ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালার মর্মান্তিক ঘটনায় শাহাদাত বরণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছেন যা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে দুটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
হযরত সালমা (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
دخلتُ على أمِّ سلمةَ، وهي تبكي، فقلتُ: ما يُبْكِيكِ؟ قالت: رأيتُ رسولَ اللهِ ﷺ تَعْنِي في المنامِ وعلى رأسِهِ ولِحْيَتِهِ التُّرابُ، فقلتُ: ما لكَ يا رسولَ اللهِ؟ قال: شَهِدْتُ قَتْلَ الحُسَيْنِ آنِفًا- (سنن الترمذي)
-আমি উম্মু সালামা (রা.) এর ঘরে প্রবেশ করলাম তখন তিনি কাঁদছিলেন, আমি বললাম আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম অর্থাৎ স্বপ্নে দেখলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাথা ও দাঁড়ি মুবারকে মাটি লাগানো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনার কী হয়েছে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, আমি এইমাত্র হুসাইনের শাহাদাত দেখে আসলাম। (তিরমিযী, বাবু মানাকিবু আবি মুহাম্মাদ আল হাসান ওয়াল হুসাইন ইবন আলী রা.)
হযরত ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
رأيتُ النبيَّ ﷺ فيما يرى النائمُ ذاتَ يومٍ بنصفِ النهارِ أشعثُ أغبرُ، بيده قارورةٌ فيها دمٌ، فقلت: بأبي أنت وأمي، ما هذا؟ ! قال: هذا دمُ الحسينِ وأصحابُه، لم أزل ألتقطُه منذ اليومَ- (أخرجه أحمد، والطبراني، والحاكم)
-আমি একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিনের মধ্যভাগে স্বপ্নে দেখলাম এলোমেলো চুল ও ধুলোমলিন দেহ মুবারকে। তাঁর হাতে একটি পাত্র যাতে রক্ত রয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মা বাবা আপনার জন্য কুরবান হোক, ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটা কী? জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা হুসাইন ও তাঁর সাথিদের রক্ত। আমি আজ থেকে এটা কুড়াচ্ছি। (মুসনাদ আহমাদ, আত-তাবরানী ও হাকিম)
বর্তমানে কতিপয় মুসলমান উক্ত ঘটনায় মর্মাহত না হয়ে ইয়াযীদের প্রশংসা ও হুসাইন (রা.) কে দোষারোপের চেষ্টা করেন। তারা মানুষকে সালফে সালিহীনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশ্যে শিয়াদের বিরোধিতার নামে খারিজীদের মতো সালফে সালিহীনের উপর বিভিন্ন ধরনের কটুক্তি করে থাকেন। এ বিষয়ে দেওবন্দী মুনাযিরে আযম আমীন সফদর উকাড়বী ‘ফিতনায়ে ইয়াযীদিয়ত’ শিরোনামে লেখেন, “খারিজিয়ত ও ইয়াযীদিয়তের সবচেয়ে দুঃখজনক প্রচার হচ্ছে যে, এরা হিদায়া গ্রন্থকার আল্লামা মুরগিনানী, আল্লামা সাদ উদ্দীন তাফতাযানী প্রমুখ বুযুর্গগণের প্রতি পেশাদার গাইর মুকাল্লিদীনের চেয়ে আরো বাড়িয়ে আক্রমণ করে থাকে। ইয়াযীদের ফাসিক হওয়ার ব্যাপারে মত প্রকাশ করার কারণে সকল আকাবির ও সালাফদেরকে শিয়াদের প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার অপবাদ দিয়ে থাকে। কিন্তু হযরত আলী (রা.) এর খিলাফতকালকে অস্বীকার করে এটাকে সাময়িক সংঘাত আখ্যাদানকারী, হযরত হাসানাইন (রা.) এর সাহাবী হওয়াকে প্রকাশ্যে অস্বীকারকারী, সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) কে জান্নাতের নারীদের সরদার হওয়া অস্বীকারকারী এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের ঐকমত্যে সহীহ হাদীসসমূহকে ইরানী মজুসী ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে তা অস্বীকারকারী ও আহলুল বাইতের দুশমনদের ব্যাপারে তাদের মুখ ও কলম নীরব।” (খুতবাতে সফদর, খ- ১, পৃষ্ঠা ১৬৭)
