(ক) তালকীন কি?
(খ) তালকীন করা কি জায়িয?
(গ) মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার পর কবরের চার কোণায় চারজন বসে কিছু আয়াত তিলাওয়াত করেন। তিলাওয়াত শেষে একজন ব্যক্তি মৃতের বুক বরাবর কবরের পাশে বসে কবরের উপর হাত রেখে বলেন, “ইয়া আব্দাল্লাহ! কুল রাব্বিয়াল্লাহ, দ্বীনিয়াল ইসলাম, হাযা নাবিয়্যী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” এরপর দুআ করে বিদায় নেন। শরীআতের দৃষ্টিতে এরূপ করা বৈধ কি না? দলীলসহ জানালে খুশি হব।
প্রশ্নকারী: আব্দুস সামাদ রাফি, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার
জবাব: (ক) তালকীন শব্দের বিশ্লেষণে ‘মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা’ কিতাবে এসেছে,
التلقين مصدر لقَّن ، التفهيم مشافهة – إلقاء الكلام على الغير ليأخذ به ، ومنه : تلقين الشهادة ، وتلقين المأموم الإمام إذا أغلق عليه في القراءة ، وتلقين المحتضر الشهادة
অর্থাৎ তালকীন لقَّن এর মাছদার (ক্রিয়ামূল) যার অর্থ হচ্ছে, সরাসরি বুঝিয়ে দেওয়া, অন্যকে অনুধাবন করানোর উদ্দেশ্যে কিছু বলা। এর বিভিন্ন প্রকারের আওতায় রয়েছে শাহাদাতের তালকীন, ইমাম কিরাতে আটকা পড়লে মুক্তাদী তা বলে দেওয়া এবং মুমূর্ষুকে কালিমা শাহাদাতের তালকীন প্রভৃতি।
(খ) সহীহ মুসলিম, সুনানে ইবনে মাজাহ, সুনানে নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদ গ্রন্থে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) ও হযরত আবূ হুরাইরাহ (রা.) প্রমুখ সাহাবায়ে কিরাম সূত্রে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, لقنوا موتاكم لا إلٰه إلا الله “তোমরা মৃতদেরকে (মুমূর্ষুদেরকে) তালকীন করো যে আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই”। উক্ত হাদীসে বর্ণিত موتى (মৃত) শব্দকে বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থে প্রয়োগ করলে সরাসরি মৃতদেরকে দাফনের পর তালকীন করা হাদীস শরীফ থেকে সাব্যস্ত হয়। তবে উক্ত হাদীসের موتى (মৃত) শব্দকে রূপকার্থে মুমূর্ষু অর্থে প্রয়োগ করে অধিকাংশ মনীষী মুমূর্ষু ব্যক্তিকে মৃত্যুর পূর্বে কালিমার তালকীন অর্থে হাদীসকে প্রয়োগ করেছেন, যা সর্বসম্মত মতানুযায়ী সুন্নাত।
দাফন পরবর্তী তালকীনের সমর্থনে স্বতন্ত্র হাদীসের বর্ণনা রয়েছে। ইমাম তাবরানী তদ্বীয় المعجم الكبير গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,
عن سعيد بن عبد الله الأودي، قال: شهدت أبا أمامة وهو في النزع، فقال: إذا أنا مت، فاصنعوا بي كما أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نصنع بموتانا، أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: ” إذا مات أحد من إخوانكم، فسويتم التراب على قبره، فليقم أحدكم على رأس قبره، ثم ليقل: يا فلان بن فلانة، فإنه يسمعه ولا يجيب، ثم يقول: يا فلان بن فلانة، فإنه يستوي قاعدا، ثم يقول: يا فلان بن فلانة، فإنه يقول: أرشدنا رحمك الله، ولكن لا تشعرون. فليقل: اذكر ما خرجت عليه من الدنيا شهادة أن لا إله إلا الله، وأن محمدا عبده ورسوله، وأنك رضيت بالله ربا، وبالإسلام دينا، وبمحمد نبيا، وبالقرآن إماما، فإن منكرا ونكيرا يأخذ واحد منهما بيد صاحبه ويقول: انطلق بنا ما نقعد عند من قد لقن حجته، فيكون الله حجيجه دونهما “. فقال رجل: يا رسول الله، فإن لم يعرف أمه؟ قال:فينسبه إلى حواء، يا فلان بن حواء.
