الم- ذٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيْهِ- هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ
আলিফ-লাম-মীম। এটা সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, মুত্তাকীদের জন্য ইহা পথ প্রদর্শক।
الم
এ ধরনের ‘হরফ’ যা কতগুলো সূরার শুরুতে রয়েছে, এ সম্পর্কে দুটি বক্তব্য রয়েছে। প্রথম বক্তব্য হচ্ছে, এগুলো হলো আশিক ও মাশুকের মধ্যে পরস্পর ভাব বিনিময়ের কতগুলো সংকেত। আর পৃথকভাবে একেকটি হরফ নিয়ে সম্বোধন করে আহ্বান করাই হচ্ছে অন্তিম ও অত্যধিক প্রেম-প্রীতির পদ্ধতি, এগুলো হলো প্রেমিকের সাথে প্রেমাস্পদের গোপন ভেদ। যার উপর কোনো পর্যবেক্ষকের নিয়ন্ত্রণ থাকে না অর্থাৎ যার অর্থ কোনো পর্যবেক্ষকও বুঝতে পারে না। যেমন কবি তার কবিতায় বলেন,
بين المحبين سر ليس يفشيه قول ولا قلم للخلق يحكيه
-দু’প্রেমিকের মধ্যে রয়েছে এমন কিছু গোপনীয় বিষয়, সৃষ্টি জগতের কাছে এমন কোনো কথা বা কলম সৃষ্টি হয়নি যা তা প্রকাশ করতে পারে।
হযরত আবূ বকর (রা.) হতে বর্ণিত, প্রত্যেক কিতাবেই কিছু গোপনীয় বিষয় থাকে, এ হরফগুলো হলো কুরআনের গোপনীয় কথা। হযরত আলী (রা.) বলেন, একথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক কিতাবের মধ্যে হৃদ্যতামূলক কিছু কথা থাকে, এ হরফগুলো হলো, কুরআনের হৃদ্যতার সংকেত১। দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে, কোনো কোনো আরিফ বলে থাকেন, ইলম বা জ্ঞানের উপমা হচ্ছে সাগরের মতো, যে সাগর থেকে প্রবাহিত হয়েছে একটি উপত্যকা, সে উপত্যকা প্রবাহিত হয়েছে একটি নদী, অতঃপর এই নদী থেকে প্রবাহিত হয়েছে একটি নালা। এ নালা থেকে প্রবাহিত হয়েছে ছোট একটি খাল।
একটি উপত্যকা সাগরের সমুদয় পানি ধারণ করতে পারে না, অনুরূপ একটি নদীও উপত্যকার সমুদয় পানি ধারণ করতে পারে না। এজন্য আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
أَنزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَالَتْ أَوْدِيَةٌ بِقَدَرِهَا
-তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর ¯্রােতধারা প্রবাহিত হতে থাকে নিজ নিজ পরিমাণ অনুযায়ী।২
ইলমের সাগর হলো আল্লাহর কাছে, তিনি এ সাগর থেকে তার রাসূলদেরকে উপত্যকাতুল্য দান করেন, রাসূলগণ তাদের ইলমের উপত্যকা থেকে আলিমদেরকে যা দান করেন তা নদীতুল্য। আলিমগণ তাদের ইলমের নদী থেকে সাধারণ মানুষকে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী যা দান করেন তা হলো নালার মতো, আর সাধারণ মানুষগণ তাদের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী যা গ্রহণ করে তা ঐ খালের মতো। এ বিষয়গুলো মূলত হাদীস শরীফ থেকেই চয়নকৃত। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আলিমদের কিছু গোপন বিষয় রয়েছে, খলীফাদের অনুরূপ গোপন বিষয় রয়েছে, নবীগণের গোপন বিষয় রয়েছে, ফিরিশতাদের গোপন বিষয় রয়েছে, আর সমস্ত গোপনীয়তা আল্লাহ তাআলার কাছে রক্ষিত। উলামাদের গোপন তথ্য মূর্খ লোকেরা জানলে তা তারা অবশ্যই প্রকাশ করে দিত। খলীফাগণের গোপন তথ্য আলিমগণ জানলে তাদেরকে তারা গ্রহণ করত না। নবীদের গোপন তথ্য (যা সাধারণ মানুষ বুঝে না) খলীফাগণ জানলে অবশ্যই তাঁরা এর বিরোধিতা করত, নবীগণ ফিরিশতাদের গোপন তথ্য জানলে তাদেরকে দোষারোপ করতেন, ফিরিশতারা আল্লাহ তাআলার গোপনীয়তা সম্পর্কে জানতে পারলে তা নিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং ঘুরতে থাকতেন। এ রকম হওয়ার কারণ হচ্ছে বুদ্ধি ও জ্ঞানের দুর্বলতা। এর কারণ হলো তাদের বুঝের অপরিপক্কতা। এ অপরিপক্কতার জন্য তারা নিগূঢ় তথ্যের গোপন রহস্য বুঝতে পারেন না, যেভাবে বাদুরের চোখ সূর্যের আলো ধারণ করতে পারে না। অনুরূপভাবে কুরআনের এ হরফগুলোর মধ্যে গোপনীয় কিছু মাহাত্ম্য রয়েছে যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়।৩
