1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
নিয়তের গুরুত্ব
মাওলানা মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান
  • ১ জানুয়ারী, ২০২১

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: “إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ اِلٰى الدُّنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إلٰى مَا هَاجَرَ إلَيْهِ”. (مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)

অনুবাদ: হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “নিশ্চয় সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পাবে যা সে নিয়ত করে। সুতরাং যার হিজরত আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্য হবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই। আর যার হিজরত দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে অথবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে তার হিজরত সে উদ্দেশ্যেই বিবেচিত হবে যে জন্য সে হিজরত করেছে।” (বুখারী ও মুসলিম)

বর্ণনার প্রেক্ষাপট: পবিত্র কুরআন মজীদের কোনো আয়াত বা সূরা নাযিলের পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা বা কারণ থাকলে তা এর ‘সববে নুযূল’ নামে পরিচিত। আর হাদীস বর্ণনার পেছনে কোনো বিশেষ ঘটনা থাকলে তা ‘সববে উরুদ’ নামে পরিচিত। এ হাদীসের পেছনে একটি বিশেষ ঘটনা রয়েছে। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র.) লিখেছেন, ইমাম তাবারানী ‘আল মু’জামুল কাবীর’ গ্রন্থে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের সনদে উল্লেখ করেছেন, হযরত আবূ ওয়াইল থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন; তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তি ‘উম্মু কায়স’ নাম্মী এক মহিলার নিকট বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। উম্মু কায়স উক্ত ব্যক্তির হিজরত করা ছাড়া তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে অস্বীকার করলেন। তখন সে ব্যক্তি হিজরত করে তাকে বিবাহ করলেন। (ইবনু মাসউদ বলেন) আমরা তাকে ‘মুহাজিরু উম্মি কায়স’ তথা উম্মু কায়স নাম্মী মহিলার উদ্দেশ্যে হিজরতকারী বলে ডাকতাম। (উমদাতুল কারী, প্রথম খ-, পৃষ্ঠা: ২৮)
আল্লামা আইনী (র.) বলেন, ইবনু দাহিয়া বলেছেন, এ মহিলার নাম ‘কায়লাহ’। তবে উক্ত ব্যক্তির নাম জানা যায়নি। (প্রাগুক্ত)

বিভিন্ন কিতাবে হাদীসটি প্রথমে উল্লেখ করার কারণ: অনেক উলামায়ে কিরাম দারস বা গ্রন্থ রচনার শুরুতে এ হাদীস প্রথমে উল্লেখ করা মুস্তাহাব মনে করেন। এর দ্বারা তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, দারসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ও গ্রন্থ পাঠকারীদের পরিশুদ্ধ নিয়তের প্রতি সতর্ক করা ও এর প্রতি গুরুত্ব প্রদান করা। ইমাম বুখারী (র.) তাঁর ‘আল জামিঈ আস-সহীহ’ এর শুরুতে এ হাদীস এনেছেন। অনুরূপ অনেক মুহাদ্দিস করেছেন। ইমাম আবূ সুলায়মান আল খাত্তাবী (র.) বলেছেন, আমাদের পূর্বসূরী শায়খগণ সকল কাজের আগে নিয়তের হাদীসকে উল্লেখ করতেন। ইমাম আবূ সাঈদ আবদুর রাহমান ইবনু মাহদী (র.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোনো কিতাব রচনা করতে চায় সে যেন এ হাদীস দ্বারা তা শুরু করে।

রাবী পরিচিতি: এ হাদীসের মূল রাবী তথা বর্ণনাকারী হলেন হযরত ওমর (রা.)। তাঁর পিতার নাম খাত্তাব। উপনাম আবূ হাফস। ফারুক তাঁর উপাধি। তিনি ছিলেন আমীরুল মুমিনীন, মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জন্মের তেরো বছর পর ৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জন্ম। নবুওয়াতের ষষ্ঠ বর্ষে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তেরো হিজরীতে হযরত আবূ বকর (রা.)-এর ইন্তিকালের পর তিনি খলীফা হন এবং দীর্ঘ দশ বছর ছয় মাস পাঁচ দিন খেলাফতের মসনদে আসীন ছিলেন। ২৩ হিজরী সনের ২৭ যিলহজ্জ তারিখে ফজরের নামাযের সময় তিনি অগ্নি উপাসক আততায়ী আবূ লুলুর হাতে আহত হন এবং ১ মুহররম শাহাদাত বরণ করেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা ও প্রাসঙ্গিক কথা: এ হাদীস ইসলামের মূলনীতি সম্পর্কিত হাদীসসমূহের একটি। এটি মুত্তাফাকুন আলাইহি হাদীস। কেউ কেউ একে মুতাওয়াতির পর্যন্ত বলেছেন। তবে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (র.) বলেছেন, হাদীসটি মুতাওয়াতির নয়; মাশহুর।
এ হাদীসে নিয়তের বিশুদ্ধতা তথা ইখলাসের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। হাদীসের সারকথা হলো, নিয়ত যেমন হবে ফল বা সাওয়াবও তেমন হবে। যদি ব্যক্তি খুলুসিয়াতের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোনো কাজ সম্পাদন করেন তাহলে তিনি সে অনুযায়ী সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন। পক্ষান্তরে দুনিয়াবি কোনো ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে যদি কাজ সম্পাদন করেন তাহলে তিনি সে অনুযায়ী ফল পাবেন।
রাসূলে পাক (সা.) বিশেষ কারণে (যা হাদীস বর্ণনার প্রেক্ষাপটে উল্লেখ আছে) এ হাদীসে হিজরতের প্রসঙ্গ এনেছেন এবং একথা সুষ্পষ্ট করেছেন যে, কেউ যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরত করেন তাহলে তার হিজরত আল্লাহ ও তার রাসূলের উদ্দেশ্যে পরিগণিত হবে। পক্ষান্তরে কেউ দুনিয়া লাভ কিংবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন তাহলে তার হিজরত তার যে দুনিয়াবি উদ্দেশ্যেই পরিগণিত হবে। অর্থাৎ খালিসভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে হিজরতকারীগণ যে সাওয়াব প্রাপ্ত হবেন দ্বিতীয় ব্যক্তি সে সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন।
এ হাদীস থেকে মূলনীতি হলো- নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, দান, সদকা ইত্যাদি সকল আমলের সাওয়াব নিয়তের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয়। এটি হানাফী উলামায়ে কিরামের অভিমত। সুতরাং কেউ যদি দুনিয়াবি উদ্দেশ্যে কোনো নেক আমল করেন তাহলে সে আমল তার জন্য পরকালীন কোনো সুফল বয়ে আনবে না। আর শাফিঈগণের মতে, নিয়ত ছাড়া কোনো আমল শুদ্ধই হবে না। এ বিষয়টি নিয়ে উলামায়ে কিরাম দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। পরিসর স্বল্পতার কারণে আমরা এখানে তা আলোচনা করছি না।

হাদীসের মূল শিক্ষা: হাদীসের মূল শিক্ষা হলো, সকল কাজে নিয়তকে বিশুদ্ধ করা আবশ্যক। যদি নিয়ত বিশুদ্ধ না হয় আমল নেক হলেও তাতে কোনো ফায়দা হবে না। কেউ যদি লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়েন তাহলে তার সে নামায কোনো সুফল বয়ে আনবে না। কেউ যদি নিজেকে দানশীল হিসেবে পরিচিত করার জন্য দান সদকা করেন তাহলে তার সে দান-সদকাও কোনো কাজে আসবে না। পক্ষান্তরে কেউ যদি তার স্বাভাবিক কাজ-কর্মকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নির্ধারিত করে নেন তাহলে তার এ স্বাভাবিক কাজ-কর্মও ইবাদত হবে, সাওয়াব লাভের কারণ হবে। যেমন আমরা প্রতিদিন দু-তিন বেলা খাবার গ্রহণ করি। সাধারণত এতে খাদ্যের চাহিদা পূরণ ছাড়া অন্য কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে না। কিন্তু যদি আমরা খাবারের উদ্দেশ্য ‘আল্লাহর ইবাদাতের জন্য শরীর সুস্থ-সবল রাখা’ বানিয়ে নেই তাহলে এ থেকে যেমন আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হবে তেমনি সাওয়াবও হবে। আমরা কুরবানী করি, কুরবানীর গোশত আমরা নিজেরা খাই, কিন্তু এর দ্বারা আল্লাহর কুরবত বা সাওয়াবের প্রত্যাশা করি সেতো নিয়তের ভিত্তিতেই। সুতরাং জীবনের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম পালন ও সন্তুষ্টিকে উদ্দেশ্য বানিয়ে নিলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে। আল্লাহ মানুষকে কেবল তাঁর ইবাদতের জন্য বানিয়েছেন। কিন্তু সবসময় কি আল্লাহর ইবাদত করা সম্ভব? হ্যাঁ, এভাবে নিয়তকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে তা সম্ভব হবে।

আল্লাহ আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে তাঁর সন্তষ্টির উদ্দেশ্যে খালিস করার তাওফীক দান করুন, যাতে আমরা আকুণ্ঠ চিত্তে উচ্চারণ করতে পারি
إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ (سورة الانعام: ১৬২)

-নিশ্চয় আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য। (সূরা আনআম: ১৬২)

ফেইসবুকে আমরা...