জুমুআর জামাআত পড়িয়ে ইমাম সাহেব ছুটিতে যান। পরদিন শনিবার মক্তব বন্ধ থাকে। এ রীতি চলে আসছে সেই দাদার আমল থেকে। আজ তিহাম মক্তবে যায়নি। এক ঝলক রোদের দেখা পেতে হাঁটতে বেরিয়েছে। বাড়ির সামনে বেরুলে রক্তিম সূর্যের দেখা মিলে। পুবের গাঁয়ের উঁচু শিমুল গাছের মাথায় সূর্য ওঠে। এটা সবখানে সমান নয়। গত বছর তিহাম ফুপুমণির বাড়ি গিয়েছিল। সেখানে সুরমা নদীর ওপারে সূর্য ওঠে। সকালের রোদ মিষ্টি। এটা মিষ্টি হয় কিভাবে? রসনায় না পড়লে তিতা মিঠা জানার উপায় নেই। তবে সকালের রোদের ব্যবহার খুব মিষ্টি। তার দিকে তাকিয়ে থাকলে কোনো অভিমান করে না। গোল বৃত্তের মতো সূর্যটার পরিধি মাপা যায়। কোথাও এর পরিধি আরো ছোট হয়। গত বছর আফনান ভাইয়া সমুদ্র সৈকতে গিয়েছিলেন। সেখানে নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলেছেন। একটি ছবিতে তিনি সূর্যকে হাতের তালুতে নিয়েছেন। বড় হলে সমুদ্র সৈকতে যাওয়া হবে। এখন হাত মেলে পরিমাপ নিতে হবে।
উত্তর-দক্ষিণ বরাবর হাত দুটো প্রসারিত করল তিহাম। বাম হাতে কি যেন লাগল। মাচা থেকে নুয়ে পড়া শিমের লতায় তিহামের হাতের পরশ লাগে। কচি শিমলতা খুব বিপদজনক। ত্বকে লাগলে ঘা হয়ে যায়। এই শিমলতার কারণে বাছির মিয়া চোখ হারিয়েছেন। ছোটবেলায় শিমঝাড়ের পাশ দিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছিলেন। ঘটে দুর্ঘটনা। গরম সেক তার চোখ ভালো করতে পারেনি। এক সময় পঁচে যায়। এক চোখের টানে অন্যটিরও আলো হারিয়ে যায়। এখন তিনি ভিক্ষা করেন। কানা বাছির নামে পরিচিত। তিহাম নুয়ে পড়া তিনটি শিমলতা বেড়ার ভিতরে ফিরিয়ে দিল।
সকালের সূর্য হাজারও আলোর উৎস। সূর্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঘন ঘন তিন চার বার চোখ বন্ধ করলে সে চমক দেখা যায়। সূর্য থেকে রঙ বেরঙের গোল গোল বৃত্ত ভেসে আসে। ছোট থেকে বড় হয়। আবার মুহূর্তে হারিয়ে যায়। তিহামের কাছে এটা খুবই আনন্দের। ও দিকে মুন্নার মার ছেলেরা সবজি ক্ষেতে পানি দিচ্ছে। একজন খালের পানিতে পা ডুবিয়ে বালতি ভরে দিচ্ছে। বাকি দুজন খালি পায়ে পানি বয়ে নিচ্ছে। কারো গায়ে শীতের পোশাক নেই। তাদের কি ঠান্ডা লাগে না। পাশের বেড়ায় একটি চাদর রাখা আছে। কাজের সুবিধায় সেটিও খুলে রেখে। মুন্নাদের নিজস্ব জমিজমা নেই। আমন ধান কাটা হলে খালি ধানক্ষেতে তারা রবিশস্যের চাষ করে। কোদাল দিয়ে খুড়ে দুতিন বিঘা জমিতে সবজি ফলাতে পারে। কাঁচা মরিচ ও ফরাস ডাল চাষ করেছে। সিলেটের বাইরে ফরাস চাষ হয় না। শুদ্ধ ভাষায় ফরাসের নাম কি, তিহাম জানে না। তবে একবার একটি জাতীয় পত্রিকায় ‘ফরাস ডাল’ শব্দটি দেখেছে। বোয়াল মাছের সাথে ফরাস ডালের তরকারি তিহামের পছন্দ। প্রতি বছর মুন্নার মা মণ আধেক ফরাস বিচি তিহামদের কাছে বিক্রি করেন। তিহাম ভাবছে, এত স্বাদের তরকারি ফলাতে কতই না শীত সহ্য করতে হয়। তার মনে কি যেন এল। মান্না ডেকে এনে জ্যাকেটটি পরিয়ে দিল। বারবার ফিরে দেখছে তার জ্যাকেট মান্নাকে কেমন দেখায়। গত বছর সাকিবা আপুর বাবা গ্রিস থেকে এটি এনেছেন। কতো দামি জ্যাকেট। ভোরে আম্মু পরিয়ে দিয়েছেন। এখন বাড়ি ফিরলেই বলবেন, জ্যাকেট কোথায়? ঘরে ফিরতে ভয় হচ্ছে। তালগাছের কাটা মুড়ায় বসে রইল সে। সূর্য দেখা গেলেও রোদের উষ্ণতা নেই। খুব ঠান্ডা লাগছে। কিছু আগে মান্নারও একই রকম ঠান্ডা লেগেছিল নিশ্চয়।
হঠাৎ ডাক শুনল, তি-হা-ম। ফিরে দেখল রিদা আসছে। তিহামের একমাত্র বোন রিদা। কিছু বলার আগেই জিজ্ঞেস করল, জ্যাকেট কই? কোনো উত্তর না দিয়ে তিহাম হাত দিয়ে দেখাল। রিদা হেসে দিয়ে বলল, এটা মুন্নার গায়ে! পরশু আমাকে একবার পরতে দেওনি। তিহামের মনে হলো, সে বলবে তোমার কি শীতের কাপড়ের অভাব? কিন্তু বলল না। এখন রিদাকে পক্ষে রাখা দরকার। রিদা বলল, তুমি জানো, আম্মু কি বলবেন? কি আর বলবেন; বলবেন, মুন্নার মার ছেলেদেরকে এসব দিয়ে লাভ কী? কদিন পরে এসে বলবে ইদুরে কেটে ফেলেছে। উত্তর দিল তিহাম। রিদা সমর্থন জানিয়ে বলল, হুম, এটা বলবেন আর কত সময় বকবেন। তবে বকাঝকা থেকে বাঁচার উপায় একটা আছে। রাতে সে ঘুমুতে যাবার সময় দাদু যখন বলবেন, আজকের সেরা ভালো কোনটি। তখন বলে দিব। দাদু খুশি হলে আম্মু কিছু বলবেন না। তবে এর আগ পর্যন্ত বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে হবে। রোদ গরম হবার পর বাড়িতে গেলে কেউ জ্যাকেটের খুঁজ করবে না। রিদা, তিহাম এখন রোদ গরম হবার অপেক্ষায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, হাফসা মজুমদার মহিলা ডিগ্রি কলেজ, সিলেট