1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
ষোলই ডিসেম্বরের শিক্ষা
অধ্যাপক আবদুল গফুর
  • ৩ নভেম্বর, ২০২২

ইসলামের একটি শিক্ষা হলো, পৃথিবীতে আল্লাহ কোন জাতি বা জনগোষ্ঠীকে যখন কোন সুযোগ বা ক্ষমতা দান করেন, তখন সেই জাতি বা জনগোষ্ঠী যদি আল্লাহর সেই নিআমতের মর্যাদা দিতে সক্ষম না হয় এবং সেই নিআমতের আলোকে আল্লাহর আনুগত্য করার পরিবর্তে তারা যদি আল্লাহর নাফরমানী, অকৃতজ্ঞতা এবং পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা ও বিলাসব্যসনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, আল্লাহ তখন তাদেরকে সেই নিআমত থেকে বঞ্চিত করে দেন। এমনকি এই জনগোষ্ঠী যদি মুসলিম নামধারীও হয়, তবুও আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান হতে তারা মুক্তি পায় না। ইসলামের আরেকটি শিক্ষা হলো, প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ মানুষকে স্বাধীনতাপ্রিয় করে সৃষ্টি করেছেন। ইসলামের মূল আদর্শ তাওহীদ, আর এই তাওহীদের মূল শিক্ষাই হলো, এক আল্লাহ ছাড়া কেউ মানুষের ইলাহ বা প্রভু নয়। এ কথাটা যেমন ব্যক্তির জীবনে সত্য, তেমনি সত্য যেকোন জনগোষ্ঠীর জন্য। শুধু পেশিবল প্রয়াগ করে কোন মানুষকে যেমন চিরদিনের জন্য গোলাম করে রাখা যায় না, তেমনি কোন জনগোষ্ঠীকেও গায়ের জোরে অস্ত্রের জোরে পদানত করা বা পদানত করে রাখার চেষ্টা পরিণামে সাফল্যমন্ডিত হয় না। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, এমনকি অতি সম্প্রতিকালের সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আজকের বিশ্ব মানবের সোচ্চার হয়ে ওঠা থেকে ইসলামের এই মহান শিক্ষার সঙ্গে মানব প্রকৃতির গভীর সম্পর্কই দৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়। কোন ব্যক্তি বা কোন জনগোষ্ঠীকে অন্যায়ভাবে শৃঙ্খলিত করতে চাইলে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে যে ব্যর্থ হতে বাধ্য, তা যেমন অন্যান্য মানুষের বেলায় সত্য, তেমনি সত্য মুসলমানদের বেলায়।

ইসলাম মানব-ইতিহাসের চালিকাশক্তির সঠিক পথনির্দেশ করেছে এবং কুরআনুল কারীমে বারবার তাকীদ দেওয়া হয়েছে, অতীতের বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান-পতনের ইতিহাস হতে শিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু ইতিহাসের বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় না। এরই পরিণতিতে মানব জাতি পৃথিবীর দিকে দিকে আজ চরম ভোগান্তির মধ্যে কালাতিপাত করছে। কুরআনুল করীমের নির্দেশনার আলোকে মানুষ যদি সুদূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পথ চলত, তবে তার দুঃখ-দুর্দশা অবশ্যই কম হত।

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর এবং তার ঐতিহাসিক পটভূমির দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? আমরা দেখি, পূর্বতন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষের মাধ্যমে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে ১৬ই ডিসেম্বরে। ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত লজ্জাকর ঘটনা হিসেবে পাকিস্তানের প্রায় এক লক্ষ মুসলিম সৈন্য সেদিন যিল্লতীর পরাজয় বরণ করে। ১৬ই ডিসেম্বর যেমন একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের দিন হিসেবে পরম গৌরবের দিন, তেমনি একটি যালিম মুসলিম শক্তির যুলমের পরিণতি হিসেবে চরম যিল্লতী বরণের লজ্জাকর দিনরূপে সবার জন্য এক শিক্ষণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত।

