গেলো জুন মাস আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নানা আকস্মিক ঘটনার সাক্ষী হতে হলো বিশ্ববাসীকে। কেউ ভাবেনি ঘটবে, এমন অনেক ঘটনাই বলা চলে একদম আচমকাই ঘটেছে গত মাসে, এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য তথা সারা দুনিয়ার বহু হিসাব-নিকাশও বদলে গেছে। শুরুটা মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলই করেছিল, পৃষ্ঠপোষক মার্কিন প্রেসিডেন্টের আশীর্বাদ নিয়েই। জুন মাসের ১৩ তারিখ ইসরায়েল সরাসরি ইরানে হামলা চালায়। দুই দিন পর ১৫ তারিখ ওমানের রাজধানীতে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপের পরবর্তী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে এমন একটা মুহূর্তে ইসরায়েলের এই আকস্মিক হামলা ইরানকে সংলাপ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। এর আগে ইরান-ইসরায়েলের সীমিত পরিসরের সংঘাতের মাত্রা ছাড়িয়ে এবার উভয় পক্ষ পুরো দমে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১২ দিনের এই রক্ষক্ষয়ী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শেষ হয় ২৪ জুন। পুরো সময়জুড়ে ইসরায়েল প্রধানত দুটো ক্ষেত্রে সাফল্য দেখায়– যুদ্ধবিমান দিয়ে আকাশ হামলা আর ইরানের অভ্যন্তরের মোসাদ এজেন্টদের সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদেরকে হত্যা। অন্যদিকে ইরান আশাতীত সাফল্য দেখায় ইসরায়েলের প্রাণকেন্দ্রে মিসাইল হামলা করে। অবৈধ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি দেশটির গুরুত্বপূর্ণ শহরসমূহে এতো ধ্বংসযজ্ঞ আর কখনো দেখা যায়নি, তাই ইসরায়েলীদের জন্যও এটি ছিল একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। এর আগে হামাসসহ প্রতিরোধযোদ্ধারদের ছোড়া কয়েকটা রকেট তেল-আবীবে আঘাত হানলেও সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল নেহায়েতই নগণ্য, জানমালের ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় ইরানের হামলার সাথে সেগুলো মোটেও তুলনীয় নয়। ১২দিন ধরে চলমান এ যুদ্ধে ইরানের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলেও ইসরায়েলের জন্যে ইরানের আঘাত সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ছিল। অবৈধ রাষ্ট্রটি নাগরিকদের দেশত্যাগ আটকাতে আকাশপথ বন্ধ রাখলেও বেআইনি উপায়ে ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই নৌপথে ইসরায়েল ত্যাগ করেন।
সকল মুশকিল আসান করতে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২২ জুন ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ করে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি মার্কিন হামলার আগেই ইরান তাদের ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামসহ অন্যান্য উপাদান আক্রান্ত স্থাপনাসমূহ থেকে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়, ফলে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর কোন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ইরানের। সরাসরি মার্কিন হামলার পর ইরানের তরফ থেকে পালটা জবাবি হামলা দেওয়া হবে এমনটা প্রত্যাশিতই ছিল, কিন্তু সেটা যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান ঘাঁটি কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমান ঘাঁটিতে হবে, তা অনেকেরই কল্পনার বাইরে ছিল। শেষ পর্যন্ত তাই হলো, ইরান পরদিন রাতে কাতারে অবস্থিত ঘাঁটিতে হামলা করে। হামলায় কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও এটি ছিল অনেক কঠিন পদেক্ষেপ, ইরাক কিংবা সিরিয়ার মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা করা আর কাতারের মাটিতে হামলা করার মধ্যে তফাত অনেক। ইরানকে সে ঝুঁকি নিতে হলেও কাতারের সাথে বোঝাপাড়ার সুবাদে এই ঘটনা আর সংঘাতের আগুনে ঘি ঢালেনি, বরং সে রাত থেকেই যুদ্ধবিরতির আলাপ শুরু হয়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরদিন সকাল থেকে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতি শুরু হয়, কাতার তাদের ভূখণ্ডে হামলার জবাবে পাল্টা আক্রমণ করার অধিকারের কথা জানালেও শেষ পর্যন্ত আক্রমণ না করে উলটো যুদ্ধবিরতি নিশ্চিতের মধ্যস্থতায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
