প্রকাশকাল- নভেম্বর, ২০২১
দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম বিশ্বে একক প্রভাব ও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল সৌদি আরব। কিন্তু এখন সৌদির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এগিয়ে আসছে তুরস্ক ও দেশটির নেতা প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে যেখানেই সংকট সেখানেই উচ্চ কণ্ঠে সোচ্চার তুরস্ক এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। হালফিল আফগানিস্তান পরিস্থিতি থেকে শুরু করে ফিলিস্তিন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট, চীনের উইঘুর সংকট এবং ভারতের কাশ্মীরের মুসলিমদের নিয়ে বলতে গেলে একমাত্র উচ্চকন্ঠ তুরস্ক। আর এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ভূমিকা একেবারেই নিরব দর্শক।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সবসময়ই সুদৃঢ় অবস্থান তুরস্কের। ইসরায়েল ‘অসলো শান্তি চুক্তি’ লঙ্ঘন করে স্বাধীন ফিলস্তিন রাষ্ট্রের অবস্থান থেকে শুধু সরেই আসেনি, ফিলিস্তিনি জনগণের শান্তিতে বসবাস এবং শান্তিতে কাজ করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে ইসরায়েল শুধু ওই অঞ্চলের ভবিষ্যতকেই বিপন্ন করে তোলেনি, পুরো বিশ্বকেই আজ বিপন্ন করে তুলেছে। আজ ইসলামী বিশ্বের এই সংকটকালে সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে ঐক্য এ সংহতি। যতদিন মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ থাকবে, ততদিন সব সমস্যার সমাধানও হবে। আজকে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ রাখাটাই বড় সংকট।
আজ মুসলিম বিশ্ব নিজেরাই অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বিভেদ ও হানাহানিতে লিপ্ত। এক মুসলিম দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সংঘাত বেড়েই চলেছে। বেড়ে চলেছে রক্তপাত। চলমান আফগান ইস্যুতেও মুসলিম বিশ্ব এক হতে পারছে না। তুরস্ক, পাকিস্তান, ইরান আফগানিস্তানের নতুন তালেবান সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও অন্যান্য মুসলিম দেশ এ থেকে পিছিয়ে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মুসলমান ও মুসলিম বিশ্ব। এমনকি আফগানিস্তানের তালেবান ইস্যুতে মুসলিম বিশ্বের জোট ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার (ওআইসি) ভূমিকাও খুব একটা ইতিবাচক নয়। আফগানিস্তান ছাড়াও নিরন্তর রক্ত ঝরে চলেছে ইয়েমেনে। সাত বছরের গৃহযুদ্ধ ও সৌদি জোটের বিমান হামলায় ইয়েমেন আজ ক্ষত–বিক্ষত। কিন্তু ইয়েমেন সংকট নিরসনেও মুসলিম বিশ্বের যৌথ উদ্যোগ কিংবা ওআইসির কোনো ভূমিকা নেই। মুসলিম বিশ্বে সত্যিই আজ এক ক্রান্তিকাল চলছে। এই ক্রান্তিকালে মুসলিম বিশ্বের জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের। কিন্তু কে নেবে সেই নেতৃত্ব? কে ধরবে হাল?
আসলে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে কে?
