১. মোটিভেশন (প্রণোদনা)
আখিরাতের শাস্তির ভয়, জান্নাতের নিআমতের আশা হচ্ছে মানসিক পরিবর্তনের মূল উপাদান। এতে প্রথম শ্রেণির মানুষ যেমন নিজেকে ধরে রাখতে পারে তেমনই দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের মানুষ পারে নিজেদেরকে পরবর্তী স্তরে উন্নীত করতে। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির মানুষ জান্নাতের আশা দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। কেননা তাঁরা স্বভাবতই পাপ থেকে বিরত থাকেন। ফলে জাহান্নামের ভয়ের চাইতে জান্নাতের আশাই তাদের জন্য বেশি কার্যকর। এ ছাড়া আরো একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হচ্ছে আল্লাহর মহব্বত। এ পর্যায়ের মানুষ (প্রথম শ্রেণির সবচেয়ে উঁচু স্তর) আল্লাহর মহব্বত ও সন্তুষ্টিকেই বেশি প্রাধান্য দেন। তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টির বাইরে কিছু করার কথা চিন্তাও করেন না। সেক্ষেত্রে পরকালীন জীবন সম্পর্কে ইসলামের বয়ান তাদের জন্য খুবই উপকারী, সন্দেহ নেই।
মোটিভেশন এর ক্ষেত্রে ইসলামী নির্দেশনা অনেক। কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে সব উল্লেখ না করে দুএকটি করছি। সবচেয়ে বড় প্রণোদনা হচ্ছে, ইসলামে যিনা সুস্পষ্ট হারাম ও খুবই নিন্দনীয় অপরাধ। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ’ (সূরা বনী ইসরাঈল-৩২)। ইমাম কুরতুবী (র.) বলেন, আল্লাহর বাণী ‘যিনা (ব্যভিচার) করো না’ এর চেয়ে ‘যিনার কাছেও যেয়ো না’ অনেক বেশি কঠোর বাক্য। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি যিনা করা তো দূরের কথা যিনার কল্পনাও করতে পারে না। এমনকি যিনার সহযোগী ও যিনার পর্যায়ভুক্ত কোনো কিছুর কাছেই যেতে পারে না। কেননা এসবকিছুই হারাম। বস্তুত আল্লাহ তাআলার নির্দেশই অনেক মানুষের জন্য যথেষ্ট। তারপরও আল্লাহ তাআলা এহেন মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার পুরস্কার হিসেবে প্রণোদনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আর তারা নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহকে সংযত রাখে, তাদের স্ত্রী ও তারা যাদের মালিক হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে ছাড়া, এতে তারা নিন্দিত হবে না। সুতরাং কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে তারা হবে সীমালঙ্ঘনকারী। আর যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী; এবং যারা নিজেদের নামাযে যতœবান থাকে তারাই হবে উত্তরাধিকারী; উত্তরাধিকারী হবে ফিরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে”(সূরা মুমিন-৫-১১)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি আমাকে তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিস (জিহ্বার) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিস (যৌনাঙ্গ) এর নিশ্চয়তা (সঠিক ব্যবহারের) দেবে আমি তার বেহেশতের নিশ্চয়তা দিব” (বুখারী, কিতাবুর রিকাক, বাবু হিফযিল লিসান)।