হযরত শা’বী (র.) বলেন, এসব হরফ বা বর্ণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার একান্ত গোপনীয় বিষয়। কাজেই গোপনীয় বিষয়ে জানার চেষ্টা করো না। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এসকল হরফের অর্থ উপলব্ধি করতে আলিম সমাজ সক্ষম নয়। কোনো কোনো মুফাসসির এ বিচ্ছিন্ন হরফগুলোকে মুতাশাবিহ (অর্থাৎ যার অর্থ অস্পষ্ট ও বুঝা যায় না) বলেছেন।৪
ذٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيْهِ
ذٰلِكَ দূরবর্তী ইসমে ইশারা। যদিও আক্ষরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুরআন নিকটবর্তী, কিন্তু কুরআনের রহস্য আর নিগূঢ় তথ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বুঝা যায় যে, কুরআনের সবই অদৃশ্য আর দূরের। অথবা দূরবর্তী ইসমে ইশারা এজন্য ব্যবহার করা হয়েছে যে, কুরআন লাওহে মাহফুজ হতে অবতীর্ণ হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّهُ فِي أُمِّ الْكِتَابِ لَدَيْنَا لَعَلِيٌّ حَكِيْمٌ
-নিশ্চয় এ কুরআন আমার কাছে সমুন্নত অটল রয়েছে লাওহে মাহফুযে। ৫
ذٰلِكَ ইসমে ইশারারمشار اليه হয়েছেالكتاب । এজন্য ইসমে ইশারাمذكر ব্যবহার হয়েছে। আর এখানে কিতাব দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হয়েছে।
পবিত্র কুরআন শরীফের অনেক নাম রয়েছে। নি¤েœ এগুলো উল্লেখ করা হলো-
১.اُمُّ الْكِتَابِ যেমন- إِنَّهُ فِي أُمِّ الْكِتَابِ -নিশ্চয় ইহা কিতাবের মূল।
২. القران যেমন- بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ বরং এটি হচ্ছে মহিমান্বিত কুরআন।
৩.فرقان যেমন- تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ বরকতময় সেই সত্তা যিনি ফুরকান অবতীর্ণ করেছেন।
৪. تذكرة যেমন- وَإِنَّهُ لَتَذْكِرَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ এটি পরহেযগার লোকদের জন্য নসীহত।
৫.ذكرى যেমন- وَذَكِّرْ فَإِنَّ الذِّكْرَىٰ تَنفَعُ الْمُؤْمِنِينَ আপনি উপদেশ দিন। নিশ্চয় উপদেশ মুমিনদের উপকারে আসে।
৬.ذكر যেমন- وَإِنَّهُ لَذِكْرٌ لَّكَ وَلِقَوْمِكَ অর্থাৎ এ কুরআন তোমার জন্য (মুহাম্মদ ব) আর তোমার কওমের জন্য নসীহত ও উপদেশ স্বরূপ।
৭. تنزيل যেমন- وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ নিশ্চয় ইহা জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অবতীর্ণ।
৮. اَحْسَنُ الْحَدِيْثِ যেমন- اللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ আল্লাহ তাআলা সর্বোত্তম বাণী অবতীর্ণ করেছেন।
৯. موعظة যেমন- قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ তোমাদের পরওয়ারদিগারের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে উপদেশ বাণী এসেছে।
১০. حكم যেমন- وَكَذَٰلِكَ أَنزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا এমনিভাবে আমি তা আরবী ভাষায় বিধানরূপে অবতীর্ণ করেছি।
১১. حِكْمَة যেমন- حِكْمَةٌ بَالِغَةٌ ۖ فَمَا تُغْنِ النُّذُرُ ইহা পরিপূর্ণ জ্ঞান, তবে এ সতর্কবাণী তাদের কোনো উপকারে আসেনি।
১২. حكيم যেমন- تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ ঐগুলো জ্ঞানগর্ভ কিতাবের আয়াত।