শিয়াদের বিরোধিতার নামে খারিজীদের প্রতি ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত থাকার উদ্দেশ্যে ইয়াযীদের আসল রূপ এবং ইমাম হুসাইন (রা.) এর সাথে কৃত ইয়াযীদের অপকর্মের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ইয়াযীদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যদবাণী
হযরত সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لا يَكِيدُ أهْلَ المَدِينَةِ أحَدٌ، إلّا انْماعَ كما يَنْماعُ المِلْحُ في الماءِ
-মদীনাবাসীর সাথে যে ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা করবে সে এমনভাবে গলে যাবে লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়। (বুখারী, বাবু ইসমি মান কাদা আহলাল মাদীনাতি)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) আশিআতুল লুমআত গ্রন্থে লেখেন, (মদীনাবাসীদের সাথে প্রতারণা করার কারণে) হতভাগা ইয়াযীদের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, হাররার ঘটনার পরপরই আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি হিসেবে ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হয়ে সে মারা যায়। (আশিআতুল লুমআত, খ–০২, পৃষ্ঠা-৩৯৫)
একই হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম বদরুদ্দীন আইনী (র.) ‘উমদাতুল কারী’ কিতাবে লেখেছেন, মদীনাবাসীর সাথে দূর্ব্যবহার ইয়াযীদের নির্দেশে মুসলিম বিন উকবা করেছিল। যার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (উমদাতুল কারী, খ–০৮, পৃষ্ঠা-৪৯০)
হযরত উসামা (রা.) থেকে বর্ণিত বুখারী শরীফের অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি টিলার উপর আরোহন করে বললেন, আমি যা দেখছি তোমরা কি তা দেখছ? আমি বৃষ্টির কণার মতো তোমাদের গৃহসমূহের মধ্যে ফিতনার স্থানসমূহ দেখতে পাচ্ছি। (বুখারী, বাবু আতামিল মাদীনাতি)
উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ ও ‘উমদাতুল কারী’ কিতাবদ্বয়ে আছে, এটা নবুওয়াতের আলামতসমূহের মধ্যে একটি আলামত। আর তা হলো ভবিষ্যতে যা হবে তার সংবাদ প্রদান করা। এর সত্যায়ন হয়েছিল হযরত উসমান (রা.) এর নিহত হওয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে। আর পরবর্তীতে এমন ঘটনা চলতেই আছে বিশেষ করে হাররার ঘটনা। (ফাতহুল বারী, খণ্ড-০৪, পৃষ্ঠা-৮১; উমদাতুল কারী, খণ্ড-০৮, পৃষ্ঠা-৪৯১)
ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) উল্লেখ করেন, আবূ ইয়ালা স্বীয় মসনদে দুর্বল সূত্রে হযরত আবূ উবাইদা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি। সর্বদা আমার উম্মতের শাসনভার ন্যায়পরায়ণতার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে যতক্ষন না এটা বনূ উমাইয়ার একজন লোকের দ্বারা ক্রুটিযুক্ত হবে আর তাকে ইয়াযীদ নামে ডাকা হবে। (তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা-১৬৭)
উম্মু সালামা (রা.) এর প্রতিক্রিয়া
উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামা (রা.) আহলুল বাইতের হত্যাকারীদের লানত করেছেন। হযরত শাহর বিন হাওশাব (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতের সংবাদ আসল, তখন হযরত উম্মু সালামা (রা.) কে ইরাকবাসীদের উপর এই বলে লানত দিতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, তারা তাঁকে (হুসাইনকে) হত্যা করেছে। আল্লাহ তাদেরকে হত্যা করুন। তারা তাঁকে ধোঁকা দিয়েছে, ধোঁকার মধ্যে পতিত করেছে। আল্লাহ তাদেরকে লানত প্রদান করুন। (মাজমাউয যাওয়াইদ, খ–০৯, পৃষ্ঠা-১৯৭)