হযরত সাঈদ ইবনে যায়িদ (রা.) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, ‘সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সে শহীদ। জীবন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সে শহীদ। দ্বীন রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ। আর সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে যে নিহত হয়েছে, সেও শহীদ।’ (আবু দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ, বাবুন ফি কিতালিল লাসূস)। সুবহানাল্লাহ, কত বড় প্রণোদনা। নিজের ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যু হলেও তা আখিরাতে বিশাল প্রতিদানের উপলক্ষ্য হয়ে যাচ্ছে।
ভয়ের দ্বারা মানুষকে যিনা থেকে বিরত রাখার কথাও ইসলাম বিবেচনায় এনেছে। এজন্য হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আমি স্বপ্নে একটি চুলা দেখতে পেলাম যার উপরের অংশ ছিল চাপা আর নিচের অংশ ছিল প্রশস্ত আর সেখানে আগুন উত্তপ্ত হচ্ছিল, ভিতরে নারী পুরুষরা চিৎকার করছিল। আগুনের শিখা উপরে আসলে তারা উপরে উঠছে, আবার আগুন স্তিমিত হলে তারা নিচে যাচ্ছিল, সর্বদা তাদের এ অবস্থা চলছিল, আমি জিবরাইল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, তারা হলো, অবৈধ যৌনাচারকারী নারী ও পুরুষ (বুখারী, বাবু তা’বিরুর রুইয়া বা’দা সালাতিস সুবহ)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায় আর তিনটি আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো- ১. চেহারার সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া ২. দরিদ্রতা ও ৩. অকাল মৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হলো- ১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা ও ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি।
২. মনস্তাত্বিক চিকিৎসা
মানসিকতার পরিবর্তন এ সমস্যা সমাধানের অন্যতম প্রধান উপায়। মোটিভেশনের মাধ্যমে যেমন মানুষের মানসিক অবস্থা স্থায়ীভাবে পরিবর্তন হতে পারে, তেমনই তা সাময়িকও হতে পারে। কেননা মোটিভেশনের প্রভাব চলে গেলেই নফসে আম্মারার প্রভাব কার্যক্ষম হয়ে উঠতে পারে। এমতাবস্থায় স্থায়ী সমাধান হিসেবে মনস্তাত্বিক চিকিৎসা কার্যকরী। আমাদের প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে সঠিক নির্দেশনাই আমাদের দিয়ে গিয়েছেন।
হাদীসে এসেছে, একদা এক যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চাইলে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তোমার মা, মেয়ে, বোন, ফুফু ও খালার সঙ্গে কেউ এমন করুক এটা কি তুমি পছন্দ করবে? সে বলল, না, এটা কেউ পছন্দ করবে না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তেমনিভাবে কোনো মানুষই তার আপনজনের সঙ্গে ব্যভিচার করা পছন্দ করবে না। অতঃপর তিনি তার পাপমুক্তি ও আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য দুআ করেন (মুসনাদ আহমদ, মুসনাদুল আনসার)। উল্লেখ্য যে, এরপর ব্যভিচারের চাইতে খারাপ পাপ সে যুবকের জন্য আর কিছু ছিল না।
এখানে লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকের ইচ্ছার কথা শুনে তাকে ধমক দেননি, মুখ ফিরিয়ে নেননি। বরং তাকে সময় দিয়েছেন; সুন্দর করে যুক্তি দিয়ে তাকে বুঝিয়েছেন, অতঃপর তার জন্য দুআ করেছেন। উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝানোর ক্ষেত্রে কুরআনের আয়াত বলেননি, মোটা মোটা তত্ত্বকথাও বলেননি; কেননা তিনি ছিলেন মানবতার চিকিৎসক। তিনি যুবকের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য সুন্দর করে, তার উপযোগী করে কোমল ভাষায় যুক্তির মাধ্যমে তার চিকিৎসা করেছেন। হ্যাঁ, আমি চিকিৎসার স্বার্থে কুরআন হাদীসের উক্তি উল্লেখ না করার কথা বলছি না। বরং বলছি, মানসিক অবস্থা বিবেচনা করার কথা। অনেক মানুষের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে, দ্বিতীয় ও প্রথম শ্রেণির ক্ষেত্রে) কুরআনের একটি আয়াত বা হাদীসের বাণী খুবই কার্যকর। তবে তৃতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে যুক্তি আর উদাহরণ অনেক বেশি কার্যকর। অতএব চিকিৎসাক্ষেত্রে এসব কিছুই বিবেচনা করা আবশ্যক।
আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি বিষয় নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে দেখি। বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর তা হচ্ছে, নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে ধর্ষকের প্রতি কোনো নারীর বক্তব্য “তোমার কি মা-বোন নেই”। প্রিয় পাঠক, এ বক্তব্য কিন্তু হাদীসের বাক্যের দ্বারা সমর্থিত। কোনো বিবেকবান মানুষই এ কথার পর অপরাধ করার কথা চিন্তাও করতে পারেনা। হ্যাঁ, নফসে আম্মারা দ্বারা প্রভাবিত পশুত্বের পর্যায়ের মানুষের কাছে অবশ্য এসবের কোনো দাম নেই।
৩. প্রভাবকের নিয়ন্ত্রণ
সামাজিক নানা প্রভাবকের নিয়ন্ত্রণ এ সমস্যা সমাধানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের গ্রহণীয় সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ শুধু এর অভাবেই ব্যর্থ হচ্ছে। কেননা আমরা সমাজের নানা প্রভাবককে নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই করছি না। অথচ প্রভাবকের নিয়ন্ত্রণ তিন প্রকার মানুষেরই মানসিক অবনমন ঠেকিয়ে রাখে। এক্ষেত্রে ইসলামের মূল নির্দেশনাগুলো নিম্নরূপ-
অশ্লীলতা হারাম
প্রভাবক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ইসলামের সর্বপ্রধান ঘোষণা হলো সকল প্রকার অশ্লীলতা, অশালীনতা হারাম। এর জন্য পরকালে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। মহান আল্লাহ সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘যারা ঈমানদারদের মধ্যে অশ্লীলতার বিস্তারে উৎসাহী তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (সূরা নূর-১৯)। সুতরাং যারা নানাভাবে সমাজে অশ্লীলতার বিস্তার করছেন, হোক তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, বা সিনেমা, টিভি, মিডিয়া দ্বারা, কিংবা লিখনের মাধ্যমে, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। আমাদের সমাজ কতভাবেই না অশ্লীলতায় লিপ্ত। নাটক-সিনেমা, গান, সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফ্রেন্ডশিপ সংস্কৃতি (বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ড, জাস্টফ্রেন্ড), নানা দিবস উদযাপন (ভ্যালেন্টাইন ডে, থার্টি ফার্স্ট নাইট ইত্যাদি), অশ্লীল সাহিত্য, পর্ণগ্রাফি ইত্যাদি দিন দিন বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধ থেকে শিশু পর্যন্ত কেউই এসবের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। অথচ এসবই সম্পূর্ণরূপে হারাম।
