কিছুদিন পূর্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন, “ইসলাম তো দুটি। একটি মোল্লাদের ইসলাম, আরেকটি সূফীদের।”
এমন নয় যে, কথাটি আমরা প্রথমবার শুনেছি। এমনও নয় যে, কথাটি শাহরিয়ার কবিরের মস্তিষ্কজাত। বরং বহু বছর ধরে এ তত্ত্বটি পশ্চিমা ইসলাম-বিদ্বেষী (Islamophobic) নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে স্থান পেয়ে আসছে। পশ্চিমা যুদ্ধবাজ নেতারা এরকম যুক্তি দিয়ে বারবার মুসলিম বিশ্বে হামলা করাকে বৈধতা দিতে চেয়েছেন। ৯/১১ দুর্ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তান ও ইরাক হামলার প্রারম্ভে মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের মন্তব্য ছিল প্রায় এরকমই। তিনি দাবি করেছিলেন, “আমরা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না। আমাদের যুদ্ধ মৌলবাদী ইসলামের বিরুদ্ধে।” তারা বারবার বুঝাতে চেয়েছেন, ইসলাম দুটি। এক ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর আর দশটি ধর্মমতের মতো একটি Religious Tradition তথা প্রথাসর্বস্ব ধর্মমত, যেখানে কিছু ব্যক্তিগত বিশ্বাস, ব্যক্তিগত ধর্মকর্ম এবং ব্যক্তিগত বা একান্ত পারিবারিক পরিম-লে কিছু প্রথা পরিপালন করার সুযোগ রয়েছে। ইসলামের এ ধরনের ব্যাখ্যা পশ্চিমাদের কাছে অনেকাংশেই গ্রহণযোগ্য। রামাদান মাসে হোয়াইট হাউজে ইফতার পার্টি আয়োজন করার মাধ্যমে এ প্রথা সর্বস্ব ইসলামকে তাঁরা কিঞ্চিত পৃষ্ঠপোষকতাও প্রদান করেন।
পশ্চিমাদের কাছে ইসলামের দ্বিতীয় রূপ হচ্ছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ধর্মকর্মের বাইরের অংশ। ব্যক্তিগত ধর্মকর্মের বাইরে ইসলামের অন্য যে কোনো ভূমিকাকে তারা “মৌলবাদী ইসলাম” নামে আখ্যায়িত করেন। আবার কখনো নাম দেওয়া হয় “রাজনৈতিক ইসলাম” এ নামগুলো তাদেরই দেওয়া। সুবিধামতো এসব পরিভাষার যথেচ্ছা ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে মুসলমানদের যেকোনো অধিকার আন্দোলনের সাথে Political Islam কিংবা Fundamental Islam এর লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়।
এতটুকু পর্যন্ত হজম করা আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য নয়। যাদের চিরন্তন লড়াই ইসলামের বিপক্ষে, তাদের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা করাও নেহায়েত ছেলেমানুষি। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ইদানিং ইসলাম-বিদ্বেষীদের পছন্দনীয় ইসলামকে নতুন একটি নাম প্রদান করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘সূফীবাদী ইসলাম’। ২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী সূফী সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানকালে বলেছেন, ‘ভারতকে সূফীবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হবে।’ তিনি সূফীবাদী ইসলামের মাধ্যমে মৌলবাদী ইসলামকে রুখে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। VOA (ভয়েস অব আমেরিকা) এর তথ্য অনুযায়ী, এ সম্মেলন আয়োজন করার পেছনে কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির বড় ভূমিকা ছিল।
বলা বাহুল্য, ইসলাম-বিদ্বেষী নেতা ও পণ্ডিতদের মুখে ইসলামের যে বিভাজন শোনা যায়, তা ইসলামের নিজস্ব ব্যাখ্যা নয়। এসব তাদেরই আবিষ্কার। বস্তুত ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللهِ الْإِسْلَامُ
‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট মনোনীত দ্বীন হচ্ছে ইসলাম’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৯]
অপর আয়াতে বলা হয়েছে,