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) এর আশ্রয় প্রার্থনা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) ইয়াযীদের দুষ্কর্ম থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। হাফিয ইবন হাজার আসকালানী (র.) বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ কিতাবে বর্ণনা করেন, হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) তাঁর (বনূ উমাইয়ার পক্ষ থেকে) প্রাণনাশের আশংকায় বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ না করে বলতেন, আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি ৬০ হিজরী থেকে এবং বালকদের শাসন থেকে। তাঁর এ কথার উদ্দেশ্য ছিলো ইয়াযীদ ইবন মুআবিয়ার শাসন, কারণ তা হয়েছিল ৬০ হিজরীতে। আল্লাহ পাক তাঁর দুআ কবূল করেছিলেন। তিনি এর এক বছর আগে ইন্তিকাল করেন। (ফাতহুল বারী, খ–১, পৃষ্ঠা-১৯৩)
উমর বিন আব্দুল আযীয (র.) এর দৃষ্টিভঙ্গি
নওফল বিন আবুল ফুরাত বলেন, আমি একদিন খলীফা হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয (র.) এর কাছে বসা ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি ইয়াযীদের কথা উল্লেখ করল। সে বলল ‘আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদ বিন মুআবিয়া বলেন’। এটা শুনে উমর বিন আব্দুল আযীয (র.) বললেন, তুমি তাকে ‘আমীরুল মুমিনীন’ বলছ? অতপর হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয (র.) এর নির্দেশে এ অপরাধের জন্য তাকে বিশটি বেত্রাঘাত করা হলো। (তারীখুল খুলাফা, পৃষ্ঠা-১৬৭)
হযরত মুআবিয়া বিন ইয়াযীদের ভাষণ
ইয়াযীদের মৃত্যুর পর তার পুত্র মুআবিয়া সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি তার পিতার তুলনায় অধিক ভালো ছিলেন। দ্বীনদারী এবং বিবেকবান উভয় গুণের অধিকারী ছিলেন। যেদিন তার পিতার ইন্তিকাল হয় সেদিনই তার নিকট বাইআত নেওয়া হয়। মুআবিয়া ইবন ইয়াযীদ ৪০ দিন মসনদে ছিলেন। এর পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।
বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম লেখেছেন, যখন তিনি স্বেচ্ছায় মসনদ ত্যাগ করেন, মিম্বারে আরোহন করে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চুপ করে বসে থাকেন। তারপর উত্তমভাবে হামদ ও সানা এবং দুরুদ শরীফ পাঠ করার পর বললেন, হে লোক সকল! রাজত্ব ও খিলাফতের ইচ্ছা আমার নেই। কেননা, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তদুপরি আপনারা আমার প্রতিও সন্তুষ্ট নন।… খিলাফত আমার বাবা ইয়াযীদের নিকট স্থানান্তরিত হলো। তিনিও তার পছন্দ মাফিক তোমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, যেভাবে তার বাবা করেছিলেন। আমার বাবা তার পাপ ও অপব্যয়ের কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের উপর খিলাফতের অনুপযুক্ত ছিলেন। তিনি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করলেন এবং নিজের ভুলকে ভালো মনে করলেন। তিনি আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে যে স্পর্ধা দেখানোর, তা দেখালেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধরদের বিষয়ে আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ কাজকে বৈধ মনে করা তার সীমালঙ্ঘন।