বিদ্যমান বাস্তবতায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের কথা বললে সম্ভাব্য তিনটি দেশের নাম সামনে চলে আসে। সৌদি আরব, ইরান ও তুরস্ক। অনেক দিন ধরেই মুসলিম বিশ্ব সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সংকট উত্তরণে সৌদি আরব প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নিতে পারেনি নেতৃত্বের আসন। রোহিঙ্গা ইস্যু, আফগানিস্তানের তালেবান ইস্যু, ভারতের কাশ্মীর ইস্যু এবং চীনের উইঘুর মুসলিম ইস্যু ইত্যাদি কোন ইস্যুতেই সৌদি আরবের কোন ভূমিকা নেই। মুসলিম জনগণের এসব প্রতিটি ইস্যুতেই বলতে গেলে সৌদি আরব প্রায় নিরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের তিক্ততা মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই পুরো মুসলিম বিশ্বকেই প্রভাবিত করেছে। একদা কাতারকে একঘরে করে সৌদি আরব। পরে চলতি বছর কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। সৌদির নানা পদক্ষেপ বরং মুসলিম বিশ্বকে আরও দুর্বল করেছে। ইয়েমেনে দিনের পর দিন বোমা ফেলছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। ইতোমধ্যে দেশটিতে বহু মানুষের প্রাণ গেছে বোমায়। ইয়েমেনে চলছে দুর্ভিক্ষ। জাতিসংঘের তথ্যমতে দেশটি এখন মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। কিন্তু তারপরও সৌদি জোট বিমান থেকে ইয়েমেনে বোমা ফেলছেই।
ফিলিস্তিন ইস্যু
ফিলিস্তিনিদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ইয়াহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং আজ প্রায় ৭ দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান হয়নি। দেশহারা ফিলিস্তিনিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য আজও সংগ্রাম করে চলেছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হবে–জাতিসংঘ ও বিশ্ব এই অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তারা তা রক্ষা করেনি। এমনকি ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসন ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে অসলো শান্তি চুক্তিও পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এই সেদিনও ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসলিম রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে বললেন, ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র কখনই নয়। তারপরও মধ্যপ্রাচ্যের একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে গড়ে তুলছে দহরম– মহরম সম্পর্ক। এমনকি সৌদি আরবও ক্রমেই ঝুঁকছে ইসরায়েলের দিকে। তুরস্ক ছাড়া এখন কোন মুসলিম রাষ্ট্রই স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র নিয়ে আর উচ্চকণ্ঠে সোচ্চার নয়।
ট্রাম্প প্রশাসন আমলে জেরুযালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি, স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় বড় এক ধাক্কা। তবে এই সংকটের শুরু থেকেই যথারীতি সোচ্চার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। বলতে গেলে তিনিই এখন ফিলিস্তিনি তথা সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য একমাত্র সোচ্চার কণ্ঠস্বর। তাঁর ভূমিকা ও তৎপরতা মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো ও জনগণের দৃষ্টি কেড়েছে।
তালেবান নিয়ে তুরস্কের পরিকল্পনা
মুসলিম বিশ্বের চলমান সংকট এখন আফগানিস্তান। ২০ বছর পর সেখানে আবার তালেবান ক্ষমতায়। কিন্ত দেশটি এখন চরম আর্থিক সংকট ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে। কিছুদেশ ও জাতিসংঘ মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এলেও এখনও আন্তর্জাতিক বৈধতা ও স্বীকৃতি মেলেনি। এ অবস্থায় পাকিস্তান ও তুরস্ক জোরালো ভূমিকা রাখলেও তারাও স্বীকৃতি দেয়নি। তবে তুরস্ক ও পাকিস্তান সার্বিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর সঙ্গে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে যাওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলো সেখান থেকে দূতাবাস সরিয়ে নিলেও তুরস্ক তা করেনি। বরং তুরস্ক অন্য দেশগুলোকে তালেবানের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দরের কারিগরি দিক দেখভালেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং এ ব্যাপারে কাতারের সঙ্গে কাজ করছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে সহায়তামূলক কার্যক্রমও চালিয়ে যাবে তুরস্ক।
ইরান প্রসঙ্গ