ইসলাম যিনা ও অশ্লীলতার একটি ব্যাপকতর সংজ্ঞাও নির্ধারণ করেছে। এতে শুধুমাত্র দৈহিক মিলনই যিনা নয়; বরং এ লক্ষ্যে যাবতীয় কাজই এক একটি যিনা। স্পষ্ট ভাষায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ তার সমগ্র ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যিনা করে। দেখা হচ্ছে চোখের যিনা, ফুসলানো কণ্ঠের যিনা, তৃপ্তির সাথে কথা শোনা কানের যিনা, হাত দিয়ে স্পর্শ করা হাতের যিনা, কোনো অবৈধ উদ্দেশ্যে পথ চলা পায়ের যিনা, এভাবে ব্যভিচারের যাবতীয় ভূমিকা যখন পুরোপুরি পালিত হয়, তখন লজ্জাস্থান তার পূর্ণতা দান করে অথবা পূর্ণতা দান থেকে বিরত থাকে’ (মুসলিম, বাবু কাদরি আলা ইবনি আদাম হাযযাহু মিনায যিনা ওয়া গাইরিহ)।
এবার আমাদের চিন্তার বিষয় কতভাবেই না আমাদের মুসলিম সমাজ যিনাতে লিপ্ত। অশ্লীলতার কথা না হয় বাদই দিলাম। বস্তুত এসব অশ্লীল কার্যকলাপের ফলে উঠতি তরুণ-যুবকদের চরিত্র ঠিক রাখাই দায়। আমাদের সমাজে এসব প্রভাবকের আগমন খুব বেশি দিন নয়। একবিংশ শতাব্দীতেই এটি বেশি বিস্তার লাভ করছে। এর খারাপ প্রভাবও পড়ছে আমাদের সমাজে। আমরা বেশি নয়, মাত্র ৩০ বছর আগের সমাজের সাথে বর্তমান সমাজের তুলনামূলক আলোচনা করলেই স্পষ্টতই এসব অশ্লীলতার প্রভাব বুঝতে পারব। এজন্য আমাদের সমাজবিজ্ঞানী হওয়ারও দরকার নেই। শুধু দরকার একটুখানি বিবেক-বিবেচনা।
অশ্লীলতা বিস্তার ব্যভিচার ও ধর্ষণের প্রধান কারণ। এটি তৃতীয় শ্রেণির মানুষকে যেমন পশুর ন্যায় উত্তেজিত করে রাখে, তেমনই দ্বিতীয় শ্রেণিকেও যিনা-ব্যভিচারের সুযোগ সৃষ্টি করতে প্ররোচিত করে। এমনকি এটি প্রথম শ্রেণির মানুষকেও দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষে পরিণত করে। সুতরাং অশ্লীলতার সুযোগ বন্ধ না করে অন্য যেসব পন্থাই নেওয়া হোক না কেন, তা কাজে আসবে না।
পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ
যিনা ব্যভিচারের অন্যতম জঘন্যতম মাধ্যম পতিতাবৃত্তি বা দেহ ব্যবসা। ইসলাম এটিও হারাম করেছে। এমনকি আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন ‘তোমরা তোমাদের অধীনস্তদের অবৈধ বৃত্তিতে (দেহ ব্যবসায়) বাধ্য করো না’ (সূরা নূর-৩৩)। হাদীসে এসেছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপার্জন হলো- ব্যভিচারিণীর ঐ উপার্জন যা সে ব্যভিচারের মাধ্যমে অর্জন করেছে। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে রাফে ইবন খাদিজ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কুকুরের ব্যবসা নিকৃষ্ট এবং যিনাকারিণীর উপার্জনও নিকৃষ্ট”।(মুসলিম, বাবু তাহরীমি ছামানিল কালব)
পতিতাবৃত্তি তৃতীয় শ্রেণির মানুষ তো বটেই, দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের জন্যও অশ্লীলতার দ্বার খুলে দেয়। সুতরাং এটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বন্ধ করতে হবে। হ্যাঁ এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন জাগে, এমতাবস্থায় মানুষ কীভাবে তার দৈহিক চাহিদা পূরণ করবে? ইসলাম এরও সুন্দর সমাধান দিয়েছে- বিবাহ অপারগতায় রোযা রাখা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ‘আইয়িম’ বিপতœীক বা বিধবা মহিলা তাদের বিবাহ সম্পাদন করো এবং তোমাদের দাসদাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাব দূর করে দিবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ (সূরা নূর-৩২)। পরের আয়াতে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে” (সুরা নূর-৩৩)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “হে যুবকের দল তোমাদের মধ্যে যে বিবাহ করার ক্ষমতা রাখে সে যেন বিয়ে করে। বিয়ে হলো- দৃষ্টিকে নিম্নমুখীকারী এবং লজ্জাস্থানকে রক্ষাকারী। আর যে বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে না, সে যেন সিয়াম পালন করে। এটাই তার জন্য আত্মরক্ষাকারী।” (মুসলিম, বাবু ইসতিহবাবিন নিকাহ লিমান তাকাত নাফসুহু ইলাইহ…)