তার সময়কাল সীমিত হলো, তার প্রভাবের অবসান হলো। তার কর্মকা- তার সাথেই রয়েছে এবং তা কবরের গর্তে তার সঙ্গী ও পাপের বোঝায় পরিণত হয়েছে। তার পাপের বোঝা ও তার পরিণাম অবশিষ্ট রইল, তিনি তার অগ্রসর হওয়ার জন্য অনুশোচনা করেছেন (মৃত্যুর পর) কিন্তু সে অনুশোচনা তার কোন উপকারে আসেনি। আমাদের কাজ হলো তার জন্য শোক প্রকাশের বদলে তার (এসব কাজের পরিণতির) জন্য দুশ্চিন্তা করা। হায়! তিনি যা বলতেন আর তাকে যা বলা হতো! তিনি কি তার অসদাচরণের পরিণতি ভোগ করছেন এবং তার কাজের প্রতিদান পাচ্ছেন? এসব আমার ধারণা।
এরপর চোখের জলে তার (মুয়াবিয়া ইবন ইয়াযীদের) দম বন্ধ হয়ে পড়লো, তিনি দীর্ঘক্ষণ উচ্চস্বরে কাঁদলেন, এবং আল্লাহর প্রশংসা করে তারপর বললেন, আমি আমার বংশের তৃতীয় জন (শাসক), আমার উপর সন্তুষ্টদের তুলনায় আমার উপর ক্ষুব্ধদের সংখ্যা বেশি। আমি তোমাদের পাপ বহন করছি না, মহান আল্লাহ যেন আমাকে তোমাদের বোঝার দায়িত্বগ্রহণকারী হিসেবে না দেখেন এবং তোমাদের পরিণতিতে যেন নিক্ষেপ না করেন। তোমাদের বিষয় তোমরাই গ্রহণ করো। আর তোমরা যার উপর সন্তুষ্ট, তাকে নিযুক্ত করো। আমি তোমাদের কাঁধকে আমার বাইআত থেকে মুক্ত করলাম। সালাম। (হায়াতুল হাইওয়ান)
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (র.) এর বক্তব্য
কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (র.) ইয়াযীদ সম্পর্কে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (র.) এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন, “ইবনুল জাওযী লেখেন, কাজী আবূ ইয়ালা তার ‘আল-মু’তামাদ’ কিতাবে সালিহ ইবন আহমাদ ইবন হাম্বল (র.) এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। সালিহ বলেন, আমি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু লোকের ধারণা আমরা ইয়াযীদ ইবন মুআবিয়াকে ভালোবাসি’। ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল (র.) বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে সে ইয়াযীদ ইবন মুআবিয়াকে ভালোবাসতে পারে না। যাকে আল্লাহ তাআলা লানত করেছেন তাকে কেন লানত দেওয়া জায়িয হবে না। আমি বললাম, আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমের কোন স্থানে ইয়াযীদের উপর লানত করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন,
فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِن تَوَلَّيْتُمْ أَن تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ- أُولٰئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمٰى أَبْصَارَهُمْ
-ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন। অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন। (তাফসীরে মাযহারী, সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ২২-২৩)
আল্লামা সাদ উদ্দীন তাফতাযানী (র.) এর বক্তব্য
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের প্রসিদ্ধ আকাঈদের কিতাব শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যাতে আল্লামা সাদ উদ্দীন তাফতাযানী (র.) ইয়াযীদ সম্পর্কে লেখেন,
واتفقوا على جواز اللعن على من قتله أو أمر به أو أجازه أو رضي به- والحقُّ أن رضا يزيد بقتل الحسين رضي الله عنه واستبشاره بذلك وإهانة أهل بيت النبي عليه السلام مما تواتر معناه وإن كانت تفاصيله آحاداً، فنحن لا نتوقف في شأنه بل في إيمانه، لعنة الله عليه وأنصاره أعوانه
