1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
উত্তরাধুনিক সভ্যতার যুগে মহানবীর জীবনাদর্শ অধ্যয়নের আবশ্যিকতা
মুহাম্মাদ বিন নূর
  • ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল যুগের মানুষের হিদায়াতের দিশারী হয়ে পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছিলেন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর সে কারণেই তাঁর পবিত্র সীরাত প্রতিটি যুগে একই রকম প্রাসঙ্গিক, কখনোই সে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কোন ধরনের যৌক্তিক সংশয় দেখা দেয়নি। আমাদের এই উত্তরাধুনিক যামানার নতুন নতুন সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রেও আমরা তাই নবীজির সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনাদর্শে খোঁজে পাই অমূল্য দিকনির্দেশনা।

বিখ্যাত পোলিশ দার্শনিক জিমুন্ত বাউমেন উত্তরাধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ‘লিকুইড মডার্নিটি’কে, কেননা তরল পদার্থের যেমন নির্দিষ্ট কোন আকার নেই, উত্তরাধুনিক সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যই হলো এ যুগের মানুষ কোন পরম সত্য কিংবা পবিত্র বস্তু বা আদর্শের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। আদর্শিক দৃঢ়তা এ যুগে বিলুপ্তপ্রায়, শক্তিশালী সামাজিক বা নৈতিক মানদণ্ডের কোন অস্তিত্ব নেই এই উত্তরাধুনিক সভ্যতায়। উত্তরাধুনিকতার এই আদর্শিক শিথিলতার ফলে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের অস্থিরতার, আধুনিকতার খপ্পরে পড়ে মুসলিম সমাজেও এই কথিত লিকুইড মডার্নিটির প্রভাব পড়ছে, নৈতিক মানদণ্ড ভুলে সমাজের নৈতিক-অনৈতিক সবকিছুকে একই দৃষ্টিতে বিচার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে মানবপ্রকৃতি বিরুদ্ধ বিভিন্ন বিষয়ও এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা বা অন্ততপক্ষে ছাড় পাচ্ছে, যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে ঐ লোকের এই কাজ যেহেতু সরাসরি আমাকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে না, অতএব তার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না, তাকে তার মতো চলতে দিতে হবে।

এই নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যক্তি স্বাধীনতা আর লিকুইড মডার্নিটির যুগে একজন মুসলিমের প্রকৃত পথপ্রদর্শক হতে পারে সীরাতে নববী, আমরা মহানবীর জীবনাদর্শে খোঁজে পেতে পারি আমাদের পথের দিশা। ন্যায়বিচার, সহানুভূতি এবং সততার উপর তিনি যেভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন, তার বিপরীতে আধুনিক কথিত নৈতিক মানদণ্ডের দূর্বলতা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। উত্তরাধুনিক মননে ব্যক্তি ও সমাজের নৈতিকতা নিয়ে যে দ্বিধা দেখা দিতে পারে, নবীজির সীরাত অধ্যয়ন সে দ্বিধা থেকে মুক্তির পথ দেখায়।

আমাদের সময়ে একদিকে যেমন ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলা হয়, অন্যদিকে তার আড়ালে চলে ব্যক্তিকে বস্তু হিসেবে কিংবা আরো স্পষ্ট করে বললে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করার মতো ঘৃণ্য চর্চা। মানুষ এই ভোগবাদী সভ্যতার চোখে কেবলই পণ্য, ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সেই পণ্যকে পুঁজিপতিদের জন্য আরো লাভজনক করে তোলার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট। এর বিপরীতে নবীজির জীবনাদর্শ অনুসরণ করলে আমরা জানতে পারি মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং মানব সত্তার পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যের কথা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি মানুষের সাথে মোয়ামালার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে তার উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে রেখে গেছেন। একেবারে প্রান্তিক মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের সর্বোচ্চ মানুষটি পর্যন্ত প্রত্যেকের যে মানবিক মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে, মানুষ যে কেবল বস্তু কিংবা পণ্য নয়, অবজেক্টিফিকেশনের এই যুগে মানুষের সাথে মানুষের পারস্পরিক আচরণের ক্ষেত্রে নবীজির জীবন থেকে প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সীরাত অধ্যয়ন করলে অজস্র ঘটনা আমরা দেখতে পাই যা আমাদেরকে ব্যক্তির মর্যাদা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা প্রদান করে।

