আল্লামা ইকবাল বলেন, হযরত মারইয়াম আলাইহাস সালাম কেবল একদিক থেকে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের আম্মাজান হওয়ার কারণে জগতবাসীর নিকট সম্মানিত আর হযরত ফাতিমা (রা.) তিনদিকে সম্বন্ধযুক্ত হওয়ার কারণে সম্মানিত। প্রথমত, তিনি রাহমাতুল্লিল আলামীন হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নয়নমণি। দ্বিতীয়ত, ‘হাল আতা আলাল ইনসানি হিনুম মিনাদ দাহ্র’ (কুরআনের এ আয়াত) যার শানে অবতীর্ণ হয়েছে, তিনি সেই হযরত আলী (রা.) এর পবিত্রতম স্ত্রী। তৃতীয়ত, ইশক-মহব্বতের মধ্যমণি ইমাম হাসান (রা.) ও ইশক-মহব্বতের সেনাপতি হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর আম্মাজান। (রুমূযে বেখূদী, কুল্লিয়্যাতে ইকবাল)
অধিকতর বিশুদ্ধ অভিমত অনুযায়ী হযরত ফাতিমা (রা.) নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একচল্লিশতম বছরে জন্মগ্রহণ করেন। فاطمة শব্দটি فطم থেকে নির্গত, অর্থ হলো পৃথককারিণী। হযরত আলী (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! ফাতিমাকে কেন এ নামে নামকরণ করা হয়েছে? তিনি বলেন, কেননা আল্লাহ তাআলা তাকে এবং তাঁর মহব্বতকারীদেরকে জাহান্নাম থেকে পৃথক করেছেন। (হায়তামী, আসসাওয়াইকুল মুহরিকাহ)
তাঁর উপাধিগুলোর মধ্যে প্রধানত হলো- ১. যাহরা বা ফুলের কলি। কেননা তিনি বেহেশতের ফুলের কলি। ২. বাতুল বা পৃথক। কেননা তিনি তাঁর সময়ের অন্যান্য মহিলাদের চেয়ে জ্ঞান, বংশ মর্যাদা, চরিত্র মাধুর্য ও পরহেযগারী বা খোদাভীতিতে সবার শীর্ষে উঠে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। ৩. তাহিরা বা পূতপবিত্রা। কেননা তিনি চরিত্র ইয্যত আবরূ ও সম্মানহানী হয় এমন যাবতীয় কর্মকা- থেকে সম্পূর্ণ পূতপবিত্রা ছিলেন। তাছাড়া আয়াতে তাতহীর
إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا
-এর মধ্যে যে সকল ব্যক্তিগণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন তার মধ্যে তিনিও গণ্য রয়েছেন বিধায় তাকে তাহিরা বলা হয়। ৪. যাকিয়্যা: তিনি হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী কন্যা হওয়ার কারণে নবুওয়াতের কল্যাণে আত্মিক দিক থেকে পবিত্রতা লাভ করেছিলেন। তাই তাঁকে যাকিয়্যা বলা হয়।
হযরত ফাতিমা (রা.) দৈহিক গঠনাকৃতির দিক থেকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ ছিলেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা (রা.) ইরশাদ করেন, দৈহিক গঠন, চাল-চলন, উঠা-বসায় হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ হযরত ফাতিমা (রা.) এর চেয়ে আর কাউকে দেখিনি। তিনি বলেন, যখন তিনি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে প্রবেশ করতেন তখন তিনি (নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর (ফাতিমা (রা.) এর) উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াতেন, তাঁকে চুম্বন করতেন এবং নিজ আসনে তাঁকে বসাতেন। আর যখন নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিকট প্রবেশ করতেন, তখন তিনি নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে যেতেন, তাঁকে চুম্বন করতেন এবং নিজ আসনে তাঁকে বসাতেন। যখন নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন ফাতিমা (রা.) তাঁর নিকট প্রবেশ করে তাঁর দিকে ঝুঁকে গেলেন এবং চুম্বন করলেন অতঃপর মাথা উচু করে কাঁদলেন। অতঃপর তিনি আবার তাঁর উদ্দেশ্যে ঝুঁকে পড়লেন অতঃপর মাথা উচু করলেন এবং হাসলেন। আমি (আয়িশা) বললাম, আমি অবশ্যই ধারণা রাখি যে, তিনি আমাদের নারীদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী নারী। কিন্তু (তাঁর হাসি দেখে মনে হলো) অন্যান্য নারীদের মতো তিনিও একজন নারীই। যখন নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করলেন, আমি (আয়িশা) তাঁকে (ফাতিমা) বললাম, আপনি আমাকে এর রহস্য বলবেন কি যে, যখন আপনি নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ঝুঁকে যাওয়ার পর মাথা উত্তোলন করলেন, তখন কেঁদেছিলেন; এবং আবার যখন তাঁর দিকে ঝুঁকে যাওয়ার পর মাথা উত্তোলন করেছিলেন তখন হেসেছিলেন। হযরত ফাতিমা (রা.) বলেন, তাঁর জীবদ্দশায় আমি বিষয়টি গোপন রেখেছি। (কেননা তিনি গোপন বিষয় প্রকাশ করে দেওয়া পছন্দ করতেন না।) তিনি আমাকে বলেছিলেন, এ অসুস্থ অবস্থাতেই তিনি ইন্তিকাল করবেন, তাই আমি কেঁদেছি। অতঃপর তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর ইন্তিকালের পর তার পরিবারের লোকদের মধ্যে সর্বপ্রথম আমিই তাঁর সাথে মিলিত হব, এ জন্য আমি হেসেছি। (তিরমিযী)
হযরত ফাতিমা (রা.) কে হযরত আলী (রা.) বিবাহ করেন দ্বিতীয় হিজরী সনের রামাদান মাসে। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর ৫ মাস অথবা ১৫ বছর সাড়ে ৬ মাস এবং তিনি আলী (রা.) এর গৃহে গমন করেন যিলহজ্জ মাসে। কেউ কেউ বলেন বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল রজব মাসে, কেউ বলেছেন সফর মাসে। তখন হযরত আলী (রা.) এর বয়স ছিল ২১ বছর পাঁচ মাস। হযরত ফাতিমা (রা.) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন হযরত আলী (রা.) আর কোনো নারীকে বিবাহ করেননি। (মুহাম্মদ আহমদ ঈসা, বানাতুর রাসূল)
মুসাদ্দাদ এক ব্যক্তির নিকট থেকে বর্ণনা করেন, তিনি কুফায় হযরত আলী (রা.) এর নিকট থেকে শুনেছেন, হযরত আলী (রা.) বলেন, আমি হযরত ফাতিমাকে বিবাহের প্রস্তাব দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলাম। তখন আমার মনে হলো যে, আমার কিছু নেই। কিন্তু রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমার সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধনের কথা মনে করে ফাতিমাকে বিবাহের প্রস্তাব পেশ করলাম। হাকিম, বায়হাকী ও ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কিছু আছে কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি আমাকে বললেন, বদর যুদ্ধের মালে গণিমতের বর্মটি কোথায়? হযরত আলী বলেন, এটি আমার কাছে রয়েছে। তিনি বললেন, এটিই তুমি তাঁকে (ফাতিমাকে) দিয়ে দাও। অতঃপর তিনি বললেন, আমি তোমাদের নিকট না আসা পর্যন্ত কোনো কথা বলবে না। তিনি আমাদের নিকট আসলেন, আমাদের উপর তখন একখানা চাদর ছিল। তিনি আমাদেরকে দেখলেন, তখন আমরা পৃথক হয়ে গেলাম। অতঃপর তিনি একটি (পানির) পাত্র চাইলেন, তা নিয়ে আসা হলো, এবং এতে তিনি দুআ করে দিলেন, অতঃপর তা আমাদের উপর ছিটিয়ে দিলেন। আমি বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের মধ্যে কে আপনার নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, সে (ফাতিমা) আমার নিকট তোমার চেয়ে প্রিয়, তবে তুমি আমার নিকট তাঁর (ফাতিমা) চেয়ে অধিকতর সম্মানিত। (হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়াঈদ)
সায়্যিদায়ে কায়িনাত হযরত ফাতিমা (রা.) যখন বিবাহের বয়সে পদার্পণ করেন, তখন সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে তাঁর জন্য বিবাহের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। যাখাইরুল উকবা কিতাবে এসেছে হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, সর্বপ্রথম হযরত আবূ বকর (রা.) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হযরত ফাতিমা (রা.) এর বিবাহের প্রস্তাব পেশ করেন; রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোন ফায়সালা আসেনি। অতঃপর কুরাইশদের সকল সম্ভ্রান্ত লোকদের মধ্যে হযরত উমার (রা.) সহ অনেকেই বিবাহের প্রস্তাব পেশ করেন। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে একই উত্তর দেন। অতঃপর কেউ একজন হযরত আলী (রা.)