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ইরান এখন আলোচিত নাম। মুসলিম বিশ্বের একটি অংশের সাথে ইরানের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। ইয়েমেনে সৌদি জোটের হামলার বিরুদ্ধে সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত হুতি বিদ্রোহীদের ইরান সার্বিক সামরিক সহায়তা যোগাচ্ছে। কিন্তু দেশটির পারমাণবিক ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অবরোধে ইরান জর্জরিত। দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা চাপ মুকাবিলার পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ সৌদি আরবকে সামাল দিতে ইরানকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে আসা এই মুহূর্তে ইরানের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ভারতের সাথে সম্পর্কের কারণে কাশ্মীর ইস্যুতেও তেমন সোচ্চার নয় ইরান। একই কারণে চীনের উইঘুর মুসলিম ইস্যুও ইরানের কণ্ঠে উচ্চকিত নয়। এদিকে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ইবরাহীম রাইসীও মুসলিম বিশ্বে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। আর মুসলিম বিশ্ব তাঁর নেতৃত্বে আসবে তেমনটি মনেও হয়না। আর রাইসী এখনও ব্যক্তিগত কোন ক্যারিশমাও দেখাতে পারেননি।
রোহিঙ্গা সংকট
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষাপটে মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের মধ্যে এরদোয়ানকেই সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা যায়। রোহিঙ্গা সংকটে এরদোয়ানের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্টিন পি স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাজ হাশমী এই মত দেন যে, ‘এরদোয়ান তুরস্কের হারানো শৌর্য–বীর্য ফিরিয়ে আনতে চান। একই সঙ্গে তুরস্ককে নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে তিনি হতে চান মুসলিম বিশ্বের প্রধান নেতা।’
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বে বর্তমানে সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। আর আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা মেডিসিনস স্যান ফ্রন্টিয়ারসের মতে, পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় আদিগোষ্ঠীর তালিকায় ভয়াবহ অবস্থানে রয়েছে রোহিঙ্গারা। অথচ আজকের এই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের রয়েছে গৌরবময় অতীত। রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। রাজ্যের আদি নাম ছিল আরাকান। বর্তমান নাম রাখাইন। আরাকান ছিল বরাবরই স্বাধীন ও অতিশয় সমৃদ্ধ দেশ। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব। কিন্তু মিয়ানমারের সরকার এবং সেনাবাহিনী দেশটির রাখাইন রাজ্যের (আদি নাম আরাকান) রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালী নাম দিয়ে এবং তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় এই ফাতওয়া দিয়ে সেখানকার রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে দুই দফায় প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।
বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক সংকটজনক অবস্থায় আছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘ মাঝে মাঝে কথা বললেও সৌদিসহ আরব দেশগুলো এবং ওআইসি একেবারেই নিরব। তবে এরদোয়ান সর্বদাই উচ্চকণ্ঠ।
লিবিয়া সংকট ও তুর্কি সেনার অবস্থান
আজ থেকে একদশক আগে লিবিয়ায় ‘আরব বসন্ত’ নাম দিয়ে বিদ্রোহ উসকে দিয়ে দেশটির জনপ্রিয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে হত্যা করে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে ন্যাটো জোটের সেনারা। দেশটিতে তারা তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু গাদ্দাফির নিহত হওয়ার পর গত এক দশকে লিবিয়ায় কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও গণতন্ত্র ফেরেনি। সরকার এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে লিবিয়া। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিবদমান পক্ষগুলোকে নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়, যা গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড (জিএনএ) নামে পরিচিত। পরবর্তিতে ফাইয আল সারাজের নেতৃত্বাধীন জিএনএর সাথে বিরোধে লিপ্ত হয় বিদ্রোহী গ্রুপ খলিফা হাফতারের নেতৃত্বাধীন লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি(এলএনএ)। হাফতার বাহিনী লিবিয়ার বেশ কিছু শহর ও অঞ্চল দখলে নেয়। এরপর তুরস্কের সেনারা প্রবেশ করে লিবিয়ায়। জাতিসংঘ সমর্থিত সারাজের নিয়ন্ত্রণাধীন জিএনএ-র সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তুরস্কের এই সেনারা। তারা বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ, অত্যাধুনিক ড্রোন আর সিরিয়া থেকে বিদ্রোহীদের এনে হাফতার বাহিনীর ত্রিপোলি অভিযান রুখে দেয়।
সিরিয়ায়ও তুর্কি সেনার অবস্থান