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘আর যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চায়, সেটি তার পক্ষ থেকে কবুল করা হবে না। এবং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৮৫)
উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে ‘দ্বীন’ শব্দের অর্থ কেবল ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নয়; বরং পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। যার মধ্যে রয়েছে আকীদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার, পারিবারিক ও সামাজিক বিধিবিধান, আইন প্রণয়নের মূলনীতি, অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ, পারস্পরিক লেনদেন, বিচারিক নীতিমালা, সামরিক কর্মপন্থা, রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনা তথা মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। সূরা ইউসুফে যখন دِينِ الْمَلِكِ বা রাজার দ্বীন বলা হয়েছে, তখন এর দ্বারা ‘রাজার ধর্মবিশ্বাস’ উদ্দেশ্য করা হয়নি। উদ্দেশ্য করা হয়েছে রাজার রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে পরিবর্তন করেননি; বরং জীবন যাপনের পুরো পদ্ধতিকেই নতুনভাবে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। কারও ধর্মবিশ্বাস পাল্টানোর জন্য আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরবারি হাতে নেননি। তরবারি হাতে নিয়েছেন আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীনকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ইসলাম একটি Organic Whole বা জৈবিক একক, যার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবিচ্ছেদ্য। একটি অঙ্গকেও কর্তন করলে সেটি আর পরিপূর্ণ থাকে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَنْ يَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّوْنَ إِلٰى أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
“তাহলে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশকে বিশ্বাস করো এবং কিছু অংশকে প্রত্যাখ্যান করো? অতএব তোমাদের যারা এমন করে, তাদের জন্য পার্থিব জগতে লাঞ্ছনা ও অবমাননা ছাড়া আর কী প্রতিদান হতে পারে? এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। আর তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফিল নন।” (সূরা বাকারা, আয়াত- ৮৫)
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ইসলাম-বিদ্বেষীদের মুখে সূফীবাদী ইসলাম বনাম মৌলবাদী ইসলামের পার্থক্যের বয়ান শুনার পর এখন দেশীয় ঊনপাঁজুরে বুদ্ধিজীবীদের মুখেও এ বয়ান শুনতে হচ্ছে। দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতাকে ধ্বংস করে কিছু নির্জীব প্রথা-পার্বণকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। আর এজন্য ‘সূফীবাদ’ নামক পরিভাষাটি এখন তাদের কাছে তুরুপের তাস। কারণ তথাকথিত সূফীবাদের ঠিকাদাররা বর্তমানে এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন, যেখানে তাদের মধ্যে নববী আদর্শের লেশমাত্র বাকি নেই। নেই তাকওয়া, নেই ইলম, নেই দ্বীনী দাওয়াত, নেই তালীম-তারবিয়াত, নেই বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, নেই তাকবীর দেওয়ার হিম্মাত, নেই জিহাদ, আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করার প্রচেষ্টা তো নেই-ই। আছে শুধু ব্যক্তিপরস্তি, কবরপরস্তি, অসাড়তা, নির্জীবতা, শিরকী প্রথা-পার্বণ, শিরকী ভক্তি-কুর্নিশ, গা বাঁচানো আষাঢ়ে যুক্তি, দ্বীনকে বিক্রি করে পেট চালানোর ধান্ধা। এ জন্য আজ ইসলাম-বিদ্বেষীদের মনে এসব তাগুতের ক্রীড়নকদের ব্যাপারে আশা জন্মেছে।