কে হযরত ফাতিমা (রা.) এর উদ্দেশ্যে বিবাহের পয়গাম পেশ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, যেখানে কুরাইশ বংশের সম্ভ্রান্ত লোকেরা প্রস্তাব পাঠিয়েছে, সেখানে আমি প্রস্তাব পাঠিয়ে কী লাভ হবে? হযরত আনাস (রা.) বলেন, হযরত আলী (রা.) প্রস্তাব দিলেন এবং প্রতিউত্তরে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা আমাকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, কয়েকদিন পর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, হে আনাস! যাও, আবূ বকর, উমর, উসমান, আব্দুর রহমান বিন আউফ, তালহা, যুবাইর (রা.)সহ অন্যান্য আরো কতিপয় আনসারদের ডেকে নিয়ে এসো। আমি তাদের সবাইকে ডেকে আনলাম। তারা সকলে নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একত্রিত হলেন, কিন্তু হযরত আলী (রা.) নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এ মজলিসে অনুপস্থিত ছিলেন। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উদ্দেশ্যে খুতবা পাঠ করলেন। অতঃপর বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হযরত আলীর সাথে আমার কন্যা ফাতিমাকে বিবাহ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেছেন। তোমরা সাক্ষী হও আমি আমার কন্যা ফাতিমাকে চারশ মিসকাল রৌপ্য মোহরানায় আলীর নিকট বিবাহ প্রদান করলাম, যদি আলী এতে রাজি থাকেন। অতঃপর কাঁচা খেজুরের একটি বারকোশ নিয়ে এসে আমাদের সম্মুখে রাখা হলো। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা এ খেজুর কাড়াকাড়ি করে খেতে থাকো, আমরা এ খেজুর কাড়াকাড়ি করেই খেতে থাকলাম। (উল্লেখ্য, খেজুর বা খাদ্যদ্রব্য পরস্পরে কাড়াকাড়ি করে খাওয়া জায়েয নেই, সম্ভবত বিবাহের মিষ্টান্ন কাড়াকাড়ি করে খাওয়া সুন্নাত বা মুস্তাহাব)। ইতোমধ্যে হযরত আলী (রা.) উপস্থিত হলেন, নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন এবং বললেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আমি যেন ফাতিমাকে তোমার নিকট চারশ মিসকাল রৌপ্যের মোহরানায় বিবাহ প্রদান করি, যদি তুমি এতে রাজি থাকো। হযরত আলী (রা.) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি এতে রাজি আছি। অতঃপর নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের উদ্দেশ্যে দুআ করলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদের উভয়ের আঁচলকে একত্রিত করে দিন, তোমাদের উদ্দেশ্যকে ফলপ্রসূ করুন, তোমাদের উভয়ের মাঝে বরকত দান করুন এবং তোমাদের মধ্য থেকে প্রভূত কল্যাণ বের করুন। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার নিকট একজন ফেরেশতা আগমন করে বললেন, আল্লাহ তাআলা আপনাকে সালাম পেশ করেছেন এবং বলেছেন, আমি ঊর্ধ্বজগতের অধিবাসীদের মাঝে আপনার কন্যা ফাতিমাকে আলী বিন আবি তালিবের নিকট বিবাহ প্রদান করেছি। আপনিও পৃথিবীতে ফাতিমাকে আলী বিন আবি তালিবের নিকট বিবাহ প্রদান করুন। (মুহিবুদ্দীন তাবারী, যাখায়েরুল উকবাহ)
হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতিমা (রা.) পারিবারিক জীবনে নিজের কাজ নিজে করতেন। নিজে ঘর ঝাড়– দিতেন, চাক্কি দিয়ে গম পিষতেন, নিজ হাতে রান্না করতেন, মশক ভরে পানি তুলে আনতেন। যার কারণে তাঁর হাত ও শরীর যখম হয়ে যেত। এরপরেও তিনি সর্বদা হযরত আলী (রা.) এর নিকট নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। কখনো এতে তাঁর নামায, রোযা, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য ইবাদত বন্দেগি ব্যাহত হয়নি।
