ইসলামের সূচনাকাল থেকে ওয়ায মুসলিম সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কখনো আড়ম্বরপূর্ণ মাহফিলে, কখনো একান্ত হালাক্বায়, ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষ্য ও ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে মুসলিম সভ্যতার প্রতিটি পরতে ওয়াযের সুপ্রতিভ উপস্থিতি বিদ্যমান ছিল। ওয়ায শব্দের আভিধানিক অর্থ উপদেশ। প্রচলিত ওয়ায মাহফিলে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক, আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্ব এবং নবী-রাসূল ও পুণ্যবানদের জীবনাদর্শকে হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করা হয়। জনসাধারণের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য এটি সহজতর, সর্বজনবিদিত এবং সুন্নাহ-সমর্থিত পদ্ধতি হিসেবে প্রমাণিত।
উম্মাতের উদ্দেশ্যে ওয়ায করা সমস্ত নবী-রাসূলের সুন্নাহ। তাঁদের দায়িত্বের সূচনা হতো ওয়ায-নসীহতের মাধ্যমে। কেবল তা-ই নয়। বান্দার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম ওয়ায করেছেন খোদ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। কুরআন মাজীদে এমন অসংখ্য আয়াত রয়েছে, যেখানে আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে কোনো কিছু অবহিত করা, বুঝিয়ে বলা অথবা সতর্ক করা অর্থে ‘ওয়ায’ ও ‘বয়ান’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। এমনকি পবিত্র কুরআনের একটি নামই হচ্ছে ওয়ায। আল্লাহ বলেছেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
-হে মানবজাতি, তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে একটি ‘ওয়ায’ এসেছে, যা অন্তরের (রোগসমূহের) জন্য শিফা। এটি হিদায়াত এবং মুমিনদের জন্য রহমত। (সূরা ইউনুস, আয়াত-৫৭)
আমাদের নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহ তাআলা যেসব দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তন্মধ্যে বেশিরভাগই অর্জিত হয়েছে ওয়াযের মাধ্যমে। মানুষের কাছে আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরা, আল্লাহর কিতাব ও শরীআহ শিক্ষা দেওয়া, আখিরাতের প্রতিদান ও শাস্তির ব্যাপারে সতর্ক করার ক্ষেত্রে ওয়ায-নসীহত ও তালীম-তারবিয়াত বড় ভূমিকা পালন করেছে। যদিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গই একজন মানুষের জীবন পরিবর্তনের জন্য যথেষ্ট ছিল, তবুও তিনি সাহাবীদের উদ্দেশ্যে নিয়মিত ওয়ায করতেন। ইসলামী আকীদা ও জীবনদর্শনের যেসব সবক আমরা হাদীসের কিতাবসমূহে পাই, সবই আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা তথা ওয়াযের অংশবিশেষ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ায শুরু করতেন আল্লাহর হামদ ও সানা দিয়ে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূল বক্তব্য শুরু করার পূর্বে ‘খুতবাতুল হাজাহ’ নামে একটি বিশেষ খুতবা পাঠ করতেন। পাঠকের জন্য খুতবাটি তুলে ধরা হলো-
الْحَمْدُ لِلّٰهِ نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ وَنَعُوذُ بِاللهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا مَنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
উল্লেখ্য যে, খুতবাতুল হাজাহ’র শব্দের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বর্ণনার মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। খুতবাতুল হাজাহ পাঠ করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শরীফের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করতেন। এরপর মানুষকে নসীহত করতেন (আবূ দাউদ, হাদীস-১১০১)। এমনিতেও তাঁর বক্তৃতা কুরআনের আয়াতে ভরপুর থাকত। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনকে মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম ওয়ায হিসেবে নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেছেন-
هَٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ
-এটি মানুষের জন্য বয়ান (স্পষ্ট বর্ণনা) এবং মুত্তাকিদের জন্য হিদায়াত ও উপদেশ। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৩৮)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ায ছিল মধ্যম দৈর্ঘের (আবূ দাউদ, ১১০১)। প্রাত্যহিক নসীহতের বেলায় তিনি বক্তৃতা লম্বা করতেন না। তবে মাঝেমধ্যে ইলমী বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ওয়ায করতেন। একবার তিনি ফজরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বয়ান করেছিলেন। মধ্যখানে কেবল নামাযের বিরতি ব্যতীত আর কোনো বিরতি নেননি। সে বায়ানে তিনি সৃষ্টির সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে এবং হবে, সবই জানিয়েছেন (সহীহ মুসলিম, ২৮৯২)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথাগুলো ছিল পরিষ্কার ঝরঝরে। তাড়াহুড়ো করে, অগোছালোভাবে তিনি কথা বলতেন না। কেউ চাইলে তাঁর কথা থেকে প্রতিটি শব্দ গুনতে পারত (সহীহ বুখারী, ৩৫৬৭)। তিনি অধিক ও অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা এবং কাউকে ইঙ্গিত করে নিন্দামন্দ করা থেকে সম্পূর্ণরূপে পাক ছিলেন। কথাকে গুরুত্বারোপ করার জন্য তিনি মাঝে মাঝে কসম করতেন। কথা বলার সময় হাত নাড়াতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিদিন ওয়ায করতেন না। সাহাবীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে নির্দিষ্ট দিনে করতেন, যাতে মানুষের মধ্যে ক্লান্তি না আসে (সহীহ বুখারী, ৬৮)। তিনি শ্রোতার প্রয়োজন, মেধার পর্যায় ও পারিপার্শ্বিকতা ভেদে নসীহত করতেন। তাই দেখা যায়, কোনো বক্তৃতায় তিনি কেবল কুরআনকে আঁকড়ে ধরার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন (তিরমিযী, ২৯০৬), কোথাও কুরআন ও সুন্নাহকে (মুয়াত্তা, ১৮৭৪), আবার কোথাও কুরআন ও আহলুল বাইতকে (সহীহ মুসলিম, ২৪০৮)। দেখা যায়, একই জিজ্ঞাসার বিপরীতে ভিন্ন মানুষকে তিনি ভিন্ন আমলের কথা বলেছেন। কারণ তিনি জানতেন, কার কী প্রয়োজন এবং কে কতটুকু নিতে পারবে। রাসূল e বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব জোর দিয়ে ওয়ায করতেন। (অবস্থাভেদে কখনো) কথা বলার সময় তাঁর চোখ লাল হয়ে যেত, চেহারা মুবারকে রাগ ফুটে উঠত, কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেত। মনে হতো যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদেরকে সতর্ক করছেন (সহীহ মুসলিম, ৮৬৭)। আবার কখনো খুব আবেগময় হৃদয়স্পর্শী ভঙ্গিমায় ওয়ায করতেন, যাতে শ্রোতাদের অন্তর বিগলিত এবং চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যেত (আবু দাউদ, ৪৬০৭)। জান্নাত ও জাহান্নামের কথা এমনভাবে বলতেন, যেন শ্রোতারা তাদের চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন (সহীহ মুসলিম, ২৭৫০)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো মিম্বারের উপর, কখনো মাটিতে বসে বা দাঁড়িয়ে, কখনো উট বা খচ্চরের উপর বসেও ওয়ায করেছেন। মোটকথা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় সুন্নাহের মধ্যে একটি সুন্নাহ হচ্ছে ওয়ায-নসীহত, যা আজও তাঁর উম্মাতের মধ্যে বহুলভাবে প্রচলিত আছে।