১৩. محكم যেমন- فَإِذَا أُنزِلَتْ سُورَةٌ مُّحْكَمَةٌ যখন মুহকাম সূরা অবতীর্ণ হয়।
১৪. شفاء যেমন-وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ -আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত স্বরূপ।
১৫. رحمة যেমন-وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ -আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত স্বরূপ।
১৬. هُدًي যেমন- هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ এ কুরআন মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াতকারী।
১৭. هادي যেমন- إِنَّ هٰذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ এ কুরআন হিদায়াতকারী ঐ সমস্ত লোকদের জন্য যারা প্রতিষ্ঠিত।
১৮. صِرَاطٌ لْمُسْتَقِيْمَ যেমন- وَأَنَّ هٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا এটি আমার সঠিক রাস্তা।
১৯. حبل الله যেমন- وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا তোমরা সকলেই আল্লাহ তাআলার রশি মজবুত করে ধর।
২০. روح যেমন- وَكَذٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا এভাবে আমি তোমার নিকট ওহী পাঠিয়েছি।
২১. قصص যেমন- إِنَّ هٰذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ অবশ্যই এগুলো সত্য কাহিনী।
২২. بَيَانٌ যেমন- هٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ ইহা মানুষের স্পষ্ট বর্ণনা।
২৩.تِبْيَانٌ যেমন- وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি প্রতিটি বিষয়ে বর্ণনা স্বরূপ।
২৪. مُبِينٌ যেমন- تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ ঐগুলো স্পষ্ট কিতাবের আয়াত।
২৫. بَصَائِرُ যেমন- هٰذَا بَصَائِرُ مِن رَّبِّكُمْ এটি তোমাদের পরওয়ারদিগারের পক্ষ থেকে নিদর্শন স্বরূপ।
২৬.فَصْلٌ যেমন- إِنَّهُ لَقَوْلٌ فَصْلٌ নিশ্চয় ইহা পার্থক্যকারী বাণী।
২৭.مَّثَانِيَ যেমন- اللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সম্বলিত কিতাব যা সুসামঞ্জস্য এবং যা পুনরায় তিলাওয়াত করা হয়।
২৮. نِعْمَةِ যেমন- وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ আপনার পরওয়াদিগারের পক্ষ থেকে প্রেরিত নিআমতের আলোচনা করুন।
২৯. بُرْهَانٌ যেমন- قَدْ جَاءَكُم بُرْهَانٌ مِّن رَّبِّكُمْ তোমাদের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট এসেছে দলীল।
৩০. بَشِير যেমন- قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ بَشِيرًا وَنَذِيرًا এ আরবী ভাষায় প্রেরিত কুরআন সুসংবাদ প্রদানকারী এবং ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরিত হয়েছে।
৩১. نَذِير যেমন- قُرْآنًا عَرَبِيًّا لِّقَوْمٍ يَعْلَمُونَ بَشِيرًا وَنَذِيرًا এ আরবী ভাষায় প্রেরিত কুরআন সুসংবাদ প্রদানকারী এবং ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরিত হয়েছে।
৩২. قَيِّم যেমন- قَيِّمًا لِّيُنذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا ইহাকে করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত তাঁর কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য।
৩৩. الْمُهَيْمِنْ যেমন- مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْكِتَابِ وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ এ কিতাব তার পূর্ববর্তী কিতাবে সত্যায়নকারী ও সংরক্ষক।
৩৪.النُّور যেমন- وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنزِلَ مَعَهُ আর তারা অনুসরণ করেছেন সেই নূরের যা তার সাথে অবতীর্ণ হয়েছে।