অথচ তাসাওউফ তথা রূহানিয়্যাত দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব দায়িত্ব নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, তন্মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ছিল তাযকিয়ায়ে নাফস তথা আত্মার পরিশুদ্ধি। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
“তিনি উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, তাদেরকে শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত।” (সূরা জুমুআ, আয়াত- ২)
আল্লাহর মারিফাত অর্জন ও দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার যে দীক্ষা আল্লাহর নবী প্রদান করেছিলেন, আল্লাহর তরে জানমালের নযরানা পেশ করে সাহাবায়ে কিরাম সে পরিশ্রমের মান রেখেছেন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চোখে পানি এসেছিল, সাহাবায়ে কিরাম শরীরের ঘাম ঝরিয়ে সে স্বপ্নকে সার্থক করেছেন। যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এক ফোঁটা ঘাম ঝরেছিল, সাহাবায়ে কিরাম সেখানে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে সেই ঘামের ফোঁটার হক আদায় করেছেন। এই ছিল তাঁদের আত্মশুদ্ধির নমুনা, এই ছিল তাঁদের তাকওয়া ও হুব্বে রাসূলের উদাহরণ, এই ছিল দ্বীনের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার।
সাহাবায়ে কিরামের ত্যাগের মহিমা ইতিহাসে রঙ ছড়িয়েছে। বনূ উমাইয়ার হাতে খিলাফত ভেঙ্গে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার প্রেক্ষিতে জোরালো কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আবূ বকর (রা.), হুসাইন ইবনে আলী (রা.), আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়র (রা.) প্রমুখ সাহাবীরা। ইয়াযীদের দুঃশাসন থেকে ইসলামী খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য ইমাম হুসাইন (রা.)সহ আলে-মুহাম্মাদের ১৯ জন সূর্যসন্তান কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণ করেছেন। আব্বাসী শাসনামলে খলীফা মনসুর ইমাম আবূ হানীফাকে তাঁর অধীনে প্রধান বিচারপতির পদ অর্পণ করতে চেয়েছিলেন, যেন ইমাম আবূ হানীফার কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ করা যায়। কিন্তু জালিমের অধীনে উচ্চপদস্থ চাকরি করার চেয়ে ইমাম আবূ হানীফা কারাগারে বন্দী অবস্থায় বিষ পান করাকে শ্রেয় মনে করেছেন। একই শাসকের বিরুদ্ধে ফতওয়া প্রদান করে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ইমাম মালিক। মুতাযিলা আকীদায় প্রভাবিত হয়ে আব্বাসী খলীফা মামুন যখন কুরআন কারীমকে ‘আল্লাহর কালাম’ হিসেবে অস্বীকার করেছিলেন, তখন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। অন্ধকার কুঠুরিতে বছরের পর বছর চরম নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু আল্লাহর কালামের ইয্যতের জন্য লড়াই করা থেকে ক্ষান্ত হননি।
একই পথে হেটেছেন পরবর্তী আউলিয়া-সালিহীন। ১১৮৭ সালে ক্রুসেডারদের হাত থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয় করে এনেছিলেন তাসাওউফের খানকায় বেড়ে ওঠা বীর মুজাহিদ সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবী। তাঁর ডাকে সে অভিযানে যোগ দেওয়া মুজাহিদীনের একটি বড় অংশ ছিলেন ইমাম সায়্যিদ আব্দুল কাদির জিলানীর মুরিদীন-মুহিব্বীন। ইমাম শাযুলী জিহাদ করেছেন ফরাসিদের বিরুদ্ধে। ১১৯১-৯২ সালে তরাইনের যুদ্ধে সামন্ত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করে ভারতের বুকে ইসলামকে যিনি একটি শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই সুলতান মুহাম্মদ ঘুরীর মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী। ১৩০৪ সালে তরফ রাজ্যের রাজা গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে সায়্যিদ নাসিরুদ্দীন সিপাহসালারের বিজয় অভিযানের পেছনে অনুপ্রেরণার খুঁটি ছিলেন তাঁর মুরশিদ সুলতানে সিলেট শাহজালাল ইয়ামনী (র.)। মুঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের তৈরি দ্বীনে এলাহী নামক নব্য আবিষ্কৃত ধর্মের বিদায়ঘণ্টা বেজেছিল মুজাদ্দিদে আলফে সানী ইমাম আহমদ সিরহিন্দীর হাতে। আল্লাহর এ মহান ওলীর ইসলাহী কার্যক্রম ও জিহাদী চেতনা ভারতের যমীন থেকে দ্বীনে এলাহীর নামকে চিরতরে মুছে দিয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রথম জিহাদের ফতওয়া জারী করেছেন শাহ আবদুল আযীয দেহলভী। তাঁর খলীফা সায়্যিদ আহমদ বেরেলভী মাঠে নেমেছিলেন মুরশিদের ফতওয়াকে বাস্তবায়ন করার জন্য। শিখ, মারাঠা ও ইংরেজদের ত্রিমুখী শক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি ভারতের বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিলেন। ১৮৩১ সালে শিখদের সাথে জিহাদরত অবস্থায় বালাকোটের ময়দানে শাহাদাত বরণ করেন আমীরুল মুসলিমীন সায়্যিদ আহমদ বেরেলভী। সেই ১৮৩১ সাল থেকে আজ অবধি ভারতীয় উপমহাদেশে যত ইসলামী আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে, সবগুলোই মহান বালাকোট আন্দোলনের প্রতিধ্বনি। বালাকোট দেখিয়ে দিয়েছে, জিহাদের মানে কী। পরবর্তীতে সায়্যিদ আহমদের সংগ্রামী সাধনাকে সার্থক করেছেন তাঁর খলীফা মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী ও মীর নিসার আলী তিতুমীর। ইংরেজ সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের বাঁশেরকেল্লার প্রতিরোধ আজও উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে আন্দোলিত করে। একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন শায়খ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী এবং তদ্বীয় খলীফা শায়খ উবায়দুল্লাহ সিন্ধী।
রাশিয়ান সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী সীসাঢালা প্রাচীরের মতো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দাগেস্তানের সিংহ ইমাম শামিল। ইসলাহী কার্যক্রমের মাধ্যমে দ্বিধাবিভক্ত ককেশীয় মুসলমানদেরকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন। এরপর জার স¤্রাটের নাকের নিচে ১৮৩৪ থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি দাগেস্তানে ইসলামী খেলাফত পরিচালনা করেছেন। বারবার আক্রমণ করেও তাঁকে পরাজিত করতে পারেনি রাশিয়ানরা। একটি যুদ্ধে তাঁর পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। আহত অবস্থায়ও ঘোড়ায় চড়ে তিন সারি রাশিয়ান সৈন্যের মাথার ওপর দিয়ে লাফিয়ে চলে যান ইমাম শামিল। শেষমেশ যখন গ্রেফতার হয়েছিলেন, তখনও তাঁকে কারাগারে বন্দী করে রাখার সাহস পায়নি জার সম্রাটের বাহিনী। ১৮৭১ সালে ইমাম শামিল মদীনা মুনাওয়ারায় ইন্তিকাল করেন। জান্নাতুল বাকিতে চিরনিদ্রায় শায়িত নকশবন্দী সিলসিলার এ মহান মুজাহিদের অমর বীরত্বগাথা আজও ককেশাস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে গুঞ্জিত হয়।