যুদ্ধ শেষ হলেও তার রেশ শেষ হয়নি। যুদ্ধ শেষে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা আবার ইরানে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে চাইলে বেঁকে বসে ইরান। জানিয়ে দেয়, তাদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসমূহের নিরাপত্তা এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার নিঃশর্ত অনুমোদন না দিলে ইরান সরকার আর তাদের সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। উল্লেখ্য ইসরায়েলী হামলার পিছনে এই পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সংস্থার কিছুটা হলেও ভূমিকা ছিল। ইসরায়েলী হামলার পূর্বে এই সংস্থা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দাবি করে ইরান তাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে না; বাস্তবে যদিও তারা পুরো পৃথিবীর সবগুলো দেশে যতটা তদন্ত করে ইরানে তার চেয়ে বেশি তদন্ত করেছে এবং বারবার তদন্ত করে তারাই অনেক আগে থেকে বলে আসছিলো যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী শতভাগ শান্তিপূর্ণ, এমনকি সর্বশেষ প্রতিবেদনেও তারা স্বীকার করেছিল যে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের কোন ধরনের উদ্যোগ ইরানের নেই। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের কোন ধরনের সমালোচনা না পেলেও নিছক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলকে হামলার সুযোগ করে দিতে তারা বায়বীয় ‘‘অসহযোগিতা” কথাটা রিপোর্টে জুড়ে দেয়। আর এই অজুহাত সামনে রেখেই ইসরায়েল শুরু করে তাদের বেআইনি হামলা।
যুদ্ধ শেষে স্বভাবতই ফলাফল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এবারের ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধটি যদিও কোন চূড়ান্ত যুদ্ধ নয়, কেননা দখলদার রাষ্ট্রে পতন কিংবা– আল্লাহ না করুন– মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি রাষ্ট্রীয়-অরাষ্ট্রীয় শক্তির আত্মসমর্পণ, এই দুটির মধ্যে কোন একটি না হওয়া অবধি এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে; সে দিক বিবেচনায় এটি কেবল একটি ফ্রন্টে সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র, তবু এই বিরতি অবধি যে কোন হিসেবে এই ফ্রন্টে নিঃসন্দেহে ইসরায়েলের পরাজয় হয়েছে। ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করার পাশাপাশি মিসাইল নিক্ষেপের ক্ষমতা শেষ করে দেওয়া এবং দেশটির বর্তমান শাসন ব্যবস্থা বদলে দেওয়া। নিজেদেরে পক্ষে এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকেও সরাসরি যুদ্ধে নামিয়েছিল ইরান, তবু তাদের ঘোষিত লক্ষ্যসমূহের কোন একটিও পূরণ হয়নি। উলটো এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতার মিথ একদম ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এর আগে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আল আকসার তুফান ইসরায়েলের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও এবার ইরানের পালটা আক্রমণ সেটাকে একেবারে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে। সরাসরি মার্কিন মদদ ছাড়া অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রটি যে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে টিকে থাকতে মোটেও সক্ষম নয়, এটি এখন দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
অপরদিকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাসমূহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হলেও এর মধ্য দিয়েও ইরান নিজেদের পারমাণবিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি, কয়েক মাস কিংবা সর্বোচ্চ বছর কয়েকের জন্য হয়তো পিছিয়েছে মাত্র। কিন্তু এই যুদ্ধের আগে ইরান প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক নজরদারিতে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি পরিচালনা করলেও যুদ্ধের পর তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক নজরদারি মেনে নিচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বাধুনিক ও সর্বোচ্চ ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বোমা বানাতে ৯০ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হলেও ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম দিয়েও বোমা বানানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে হয়তো বোমার আকার তুলনামূলক বড় হবে, যা বহন করা কঠিন হবে, অথবা ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা তুলনামূলক কম হবে; তবে কার্যকর পারমাণবিক বোমা বানানো যাবে। ইরানের হাতে এই মুহূর্তে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি ইউরেনিয়াম রয়েছে। ফলে নতুন সমৃদ্ধকরণ ছাড়াও ইরান খুব অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি পারমাণবিক বোমা বানাতে পারে, এবং সমরবিদদের ধারণা, ইরান এখন সে পথেই হাঁটার সম্ভাবনা বেশি। আর সে জন্যই ইরান আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কার্যক্রম ইরানের অভ্যন্তরে সীমিত করবে, হয়তো এ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন চুক্তি থেকেও বেরিয়ে আসতে পারে ইরান। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বেআইনি হামলার শিকার হওয়ার পর এরকম পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার ইরানের আছে। নিজেদের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনার নিরাপত্তা যে সকল চুক্তি ও সংস্থা কিংবা আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না, ইরানের সেসকল চুক্তি কিংবা সংস্থার সাথে সম্পর্ক অব্যাহত রাখার কোন যৌক্তিকতাও নেই।
ইরানের উপর এমনিতেও বহু নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে। যুদ্ধ শেষে ট্রাম্পের প্রস্তাব ছিল পরমাণু প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালে নিষেধাজ্ঞা কমানোর পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে ইরানের জব্দকৃত রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। ইরান যৌক্তিক কারণেই সে প্রস্তাব গ্রহণ করবে না, ফলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা হয়তো আরো কঠোর হবে। কিন্তু এর মধ্যেও নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে সম্ভবত ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় (কিংবা সত্যিকার অর্থে প্রথম, দখলদার রাষ্ট্রটি আসলে মধ্যপ্রাচ্যের নয় বরং পশ্চিমা উপনিবেশমাত্র) পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে উঠতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এবারের এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক দেশকেও পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবাবে, বিশেষতঃ ইরান এই সক্ষমতা অর্জন করলে সৌদি, কাতার, আমিরাত এবং তুর্কি এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে ভাবতে বাধ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের তথা পশ্চিমা বিশ্বের সুনির্দিষ্ট অবস্থান হলো– ইসরায়েল ব্যতীত মধ্যপ্রাচ্যে আর কোন পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারবে না, এমনকি পরম মিত্র সৌদি, কাতার কিংবা আমিরাতকেও তারা পারমাণবিক কর্মসূচির অনুমতি দিতে রাজি নয়। কিন্তু ইরানের হাতে অস্ত্র চলে আসলে তখন যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের তৈরি ইরান-ভীতির যুক্তিতেই এসকল দেশের পারমাণবিক প্রয়োজনীয়তা তৈরি হবে। এমনকি এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা না পেলে কোনো কোনো দেশ রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে কোনো কোনো দেশ, তাতে এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
