথায় বিশাল বড় পাগড়ি, পশতু টানে কথা বলে। বাকি উজবেকদের মতো এরাও অমায়িক, অতিথিপরায়ণ।
পরদিন আমরা তিরমিয শহর থেকে বের হয়ে প্রখ্যাত সূফি-চিকিৎসক হাকিম তিরমিযী এবং নকশবন্দী তরীকার শায়খ আলাউদ্দীন আত্তার (র.) এর কবর যিয়ারত করলাম। শায়খ আলাউদ্দীন আত্তার ৭৩৯ হিজরীতে এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অল্পবয়সেই পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সব ধনসম্পদ ভাইদেরকে দিয়ে তিনি শূন্য হস্তে দ্বীনী ইলম অর্জনের জন্য বুখারায় চলে যান। এক পর্যায়ে তাঁর সাক্ষাত হয় ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ বুখারী (র.) এর সাথে। তিনি ইমাম নকশবন্দের কাছে তাঁর কন্যা বিয়ে করার আবেদন করেন। ইমাম নকশবন্দ আলাউদ্দীন আত্তারের কাছে নিজের কন্যাকে বিবাহ দেন। একদিকে নকশবন্দিয়্যা সিলসিলায় ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দের খলীফা খাজা ইয়াকুব চারখি, অপরদিকে নকশবন্দিয়্যা-মুজাদ্দেদিয়া সিলসিলায় ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দের খলীফা হচ্ছেন তাঁর জামাতা আলাউদ্দীন আত্তার।
তিরমিয থেকে আমরা ফ্লাইটে চড়লাম উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দের উদ্দেশ্যে। তাশখন্দে পৌঁছে উজবেকিস্তানের সাবেক গ্রান্ড মুফতি, মধ্য এশিয়ার খ্যাতনামা আলিমে দ্বীন সূফি শায়খ মুহাম্মদ সাদিক মুহাম্মদ ইউসুফের স্মৃতিবিজড়িত মসজিদে আমাদের সমাপনী অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। সেখানে পরিচিত হলাম শায়খ ইউসুফের পুত্রের সাথে, যিনি বর্তমানে ওই মসজিদের খতিব।
প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ আমাদেরকে খাবার দেওয়া হলো। খাবার খেয়ে আমরা চলে গেলাম হাস্ত ইমাম কমপ্লেক্সে। এখানে সংরক্ষিত আছে আমীরুল মুমিনীন সায়্যিদুনা উসমান ইবনে আফফান (রা.) এর সময়ে লিখিত পবিত্র কুরআনের মূল কপিগুলোর মধ্যে একটি। এর নাম ‘মুসহাফে সমরকন্দ’। অটোমান খিলাফতকালে তৈমুর লং সিরিয়া থেকে লুণ্ঠন করে এ পাণ্ডুলিপি মধ্য এশিয়ায় নিয়ে আসেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী পা-ুলিপিটি সমরকন্দে তার সমাধিতে রাখা হয়েছে বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। পরবর্তীকালে এটি রাশিয়ান সম্রাজ্যের রাজধানী পেট্রোগাদে (লেনিনগ্রাদে) স্থানান্তরিত হয়। কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর লেনিনের নির্দেশে এটি পুনরায় তাশখন্দে ফেরত পাঠানো হয়। এখনো তা সেখানেই আছে। উজবেকিস্তানে স্থানান্তরিত হবার পূর্বে এ কপিটি দীর্ঘকাল যাবৎ লেনিনগ্রাদের ইম্পেরিয়াল মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ছিল। বর্তমানে এটি তাশখন্দে সংরক্ষিত আছে। আল্লাহর কালামের প্রাচীন লিখিত সংস্করণ দেখে চোখের পানি আটকাতে পারিনি। হংকংয়ের এক শায়খ আমাকে বললেন, দেখুন আমাদের ইতিহাস কতো সুরক্ষিত। আমি বললাম, শায়খ, যে ইতিহাস কুরআনের হাত ধরে চলে, সেটি সুরক্ষিত না হয়ে পারে? ওখানে রয়েছে মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদ।
রাতে আমাদের ফ্লাইট। উজবেকিস্তানকে আল-বিদা বলার সময় এসে গেছে। এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে আমরা স্থানীয় বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা করলাম। যুদ্ধাস্ত্রের মতো শক্ত ও মোটা একটি কোট, সাথে চারকোণা বিশিষ্ট একটি টুপি আজও আমার আলমারিতে শোভা পাচ্ছে। সমরকন্দ থেকে কেনা নয়নাভিরাম বাসনকোসন দেখে যদিও মানুষ আহ্লাদিত হয়েছে; তবে এ বেঢক সাইজের পোশাক কেবল হাসির উপকরণ-ই যোগান দিয়ে আসছে।
দীর্ঘ এক সপ্তাহের সঙ্গী আমাদের ট্যুর গাইডরা এয়ারপোর্টের বাইরে আমাদের হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিল। তাঁদেরকে কিছু হাদিয়া দিয়ে আমরা মুসাফাহা করলাম। অনেকেই তখন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। এরা দীর্ঘ এক সপ্তাহ আমাদেরকে সাধ্যমতো সঙ্গ দিয়েছে। চাইবার আগে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। উজবেকিস্তানে এসে অনেক কিছু দেখলাম, শিখলাম। পেছনে রেখে গেলাম একদল অমায়িক বন্ধুবৎসল ভালো মনের মানুষকে। ওরা এবং ওদের নয়নাভিরাম মাতৃভূমি চিরদিন আমাদের হৃদয়ে অম্লান স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে ফ্লাইট আকাশে উড়ল, টের পেলাম না।
লেখক: পরিচালক, তাইয়্যিবা ফাউন্ডেশন