হযরত ফাতিমা (রা.) নিজে চাক্কি পিষতেন বিধায় তাঁর হাতে কড়া পড়ে যায়। এ কষ্টের কথা তিনি হযরত আলী (রা.) এর নিকট বললে হযরত আলী (রা.) একজন খাদেমের জন্য তাকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট প্রেরণ করেন। হযরত ফাতিমা (রা.) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গিয়ে খাদেমের কথা না বলেই ফিরে আসেন। ঘরে ফিরে এসে তারা একত্রে একটি চাদরে আচ্ছাদিত হয়ে শুয়ে পড়েন। চাদরটি এত ছোট ছিল যে, যদি এটি লম্বালম্বীভাবে দিতেন তবে পিঠ বের হয়ে যেত আর যদি আড়াআড়িভাবে দিতেন তবে পা বের হয়ে যেত। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমার আগমনের সংবাদ পেয়ে তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আম্মাজান! তুমি আমার কাছে গিয়ে আবার ফিরে চলে এসেছ। আমার কাছে তোমার কোনো প্রয়োজন আছে কি? তিনি বললেন; না, আপনার নিকট আমার কোন প্রয়োজন নেই। তখন হযরত আলী (রা.) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ফাতিমা চাক্কি পিষতে পিষতে তাঁর হাতে কড়া পড়ে যায়। এজন্য আমি তাকে আপনার নিকট একজন খাদেমের জন্য প্রেরণ করেছিলাম। (মুহিবুদ্দীন তাবারী, যাখায়েরুল উকবাহ)
এখানে উল্লেখ্য যে, এ বর্ণনাটিতে পরিলক্ষিত হয় যে, হযরত ফাতিমা (রা.) নিজ থেকে খাদিমের জন্য রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গমন করেননি; বরং তিনি হযরত আলী (রা.) এর নির্দেশ পালন করার জন্যই গিয়েছিলেন। তবুও তিনি গিয়ে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট খাদিম চাননি, ভয় ও লজ্জায় ফিরে এসেছেন।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁেক সরাসরি কোনো খাদিম না দিয়ে একখানা আমল বলে দিলেন যে, তোমরা যখন বিছানায় যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। এ তাসবীহগুলো তোমাদের প্রার্থিত খাদিমের চেয়েও উত্তম। অপর বর্ণনায় এসেছে, এ তাসবীহগুলো উচ্চারণে ১০০ বার কিন্তু আমলের পরিমাণে ১০০০ বার। উল্লেখ্য যে, এ তাসবীহকে তাসবীহে ফাতেমী বলা হয়ে থাকে।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হযরত ফাতিমা (রা.) যখন রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট খাদিম চাইলেন তখন তিনি তাদেরকে নিম্ন বর্ণিত দুআ শিখিয়ে দিলেন-
اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبَّ الْأَرْضِ، وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ، فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى، وَمُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ وَالْفُرْقَانِ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ، اللَّهُمَّ أَنْتَ الْأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ، وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ، اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ
‘হে আল্লাহ! সাত আসমান, সাত যমীন ও মহান আরশের প্রতিপালক, আপনি আমাদের ও সকল কিছুর প্রতিপালক। আপনি বীজ ও দানা সকল কিছুর সৃষ্টিকারী। আপনি তাওরাত, ইনজীল ও কুরআন অবতীর্ণকারী। কপালের চুল ধরে পাকড়াও করেন এমন সকল বস্তু থেকে আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে কিছুই নেই। আপনিই শেষ, আপনার পরে কিছুই নেই। আপনিই প্রকাশকারী, আপনার উপরে কোন কিছু নেই। আপনিই গোপনকারী আপনার নিচে কোন কিছু নেই। আপনি আমাদের ঋণ পরিশোধ করে দিন এবং আমাদের দারিদ্র থেকে অমুখাপেক্ষী করুন।’ (মুহিবুদ্দীন তাবারী, যাখায়েরুল উকবাহ)
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন হযরত ফাতিমা (রা.)কে সম্বোধন করে বলেন, আল্লাহ তাআলা তোমার অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট এবং তোমার সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট। (মুজাম, তাবরানী)