উত্তরাধুনিক সভ্যতার আরেকটি অস্তিত্বের সংকট হচ্ছে নৈতিক নেতৃত্বের সংকট। এ সভ্যতা যেহেতু বস্তুবাদী সভ্যতা, আধ্যাত্মিকতা যেহেতু এখানে অনুপস্থিত কিংবা সমাজের জন্য অগুরুত্বপূর্ণ নিছক ব্যক্তিগত বিষয়, তাই নৈতিক নেতৃত্ব এ সভ্যতায় দুর্লভ। এ সভ্যতায় সমাজবিজ্ঞানীরা স্বীকার্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন দুর্নীতি থাকবেই, যথাসম্ভব এটিকে কমিয়ে আনতে হবে, শাসক এবং শাসিতের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এ সভ্যতায় প্রায় অসম্ভব বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে নবীজির জীবনাদর্শ এবং তার পরবর্তী খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনাদর্শ আমাদের জন্য একেবারে ভিন্ন নজির, নেতৃত্বের সর্বোচ্চ শিখরে ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার উর্ধ্বে ‍নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব ঠিক কীরূপ হতে পারে; জবাবদিহিতা, স্বার্থহীনতা এবং নৈতিকতার বিচারে নেতৃত্বের রূপ কেমন হওয়া উচিত তার জন্য উত্তরাধুনিক সভ্যতার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রেখে যাওয়া জীবনাদর্শ অবশ্য অনুসরণীয় এবং শিক্ষণীয়।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক উত্তরাধুনিক সভ্যতায় সামাজিক বন্ধন ও মূল্যবোধের অবক্ষয় চরম আকার ধারণ করেছে। একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজে সামাজিক বন্ধনের ধরন কী হবে, সমাজের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব ও অধিকার কী হবে, সেটি কীভাবে নিশ্চিত করতে হবে, এ সকল বিষয়ে উত্তরাধুনিক সভ্যতার ধারণা কেবল অস্পষ্টই নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে সেটি অসম্পূর্ণও বটে। সামাজিক সম্পর্কের বহু প্রশ্নে এ সভ্যতা নিরুত্তর, কেবল ব্যক্তির স্বাধীনতা আর ভোগবাদের দিকেই সকল গুরুত্ব। এর বিপরীতে একজন মুসলিমের জন্য স্পষ্ট, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সামাজিক বন্ধন ও মূল্যবোধের নির্দেশনা পাওয়া যায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনাদর্শের মধ্যে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা ও বৃহত্তর স্বার্থে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মূল্যবোধের যে শিক্ষা মহানবীর জীবনাদর্শে আমরা পাই, এর অনুপস্থিতিতে মানুষ শুধু ইসলাম থেকেই বিচ্যূত হচ্ছে না, বরং মানব সভ্যতাই অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে।

সর্বোপরি উত্তরাধুনিকতার এই অস্থির সময়ে সুস্থ, স্বাভাবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গঠনে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনাদর্শ অধ্যয়ন ও তাঁর শিক্ষার বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এই যুগের সকল দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক প্রশ্নের সমাধান পেতে সীরাতের শিক্ষার দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া মানবজাতির সামনে আর কোন পথ নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনাদর্শকে এড়িয়ে আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে মুসলিম সমাজে যে অস্থিতিশীলতা ও অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধানের জন্য আমাদেরকে নবীজীবনের শিক্ষায় ফিরে যেতে হবে। এমনকি অমুসলিমদের মধ্যেও যে সামাজিক বন্ধনহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে, যার ফলে মানব সমাজের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিচ্ছে তার সমাধানের জন্যও ধর্মনির্বিশেষে মানবসমাজকে অনুসরণ করতে হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান জীবনাদর্শকে। আসুন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনী মাস রবীউল আউয়ালেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান জীবনাদর্শ চর্চায় দৃঢ় প্রতয়ী হই।

ফেইসবুকে আমরা...