অথচ আমাদের সমাজে বিবাহের পথরুদ্ধ করে পতিতাবৃত্তির পথ খুলে দিয়ে যিনা-ব্যাভিচার বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা অনেকটা সে-ই অঙ্কের ন্যায় যে ট্যাঙ্কে দুটি ছিদ্র রেখে পানি ঢালা হচ্ছে। কোনোদিনই যা পূরণ হওয়ার নয়। বরং কতক্ষণে তা খালি হবে সে হিসেব মিলাতেই আমরা ব্যস্ত। বিবাহের পথ বন্ধ রেখে বা কঠিন করে দিয়ে যিনা-ব্যাভিচার হ্রাস করার প্রয়াস এমনই। হ্যাঁ, আমি এটা বলছি না যে, বিবাহ প্রথা সহজ করে দিলেই যিনা লুপ্ত হয়ে যাবে। কেননা বিবাহ শুধু সমাধানের একটি অংশ মাত্র। তাতে যিনা-ব্যভিচার কমবে, সেটা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
পর্দা ফরয
যিনা ব্যভিচার প্রতিরোধে ইসলামের সর্বোত্তম নির্দেশনা হচ্ছে পর্দা প্রথার প্রচলন। এর দ্বারা সকল শ্রেণির মানুষই উপকৃত হতে পারে। আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা আছে যে, শুধু নারীদেরই পর্দা রক্ষা করা ফরয। অথচ এটা সর্বোতভাবেই ভুল। শুধু নারী নয়, পর্দার হুকুম সকলের জন্যই। পর্দা প্রথার ব্যাপকতা অনেক, যেমন-
ক. নর-নারী উভয়ের জন্যই পর্দা ফরয।
খ. প্রকাশ্যে-গোপনেও পর্দা ফরয। একাকী থাকাবস্থায়, যখন কেউ জানবে না শুনবে না সে অবস্থাতেও পর্দা করা ফরয।
গ. সরাসরি ও মাধ্যমযোগেও পর্দা ফরয। অর্থাৎ সরাসরি দেখা সাক্ষাত যেমন হারাম তেমনই কোন মাধ্যমে গায়রে মাহরামকে দেখা হারাম। কেননা সরাসরি যা হারাম তা টিভি, মিডিয়া, ফেইসবুক, বই-খাতা সবকিছুতেই দেখা হারাম।
এ প্রেক্ষিতে সর্বোত্তম হচ্ছে নর-নারী উভয়েরই দৃষ্টি অবনত রাখা (সূরা নূর-৩০-৩১)। আর নারীদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতাস্বরূপ সৌন্দর্য প্রকাশ না করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, বোরকা পরিধান করেও যদি সৌন্দর্য প্রদর্শন উদ্দেশ্য হয় তবে তাও পর্দার খিলাফ।
ইসলামের এই একটি বিধান যদি সর্বোতভাবে পালন করা যায়, তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যিনা-ব্যভিচার তো দূরের কথা, এর সামান্যতম কোনো লক্ষণও সমাজে আর বাকী থাকবে না।
৪. পরিবেশের নিয়ন্ত্রণ
প্রভাবক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি ইসলাম নিজেদের পরিবেশকে সুন্দর ও সুস্থ রাখার নির্দেশনাও প্রদান করেছে। যেন মানুষ নিজেদের অবস্থা ও স্তর উন্নত করতে পারে। তৃতীয় ও দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ ক্রমান্বয়ে প্রথম স্তরে উপনীত হতে পারে। এটাও অনেকটা প্রণোদনার মতোই কাজ করে। এ লক্ষ্যে ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে-
-তাকওয়া অর্জন।
-লজ্জাবোধের অনুশীলন।
-ধর্মীয় ও সামাজিক মূলবোধের সংরক্ষণ।
-সৎসঙ্গী ও বন্ধু নির্বাচন।
-বান্দার হক সম্পর্কে সচেতন হওয়া ইত্যাদি।
[এরকম আরো বেশ কিছু নির্দেশনা আছে যা দ্বারা একজন মানুষ তার পরিবেশ ঠিক রাখতে পারে। এর প্রতিটি বিষয় নিয়েই পৃথক গ্রন্থ রচনা সম্ভব। কলেবরের সীমাবদ্ধতায় উপরে শুধু কয়েকটি পন্থা উল্লেখ করলাম মাত্র।]
৫. যিনার প্রতিষেধক
যিনার শাস্তি