-হযরত সাঈদ ইবনে আব্দিল্লাহ আল আওদী (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি হযরত আবূ উমামাহ (রা.) এর মৃত্যুকালে তার কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার ক্ষেত্রে সেরূপ আচরণ করবে যেমনিভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদের মৃতদের ব্যাপারে নির্দেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে আদেশ করেছেন আমাদের কারো মৃত্যু হলে তাকে কবরস্থ করার পর যেন শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, হে অমুকের ছেলে অমুক! সে তখন শুনবে তবে কোনো উত্তর দিবে না। অতঃপর বলবে, হে অমুকের পুত্র অমুক! তখন সে সোজা হয়ে বসবে। অতঃপর বলবে, হে অমুকের পুত্র অমুক! তখন সে বলবে, আল্লাহ আপনাকে রহম করুন! কি বলতে চান? কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে না। তখন সে যেন বলে, তুমি স্মরণ কর, দুনিয়া থেকে যাবার সময় তুমি “আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দাহ ও রাসূল” বলে যে বিশ্বাসের সাক্ষ্য দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলে এবং তুমি আল্লাহকে রব, ইসলামকে ধর্ম, মুহাম্মদ (সা.) কে নবী এবং কুরআনকে পথপ্রদর্শক হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট ছিলে। তখন ফেরেশতাদ্বয়ের একজন অন্য জনের হাত ধরে বলবেন, চল এবার যাই। এমন লোকের কাছে বসে লাভ কী যাকে তার আখিরাতের (মুক্তির) দলীল শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে (জবাব বলে দেওয়া হয়েছে)। অতঃপর ফিরিশতার পর আল্লাহ তাআলাই তার জবাব গ্রহণ করবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি সে ব্যক্তির মায়ের নাম ঐ লোকটি না জানে তাহলে কিরূপ সন্বোধন করবে? তিনি বললেন, মা হাওয়ার নামের সাথে সম্পর্কিত করবে যথা: ইয়া ফুলাল ইবনা হাওয়া বলবে। (আল মু’জামুল কাবীর: ৮ম খ-, ২৪৯ পৃষ্ঠা, হাদীস নং: ৭৯৭৯, আল বিনায়াহ শরহুল হিদায়াহ: ৩য় খ-, ১৭৭ পৃষ্ঠা, যাদুল মায়াদ: ১ম খ- ৫০৪ পৃষ্ঠা)
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিতে কবরে মায়্যিতকে তালকীন শরীআতসম্মত এবং এর দ্বারা মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয়। কেননা মৃত্যুর পর পরই রূহ ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং মৃত ব্যক্তি সবকিছু অনুধাবনে সক্ষমতা রাখে। বাতিল ফিরকাহ মু’তাজিলাহ তা অসম্ভব বলে অস্বীকার করে। (রদ্দুল মুহতার: ২য় খ–১৯১ পৃষ্ঠা, আল জাওহারাতুন নায়্যিরাহ: ১ম খ- -১০২ পৃষ্ঠা, আল হাবী লিল ফাতাওয়া: ২য় খ– ২১১ পৃষ্ঠা, তাবয়ীনুল হাক্বায়িক্ব: ১ম খ– ২৩৪ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)
শায়খ ইবনে তাইমিয়া ও অধিকাংশ মনীষী তালকীনকে জায়িয বলেছেন। তার ফাতাওয়া’র মধ্যে আছে, হযরত আবূ উমামা বাহিলী (রা.) ও হযরত ওয়াসিলাহ ইবনুল আসকা (রা.)সহ কতিপয় সাহাবায়ে কিরাম তালকীন করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই অধিকাংশ মনীষীদের মতে তা জায়িয। কেউ কেউ একে মুস্তাহাব বলে অভিহিত করেছেন। (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম: ২য় খ- ১৭৯ পৃষ্ঠা, আল ফাতাওয়াল কুবরা: ৩য় খ- পৃষ্ঠা ২৪ দ্রষ্টব্য)
(গ) মৃতের তালকীনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বাক্য সর্ম্পকে ফকীহগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। যাদুল মায়াদ গ্রন্থে আছে,
وقد ذكر سعيد بن منصور في “سننه” عن راشد بن سعد، وضمرة بن حبيب، وحكيم بن عمير، قالوا: إذا سوي على الميت قبره، وانصرف الناس عنه، فكانوا يستحبون أن يقال للميت عند قبره: يا فلان! قل: لا إله إلا الله، أشهد أن لا إله إلا الله ثلاث مرات، يا فلان! قل: ربي الله وديني الإسلام، نبيي محمد، ثم ينصرف.
-সাঈদ ইবনে মানসুর তদ্বীয় সুনানে হযরত রাশীদ ইবনে সা’দ, দ্বামরাহ ইবনে হাবীব এবং হাকীম ইবনে উমাইর থেকে বর্ণনা করেছেন যে তারা বলেছেন, মায়্যিতের দাফন সমাপ্ত হলে এবং লোকগণ চলে গেলে মায়্যিতের উদ্দেশ্যে তার কবরের পাশে থেকে হে অমুকের পুত্র অমুক! তুমি বল- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (একথা তিনবার বলবে)। অতঃপর বলবে হে অমুক! তুমি বল- আমার রব আল্লাহ, আমার ধর্ম ইসলাম, আমার নবী মুহাম্মদ (সা.)। এরপর চলে যাবে। তারা (পূর্বোক্ত ব্যক্তিবর্গ) এরূপ বলা মুস্তাহাব মনে করতেন। (যাদুল মায়াদ: ১ম খ-, ৫০৪ পৃষ্ঠা)
মোটকথা, এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে কবরের প্রশ্নের উত্তর সম্বলিত যে কোনো বাক্য ব্যবহার বৈধ রয়েছে। যেমন, ইয়া ফুলান ইবনা ফুলান বা ইয়া আব্দাল্লাহ ইবনা আব্দিল্লাহ! উযকুর দ্বীনাকাল্লাযী কুনতা আলাইহি ওয়া কাদ রাদ্বীতা বিল্লাহি রাব্বাউ ওয়া বিল ইসলামি দ্বীনাউ ওয়া বিমুহাম্মাদিন (সা.) নাবিয়্যা ইত্যাদি।
তাই প্রশ্নে উল্লেখিত নিয়মে তালকীন শরীয়তসম্মত এবং বৈধ।
জবাবদাতা: প্রিন্সিপাল ও খতীব, আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার
মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র