অবশ্য বিশ্লেষকদের ধারণা, এবারের যুদ্ধই পশ্চিমাদের সাথে ইরানের শেষ যুদ্ধ হবে না সম্ভবত। সত্যিকার অর্থে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিলে ইরানকে আবারো যুদ্ধে জড়াতে হতে পারে, এবং সে সম্ভাবনা একেবারে অবাস্তব নয়। ইরানও সে পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই প্রস্তুতি নেবে। ইরানের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা তাদের বিমান বাহিনী এবং আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়া-চীনের সহযোগিতার অভাবে ইরানের হাতে এই মুহূর্তে কোন আধুনিক যুদ্ধবিমান নেই। শাহের আমলের পুরাতন যে সকল যুদ্ধ বিমান আছে, ইসরায়েলের মুকাবিলায় সেগুলো নেহায়েতই খেলনা, যুক্তরাষ্ট্র তো দূরের কথা। ইরান ইসরায়েলের তুলনায় অনেক বড় দেশ হওয়াতে এমনিতেই ইসরায়েলের মতো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব, আর তাছাড়া ইসরায়েলের তুলনায় এক্ষেত্রেও প্রযুক্তিতে ইরান অনেক অনেক পিছিয়ে রয়েছে, যেহেতু এই সকল প্রযুক্তির নিয়ন্তা দেশসমূহের সাথেই ইরানের লড়াই আর সে সকল দেশই ইসরায়েলের রক্ষাকর্তা। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাও যে নিশ্ছিদ্র না, তা এতোদিনে সকলের কাছে স্পষ্ট। তবু সেটা অনেক কার্যকর, অধিকাংশ আক্রমণই আটকাতে সক্ষম, সেখানে ইরানের আকাশ বলতে গেলে শত্রুর হাতে উন্মুক্ত পড়ে আছে, যেখানে খুশি শত্রু খুব সহজেই আক্রমণ করতে সক্ষম হচ্ছে। ইরান এখনই বিমান বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে চীন-রাশিয়ার সহযোগিতা নেবে, চীন-রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য টেকানোর স্বার্থে সহযোগিতা এই পর্যায়ে এসে করতে পারে। অন্যথায় ইরানকে নিজেদের তৈরি মিসাইলের উপরই নির্ভর করতে হবেন আকাশ যুদ্ধের অন্য সব উপায়ের কথা ভুলে। তবে এক্ষেত্রে ইরানের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো তাদের জনগোষ্ঠী। ইরান যেহেতু ইসরায়েলের মতো আমদানি করা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে উঠা কোন অবৈধ রাষ্ট্র নয়, তাদের নিজেদের মাটির সন্তানরা দেশটির নাগরিক, ফলে এসকল মানুষ যে কোন আক্রমণের মুখে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। অন্যদিকে আক্রমণ একটু তীব্র হলেই ইসরায়েলের আমদানি করা জনগোষ্ঠী নিজেদের আদি নিবাসে ফিরে যেতে উদগ্রীব হয়ে উঠে। ফলে ইরানের সাথে পরবর্তী যুদ্ধের আগে তাদের মিসাইল সক্ষমতার বিষয়টি ইসরায়েলকে ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে। এমনকি ইসরায়েল যদি পরবর্তীতে সরাসরি আক্রমণ না করে প্রথমেই যুক্তরাষ্ট্রকেই মাঠে নামতে হয়, তাও ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সবচেয়ে যৌক্তিক লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ইসরায়েলকেই টার্গেট করবে বলে মনে হয়।
সে যাই হোক, এবারের ১২ দিনের এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পরাজয় দেখে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তবে কেন ইসরায়েল এই যুদ্ধে জড়িয়েছিল? প্রথমত, ইসরায়েল ইরানের সহ্যক্ষমতা এবং পালটা আঘাতের ক্ষমতা সম্পর্কে কিছুটা ভুল ধারণা করেছিল। তাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ গোয়েন্দা তথ্য থাকলেও তাদের ধারণা ছিল নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষা বেশির ভাগ ইরানী মিসাইল আটকাতে পারবে, যেহেতু ইরান অনেক দূরে অবস্থিত। তাদের আরো ধারণা ছিল, ইরান ইসরায়েলী হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে হাতে পায়ে ধরে আত্মসমর্পণ করে বসবে। তদুপরি মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রক্সিদের মধ্যে সিরিয়ার আসাদের পতন হয়েছে, লেবাননের হিযবুল্লাহ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, সব মিলিয়ে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে দূর্বল অবস্থায় রয়েছে বলেই মনে হচ্ছিল। সেই ধারণা থেকেই ইসরায়েল লাফালাফি শুরু করেছিল, এমনকি ট্রাম্প ঘোষণাও দিয়েছিলেন যে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া ইরানের জন্য আর কোন পথ খোলা নেই। শেষ পর্যন্ত এমনটা তো হলোই না, উলটো শেষ দিকে ইরানের আগে ইসরায়েলের তরফ থেকেই যুদ্ধবিরতির কথা শুরু হয়ে যায়। এখন যুদ্ধ শেষেও ইরানের শর্তেই চুক্তি করতে হবে কিংবা ইরানকে পারমাণবিক সক্ষমতার দিকে এগিয়ে যেতে দিতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