হ্যাঁ, এরপরও যদি কেউ যিনায় লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে এর প্রতিষেধক হচ্ছে আইনের প্রয়োগ ও শাস্তি দান। যিনা বা ব্যভিচারের শাস্তি বর্ণনা করে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ, তাদের প্রত্যেককে একশত করে বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান কার্যকর করণে তাদের প্রতি যেন তোমাদের মনে দয়ার উদ্রেক না হয়, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাকো। মুসলমানদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে’ (সূরা নূর-২)। আর হাদীসে এসেছে, ‘অবিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে শাস্তি একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তর। আর বিবাহিত পুরুষ-নারীর ক্ষেত্রে একশত বেত্রাঘাত ও রজম (পাথর মেরে মৃত্যুদ-)’ (মুসলিম, বাবু রাজমিল ইয়াহুদী আহলিয যিম্মাতি ফিয যিনা)।
এসব দলীলের আলোকে শরীআ আইন অনুযায়ী, বিবাহিত যিনাকারীর শাস্তি মৃত্যুদ-। আর অবিবাহিত ব্যভিচারী নর বা নারীর শাস্তি দুটো-
১. একশত বেত্রাঘাত
২. এক বছরের জন্য দেশান্তর (যদিও হানাফী মাযহাবে এটি বিচারকের এখতিয়ারভুক্ত)।
এ শাস্তি দুটি পর্যায়ে বিভক্ত- প্রথমত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে শাস্তি প্রদান; দ্বিতীয়ত, সামাজিকভাবে অপরাধীর অবস্থানকে চিহ্নিত করা। এজন্যই যিনার শাস্তি প্রদানে দুটি শর্তারোপ করা হয়েছে-
১। কোনোরূপ দয়া দেখানো যাবে না। অর্থাৎ ক্ষমা করা যাবে না, বেত্রাঘাত একশতের কম করা যাবে না, কিংবা কোনোরূপ কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আঘাতের মাত্রা লঘু করা যাবে না। যেমন- একশত বেত একসাথে বেধে নিয়ে একটি আঘাত করা, কিংবা আস্তে আস্তে আঘাত করা ইত্যাদি।
২। তা জনসমক্ষে প্রচারিত হতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ এর সাহস না করে।
বলতে পারেন, অবিবাহিতের জন্য মাত্র ১০০ বেত্রাঘাত, এ আর এমন কি? কিন্তু সামাজিকভাবে প্রচার তার জীবনকে কি পরিমাণ দুর্বিষহ করে তুলবে সে শাস্তির পরিমাপ করা কি সম্ভব? প্রিয় পাঠক, নিজেকে একবার শাস্তি প্রাপ্ত হিসেবে কল্পনা করে দেখুন। সমাজের সবাই জানবে আপনি যিনার কারণে শাস্তি পেয়েছেন। এই লজ্জার চাইতে মরে যাওয়াই আপনার কাছে ভালো মনে হবে, যদি ন্যূনতম লজ্জা আপনার থাকে। তাছাড়া প্রয়োজনে দেশ থেকে নির্বাসনের শাস্তিও হাদীসে আছে। আরো মজার ব্যাপার হলো, হুদুদের এই আইনে ক্ষমার কোনো বিধান নেই। রাষ্ট্রপতি তো কোনো ছাড়, কাবার ইমামেরও এই এখতিয়ার নেই যে এ শাস্তি রহিত করে। শাস্তি হবেই এবং তা জনসমক্ষে।
ইসলামে নারী-পুরুষের যেকোনো বিবাহ বহির্ভূত দৈহিক মিলনই যিনা হিসেবে চিহ্নিত। চাই তা সম্মতিতে হোক বা বিনা সম্মতিতে হোক। আর এ যিনা দ-নীয় অপরাধ। ইসলামী দ-বিধির হুদুদ শাস্তির আওতাধীন। যা কোনভাবেই বাতিলযোগ্য নয়। তবে তা প্রমাণের জন্য ইসলামে চারজন পুরুষ চাক্ষুষ সাক্ষীর বিধানসহ বেশ কিছু কঠোর প্রক্রিয়া অনুসরণের শিক্ষা ও নির্দেশনা দেওয়া আছে। অবশ্য যিনাকারীর স্বীকারোক্তি অথবা সাক্ষ্য না পাওয়া গেলে আধুনিক ডিএনএ টেস্ট, সিসি ক্যামেরা, মোবাইল ভিডিও ইত্যাদি অনুযায়ীও ধর্ষককে দ্রুত গ্রেফতার করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। তাতে স্বীকারোক্তি পাওয়া গেলে হুদুদ শাস্তি কার্যকর করা যাবে। অন্যথায় তাযীরের আওতায় শাস্তি দেওয়া হবে। উল্লেখ্য যে, ইসলামী দ-বিধিতে অনেক সময় তাযীরের শাস্তি হুদুদের চাইতেও বেশি কঠিন হতে পারে।