-হযরত হুসাইন (রা.) কে যে হত্যা করেছে অথবা হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, অথবা অনুমতি দিয়েছে বা এর উপর সন্তুষ্ট হয়েছে তাদের উপর লানত প্রদান জায়িয হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত। আর প্রকৃত কথা হলো হুসাইন (রা.) এর হত্যার প্রতি ইয়াযীদের সন্তুষ্টি ও এর কারণে খুশি হওয়া এবং আহলুল বাইতকে অপমাণিত করার বিষয়টি অর্থগতভাবে মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদিও এর বিস্তারিত বিবরণ খবরে ওয়াহিদ। আমরা এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করি না বরং তার ঈমানের ব্যাপারেও। তার উপর ও তার সাহায্যকারী সকলের উপর আল্লাহর লানত। (শারহুল আকাইদ আন নাসাফিয়্যা, পৃষ্ঠা-৩৫২)
আল্লামা মাহমুদ আলুসী বাগদাদী (র.) এর বক্তব্য
আল্লামা মাহমুদ আলুসী বাগদাদী ‘রূহুল মাআনী ফি তাফসীরুল কুরআনিল আযীম’ এর মধ্যে ইয়াযীদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পর লেখেছেন, ‘আমার প্রবল ধারণা এই খবীস (ইয়াযীদ) আসলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাতেই বিশ্বাস করত না। আল্লাহর হারাম ও তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হারামের অধিবাসীদের সাথে (অর্থাৎ মক্কা ও মদীনা এর অধিবাসীদের সাথে) সে যা করেছে এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র ও সম্মানিত পরিবারবর্গের সাথে জীবিত ও মৃত অবস্থায় যে আচরণ করেছে এবং পবিত্র কুরআনের পাতা আবর্জনার ভেতর ছুড়ে ফেলাসহ তার থেকে যেসব নির্লজ্জ কার্যকলাপ প্রকাশিত হয়েছে, এগুলো তার ঈমানহীনতার বড় প্রমাণ। আমি এটি মনে করি না যে, তৎকালীন মুসলিম মহান ব্যক্তিদের কাছে তার কর্মকা- অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু তারা পরাভূত ও দমনকৃত অবস্থায় ছিলেন। ধৈর্য ধরা ছাড়া তাদের কিছু করার ছিল না, যাতে যা হবার, আল্লাহ তাই করেন। এটা যদিও মেনে নেয়া হয় যে, এই খবিসটি মুসলমান ছিল, তবে বলতে হবে সে ছিল এমন মুসলমান, যে এত কবীরা গুনাহ করেছে যে তা বলে শেষ করা যায় না। আমি এমন ফাসিককে নির্দিষ্ট করে লানত দেওয়া জায়িয হওয়ার পক্ষে। অবশ্য এমন ফাসিক যে কেউ হতে পারে, তা কল্পনাতেও আসে না। একথা সুষ্পষ্ট যে, সে তাওবা করেনি। তার তাওবার সম্ভাবনা তার ঈমানের সম্ভাবনার চেয়েও ক্ষীণ। তার সাথে ইবন যিয়াদ, ইবন সাদ ও একটি দল রয়েছে। এদের সকলের উপর আল্লাহর লানত। তাদের সাহায্যকারী, সহযোগী এবং যারা তাদের দলভুক্ত ও তাদের প্রতি আকৃষ্ট কিয়ামত পর্যন্ত তাদের উপর আল্লাহর লানত, যতদিন পর্যন্ত একটি চোখ হলেও আবূ আবদিল্লাহ আল হুসাইন (রা.) এর জন্য অশ্রু ঝরাবে। (আল্লামা মাহমুদ আলুসী, রূহুল মাআনী ফি তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, বৈরুত: দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী, তাবি, খ–২৬, পৃষ্ঠা-২৩)
ইবনুল আরাবী আল মালিকী ইয়াযীদের পক্ষে যে উকালতি করেছেন তার জবাবে আল্লামা ইমাম আলুসী বাগদাদী তাফসীরে রূহুল মাআনীতে লেখেছেন-
وأبُو بَكْرِ بْنُ العَرَبِيِّ المالِكِيُّ عَلَيْهِ مِنَ اللَّهِ تَعالى ما يَسْتَحِقُّ أعْظَمَ الفِرْيَةَ فَزَعَمَ أنَّ الحُسَيْنَ قُتِلَ بِسَيْفِ جَدِّهِ صَلّى اللهُ تَعالى عَلَيْهِ وسَلَّمَ ولَهُ مِنَ الجَهَلَةِ مُوافِقُونَ عَلى ذَلِكَ كَبُرَتْ كَلِمَةً تَخْرُجُ مِن أفْواهِهِمْ إنْ يَقُولُونَ إلا كَذِبًا
