ফরাসী বিপ্লবের অন্যতম মহানায়ক রুশোর একটি কথা দিয়ে শুরু করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে কিন্তু তাকে সর্বত্র শৃঙ্খলিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।’ সেই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। স্বভাবগতভাবেই মানুষ একটি স্বাধীনচেতা প্রাণী। পরাধীন বা অন্যের অধীন থাকতে চায় না, স্বাধীন থাকতে চায়। প্রয়োজনে এর জন্য জীবনও দিয়ে দেয়। যে স্বাধীনতার জন্য মানুষের স্বপ্ন, সাধ, সংগ্রাম ও সাধনার অন্ত নেই। আসলে সে স্বাধীনতা নামের এ বস্তুটির সত্যিকার পরিচয় কী? কেনইবা সেই বিস্ময়কর বস্তুকে লক্ষ কোটি প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়? যার জন্য ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘটে অন্তহীন ফ্যাসাদ।
স্বাধীনতা মানে স্ব-অধীনতা বা নিজের অধীনতা, পরাধীনতা বা অন্য কারো অধীনতা নয়। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হার্বাট স্পেনসারের মতে, ‘যে স্বাধীনতা বলতে নিজের খুশিমতো কাজ করাকে বুঝায়, যদি উক্ত কাজের দ্বারা অন্যের অনুরূপ স্বাধীনতা উপভোগে বাধা সৃষ্টি না করে।’ আধুনিক পণ্ডিতদের ভাষায় স্বাধীনতা সেই বস্তুটির নাম, যা অর্জিত হলে মানুষ অন্যের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে এই পৃথিবীতে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আত্মবিকাশ ও আত্মোন্নতি করতে পারে, নিজেই নিজ দেশ ও সম্পদের মালিক হতে পারে, সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারে, কাক্সিক্ষত সুখ ভোগ করতে পারে। পাশ্চাত্য লেখকদের মতে নাগরিক স্বাধীনতা দুই প্রকার: ১. সামাজিক: যার মাধ্যমে মানুষ দমনমূলক বাধ্যবাধকতার পরিসমাপ্তি এবং প্রাকৃতিক ও নাগরিক অধিকার অর্জন করে। ২. রাজনৈতিক: যার ভিত্তিতে প্রত্যেক নাগরিক নিজের সরকার গঠন এবং তাতে পূর্ণরূপে অংশগ্রহণের অধিকার পায়। মানুষ স্বাধীনতার মাধ্যমে নিজ মনের কামনা-বাসনাকে বাস্তবায়িত করতে চায়। জীবনের উন্নতি ও বিকাশ চায়।
এ ধরাপৃষ্ঠে আল্লাহ মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, দিয়েছেন সৃষ্টির সেরা রূপ সৌন্দর্য, দিয়েছেন জগতে তার অধিকার, উন্মুক্ত করেছেন তার জন্য সকল নিআমতের ভান্ডার এবং বরাদ্দ করেছেন জ্ঞান ও অধিকার। যারা এ জ্ঞান শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অধীন বিশ্বকে জয় করে নেওয়ার সংগ্রাম সাধনা করে, স্বাধীনতা তাদেরই জন্য।
আল্লাহ পাক মানুষকে জন্মগতভাবে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। তাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মানুষ পরাধীন থাকতে চায় না। ইসলাম ধর্মও এরকম পরাধীনতাকে সমর্থন করে না। ইসলামে পরাধীনতাকে ‘আজাবুম মুহীন’ বা কঠোর আজাব বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও একটি স্বাধীন ভূখ-ের জন্য অনেক সাধনা করেছেন। এমনকি সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় হিজরত করেছেন এবং মদীনাকে একটি স্বাধীন ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠন করেছিলেন। এই স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দাওয়াতী মিশনকে আরো তীব্র গতিতে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে অল্প সময়ের ব্যবধানে মক্কা বিজিত হয়। যার মধ্য দিয়ে এ স্বাধীনতার বিস্তৃতি ও পরিধি আরো বৃদ্ধি পায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র মদীনায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল। এর ফলে বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে সহাবস্থান সম্ভব হয়। মদীনা রাষ্ট্র পৃথিবীর ইতিহাসে যে কোনো সময়, যে কোনো কালের জন্য শান্তি, শৃঙ্খলা, মানবতা ও উদারতার প্রতীক হয়ে থাকবে।
মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ঈমানের অংশ। আরবীতে বলা হয় ‘হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ঈমান’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অংশ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্বদেশকে ভালোবাসতেন এবং দেশের ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষের উচিত দেশকে ভালোবাসা। যে লোক দেশকে ভালোবাসে না সে প্রকৃতপক্ষে ঈমানদার নয়।’