১৬ই ডিসেম্বর শিক্ষা দেয় ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনাই গভীর তাৎপর্যবহ এবং মানুষের কার্যকারণ কর্মফলের দৃষ্টান্তস্থল। ১৬ই ডিসেম্বর হঠাৎ রাতারাতি ঘটে নাই। ১৬ই ডিসেম্বরের পেছনে ছিল ২৫শে মার্চের নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযঞ্জের বেদনাদায়ক ঘটনা। সেদিনকার পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের একটি অংশের নিরীহ জনগণের উপর সেনাবাহিনী নৃশংস হামলা চালিয়ে যে অকল্পনীয় যুলমবাজীর পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল, তথাকথিত স্বদেশের সেনাবাহিনী স্বদেশের জনগণকে পরাভূত করার যে স্পর্ধা দেখিয়েছিল, তারই পরিণতিতে তারা জনগণের ধিক্কার কুড়িয়েছিল। আর তারই পরিণাম ফল হিসেবে একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানী বাহিনী চরম যিল্লতীর ভাগ্যবরণ করেছিল।

ষোলই ডিসেম্বর প্রমাণ করেছে, যুলমের পরিণাম যে কখনো শুভ হতে পারে না, যালিমদের দম্ভ ও হঠকারীতাকে আল্লাহ যে বরদাশত করেন না এবং আল্লাহর বিধান যে অমুসলিম ও মুসলিম নামধারী নির্বিশেষে সকলের জন্যই একইরূপ কার্যকরী- এই মহান সত্যের অনিবার্যতা। দু’শ বছরের জানা অজানা অসংখ্য সাধক ও সংগ্রামীর সাধনা ও সংগ্রামের ফলশ্রুতি হিসেবে আল্লাহ এই উপমহাদেশের দুই প্রান্তে অবস্থিত দুই ভূখন্ডের দুটি মুসলিম আবাসভূমিতে ঐক্য ও সমঝোতার ভিত্তিতে বসবাসের যে অনন্য নিআমত দিয়েছিলেন, তার উপযুক্ত মর্যাদাদানে যোগ্যতার প্রমাণ সাতচল্লিশ-পরবর্তী নেতৃবৃন্দ দিতে পারেন নি। কী পশ্চিম কী পূর্ব, উভয় অঞ্চলের নেতৃবৃন্দের জন্য কথাটি কম-বেশি খাটে। সুতরাং আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধানেই এই নিআমত থেকে উপমহাদেশের মুসলিম জনগণকে বঞ্চিত করে এক মহান পরীক্ষার মধ্যে তাদের নিক্ষেপ করা হয়েছে।

আল্লাহর বিধানে ওয়াদা ভঙ্গের শাস্তি সুকঠোর। পাকিস্তান অর্জন করা হয়েছিল ইসলামের ওয়াদায়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ জনগণের কাছে প্রদত্ত তাদের এই ওয়াদা বেপরোয়াভাবে লঙ্ঘন করে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থপরতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, কলহ-কোন্দল এবং ভোগ-বিলাসে উন্মত্ত হয়ে পড়ে। ১২০০ মাইল ব্যবধানের দুটি স্বতন্ত্র বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ড মিলে একটি রাষ্ট্র গড়ার প্রস্তাব এমনিতেই ছিল ইতিহাসের নযীরবিহীন অসাধারণ ও সুকঠিন একটি ব্যাপার। এই সুকঠিন দায়িত্ব পালন সম্ভব হত যদি ইসলামী আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার সাধনায় নেতৃবৃন্দ একনিষ্ঠভাবে আত্মনিয়োগ করতেন। ভৌগোলিক সংলগ্নতাবর্জিত দু’টি ভূখণ্ড যার মধ্যে ভাষা, আবহাওয়া প্রভৃতি অনেক বিষয়েই মিল ছিল না, তার একমাত্র যোগসূত্র ছিল ইসলাম; অথচ যোগসূত্রের সেই একমাত্র উপাদানটিকেই করা হলো চরমভাবে অবহেলা। ফলে স্বার্থপরতা ওয়াদা ভঙ্গের পরিণতিতে যা হওয়ার, তাই হলো।