-আবূ বকর ইবনুল আরাবী আল মালিকী আল্লাহর পক্ষ থেকে তার উপর যা কিছুর উপযুক্ত তাই হোক। তিনি অত্যন্ত মিথ্যা বলেছেন, তার ধারণা হুসাইন (রা.) তার নানার তরবারীতেই নিহত হয়েছেন। তার জাহিলী উক্তি অনেক অনুসারী রয়েছে (কী মারাত্মক মন্দ সে বাক্য যা তাদের মুখ থেকে বের হয়, তারাত সে ব্যাপারে শুধু মিথ্যা বলে)। (আল কুরআন, তাফসীরে রূহুল মাআনী, খ–২৬, পৃষ্ঠা-৬৯)
শাহ ওলীউল্লাহ (র.) এর বক্তব্য
নজদী ওয়াহাবীদের দ্বারা প্রভাবিত কিছু সংখ্যক আলিম ইয়াযীদের ফদীলত র্বণনা করার উদ্যেশ্যে কনস্টান্টিনোপলের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভবিষ্যৎ বাণীকে ইয়াযীদের ব্যাপারে প্রযোজ্য বলতে চান। অথচ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ ও ‘উমদাতুল কারী’ এবং শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর ‘শারহু তারাজিমি আবওয়াবিল বুখারী’ কিতাবসমূহে ইয়াযীদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ সুসংবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না বলে মত প্রকাশ করেছেন। শাহ ওয়লীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) লেখেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী (তাঁরা নাজাতপ্রাপ্ত): কিছু লোক এটা দিয়ে ইয়াযীদ এর নাজাতের স্বপক্ষে দলীল দেয়। কারণ ইতিহাস গ্রন্থাদির সাক্ষ্য অনুসারে সে এ দ্বিতীয় দলের অর্ন্তভুক্ত ছিল। এমনকি সে তাদের নেতা ও সেনাপতি ছিল। আসলে এ হাদীস দ্বারা যুদ্ধের আগে করা তার অপরাধগুলো ছাড়া অন্য কিছু মাফ হওয়া সাব্যস্ত হয় না। কারণ জিহাদ কাফফারার অর্ন্তভুক্ত। আর কাফফারার রীতি হলো পূর্বের গুনাহ দূর করা, ভবিষ্যতে ঘটিতব্য বিষয়গুলো নয়। হ্যাঁ, যদি হাদীসে এমন বলা হতো যে, সে কিয়ামত পর্যন্ত ক্ষমাপ্রাপ্ত, তাহলে তার নাজাত বুঝা যেত। তা তো কখনো বলা হয়নি। তাই এ যুদ্ধের পর হযরত হুসাইন (রা.) কে হত্যা, মদীনা ধ্বংস করা, মদ পানের সাথে লেগে থাকা ইত্যাদি যেসব কাজ ইয়াযীদ করেছে, সেসব আল্লাহর কাছে ন্যস্ত থাকবে। অন্যান্য পাপীদের ব্যাপারে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তিনি চাইলে তাকে ক্ষমা করবেন অথবা চাইলে শাস্তি দিবেন। এর পরও পবিত্র আহলুল বাইতের অবমাননাকারী, হারামে সীমালঙ্গনকারী, সুন্নাতে পরির্বতনকারী সম্পর্কে বর্ণিত হাদীস উপরোক্ত সাধারণ বক্তব্যকে খাস করার জন্য তো রয়েছেই। (শারহু তারাজিমি আবওয়াবিল বুখারী, পৃষ্ঠা: ৩১-৩২)
ইয়াযীদকে তাবিঈ বলা যাবে না
পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা তাবিঈদের যে আলোচনা করেছেন তা থেকে বুঝা যায়, তাবিঈ হওয়ার জন্য একটি শর্ত রয়েছে। ইয়াযীদের মধ্যে যেহেতু এ শর্ত নেই এ কারণে সে তাবিঈ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ
-মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করেছেন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। (সূরা তাওবাহ, আয়াত-১০০)
এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম আলুসি বাগদাদী তাঁর তাফসীরে রূহুল মাআনীতে একটি উদ্ধৃতি পেশ করেছেন, -‘হুমাইদ ইবন যিয়াদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন মুহাম্মাদ ইবন কাব আল কুরাযীকে জিজ্ঞাসা করলাম, সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে যেসকল দ্বন্দ্ব সংঘাত হয়েছিল এ স¤পর্কে আপনি কি কিছু বলবেন? তিনি আমাকে বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে তাঁদের সকলকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, এবং তাদের থেকে ভালো কাজ বা এর বিপরীত যাই সংঘটিত হোক না কেন, তাদের জন্য বেহেশত ওয়াজিব করে