ধর্ষণের শাস্তি
ইসলামের পরিপূর্ণতার আরো একটি উদাহরণ হচ্ছে, ইসলাম ধর্ষণের ক্ষেত্রেও যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলামী আইনে ধর্ষণের শাস্তি যিনার শাস্তির চাইতেও মারাত্মক। কেননা ধর্ষণের ক্ষেত্রে দুটো বিষয় সংঘটিত হয়।
১. যিনা ব্যভিচার
২. বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন।
প্রথমটির জন্য ধর্ষক সকল ইমামদের ঐকমত্যে পূর্বোক্ত ব্যভিচারের শাস্তি পাবে। পরেরটির জন্য ইসলামী আইনজ্ঞদের একদলের মতে, ধর্ষককে মুহারাবার শাস্তি দেওয়া হবে। মুহারাবার শাস্তি প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে সংগ্রাম করে এবং দেশে হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে অথবা তাদের হস্তপদসমূহ বিপরীত দিক থেকে কেটে দেওয়া হবে অথবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা হবে। এটি হলো- তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্চনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (সূরা মায়িদা-৩৩)। অর্থাৎ তাদের শাস্তি হলো-
-তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা
-শূলে চড়ানো হবে অথবা
-তাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে (ডান হাত বাম পা/বাম হাত ডান পা) কেটে দেওয়া হবে অথবা
-দেশ থেকে বহিষ্কার তথা নির্বাসিত করা হবে।
আর সর্বাবস্থাতেই ধর্ষিতার কোনোরূপ শাস্তি হবে না। বরং সম্মানজনকভাবে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করা হবে।
প্রিয় পাঠক, একবার নিজেকেই প্রশ্ন করুন, উপরের শাস্তি যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে কি বাংলাদেশে ধর্ষণ বলে কিছু থাকবে? কার এমন বুকের সাহস যে, এরপরও ধর্ষণে এগিয়ে যাবে?
ধর্ষিতার পুনর্বাসন
ধর্ষকের শাস্তির পাশাপাশি ধর্ষিতার পুনর্বাসনের কথাও ইসলাম ভুলে যায়নি। বর্তমানে আমাদের সমাজে বিবেকবান কিছু মানুষ ধর্ষিতার ছবি বা পরিচয় প্রকাশ না করার কথা বলছেন। নিঃসন্দেহে তা ভালো উদ্যোগ। কেননা আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষিতাকে খারাপই মনে করা হয়। সে হিসেবে তাদের পরিচয় প্রকাশ হলে তা তাদের ভবিষ্যত জীবনের জন্য চরম দুর্ভোগ ডেকে আনতে পারে। অথচ ইসলামের পুনর্বাসন ব্যবস্থা আরো উন্নত ছিল। আর তাও এমন সমাজে, যেখানে ধর্ষিতাকে খারাপ চোখে দেখা হতো না; বরং অবস্থার শিকার হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। তারপরও ইসলাম তাদের ব্যাপারে খুবই উন্নত মানবিকতার নির্দেশনা প্রদান করেছে। যেমন,
-ধর্ষিতাকে সসম্মানে নির্দোষ ঘোষণা করা
-ধর্ষক কর্তৃক তাঁকে মোহর পরিমাণ টাকা জরিমানা প্রদান।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের ভুলবশত করা অপরাধ, ভুলে যাওয়া কাজ এবং বলপ্রয়োগকৃত বিষয় ক্ষমা করে দিয়েছেন (সহীহ ইবনু হিব্বান, বাবু যিকরিল আখবারি আম্মা ওয়াদাল্লাহু বিফাদ্বলিহি আন হাযিহিল উম্মাহ)। এ মূলনীতির আলোকে শরীআর বক্তব্য হলো ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষিতার কোনো গুনাহ হয় না। সুতরাং তাকে যারা কটূক্তি করবে তারাই অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।