ষোলই ডিসেম্বরের আরেকটি শিক্ষা এই যে, মানবপ্রকৃতির মধ্যেই আল্লাহ স্বাধীনতার অদম্য আকুতি সৃষ্টি করেছেন। হাজার বছরের গোলামী যিন্দেগীর চাইতে একদিনের আযাদ জীবনকে মানুষ অনেক বেশি মূল্য দেয়। বাংলার মানুষ একদিন পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল স্বাধীন দেশে বসবাস করার স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু ভিতরে এক শ্রেণির পশ্চিমা নেতা ও আমলা চাইছিলেন বাংলার বুকে পাঞ্জাবী আধিপত্যবাদ কায়িম করতে, যার নৃশংস বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২৫শে মার্চের কালো রাতে। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাকামী জনগণ এই প্রভুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এক অসম যুদ্ধে। মানুষের স্বাধীনতা কামনা যে দুর্দমনীয় এবং যুলম, হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যে মানুষের স্বাধীনতা কামনাকে স্তব্ধ করা যায় না, তার প্রমাণ ষোলই ডিসেম্বর। পাকিস্তানী বাহিনীর নয় মাসের বর্বর অভিযানে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, শত শত মা-বোনের ইযযত হরণ করা হয়েছে, ধ্বংস করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ আর এসব করা হয়েছে ইসলাম রক্ষার নামে। কিন্তু চির ইসলামপ্রিয় বাংলার মানুষ এসব কথায় কান না দিয়ে প্রমাণ করেছে, ইসলাম এবং যুলম বর্বরতাকে তারা কখনও সমার্থক মনে করতে অভ্যস্ত নয়। তারা তাদের এ বিশ্বাসও প্রমাণ করেছে যে, ইসলাম মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করতে আসে নাই, এসেছে এক আল্লাহর ইলাহিয়াতের অধীনে। সমস্ত মানবীয় প্রভুত্ববাদ ও আধিপত্যবাদের শৃঙ্খল ছিন্ন করতে।

ষোলই ডিসেম্বরের সবচাইতে বড় শিক্ষা কোন মানুষ বা মানবগোষ্ঠীর কোন চিরন্তন শত্রু-মিত্র থাকে না। আজ যে পরম শত্রু, কাল সে পরম সুহৃদও হয়ে যেতে পারে। উপমহাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই উপমহাদেশে বৃহৎ দু’টি জাতি- হিন্দু ও মুসলিম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দ্বন্দ্বে রত। দু’টি জাতির ধর্ম, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি-নীতি ও মূল্যবোধের পার্থক্যের কারণে সমগ্র উপমহাদেশের মুসলিম জনগণ পাকিস্তান আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আর এই পাকিস্তান আন্দোলনে বাংলার মুসলমানদের অবদান যে ছিল সর্বাধিক, তা এক ঐতিহাসিক সত্য। পাকিস্তান আন্দোলনের মূল সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই ঢাকারই বুকে এবং তার প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিলেন তদানীন্তন মুসলিম বাংলার অবিসংবাদিত নেতা নবাব সলীমুল্লাহ। ১৯৪০ সালে বাংলারই আরো এক কৃতিসন্তান শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পাকিস্তান দাবি যখন ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের চরম বিরোধিতার মুখে প্রবল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তখন বাংলার আর এক কৃতিসন্তান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বাধীন উপমহাদেশের একমাত্র মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা সেই ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে দৃঢ়ভাবে কায়েদে আযমের পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন দিয়ে পাকিস্তান দাবিকে জোরদার ও অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। প্রধানত বাংলার মুসলমানদের প্রবল সংগ্রামের ফলেই, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সেদিন সম্ভব হয়। সাতচল্লিশের ১৪ই আগস্টের পূর্বে যে বাংলার মুসলমানরা প্রাণপাত করল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য, একাত্তরে এসে তাদেরই অস্ত্র ধরতে হলো পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য। কারণ পঁচিশে মার্চের পর পাকিস্তান টিক্কাশাহীর কল্যাণে বাংলার মুসলমানদের জন্য হয়ে উঠেছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর গোলামীস্থান, যা ছিল বর্বরতা, পৈশাচিকতা ও উন্মত্ত হত্যাযজ্ঞের প্রতীক। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাকামী বাংলার দামাল ছেলেরা সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক অসম প্রাণান্তকর সংগ্রামে।