৩৫. الْحَقُّ যেমন- وَإِنَّهُ لَحَقُّ الْيَقِينِ নিশ্চয় ইহা নিশ্চিত সত্য।
৩৬. عَزِيزٌ যেমন- وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ নিশ্চয় ইহা মহিমান্বিত কুরআন।
৩৭. كَرِيمٌ যেমন- إِنَّهُ لَقُرْآنٌ كَرِيمٌ নিশ্চয় ইহা সম্মানিত কুরআন।
৩৮. الْعَظِيم যেমন- وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ আমি আপনাকে سبع المثانى ও কুরআনে আযীম দান করেছি।
৩৯.مُبَارَكٌ যেমন- كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ এ কিতাব আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি বরকতময় করে।৬
الم প্রথম মুবতাদা ذالك দ্বিতীয় মুবতাদা আর الكتاب হচ্ছে খবর। এর পরের বাক্য প্রথম বাক্যের খবর অথবা الم مبتدا محذوف এর খবর। যা আসলে এরকম الم هذه আর ذالك কিতাবের بدل হয়ে خبر ثاني অথবা الم একটি বাক্য এবং الكتاب অপর আরো একটি বাক্য, আর এর মধ্যখানে কোনো অব্যয় বা حرفব্যবহার করা হয়নি, যার কারণ এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বাক্য প্রথম বাক্যের বয়ান। الريب মাসদার, এটি এসেছে رابني থেকে। অর্থ قلق النفس যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন্দভাবে সন্দেহ করা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ কুরআন যে আল্লাহ তাআলার নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে, এ ব্যাপারে সন্দেহ করা কারো জন্য বাঞ্চনীয় নয়। হ্যাঁ, কেউ যদি সন্দেহ করেও থাকে, তার জন্য বলা হয়েছে, وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ এ কুরআন আল্লাহ তাআলার নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে। এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে এ ধরনের একটি সূরা প্রণয়ন করো দেখি। কাজেই এখানে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই, যদিও কেউ কেউ সন্দেহ করে থাকে।
هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ
هُدًى শব্দটি মাসদার, অর্থ হিদায়াত যা গোমরাহীর বিপরীত এবং মুত্তাকী শব্দটি وقاه فاتقي থেকে اسم فاعل এর সীগাহ। وقايت এমন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অবস্থার নাম, যাতে খুবই কঠোরভাবে নিজেকে সংরক্ষণ করা হয়। المتقي বলা শরীআতের দৃষ্টিতে যা হারাম তা থেকে পরহেযকারীকে। تقوٰى শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো ভীতি আবার কখনো তাকওয়া শব্দ দ্বারা ঈমান বুঝানো হয়। যেমন- أَلْزَمَهُمْ كَلِمَةَ ٱلتَّقْوَىٰ اي التوحيد অর্থাৎ একত্ববাদের উপর বিশ্বাস করা অবশ্যই তোমাদের জন্য জরুরী। আবার কখনো تقوٰي দ্বারা ‘তাওবা’ বুঝায়। যেমন-
الْقُرٰى آمَنُوا وَاتَّقَوْا اى تابوا وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ
অর্থাৎ যদি গ্রামবাসীরা ঈমান আনত আর তাকওয়া ধারণ করত অর্থাৎ তাওবা করত। আবার কখনো গোনাহ ছেড়ে দেওয়াকে বোঝায়। যেমন- وَأْتُوْا الْبُيُوْتَ مِنْ أَبْوَابِهَا ۚ وَاتَّقُوْا اللهَ অর্থাৎ তোমরা ঘরের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো। আবার কখনো ইখলাস (অর্থাৎ বিশুদ্ধতা যেখানে রিয়ার কোনো অবকাশ থাকে না) অর্থ হয়। যেমন অন্যত্র এসেছে فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ اى من اخلاصها আর تقوٰى হচ্ছে মর্যাদাবান হওয়ার শ্রেষ্ঠতম পন্থা। এজন্য আল্লাহ তাআলা বলেন, إِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِيْنَ اتَّقَوا -আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের সাথেই রয়েছেন।