যুগ যুগ ধরে আমাদের বাংলাভাষী অঞ্চলে ওয়ায মাহফিল সবচেয়ে লোকপ্রিয় দ্বীনি সমাবেশ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। রাষ্ট্রীয় পরিসরে কিছুটা কম হলেও সামাজিক পরিসরে ওয়াযের বিপুল প্রভাব বিদ্যমান। এ অঞ্চলের নিম্নমধ্য, উচ্চমধ্য ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ওয়ায মাহফিলের দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে দ্বীনি রীতিনীতি যে এখনও বহাল আছে, তার পেছনে ওয়ায মাহফিলের অবদান অনস্বীকার্য। ওয়ায মাহফিল এ অঞ্চলে ধর্মীয় জনমিতি পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়েছে, সামাজিক কুরীতি-কুসংস্কার দূরীকরণের নিয়ামক হয়েছে এবং কিছুটা হলেও আর্থিক অনাচার রোধে সহায়ক হয়েছে। নানাবিধ ফিতনার মধ্যেও বিশুদ্ধ আকীদা ও আমালের প্রতি জনসাধারণকে টেনে আনতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কেবল সীমিত পরিসরে মাদরাসা শিক্ষা এ অঞ্চলের মুসলমানদেরকে এতটা ধর্মপ্রাণ বানাতে পারত না, যদি এর সাথে ওয়ায মাহফিল যুক্ত না হতো। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ওয়ায মাহফিলের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও এর গুণগত মান মোটেও বাড়ছে না। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে বহিঃস্থ (ইসলাম-বিদ্বেষীদের) প্রতিবন্ধকতা এবং অন্তঃস্থ (মুসলমানদের মধ্যকার) ফিতনা। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও যুগের বাস্তবতার নিরিখে সম্মানিত ওয়াইযদের জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা পেশ করতে চাই।
প্রথমত, ওয়ায-নসীহতের মূল ভিত্তি হতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ ওয়ায (কথা) হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হিদায়াত হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত (সহীহ মুসলিম, ৮৬৭)। তাই ওয়ায মাহফিলে সময় কাটানো কিংবা শ্রোতাদের মনোরঞ্জন করার জন্য নিছক বানোয়াট কিচ্ছাকাহিনী সমূলে পরিহার করা একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের হাদীস, আকাঈদ ও ফিকহ শাস্ত্র যে পরিমাণ সতর্কতার সাথে এবং সুসংহত মূলনীতির ভিত্তিতে সংকলিত হয়েছে, সেরকম সতর্কতার সাথে ইতিহাস কিংবা বিষয়ভিত্তিক ব্যক্তিগত কিতাবাদি রচিত হয়নি। তাই ওগুলোতে এমন কিছু কথাবার্তা প্রবিষ্ট হয়েছে, যা ভুল এবং ক্ষেত্রবিশেষে ইসলামের মেজাযের সাথে সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, তাফসীর শাস্ত্রে অনেক ‘ইসরেঈলী রিওয়ায়াত’ রয়েছে, যার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। এটি আমার নয়, বরং ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) এর মত। অতএব তাফসীর বিল-মাসুর তথা যে সব আয়াতের তাফসীর খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা সাহাবীরা করেছেন, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এবং তাফসীর বির-রায় তথা যেসব আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখকের নিজস্ব মতামত প্রবেশ করেছে, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এক নয়। একজন আলিম যখন শরীআতের ব্যাপারে কথা বলেন, তখন বুঝা যায় যে, তিনি কুরআন-সুন্নাহের ভিত্তিতে কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি যখন জাগতিক জ্ঞান তথা বিজ্ঞান, ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল, ইতিহাস, প্রাণীবিদ্যা ইত্যাদি সম্পর্কে কথা বলেন, স্বাভাবিকভাবেই তিনি তাঁর সময়ে উপলব্ধ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই কথা বলবেন। আর এটি জানা কথা যে, কুরআন-সুন্নাহ অকাট্য এবং জাগতিক জ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল। আজ থেকে পাঁচ-সাতশ বছর আগে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা ছিল, আজ এরচেয়ে বহুগুণ স্পষ্ট ধারণা। কারণ দিন দিন নতুন তথ্য উপলব্ধ হচ্ছে। যেমন, অনেকে তাঁদের লিখনিতে পৃথিবীকে ‘স্থির’ বলেছেন। অথচ আজ আমরা জানি যে, পৃথিবী স্থির নয়। মহাকাশে যা কিছু আছে সবই নিজস্ব কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। কেউ বলেছেন, সূর্য পৃথিবী থেকে সাত গুণ বড়। অথচ সূর্য পৃথিবী থেকে তের লক্ষ গুণ বড়। কেউ বলেছেন, আমুদরিয়া ও সারদরিয়া নদীদ্বয় হিন্দুস্থানে অবস্থিত। অথচ ওগুলোর অবস্থান মধ্য এশিয়ায়। চীনের মহাপ্রাচীরকে অনেকে যুলকারনাইনের তৈরি প্রাচীর বলেছেন। অথচ এ দুটি তথ্যই ভুল। আমরা তাঁদের প্রতি দোষারোপ করছি না। বরং এ সত্যটি বুঝাতে চাচ্ছি যে, যে যুগে যে কিতাব লেখা হয়েছে, লেখক সে যুগে উপলব্ধ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই তা লিখেছেন। যেহেতু পবিত্র কুরআন কোনো নির্দিষ্ট যুগের জন্য আসেনি, তাই নির্দিষ্ট যুগের নির্দিষ্ট জ্ঞান দ্বারা কুরআনের সবকিছু নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কুরআনের ইলমের রহস্যরাজি কিয়ামাত পর্যন্ত খুলতে থাকবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
وَلَا يَشْبَعُ مِنْهُ العُلَمَاءُ وَلَا يَخْلَقُ عَلَى كَثْرَةِ الرَّدِّ وَلَا تَنْقَضِي عَجَائِبُهُ
-জ্ঞানীরা কুরআন থেকে (জ্ঞান আহরণ করতে করতে) তৃপ্ত হবে না। বারবার তিলাওয়াত করলেও এটি পুরোনো হবে না এবং এর নিগূঢ় ও বিস্ময়কর রহস্য কখনও শেষ হবে না। (তিরমিযী, হাদীস-২৯০৬)
কুরআন শরীফে পাঁচশটির মতো আয়াত এসেছে শরীআতের নিয়মনীতি সংক্রান্ত। পক্ষান্তরে এক হাজারের মতো আয়াত এসেছে জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনায়। হাজারের বেশি আয়াত এসেছে অতীত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সংবাদ বিষয়ে। তাই একজন মুহাদ্দিস, মুফাসসির বা ফকীহ যখন ইলমে শরীআতের ব্যাপারে কথা বলেন, তখন আমরা শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করব। দ্বীন সম্পর্কে তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অবগত। তবে তাঁরা যখন জাগতিক জ্ঞানের ব্যাপারে কথা বলেন, তখন আমাদেরকে সেটি খতিয়ে দেখা উচিৎ। কারণ সন্দেহের উর্ধ্বে কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যে অকাট্য বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কালামকে গ্রহণ করা হয়, একই রকম বিশ্বাস নিয়ে কারও ব্যক্তিগত রচনা, মতামত বা ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, ওয়াযের মাহফিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানাকিব, মুজিযা, সাহাবায়ে কিরাম ও আউলিয়ায়ে কিরামের মর্যাদা, কারামাত, তাঁদের শিক্ষা ও আদর্শ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রেও কেউ কেউ এমন বানোয়াট বর্ণনা উপস্থাপন করেন যা ক্ষেত্রবিশেষে ঈমান-বিধ্বংসী। মনে রাখা উচিত, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে মান ও মর্যাদা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বয়ান করেছেন, তার চেয়ে বাড়িয়ে বলা কোনো মাখলুকের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার কেউ এর থেকে বিন্দুমাত্র কমাতেও পারবে না। অতএব কুরআন, হাদীস ও সাহাবীদের আকীদা বাদ দিয়ে নিজের মনমতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা প্রণয়ন করতে গেলে সেটি চরম বেয়াদবি বৈ কিছু হবে না। একই কথা মুজিযার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত, আউলিয়ায়ে কিরামের জীবন ও কারামত ইত্যাদি বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আউলিয়ায়ে কিরামের কারামাত সত্য। তাই বলে পুঁথিসাহিত্য থেকে আজগুবি কল্পকাহিনী তুলে এনে বুযুর্গদের নামে চালিয়ে দেওয়ার কোনো মানে নেই। ওগুলোর আধিক্যের কারণে তাঁদের প্রকৃত খিদমাত দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। অথচ যুগে যুগে আল্লাহর ওলীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ কালিমার ছায়াতলে এসেছে। পার্থিবতাকে দূরে ঠেলে তাঁরা সবর-শুকর ও তাওয়াক্কুলের উপর জীবন পার করেছেন। এগুলোই বর্ণনা করা উচিত। আমাদের বাস্তব জীবনকে প্রভাবিত করে আউলিয়া-মুত্তাকিদের জীবনদর্শন, ত্যাগ ও লিল্লাহিয়্যাত।