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হিশাম বিন মুগিরার ছেলেরা আমার কাছে তাদের কন্যাকে আলীর নিকট বিবাহ প্রদানের অনুমতি চেয়েছে। আমি তাদেরকে অনুমতি দিব না, আমি তাদেরকে অনুমতি দিব না, আমি তাদেরকে অনুমতি দিব না। তবে যদি আলী আমার কন্যাকে তালাক দিয়ে বিবাহ করতে চায় তবে সেটি ভিন্ন বিষয়। কারণ আমার কন্যা আমারই অংশ। যা তার সম্মানহানি করে, তা আমারও সম্মানহানি করে। যা তাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকেও কষ্ট দেয়। (সহীহ মুসলিম)
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন সফরে বের হতেন, তখন সবশেষে তাঁর সাথে দেখা করে যেতেন এবং সফর থেকে ফিরে এসে সবার আগে তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন। (আহমাদ)
হযরত ইবনে আব্বাস বলেন, হযরত আলী (রা.) আবূ জাহেলের মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনতে পেয়ে হযরত আলী (রা.)কে বলেন, যদি তুমি আবূ জেহেলের কন্যাকে বিবাহ কর, তাহলে আমার কন্যাকে আমার নিকট ফিরিয়ে দাও। কেননা আল্লাহর রাসূলের কন্যা ও আল্লাহর শত্রুর কন্যা এক ব্যক্তির অধীনস্ত হতে পারে না। (মুজামুস সালাসাহ, তাবরানী)
হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আসমানের একজন ফেরেশতা (ইতিপূর্বে) আমার সাক্ষাত পায়নি। তিনি প্রতিপালকের নিকট আমার সাথে সাক্ষাত করার অনুমতি চাইলেন। আল্লাহ তাকে অনুমতি দিলেন, তিনি আমাকে সুসংবাদ দিলেন যে, নিশ্চয়ই ফাতিমা এ উম্মতের নারীদের সরদার। (মুজাম, তাবরানী)
হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, আমি ফাতিমার চেয়ে তাঁর পিতা রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর কাউকে অধিক সত্যবাদী দেখিনি। হযরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, আমি ফাতিমার চেয়ে তাঁর জন্মদাতা পিতা রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আর কাউকে কখনো অধিক সম্মানিত দেখিনি। (হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়াঈদ)
হযরত ফাতিমা (রা.) রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের ছয়মাস পর ইন্তিকাল করেন। অপর একটি বর্ণনায় এসেছে এগারো হিজরী সনের তৃতীয় রামাদান মঙ্গলবার রজনীতে তিনি ইন্তিকাল করেন। হযরত আলী (রা.) তাঁকে রাতেই দাফন করেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর তিন মাস পর্যন্ত তাঁকে হাসতে দেখা যায়নি। হযরত ফাতিমা (রা.) এর ওফাতের সময় যখন ঘনিয়ে আসল, হযরত আলী (রা.)কে পানি আনার জন্য বললেন। তিনি পানি আনলেন, ফাতিমা (রা.) সে পানি দিয়ে গোসল করে পবিত্রতা অবলম্বন করলেন। অতঃপর তিনি কাফনের কাপড় নিয়ে আসার জন্য বললেন। মোটা উলের কাপড় নিয়ে আসা হলো, তিনি তা পরিধান করলেন। অতঃপর হানুত্ব লাগালেন এরপর হযরত আলী (রা.)কে বললেন, তার ইন্তিকালের পর যেন তার সতর আর অনাবৃত করা না হয় বরং তার পরিহিত কাপড়েই যেন সমাহিত করা হয়। (মুহাম্মাদ আহমদ ঈসা, বানাতুর রাসূল)
হযরত আলী ও ফাতিমা (রা.) সন্তানসন্তুতি হলেন; হাসান, হুসাইন, মুহসিন, যয়নব, উম্মে কুলসুম ও রুকাইয়া। মুহসিন গর্ভপাতে ও উম্মে কুলসূম অপ্রাপ্ত বয়সেই ইন্তিকাল করেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পূর্বেই উম্মে কুলসূম জন্মগ্রহণ করেন। হযরত ফাতিমার এক কন্যাকে হযরত আব্দুল্লাহ বিন জাফর বিবাহ করেন এবং তাঁর জীবদ্দশাতেই ইন্তিকাল করেন। তাদের উভয়ের সন্তান হলেন আলী, আউন, জাফর, আব্বাস ও উম্মে কুলসূম। (মুহাম্মাদ আহমদ ঈসা, বানাতুর রাসূল)
কবি বলেন,
ثم الحسين والحسن ريحانتان
وبفاطمة هي بضعة من مصطفي
-জান্নাতের দুই ফুল হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (রা.) এবং মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরা হযরত ফাতিমা (রা.) এর তুফাইলে আমাদের অনুগ্রহ, রহমত ও দয়া করুন। (ড. মুহাম্মদ তাহিরুল কাদিরী, দালায়িলুল বারাকাত ফিত তাহিয়্যাতি ওয়াস সালাওয়াত, পৃষ্ঠা-৬০৩)
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা, সিলেট