মুসলিম বিশ্বে লিবিয়ার মত সিরিয়াও গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত। ইদলিবসহ সিরিয়ার বেশকিছু এলাকা এখনও বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। গণতন্ত্র-মুক্তি-সমৃদ্ধির আশায়,আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায়ও আছড়ে পড়েছিল। তারপর শুরু গৃহযুদ্ধের। ২০২১ সালের ১৫ মার্চ এই গৃহযুদ্ধের ১০ বছর পূর্ণ হয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থানে বেশ ভূমিকা রাখে। আইএস ইরাক ও সিরিয়ার একটা বড় অংশ দখল করে ২০১৪ সালের জুনে কথিত ‘খিলাফত’ ঘোষণা করে। বর্তমানে আইএস’র শক্তি প্রায় ক্ষীণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশটিতে অবস্থান রয়েছে বিদেশি শক্তির। বিদ্রোহী ও আইএস অবস্থানে প্রায়ই মার্কিন বাহিনী হামলা চালিয়ে থাকে। সিরিয়ায় মার্কিন সেনার ঘাঁটিও রয়েছে। এছাড়া সিরিয়ায় হামলা চালায় ইসরায়েল, তুরস্ক ও রাশিয়ার মত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি। ইদলিব হলো সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদ বিরোধী গোষ্ঠীর শক্ত ঘাঁটি। দীর্ঘদিন ধরে ইদলিব সরকারের হাতছাড়া। কুর্দী বিদ্রোহী দমনের নামে ইদলিবে রয়েছে তুরস্কের সেনা ঘাঁটি। তুরস্কের সেনারাও প্রেসিডেন্ট আসাদের সমর্থনে প্রায়ই হামলা চালিয়ে থাকে বিদ্রোহী কুর্দীদের (পিকেকে) দমনে। উল্লেখ্য, তুরস্কের পূর্বাঞ্চলে মুসলিম কুর্দীরা সেখানে একটি পৃথক কুর্দী রাষ্ট্র গঠনে সংগ্রাম চালিয়ে আসছে বহু বছর ধরে। সিরিয়া, ইরান ও তুরস্কের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কুর্দী অধ্যুষিত ভূখন্ড। কিন্তু তাদের কোন পৃথক রাষ্ট্র নেই। কুর্দীরাও এক ভাগ্য বিড়ম্বিত জাতি।
এছাড়া আসাদ বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’র ওপরও হামলা চালিয়ে থাকে তুরস্ক।
বাদশা সালমানের ভূমিকা
সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান সত্যিকার অর্থেই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। মূলত সৌদির শাসন ব্যবস্থায়ও তাঁর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। সৌদি আরবের বাদশা সালমানের নেতৃত্ব নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে ধোঁয়াশা বিরাজ করছে। কার্যত দেশটির শাসনকাজ পরিচালনা করছেন সৌদির যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান। তিনিই দেশ চালাচ্ছেন। আর যুবরাজ এমবিএস মুসলিম বিশ্বের চেয়ে সব ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি রাখতেই যুবরাজ ব্যস্ত। এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সামনে সুবর্ণ সুযোগ মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার।
এরদোয়ান ও তুরস্ক
সামরিক দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্ক। তারা সামরিক জোট ন্যাটোরও সদস্য। কিন্তু কামাল আতাতুর্কের আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণে তুরস্ক সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বে একধরনের অনীহাও রয়েছে। তবে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দেশটির ক্ষমতায় আসায় তুরস্ক সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বের ভাবমূর্তি পাল্টাতেও শুরু করেছে। এরদোয়ান দীর্ঘদিন ধরে তুরস্কের ক্ষমতায়। প্রথমে ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী, তারপর এখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত। তুরস্কে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটাতে কাজ করছেন তিনি। তার আমলেই ইস্তাম্বুলে তুরস্কের বিখ্যাত আয়া সোফিয়াকে আবারো পরিবর্তিত জাদুঘর থেকে মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্বোধনের দিন এরদোয়ান নিজে সেই মসজিদে নামায পড়েন। এতে নিজ দেশে এবং মুসলিম বিশ্বে তুরস্কের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো আয়া সোফিয়া শুরুতে গির্জা ছিল। পরে উসমানিয়া সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান মুহাম্মদ ফাতেহ ক্রয় করে এটিকে মসজিদে রূপান্তর করেন। কিন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি নেতা কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমাদের সাথে দেশটির সম্পর্কের উন্নয়ন ও ইসলাম বিদ্বেষী নীতি অবলম্বন করায় সেটিকে আবার গির্জায় রূপান্তর করা হয়। পরে এরদোয়ান সেই আয়া সোফিয়াকে আবারও মসজিদে রূপান্তর করলেন।
এরদোয়ানের জোর প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে মুসলিম বিশ্বে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আঙ্কারা। বিশেষ করে ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। অধিকতর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি। এমনকি তাঁকে অনেকে তুরস্কের নতুন সুলতান সুলেমান বলেও অভিহিত করেন। তবে এরদোয়ান শুধু নিজ দেশের সুলতান হতে চান না; তাঁর লক্ষ্য আরও বড়। তিনি মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চান। এই লক্ষ্য থেকেই ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও এরদোয়ান নিজের যোগ্যতা তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে এরদোয়ান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘আমি সুন্নি বা শিয়া নই, আমার ধর্ম ইসলাম।’
আরব বিশ্বের জনগণ যা চায়