দিয়েছেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কুরআনের কোন জায়গায় আল্লাহ তাদের জন্য বেহেশত ওয়াজিব হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন? মুহাম্মাদ ইবন কাব আল কুরাযী বলেন, সুবহানাল্লাহ, তুমি কি কুরআনের আয়াত وَالسّٰبِقُونَ الْأَوَّلُونَ পড়নি? যদি পড়তে তবে জানতে পারতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সকল সাহাবীর জন্য বেহেশত ওয়াজিব করেছেন এবং তিনি তাঁদের উপর সন্তুষ্ট। আর তাবিঈদের ব্যাপারে শর্তারোপ করেছেন। আমি বললাম শর্তটা কী? তিনি বলেন, শর্ত হলো ইহসানসহ সাহাবীদের অনুসরণ করা। আর ইহসান হলো তাদের ভালো কাজের অনুসরণ করা এবং এর বিপরীত কাজের অনুসরণ না করা, অথবা ইহসানের অর্থ এটাও হতে পারে তাঁদের প্রতি সুধারণা রেখে তাঁদের অনুসরণ করা, তাদের প্রতি কটুক্তি না করা এবং তাঁদের কৃতকর্মের কারণে তাঁদেরকে দোষারোপ না করা।’ (তাফসীরে রূহুল মাআনী)
উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে কাযী সানাউল্লাহ পানিপথি (র.)ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
উক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা গেল, সাহাবী হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ঈমানের সাথে দেখাই যথেষ্ট, কিন্তু তাবিঈ হওয়ার জন্য একটি অতিরিক্ত শর্ত রয়েছে, আর তা হলো সাহাবীদের সকল ভালো কাজের অনুসরণ করা আবশ্যক। সাহাবীদের সম্পর্কে কোনো মন্দ ধারণা না রাখা এবং তাদের সমালোচনা না করা। ইয়াযীদ যদিও তাবিঈদের যুগের ছিলো কিন্তু তাবিঈ হওয়ার জন্য যে সকল শর্ত আবশ্যক তার মধ্যে এ সকল গুণের বিপরীত পাওয়া যায়। তাই ইয়াযীদকে তাবিঈ বলা যাবে না।
মদীনাবাসীদের সাথে ইয়াযীদের দুর্ব্যবহার
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত হুসাইন (রা.) এবং আহলুল বাইতের অন্যান্য সদস্যদের কারবালার প্রান্তরে ইয়াযীদ বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদের নির্দেশনায় এ হত্যাকা- ঘটানো হয়। আহলুল বাইতের হত্যাকারীদেরকে ইয়াযীদ পুরস্কৃতও করে। তার সরাসরি নির্দেশনায় অসংখ্য সাহাবী ও তাবিঈকে হত্যা করা হয়। ইয়াযীদের ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো ইয়াযীদ লানতের উপযুক্ত। উলামায়ে কিরামের অনেকেই তাকে কাফির মনে করে থাকেন।
ইয়াযীদের পাপাচারের নযীরবিহীন কথা ইতিহাসের কিতাবসমূহে বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাই ইয়াযীদ অভিশপ্ত হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাছাড়া হাররার ঘটনার সময় ইয়াযীদ কর্তৃক মদীনা আক্রমণ, মদীনার অধিবাসীদেরকে তথা সাহাবায়ে কিরাম, তাবিঈদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেওয়া, মদীনাবাসীদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার করাসহ যাবতীয় অবৈধ কর্মকা-ের জন্য মদীনাকে হালাল ঘোষণা করা-ই ইয়াযীদ অভিশপ্ত প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া যে ব্যক্তি মদীনাকে অপকর্মের জন্য বৈধ মনে করে, অন্যকে অপকর্ম করার সুযোগ দেয় সে কাফির হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মদীনাবাসীদের সাথে দূর্ব্যবহারকারীদের সর্তক করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুশিয়ারী বাণী উচ্চারণ করেছেন। ইমাম বুখারী (র.) তার সহীহ বুখারীতে ‘মদীনাবাসীদের সাথে প্রতারণাকারীর পাপ’ শিরোনামে একটি হাদীস উল্লেখ করেন। হযরত সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لا يَكِيدُ أهْلَ المَدِينَةِ أحَدٌ، إلّا انْماعَ كما يَنْماعُ المِلْحُ في الماءِ