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ আল্লাহ তাআলার কাছে মুত্তাকী লোকই সবচেয়ে বেশি সম্মানী।
وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ তোমার পাথেয় সংগ্রহ করো; তাকওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম পাথেয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ব বলেন, যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে বেশি সম্মানী হতে চায়, সে যেন আল্লাহকে ভয় করে। আর যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে চায়, সে যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে, আর যে ব্যক্তি মানুষদের মধ্যে সব থেকে বেশি ধনী হতে চায় সে যেন তার কাছে যা আছে, এর চেয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে যা আছে তাকে অধিক মজবুত মনে করে।৭
আর হযরত আলী (রা.) বলেন, তাকওয়া হলো ترك الاصرار على المعصية وترك الاغترار بالطاعة বারবার গোনাহ করার অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া। আর প্রতারণা ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা।৮
হযরত ইবরাহীম বিন আদহাম (রা.) বলেন, تقوٰى হলো, (নিজে এমন হওয়া যে) সৃষ্টিজগত তোমার কথার মধ্যে কোনো দোষ পাবে না। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতারা তোমার কাজের মধ্যে কোনো দোষ পাবে না, আরশ বহনকারী ফিরিশতারা তোমার অন্তরের মধ্যে কোনো ত্রুটি খোঁজে পাবে না। হযরত ওয়াকিদী (রা.) বলেন, অন্তরকে সত্য গ্রহণ করার জন্য সজ্জিত করে রাখার নাম হচ্ছে তাকওয়া। ৯
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা রামাদান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করেছেন মানুষের হিদায়াতের জন্য। এ আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে ناس (মানুষ) মুত্তাকীর মধ্যে সীমাবদ্ধ আর মুত্তাকী ছাড়া অন্য যত সব মানুষ আছে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, أُولٰئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ -তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। এখন কথা হচ্ছে, যে ব্যক্তি মুত্তাকী, সে তো হিদায়াতপ্রাপ্ত। তাকে দ্বিতীয়বার কীভাবে হিদায়াত করা যাবে? এর জবাব হচ্ছে মুত্তাকীগণ হিদায়াতের দ্বারা উপকৃত হতে থাকবেন। এজন্য মুত্তাকীন শব্দটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া এ শব্দটি مجاز (রূপক) নয়, এর আভ্যন্তরীণ অর্থ নিতে হবে। বালাগাতের নিয়ম অনুসারে কোনো জিনিসের নাম উল্লেখ করে তার আসল অর্থ না নিয়ে তা যাকে ইঙ্গিত করে, তা নেওয়ার প্রথা রয়েছে। যেমন- من قتل قتيلا فله سلبه অর্থাৎ যেই যাকে হত্যা করবে তার জন্যই নিহতের পরিত্যক্ত সম্পত্তি।
—————————————————————————————————————————————————-
১। তাফসীরে বাগাভী, সূরা বাকারা, ১/৫৮, ২। সূরা বাকারা, আয়াত-১৭, ৩। আত তাফসীরুল কাবীর, ইমাম রাযী, সূরা বাকারা, ৪। প্রাগুক্ত, ৫। সূরা আয যুখরুফ, আয়াত-০৪, ৬। মাফাতিহুল গায়ব, ইমাম রাযী, ২/২৬০-২৬৫, ৭। হিলয়াতুল আউলিয়া, ৩/২৫৩, ৮। তাফসীরে মাফাতিহুল গায়ব, ইমাম রাযী, সূরা বাকারা, ২/২০, ৯। প্রাগুক্ত
[ আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) কৃত ‘আত্ তানভীর’ কিতাব থেকে মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী কর্তৃক অনূদিত ]