মিশর, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় অধিকাংশ রাষ্ট্র তুরস্ককে কোণঠাসা করার চেষ্টা করলেও সিংহভাগ আরব জনগণ মনে করছে যে তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই তাদের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। তুরস্ক এবং প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ব্যাপারে আরব দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে রয়েছে বিপরীত অবস্থান। সম্প্রতি প্রকাশিত আরব বিশ্বের ১৩টি দেশে পরিচালিত আরব জনমতের ওপর একটি ব্যাপক-ভিত্তিক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, অংশগ্রহণকারী আরব জনগণের ৫৮ শতাংশই মনে করেন, অন্য যে কোনো দেশের নীতির তুলনায় তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ও এরদোয়ানের ভূমিকা আরব স্বার্থের অনুকূল। ফিলিস্তিন ইস্যু তো বটেই, এমনকি সিরিয়া ও লিবিয়ায় তুরস্কের বিতর্কিত সামরিক হস্তক্ষেপ ও সেনা অবস্থানেও সিংহভাগ আরব জনগণ সমর্থন করছে। উল্লেখ্য, এই জরিপটি পরিচালনা করেছে দোহা ও বৈরুত ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ’।
এরদোয়ানের শক্তি প্রদর্শন
এদিকে ২০২১ এর অক্টোবরের শেষ দিকে তুরস্কে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ ১০ পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতকে একসঙ্গে বহিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে নিজের শক্তিময়তার পরিচয় দিয়েছে তুরস্ক। আর এ ঘোষনা দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। সরকারবিরোধী বিক্ষোভে জড়িত অভিযোগে আটক ব্যবসায়ী ওসমান কাভালার মুক্তির দাবিতে এই রাষ্ট্রদূতরা যৌথ বিবৃতি দিলে রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এই ১০টি দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। গত ১৮ অক্টোবার এক যৌথ বিবৃতিতে কাভালার মুক্তি নিশ্চিত করতে তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন আঙ্কারায় নিযুক্ত এই দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা। এরপর ২৩ অক্টোবার এরদোয়ানের ঘোষনা। ক্ষোভ প্রকাশ করে এরদোয়ান বলেন, এসব রাষ্ট্রদূতদের তুরস্কে জায়গা দেওয়া উচিত নয়। তাঁর ভাষায়, অন্য দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে এই বিদেশি কূটনীতিকরা দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের পরিচয় দিয়েছেন। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের কাজ নয়।
এরগোয়ানের হুমকিতে কেবল নমনীয়ই নয় বরং নিজেদের অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় পশ্চিমা ১০ টি দেশ। তারা ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারা মেনে চলতে সম্মত মর্মে যৌথ বিবৃতিতে জানায়। এরদোয়ান তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আজকের এই বিবৃতির মাধ্যমে আমাদের বিচার ব্যাবস্থা ও দেশের উপর থেকে অপবাদ অপসারিত হলো, যে ই আমাদের স্বাধীনতাকে অসম্মান করবে সে এই দেশে থাকতে পারবেনা। তার সম্মান যা ই হোক না কেন।’
শেষের কথা
এ কথা শুরুতেই বলেছি, বর্তমান বাস্তবতায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের কথা বললে সম্ভাব্য তিনটি দেশের নাম সামনে চলে আসে– সৌদি আরব, ইরান ও তুরস্ক। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তুরস্ক এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই এগিয়ে রয়েছে। মুসলিম বিশ্ব ও আরব বিশ্ব ছাড়াও আন্তর্জাতিক মহলেও এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত। লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক সামি হামদী মনে করেন, তুরস্ক রাষ্ট্রের চেয়ে বরং ব্যক্তি এরদোয়ান সাধারণ আরব জনগণের বিরাট একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন, এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তিনিই মুসলিম বিশ্বের নেতা।
এদিকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এরদোয়ানের আগের তুরস্ক আর এরদোয়ান পরবর্তী তুরস্ক অনেক আলাদা। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপটে আরব জনগণ এখন এটা বেশ ভাল ভাবেই বুঝতে পারছেন। তারা জানেন তুরস্কের নতুন যে বৈদেশিক নীতি ও ভূমিকা তার মূলে এরদোয়ান। আর সৌদি আরব ও তার নেতাদের প্রতি আরব জনগণ ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছেন। এদিকে তুরস্ক দেশটির উন্নয়ন ও সামরিক শক্তিও অনেক বাড়িয়েছে। মার্কিন হুমকি উপেক্ষা করে রাশিয়ার কাছ থেকে আরও অস্ত্র কিনছে। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত বড় বড় শক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে কথা বলছেন এরদোয়ান। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটকে মোটেই ছাড় দিয়ে কথা বলেন না রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তাই এ কথা বলা যায়, আগামী দিনে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের সম্ভাবনা তুরস্ক ও তার নেতা এরদোয়ানের দিকেই।