কিন্তু বাংলার এই বীর ছেলেরা সেদিন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এজন্য ঝাঁপিয়ে পড়েনি যে তারা পিণ্ডির বদলে দিল্লীর প্রভুত্ব মেনে নেবে। একাত্তরের পর তাই যখন দেখা গেল পিণ্ডির প্রভুত্বের অবসানের পর দিল্লীর ব্রাহ্মণ্যবাদী নয়া চাণক্যাগোষ্ঠী স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের পেটুয়া রাষ্ট্রে পরিণত করার ফন্দী-ফিকির আটছে, তখন তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তারা বুঝল, একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি পর্ব শেষ হয়েছে মাত্র, শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্ব; যা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এবং শত্রুর বৃহত্তর শক্তিমত্ততার কারণে হবে আরো দীর্ঘায়িত, আরো সুকঠিন, আরো প্রাণান্তকর। বাহাত্তর থেকে শুরু হওয়া এই সংগ্রামের পালা আজও চলেছে, কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারে না। একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের পর ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানী বাহিনীর পরিত্যক্ত কোটি কোটি টাকার অস্ত্রশস্ত্র এবং বড় বড় মিল কারখানার যন্ত্রপাতি ভারতে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থায়ী সমঝোতার পূর্বেই ফারাক্কা বাঁধ চালু করে বাংলাদেশের পশ্চিম দক্ষিণ অঞ্চলের ৮টি জেলাকে মরুভূমিতে পরিণত করার অপচেষ্টা, তিস্তাসহ আরো আটটি নদীর প্রবাহ থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে বাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ, বাংলাদেশের বাকী অংশ গঙ্গা-ব্রহ্মপূত্র সংযোগ খাল খননের মাধ্যমে কব্জা করার সুচতুর পরিকল্পনা, বাংলাদেশের উপর দিয়ে রেল ও নৌ ট্রানজিট চালানো, বেরুবাড়ী, দহগ্রাম, আঙ্গরপোতা ও তালপট্টিতে তার আগ্রাসী ভূমিকা, আসাম ও বিহারে বাঙ্গাল খেদানোর অজুহাতে মুসলমান খেদা অভিযান চালানো, সর্বশেষ-বাংলাদেশের ছয়টি জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতের কুক্ষিগত করার লক্ষ্যে দিল্লীর বুকে তথাকথিত ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টে’র মাধ্যমে ‘বঙ্গভূমি’ রাজ্য গঠনের পাঁয়তারা চলছে। এসব ঘটনা থেকে আজ জনগণের কাছে সুস্পষ্টঃ আজ বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার প্রধান শত্রু কে? তাই বলছিলাম, ষোলই ডিসেম্বরের এক মহান শিক্ষা হচ্ছে, জাতির জীবনে চিরন্তন শত্রু মিত্র বলে কিছু থাকতে পারে না।