এভাবে শাস্তির ব্যবস্থা ও প্রয়োগের কঠোরতার মাধ্যমে ইসলাম সমাজ থেকে যিনা ব্যভিচারের মূলোৎপাটন করেছে। এজন্য দেখা যায়, জাহিলিয়াতের সবচেয়ে নিকটবর্তী সময় হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের প্রথম যুগে দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া, কোনো ব্যভিচার ছিল না। অথচ ইসলাম পূর্ব যুগটাই ছিল যিনা-ব্যভিচারের যুগ। কোন যাদুতে সে মানুষগুলো যিনা-ব্যভিচার ভুলে সুন্দর আচরণের উপমা হয়ে রইলেন? প্রিয় পাঠক, ভাবুন, চিন্তা করুন।
এটা মূলত ইসলামেরই সুমহান আদর্শের ফল। যদি নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করা হয়, তাহলে সম্ভবত সবাই ইসলামের এই বিধানের উপকারিতা বুঝতে পারবেন। ইসলাম শুধু যিনা বা ধর্ষণের মানসিকতাপূর্ণ দুর্বল মানুষেরই চিকিৎসা করেনি; বরং সকল শ্রেণির মানুষকেই সমান গুরুত্বারোপ করেছে। কেননা যেহেতু এটি সামাজিক সমস্যা সেহেতু সমাজের কোনো একটা অংশকে বাদ দিয়ে এর সমাধান কীভাবে সম্ভব? পাশাপাশি ইসলাম শুধু একজন যিনাকারী বা ধর্ষককে শাস্তি দিয়েই এ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব শেষ মনে করেনি। বরং যিনা-ধর্ষণের কারণ ও এর পেছনের প্রভাবক উপাদানগুলোর প্রতিও সমভাবে দৃষ্টি দিয়েছে। আর এরূপ সর্বাত্মক প্রয়াসের ফলেই শুধু যিনা বা ধর্ষণ পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব।
আফসোস হলো, প্রায় ১৪৫০ বছর পূর্বে যেখানে এত সর্বাত্মক বিধান দেওয়া হলো, সেখানে আমাদের উত্তরাধুনিক গবেষকগণ কারণ, উপাদান সবকিছুকে একপাল্লায় মেপে যৌন হয়রানি বন্ধের পরিকল্পনা করেন। এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, ডুবন্ত জাহাজকে বাঁচাতে হলে এর সব ফুটোই বন্ধ করতে হয়। একটি ফুটোও যদি বাকী থাকে, তাহলেও জাহাজ বাঁচানো সম্ভব না। হয়ত একটু দেরি করানো যাবে, কিন্তু আজ না হয় কাল জাহাজ ডুববেই।
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ আজ এ পথেই যাচ্ছে। শুধু আইন আর এর প্রয়োগ নিয়ে মেতে থাকলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এজন্য চাই সমন্বিত পরিকল্পনা, সর্বাত্মক বিধান। ইসলাম একটি মডেল অনেক আগেই দিয়ে গেছে। আমাদের কর্তৃপক্ষ চাইলে তার সদ্ব্যবহার করতে পারেন। আর যদি মনে করেন, এটা ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে কাজ হবে, তাও চেষ্টা করে দেখেন। কিন্তু যা-ই করেন তা যেন সমন্বিত হয়। কেবল এক দুইটা ফুটো বন্ধ করার মতো যেন না হয়। এরূপ হলে তাতে কাজ হবে কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
আমি বুঝতে পারি না, ব্যভিচার বা ধর্ষণ নির্মূলই যদি আমাদের লক্ষ্য হয় তবে কেন ইসলামের এই সার্বিক বিধান অনুসরণ করা হচ্ছে না। অন্য অনেক কিছুই তো করা হলো; তাতে কতটুকু কাজ হয়েছে তাও স্পষ্ট। এবার কেন তাহলে ইসলামের দিকে ফিরে আসা নয়? এর একটাই কারণ হতে পারে, সম্ভবত আমরা নিজেরাই এর নির্মূল চাই না। যদি এমনই হয়, তবে কেনই বা লোক দেখানো সমাধান প্রচেষ্টা?
যাই হোক, আমাদের প্রিয় দেশে আমরা আর কোনো ধর্ষণ দেখতে চাই না, চাই না কোনো বোনের আহাজারি শুনতে। অপেক্ষায় থাকলাম আমরা; কেউ যেন (কোনো ধর্ষক বা সরকার) বলতে না পারে আমরা তাদের জানাইনি, সতর্ক করিনি। হয়তো একদিন সকলেই আমরা ইসলামের দিকে ফিরে আসব। আমাদের গন্তব্য তো হে রব, তোমারই পানে।
ওয়ামা তাওফিকী ইল্লা বিল্লাহ।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়