তৃতীয়ত, ওয়াযের আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজন। বিষয় নির্ধারণ বলতে তিনটি কথা উদ্দেশ্য। যথা-
(১) বক্তাকে বক্তব্যের বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ঈমানের মৌলিক বিষয়সমূহ এবং দৈনন্দিন জীবনের ফরয ও নফল আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ সর্বাগ্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিৎ। একই সাথে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও অনাচারের ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করা এবং নব-নব ফিতনার দলীলভিত্তিক জবাব দেওয়াও ক্ষেত্রবিশেষে অনেক জরুরি। বক্তাকে কেবল সমস্যার সূচিপত্র পাঠ করে গেলেই হবে না। সমস্যা থেকে উত্তরণের উপযুক্ত পথও মানুষকে দিয়ে যাওয়া আবশ্যক।
(২) কোন বক্তাকে কী ধরণের বিষয় দেওয়া হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখা। দুটি উদাহরণ দিলে কথা পরিষ্কার হবে। ওয়ায মাহফিলে ‘নারীর পর্দা’ বিষয়ে প্রায়ই আলোচনা শোনা যায়। অনেক জায়গায় দেখি, কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে লোক হাসাতে পারদর্শী বক্তাকে এ ধরণের বিষয় দেওয়া হয়। অথচ পর্দা ইসলামের ফরয বিধান, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে কুরআন শরীফের সুরা নূর ও সূরা আহযাব থেকে তাত্ত্বিক আলোচনা করার পাশাপাশি উপমা হিসেবে উম্মাহাতুল মুমিনীনের জীবনাদর্শকে তুলে ধরাই যথেষ্ট। অথচ সেদিকে না গিয়ে বক্তা নারীর চলন-বলন নকল করে দেখাতেই ব্যস্ত হয়ে যান। আবার কেউ কেউ, ‘ঈমান’ বিষয়ক আলোচনা শুধু তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলে শেষ করে দেন। অথচ কিছু তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি সাহাবীদের ঈমানদীপ্ত জীবন থেকে দুতিনটি উদাহরণ দিলে মানুষ সহজেই ঈমানের হাকীকত বুঝে নিতে পারে।
(৩) গৎবাঁধা কটি বিষয় নিয়েই যুগের পর যুগ আলোচনা চালিয়ে না যাওয়া। এমন বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যা আমাদের পূর্বসূরীরা দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে সমাধান করে গেছেন। যদি ওসব বিষয়ে সম্পূরক বা অধিক শক্তিশালী আর কোনো দলীল পাওয়া যায়, তাহলে সেগুলো উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেসব বিতর্কিত বিষয় ইতোমধ্যে সমাধান হয়ে গেছে এবং সমাজে এর প্রভাবও নেই। সেগুলোর আলোচনা কম করাই ভালো। বিতর্কিত বিষয়কে পুনরায় সামনে এনে নতুন করে মতানৈক্য তৈরি করার প্রয়োজন নেই। বরং যুগের আলোকে নতুন এবং প্রয়োজনীয় বিষয়কে ওয়াযের মধ্যে শামিল করা যেতে পারে।
চতুর্থত, ওয়ায মাহফিলে বক্তা যখন বক্তৃতা দেবেন, তখন তাঁর নিজের পাণ্ডিত্য নয়, বরং শ্রোতার প্রয়োজন, পর্যায় ও পারিপার্শ্বিকতাকে নযরে রেখে কথা বলা উচিৎ। ইমাম সারাখ্সী (র.) বলেছেন, “যদি ইমাম মুহাম্মাদ ইবন হাসান শাইবানী (র.) ছাত্রদের সামনে তাঁর নিজের মেধা অনুযায়ী কথা বলতেন, তাহলে আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না।” অতএব যা বলবেন, সহজ ও স্বাভাবিকভাবে বলবেন। এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। আমরা আগেই বলেছি, আল্লাহ তাআলা কুরআনকে আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম ওয়ায হিসেবে নাযিল করেছেন, যা সব ধরণের বক্রতা ও অসঙ্গতি থেকে মুক্ত। আল্লাহ বলেছেন,
الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِي أَنزَلَ عَلَىٰ عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجًا
-সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি তাঁর বান্দার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তাতে কোনো বক্রতা রাখেননি। (সূরা কাহাফ, আয়াত-১)
সায়্যিদুনা আলী (রা.) বলেছেন, “মানুষকে সেভাবেই বলো, যেভাবে শুনতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তোমরা কি চাও যে, (তোমাদের কথার দ্বারা) তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ করবে?” (সহীহ বুখারী, হাদীস-১২৭)
অতএব ওয়াইযদের প্রতি সবিনয় পরামর্শ হচ্ছে, ওয়ায-নসীহতের মূল ভিত্তি বানাতে হবে কুরআন ও সুন্নাহকে। সেই সাথে ইসলামের বাস্তবিক নমুনা হিসেবে সমপরিমাণ গুরুত্বের সাথে আসবে রাসূলুল্লাহ e ও সাহাবায়ে কিরামের জীবন। এরপর সালফে সালিহীন, উলামা, আউলিয়া ও মুজাহিদদের জীবনাদর্শ আসবে। তবে সকল আলোচনাই তথ্যভিত্তিক ও সনদ যাচাইপূর্বক হওয়া বাঞ্চনীয়।
আকীদার ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সরল, সঠিক ও সুদৃঢ় আকীদার ওপর স্থির থাকা অত্যাবশ্যক। স্বপ্রণোদিত ধারণাকে কখনও আকীদার মধ্যে শামিল করা উচিৎ নয়। ওয়াযের মাঠে আকীদার আলোচনাকে ঈমানের মৌলিক বিষয়াদি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখাই যথেষ্ট। ইদানিং কিছু বক্তাকে আল্লাহর পবিত্র সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত দুর্বোধ্য এবং অতি সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে জনসাধারণের সামনে আলোচনা করতে শোনা যায়। এটি উপকারী তো নয়ই, উলটো এতে মানুষের ঈমানহারা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের বুঝা উচিৎ যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চতর ইলমী দারস, খানেকার রূহানী তারবিয়াত এবং ওয়ায মাহফিলের বক্তৃতা– এ তিনটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কিছু জটিল ইলমী বিষয় আছে, যা সুবিজ্ঞ আলিম-উলামার সামনে বলা সাজে। কিছু সুক্ষ্ম আধ্যাত্মিক বিষয় আছে, যা আহলে তাসাওউফের সামনে বলা সাজে। এসব কথা সাধারণ ওয়ায মাহফিলে বললে ভয়াবহ ফিতনা সৃষ্টি হবে। তাই শ্রোতাদেরও উচিৎ নয় মাঠে-ময়দানে এমন অপ্রয়োজনীয় জটিল বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করা, যা আদৌ কারও প্রয়োজন নেই। ইমাম আহমাদ (র.) বলতেন, “এমন কিছু জিজ্ঞেস করো না, যার জবাব তুমি বুঝতে পারবে না।” আবার বক্তারও উচিৎ নয় সহজ বিষয়কে পেঁচিয়ে নিজের ইলমের গভীরতা প্রকাশ করা। ইমাম ইবন আকীল (র.) বলেছেন, “এটি মোটেও কাম্য নয় যে, একজন উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন আলিম সাধারণ মানুষের সামনে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলবেন।”
ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার বশবর্তী না হয়ে মুজতাহিদ ইমামদের অনুসরণ করাই নিরাপদ। হাদীস বর্ণনার সময় নির্ভরযোগ্য হাদীসের প্রতি খেয়াল রাখা উচিত। তাফসীর, ইতিহাস এবং কারও ব্যক্তিগত রচনা থেকে তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন ও তুলনামূলক যাচাই বাছাই করা জরুরি। সর্বোপরি ইসলামকে কোনো ‘অতিপ্রাকৃতিক’ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন না করে মানুষের বাস্তব জীবনে আমলযোগ্য সুসংহত দ্বীন তথা জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করা চাই। এতে আমাদের শ্রম সার্থক হবে, ওয়াযের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।