অবশ্য অনেক বিশ্লেষকদের ধারণা— পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞামুক্ত ইরানের চেয়ে পারমাণবিক অস্ত্রধর নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান জায়নবাদীদের নিকট অধিক কাম্য। কারণ পারমাণবিক অস্ত্র চাইলেই ব্যবহার করা যাবে না, কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র না বানানোর শর্তে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হয়ে উঠলে ইরান আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই ওবামা প্রশাসনের সাথে ইরানের যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানাবে না এ নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার ক্ষমতায় এসে সে চুক্তি বাতিল করেছিলেন। সেই চুক্তি বাতিলের পরেই ইরান ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে, যা কিনা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা এনে দিয়েছে বলা চলে। এবার একরম আরেকটি চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হলে ইসরায়েল ইরানে হামলা করে সে সম্ভাবনাকেও ভেস্তে দিয়েছে।
ইসরায়েল কোন দিনই একটি স্বাভাবিক রাষ্ট্রের ভূমিকায় ছিলো না এ কথা সত্য, তবে এখন যে মাত্রায় পাগলামো করছে, তার সূচনাটা হয়েছে আল আকসার তুফানে মার খাওয়ার পর থেকে। এমনকি ইরানের সাথে এই সংঘর্ষের পিছনেও সেই তুফানের পরোক্ষ ভূমিকার কথা অস্বীকার করার সুযোগ কম। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গাযায় চলমান বর্বরতার সমাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে কী? ইরানের সাথে সংঘাতের আগে থেকেই, এবং সংঘাত চলাকালে কিংবা সংঘাত শেষে– প্রতিনিয়ত গাযাবাসী বর্বরতম নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন। ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে শহীদ হচ্ছেন শত শত নিরীহ মানুষ। তবু প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিঃশেষ করতে পারেনি ইসরায়েল, এখনো তাদের প্রতিরোধ অব্যাহত। সর্বশেষ জুন মাসের শেষ সপ্তাহে একটি সৈন্যবাহী ট্যাংকে আগুন ধরিয়ে প্রতিরোধযোদ্ধারা অন্তত সাত জন দখলদার যোদ্ধার মৃত্যু নিশ্চিত করতে সক্ষম হন, যা ইসরায়েলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইরানে পরাজয় সত্ত্বেও ইরান যুদ্ধ নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু গাযায় যুদ্ধ শেষ না করতে পারলে এ জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে ইসরায়েলের জন্য কোনভাবে গাযা থেকে বের হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে অনেকের মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও গাযা যুদ্ধ শেষ করার চাপ রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরানের সাথে যুদ্ধবিরতির পর এবার গাযায়ও আরেক বার যুদ্ধবিরতির আশা দেখা দিচ্ছে। যদিও ইসরায়েল বরাবরই এসব ক্ষেত্রে চরম অবিশ্বস্ত। তারপরও ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে, হয়তো এবার গাযায় বর্বরতা থামার সুযোগ তৈরি হলেও হতে পারে। তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নাই যে এই সকল যুদ্ধের চূড়ান্ত সমাপ্তি হবে সেদিন, যেদিন এই দখলদার রাষ্ট্রের পুরো কাঠামো সমূলে ভেঙে পড়বে। ততদিন প্রতিরোধযোদ্ধাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তবু ইসরায়েলের অজেয় ভাবমূর্তি যেভাবে ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে, তাতে সেই চূড়ান্ত যুদ্ধ সমাপ্তির দিনও ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে বলে মনে হয়। সেদিনের অপেক্ষায় মানবেতর দিন কাটাচ্ছে লাখো অসহায় গাযাবাসী, নিশ্চয়ই তারা সে দিনের দেখা পাবে, অচিরেই।