এই পরম সত্যটি উপলব্ধি না করে পুরাতন অভ্যাস বশত আজও যারা তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্রের দেব-চরিত্রের গুণগান করণে অন্ধ একাগ্রতা প্রদর্শন করছেন, তাদের চৈত্র মাসে পৌষের গান জনগণের কানে বেসুরোই বাজছে, যদিও সেদিকে নযর দেওয়ার তাদের অবকাশ নেই।

এ প্রসঙ্গে এ কথা অবশ্যই বলতে হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে অনেক স্বাধীনতাকামী, বিশেষত ইসলামপন্থী নেতৃত্বের এক বিরাট অংশ সেদিন দুঃখজনক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পিছনে মুসলমানদের বহু শতাব্দীর পরীক্ষিত শত্রু ব্রাহ্মণ্যবাদীর সাময়িক মদদ দেখে এই যুদ্ধকে তারা ভুল বুঝেছিলেন। অথচ তারা গভীরভাবে ভেবে দেখেন নি যে, মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা ৯৯ ভাগই মুসলমান এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের আন্তরিকতা ছিল সব সংশয়ের উর্ধ্বে। পরবর্তীকালে এই মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণকারী অসংখ্য জানা-অজানা মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্রজালের শিকার হয়েছেন। ইসলামের সঙ্গে বর্বরতা ও যুলুম নির্যাতনের কোন সম্পর্ক যে থাকতে পারে না, সেদিন এই সত্য উপলব্ধি করতে এবং সোচ্চার কণ্ঠে তা ঘোষণা করতে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। তবে মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে। সেই ভুল স্বীকারে কোন লজ্জা বা গ্লানির কিছু নেই থাকা উচিতও নয়।

ষোলই ডিসেম্বরের আরো একটি বড় শিক্ষা, মানুষের স্বাধীনতার আকুতি কোন দিনই পশুশক্তি বলে দমন করা যায় না। আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে শুধু স্বাধীনতার আকুতি সৃষ্টি করে দিয়েই ক্ষান্ত হন নাই; তিনি আরো শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে মাথা নত করবে না, হোক সে পার্থিব বিচারে বিরাট শক্তি। একাত্তরে প্রবল পরাক্রান্ত পাকিস্তানী বাহিনী যেমন পারেনি বাংলার জনগণের স্বাধীনতা কামনাকে স্তব্ধ করতে, তেমনি আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যারা পরাধীনতায় রূপান্তরিত না করার পায়তারা করছে, হোক তারা বিরাট শক্তিধর, তাদের ষড়যন্ত্রও ব্যর্থ হতে বাধ্য। তবে এ ব্যাপারে একটাই শর্ত, আমরা কুরআনুল কারীমের শিক্ষা মুতাবিক আল্লাহর অসীম কুদরতে বিশ্বাস স্থাপন করে সর্বস্ব পণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে রাজী আছি কি না। অতি আধুনিক ইতিহাসেও প্রমাণ আছে, আল্লাহর অসীম কুদরতে আস্থাবান ও কুরবানীকৃত জাতি দুই পরাশক্তির চক্রান্তের মুকাবিলায় টিকে থাকতে পারে। সুদূর অতীতে বদরে, উহুদে, খন্দকে এ সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে আমরা যদি আল্লাহর উপরই ভরসা করে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাই, কোন আধিপত্যবাদী শক্তিই আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। কুরআনুল করীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘ওয়ালা তাহিনু, ওয়ালা তাহযানু ওয়া আনতুমুল আ’লাওনা ইন কুনতুম মুমিনীন’ – “তোমরা নিরাশ হইও না এবং চিন্তান্বিত হইও না তোমারই হবে বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও।” আল্লাহর এই চিরঞ্জীব অভয়বাণী ও আশ্বাসের আলোকে যেকোনো আধিপত্যবাদী শক্তির ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করে পরমপ্রিয় স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করার দুর্নিবার সাধনাই হোক ষোলই ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক দিনে আমাদের পবিত্র সংকল্প।

ফেইসবুকে আমরা...