পরাধীনরা তাদের স্বীয় মাতৃভূমি উদ্ধার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করবে এটাই ইসলামের বিধান। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন ‘এসব লোকদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো, যারা (শত্রু কর্তৃক) আক্রান্ত হয়েছে, কেননা তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে, আর নিশ্চিত যে, আল্লাহ তাদের জয়যুক্ত করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। মাতৃভূমি থেকে তাদের অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে এজন্য যে, তারা বলে আমাদের রব আল্লাহ। (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৯)
স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে ইসলামেও জোর তাগিদ রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা করেছেন, এমনকি অনেক যুদ্ধও করেছেন। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরত করার পরও কিছু সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কায় ছিল। যাদের উপর মক্কার কাফির মুশরিকরা চালিয়েছিল অত্যাচারের স্ট্রিমরোলার। এদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করাকে উৎসাহিত করে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেন আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করছ না সে সকল দুর্বল নারী-পুরুষ ও শিশুদের জন্য। যারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এই জনপদ থেকে রেহাই দাও যার অধিবাসী যালিম। তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের অভিভাবক করো এবং তোমার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করো।’ (সূরা নিসা, আয়াত-৭৫) ইসলাম শুধু স্বাধীনতা অর্জনের প্রতি উৎসাহিতই করে না বরং স্বাধীনতা অর্জন ও রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করে। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, ‘যারা দেশ রক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে তাদের জন্য চির শান্তির জান্নাত।’
রাসূল ব অন্যত্র বলেছেন, ‘একদিন ও একরাতের প্রহরা ক্রমাগত এক মাসের নফল রোযা এবং সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়া অপেক্ষাও উত্তম।’ (মুসলিম শরীফ)
যখন অন্য কোনো দেশ বা জাতি নিজের দেশের উপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করে তখন দেশের সকল জনগণের উপর দেশ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করা ফরয হয়ে যায় এবং তখন জাতীয়তাবোধও প্রবলভাবে জাগ্রত হয়। আর এর ফলেই স্বাধীনতা সংগ্রামে মানুষ অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেয়। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দ্বীন ইসলাম ও মাতৃভূমি রক্ষার জন্য যারা আল্লাহর রাস্তায় জীবন বিলিয়ে দেয়। তাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন ‘আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদের তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৫৪)
বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে এমনি অনেক বীর সেনানী রয়েছেন। যারা দেশ রক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করেছেন। জাতি তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে, ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে। বাংলাদেশ নামক যে ভূখ-টিতে আমরা বসবাস করছি সেটাও স্বাধীনতা অর্জন করতে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বর তা শেষ হয়। এ আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছে তারাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। ইসলামের দৃষ্টিতে তারা শহীদ এবং জাতি তাদের কাছে চির ঋণী। আল্লাহ পাকও তাদের চির শান্তির স্থান জান্নাতে আবাস দিবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। হাদীস শরীফে বলা হয়েছে- ‘শহীদের রূহগুলো চির শান্তির স্থান জান্নাতে ভ্রমণ করতে থাকে এবং সেখানকার ফল ও নিআমতসমূহ আহার করে থাকে।’
প্রকৃতপক্ষে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এখনো চলছে। কারণ অর্থনীতিতে আমরা এখনো আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, আমাদের রাজনীতিও বিদেশিদের প্রভাবমুক্ত নয়, সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ স্বাধীনতার পর থেকে বেশ কিছু সময় ছিল না। তাই বলা হয়ে থাকে `স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন।’ আমাদের সেই কঠিন কাজটুকু করার দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
লেখক: প্রভাষক, সরকারি তোলারাম কলেজ নারায়ণগঞ্জ