-মদীনাবাসীর সাথে যে ষড়যন্ত্র বা প্রতারণা করবে সে এমনভাবে গলে যাবে লবণ যেভাবে পানিতে গলে যায়। (বুখারী, বাবু ইসমি মান কাদা আহলাল মাদীনাতি)
মুসলিম শরীফেও অনুরূপ মর্মের হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হযরত সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
وَلا يُرِيدُ أحَدٌ أهْلَ المَدِينَةِ بسُوءٍ إلّا أذابَهُ اللهُ في النّارِ ذَوْبَ الرَّصاصِ، أوْ ذَوْبَ المِلْحِ في الماءِ
-কেউ যদি মদীনাবাসীর মন্দ কামনা করে আল্লাহ তাআলা তাকে সেভাবে গলিয়ে দিবেন, যেভাবে আগুন সীসাকে অথবা পানি লবণকে গলিয়ে দেয়। (মুসলিম, বাবু ফাদলিল মাদীনাতি ওয়া দুআইন নাবিয়্যি ব)
মদীনা শরীফের ইয্যত-হুরমত বিনষ্টকারীর প্রতিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর শাস্তির কথা বলেছেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাররার ঘটনার সময় ইয়াযীদের বাহিনী মদীনা শরীফে ত্রাসের রাজত্ব কায়িম করেছিল, মদীনাবাসীদের উপর অমানবিক নির্যাতন করেছিল, নারীদের ইয্যত লুণ্ঠন করেছিল, তিন দিন মসজিদে নববীতে আযান-ইকামত ও নামাযের জামাআত হয়নি। তার নির্যাতন থেকে তখন রেহাই পাননি অসংখ্য সাহাবী এবং তাবিঈ। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন)
ইমাম হুসাইন (রা.) এর শাহাদাতে ইয়াযীদের প্রতিক্রিয়া
ইমাম হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত পরবর্তী সময়ে ইয়াযীদ বাহ্যিক অসন্তুষ্টি প্রদর্শন করে যা প্রকৃতপক্ষে মুনাফিকী ছিলো। আল্লামা ইবন কাসীর (র.) লেখেন, ইবন যিয়াদের এহেন কাজে ইয়াযীদ তাকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে তিরস্কার করল এবং বকাঝকা করল, কিন্তু এ জঘন্য কাজের জন্য ইবন যিয়াদকে পদচ্যুতও করল না এবং কোনো শাস্তিও দিল না। এমনকি কারো মাধ্যমেও এহেন নির্লজ্জ কাজের কথা স্মরণ করে দেয়নি। (আল্লাহই অধিক জানেন) সুতরাং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য উচিত হুসাইন (রা.) এর হত্যাকা-ে দুঃখিত হওয়া, কারণ তিনি ছিলেন মুসলমানদের সরদার, সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে আলিম। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শ্রেষ্ঠ কন্যার অত্যন্ত আদরের সন্তান। হুসাইন (রা.) ছিলেন ইবাদতকারী, বীর পুরুষ ও দাতা।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮ম খ-)
ইয়াযীদের চূড়ান্ত ধৃষ্টতা
হাফিয ইমাদুদ্দীন ইবন কাসীর (র.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া’ কিতাবে উল্লেখ করেন, হযরত মুজাহিদ (র.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন হুসাইন (রা.) এর মাথা মুবারক এনে ইয়াযীদের সামনে রাখা হলো তখন ইয়াযীদ নি¤েœাক্ত কবিতা আবৃত্তি করেছিল:
ليت أشياخي ببدر شهدوا
جزع الخزرج في وقع الاسل
قد قتلنا الضعف من أشرافكم
وعدلنا ميل بدرفاعتدل
-হায়! বদর যুদ্ধে বনু খাযরাজের বর্শার আঘাতে আমার যে সকল শাইখ চিৎকার করে নিহত হয়েছিল তারা যদি দেখত, আমরা তোমাদের সম্মানিত দ্বিগুণ লোকদের হত্যা করে বদরের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছি।
মুজাহিদ (র.) বলেন, আল্লাহর কসম! এ ক্ষেত্রে সে (ইয়াযীদ) মুনাফিকী করেছে। আল্লাহর কসম! তার সৈন্য বাহিনীর সকলেই তার নিন্দা করল এবং তাকে দোষারোপ করল। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খ- ৮, পৃষ্ঠা-১৯২)