আলজেরিয়ায় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন আমির সায়্যিদ আবদুল কাদির আল জাযাইরী। অন্যান্য ঔপনিবেশিক শক্তির মতো ফ্রান্স যখন সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রচেষ্টা হিসেবে ভূমধ্যসাগরের বিপরীত তীরে আলজেরিয়ার দিকে অগ্রসর হয়, তখন আমির আবদুল কাদির প্রথম ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির গতিরোধ করেন। দ্বীনী দাওয়াতের মাধ্যমে মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি আলজেরিয়ার ছোট-বড় সকল গোত্রকে একত্রিত করেন এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী কিছু অঞ্চল ব্যতীত সমগ্র আলজেরিয়ায় নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁকে দমনের জন্য একের পর এক অভিযান পরিচালনা করেও ব্যর্থ হয় ফরাসি বাহিনী। ১৮৩৭ সালে আলজেরিয়ায় ফরাসি বাহিনী ও আমির আবদুল কাদিরের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ফরাসিদের দ্বারা শান্তিচুক্তি লঙ্ঘনের পর তিনি পুনরায় যুদ্ধ শুরু করেন। সাজ-সরঞ্জাম কম হলেও দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত আমীর আব্দুল কাদির তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলেন। শেষপর্যন্ত তাঁকে বন্দী করা হয়। জীবনের শেষদিকে তিনি উসমানী খিলাফতের অধীনে সিরিয়ায় দ্বীনের খিদমতে সময় পার করেছেন এবং সেখানেই ইন্তিকাল করেছেন।
লিবিয়ায় ইতালীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন মরুর সিংহ উমর আল-মুখতার। পেশাগতভাবে কুরআনের শিক্ষক হলেও মুখতার মরুভূমিতে যুদ্ধকৌশলের ব্যাপারে দক্ষ ছিলেন। তাঁর গেরিলা বাহিনী দক্ষতার সাথে বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও সৈন্যবহরের ওপর আক্রমণ চালায় এবং যোগাযোগ ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে বিঘœ সৃষ্টি করে। বারবার আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেওয়া হলেও মুখতার তা ফিরিয়ে দেন। ১৯৩১ সালে আহত অবস্থায় তাঁকে যুদ্ধের ময়দান থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং ফাসিতে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মুখভরা হাসি নিয়ে আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করতে করতে শাহাদাত বরণ করেন সূফী তরীকার এ মহান মুজাহিদ।
উপরিউক্ত মুজাহিদদের সময় ও কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হলেও তাঁদের মধ্যে একটি বড় সাদৃশ্য ছিল। তাঁরা সবাই ছিলেন আলিমে দ্বীন, সূফী। তাসাওউফ তাঁদের সংগ্রামের সোপান হয়েছিল। তাঁদের আত্মশুদ্ধি তাগুতের লংমার্চকে থামিয়ে দিয়েছিল। নিজেদের দেহ-প্রাণকে জ্বালানি বানিয়ে তাঁরা আল্লাহর বাতিকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। একইভাবে এ বাংলাদেশে যখনই ইসলাম-বিদ্বেষীদের চক্রান্ত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন এ দেশের উলামা-মাশায়েখ প্রতিবাদী হয়ে রাস্তায় নেমেছেন, প্রতিরোধ গড়েছেন। এ ক্ষেত্রে আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর নামটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যখন কালামে পাকের একটি হরফের উচ্চারণকে বিকৃত করে ভুলভাবে পাঠ করার রেওয়াজ চলছিল, তখন কুরআনের একটি হরফের জন্য মাঠে নেমেছিলেন আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.)। বাংলার মাটিতে কালামে পাকের বিশুদ্ধ তিলাওয়াতকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি নিজেকে মুজাদ্দিদে আলফে সানীর যোগ্য উত্তরসূরিরূপে প্রমাণ করেছেন। ঘোষিত নাস্তিকদের ইসলাম-বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এ দেশের উলামা-মাশায়েখের প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক অগ্রসেনানী। ড. কুদরত-ই-খোদা শিক্ষা কমিশন যখন এ দেশে ইসলামী শিক্ষাকে চরমভাবে কোণঠাসা করতে চেয়েছিল, তখন তিনি এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করার জন্য তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। ২০০৭ সালে স্বতন্ত্র ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সিলেট থেকে ঢাকা অভিমুখে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশালতম এক লংমার্চ করেন। ২০০৮ সালে ইহলোক ত্যাগ করার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বাংলার যমীনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শান-মান-ইয্যতের পক্ষে সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিলেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.)। ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে তাঁর শক্তিশালী ভূমিকা উপমহাদেশের ইতিহাসে তাঁকে অমরত্ব এনে দিয়েছে।
ইসলাম-বিদ্বেষীরা এই তাসাউফের ইতিহাস জানে না। জানলে সূফীবাদের নামটিও মুখে নিত না। তাদের কথিত সূফীবাদের ধ্বজাধারীরা হচ্ছে একদল মাদকাসক্ত মানুষ, যারা কখনও আল্লাহর জন্য মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। যারা রাজন্যবর্গের দক্ষিণা গ্রহণ করার জন্য দ্বীনকে বিক্রি করতে পিছপা হয় না। যারা আল্লাহর কিতাবকে তুচ্ছজ্ঞান করে, কবর দেখলে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে, পীরকে খোদার সমতূল্য মনে করে, আল্লাহকে ছেড়ে গায়রুল্লাহ’র কাছে মুনাজাত ধরে, আল্লাহর প্রাপ্য মুহাব্বাত অন্যকে দিয়ে বেড়ায়। যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের চেয়ে তাদের পীর বা নেতার আহ্লাদকে বড় মনে করে। যারা ইয়ামামায় মহাবীর খালিদ ইবনে ওয়ালিদের বীরত্বগাথা পড়েনি, হিত্তীনে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর পদধ্বনি শুনেনি, আইন জালুতে রুকনুদ্দীন বাইবার্সের রণকৌশল বুঝেনি, কনস্টান্টিনোপলের দেয়ালে দাঁড়িয়ে ‘আল্লাহু আকবার’ তাকবীর দেয়নি। ওরা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘাম-রক্ত-অশ্রুর মর্যাদা কী বুঝবে? ওসব অপকৃষ্ট, হীন, কদর্য মানুষ কীভাবে সূফী হয়? ওদের পথ তো আল্লাহর পথ নয়, আল্লাহওয়ালা প্রকৃত সূফীদের পথ নয়। ওদের তাসাওউফ ‘সুলুকে মুহাম্মাদী’ নয়। তাগুতের প্রেয়সী ওরা, আল্লাহর প্রিয় নয়।
দ্বীনহীন দাজ্জালদেরকে সূফী বানিয়ে এদের মাধ্যমে ইসলামকে খণ্ডিত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র ধুপে টিকবে না। ইসলাম আল্লাহর বাতি, এবং আল্লাহ তাঁর বাতিকে পূর্ণরূপে প্রজ্বলিত করবেন। আল্লাহ বলেছেন,
يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
“তারা মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর বাতিকে নিভিয়ে দিতে চায়। আর আল্লাহ তাঁর বাতিকে পূর্ণরূপে প্রজ্বলিত করবেন, চাই কাফিররা সেটি অপছন্দ করুক।” (সূরা সাফ, আয়াত- ৮)
মিকদাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ليَبْلُغن هذا الأمر ما بلغ اللَّيل والنَّهار ولا يترك الله بيت مَدَرٍ ولا وَبَرٍ إلَّا أدخله اللهُ هذا الدِّين
“ইসলাম তথায় পৌঁছে যাবে, যেথায় রাত ও দিন পৌঁছায়। পৃথিবীপৃষ্ঠে ইট-বালির তৈরি ঘর এবং পশমের তৈরি কোনো তাবু বাকি থাকবে না যেখানে আল্লাহ এ দ্বীনকে প্রবেশ করাবেন না।” (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং- ১৬৯৯৮)
অতএব এ উম্মত তাঁদের নবীর রেখে যাওয়া আমানতকে পৌঁছে দেবে দুনিয়ার দিকে দিকে। আবার মরুগিরি পার হয়ে অভিযান চলবে। আবার আফ্রিকা-ইউরোপে আযানের সুর ধ্বনিত হবে। আবার তাকবীরে তাকবীরে ধরণী ও আসমান প্রকম্পিত হবে। কালিমা তায়্যিবার বিজয়-নিশান আবার পতপত করে উড়বে বিশাল নীল গগনে। প্রতীক্ষা শুধু সময়ের, প্রয়োজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞার।
লেখক: পরিচালক, তাইয়্যিবা ফাউন্ডেশন