ভারতের তাকবীর কন্যা মুসকান যখন আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে জাহানের ইথারে ইথারে কাঁপন তুলেছিলেন তখন বাংলার ইসলামপ্রিয় জনতার হৃদয়ও এই ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছিলো। সে সময় অনেক পরিচিতজনের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলাম মুসকানের তাকবীর যেভাবে সারা উম্মাহকে জাগিয়ে তুলেছিলো বাংলাদেশে আমরা কোন ইসলামবিরোধী শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে এরকম তুমুল সাহসে তাকবীর দেওয়ার সৎসাহস রাখি কি না, আর রাখলেও দেশজুড়ে এর প্রতিক্রিয়াই বা কী হবে। এর জবাবে কাউকেই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে শুনিনি এদেশে এ ধ্বনি প্রতিক্রিয়াশীল সেক্যুলারদের প্রতিক্রিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে না। তাকবীর নিয়ে আমাদের নানা রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়ার হিপোক্রেসির প্রমাণ পাওয়া গেলো অতি সম্প্রতি একটি রাজনৈতিক দলের মঞ্চে তাকবীর স্লোগান এবং তৎপরবর্তী নানামুখী আলোচনা সমালোচনার মধ্য দিয়ে।
বিএনপি, বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের একটি। ক্ষমতায় ছিলো বেশ কয়েকবার। বিএনপি যখনই নির্বাচনের রাজনীতি করেছে তখনই তাদের মুখে ইসলাম, মুসলমান, মহান আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস ইত্যাদির কথা শুনা গেছে। অর্থাৎ তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সেক্যুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) অবস্থানের বিপরীতে বিএনপি সবসময়ই এদেশের জনগণকে এ বার্তা দিতে চেয়েছে আমরা দলীয়ভাবে ইসলামকে গুরুত্ব দেই। এ বার্তার সুফলও তারা পেয়েছে বহুবার মুসলমানদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের মাধ্যমে। কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে তারা যতটা দাবি করেন, বাস্তবতা যে এরচেয়ে ভিন্ন, তা প্রমাণ হয়েছে চট্টগ্রামের বিএনপির মহাসমাবেশে। সেখানে জনৈক বিএনপি নেতা স্লোগান দিয়েছিলেন নারায়ে তাকবীর, সম্মিলিত জনতাও কোরাস তুলেছিলো আল্লাহু আকবার বলে।
যার অন্তরে সীসা পরিমাণ ঈমান আছে সে-ই আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে উদ্বেলিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সকল রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে মুসলমান মাত্রেরই এ ধ্বনির আওয়াজে স্বস্তি আসে, শান্তি আসে। কিন্তু বিএনপির মঞ্চে এ স্লোগানের পর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ঘায়েল করতে যেভাবে সমালোচনায় মেতে উঠলো এবং রাম-বামদের আশীর্বাদপুষ্ট মিডিয়া যেভাবে প্রোপাগাণ্ডা চালানো শুরু করলো তাতে মনে হয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এবং তথাকথিত মূলধারার মিডিয়া এখনো বাংলাদেশের মানুষের আবেগ, অনুভূতির শিকড় আবিস্কারে ব্যর্থ হয়েছে। পরবর্তীতে বিএনপির দায়িত্বশীলগণ যেভাবে ‘এ স্লোগান আমাদের দলীয় কোন দৃষ্টিভঙ্গি নয়’, ‘এ স্লোগান অমুকের ব্যক্তিগত’ ইত্যাদি মন্তব্য করছিলেন তখন এ কথাই মনে হচ্ছিলো তারা অদৃশ্য কোন শক্তির কাছে আত্মরক্ষা করছেন, যেন তাকবীর ধ্বনি তাদের জন্য অস্বস্তিকর এক সমস্যা হয়ে উঠেছে। যে দল কথায় কথায় ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসের কথা বলে বেড়ায় সে দলের সমাবেশে পরম করুণাময়ের তাকবীর ধ্বনি তাদেরকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়! বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের এমন অবস্থান থেকে পাঠকদের কে কী বুঝেছেন জানিনা, আমি শুধু এটুকু বুঝেছি নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণকে নিজেদের পক্ষে আনা থেকে অন্য কোন শক্তিকে পক্ষে আনার চেষ্টাই এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান কাজ। আবার যখন প্রয়োজন হবে তারা হয়তো লোকরঞ্জনের জন্য ইসলামের কথা বলবে, কিন্তু মৌলিকভাবে ইসলামকে তাদের দলীয় আদর্শ হিসেবে কখনোই গ্রহণ করবে না।
অপরদিকে দলীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও আমরা আওয়ামীলীগের নেতাদেরকেও নির্বাচনের আগে আগে টুপি মাথায় মসজিদে-মাযারে ছুটতে দেখি, শাহজালালের মাযার শরীফ থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করতে দেখি আবার আলিম উলামাদের একটা বৃহৎ অংশকে সময়ে সময়ে গুরুত্ব দিয়ে পাশে বসাতেও দেখি। তাদের রাজনৈতিক দর্শনের কিসের সাথে আল্লাহু আকবারের বিরোধ আমার এখনো বোধগম্য হয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলেছিলেন- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, বরং সকল ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। আমি নিশ্চিত নই আল্লাহু আকবার বললে কার স্বাধীনতায় আঘাত লাগে, কীভাবে আঘাত লাগে!
এ তাকবীর তো মুসলমানের হৃদয়ের তাকবীর। ষোল কোটি মুসলমান প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে অসংখ্যবার সরবে, নিরবে এ তাকবীর উচ্চারণ করছে। আমি জানি এদেশের লাখো কোটি আওয়ামীলীগ-বিএনপি কর্মীও এ তাকবীর দিয়েই নামায পড়ে। তাহলে আসলে বিরোধটা কোথায়? কেউ যদি বলেন বিরোধটা আসলে তাকবীরের রাজনৈতিক মঞ্চায়নের, তাহলে বলবো ইসলামী শব্দমালা অথবা ধর্মীয় রীতিনীতি কোনকালেই এদেশের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো না, ধর্ম নিরেপেক্ষতার দাবিদার আওয়ামীলীগের মঞ্চ থেকেও না। কুরআন তিলাওয়াত, সালাম, বিসমিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ কিংবা মাযার যিয়ারত এসবই তো তাদের সমাবেশে, নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে আমরা হরহামেশাই দেখি। তাহলে বিপক্ষশক্তির সমাবেশে তাকবীর উচ্চারিত হলে তারা ঠিক কী কারণে প্রতিক্রিয়া দেখায়?
বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের এরকম প্রয়োজনভিত্তিক, জনগণের মনোরঞ্জনকামী ‘সিলেক্টিভ’ ইসলামী মূল্যবোধের বুলি আওড়ানো অথচ ইসলামী চেতনা জাগ্রত হয় এমন শব্দ-যুগলের বিরোধিতা অথবা দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি আমাদের নিকট একটি বিষয় সুস্পষ্ট করে তুলে। তা হলো, আমাদের রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে এদেশের রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার গুরুত্ব যতটুকু, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দিষ্ট ঘরানার দেশি-বিদেশি ‘প্রেশার গ্রুপ’। বলাই বাহুল্য, এসব প্রেশার গ্রুপ আসলে পশ্চিমা ভোগবাদ, রুশ/চৈনিক সমাজবাদ এবং অধুনাকালে জেগে ওঠা বিজেপির হিন্দুত্ববাদের এক অদ্ভুত মিশেল। এসব নানা ইজমের মাঝে আপাতদৃষ্টিতে অনেক বিরোধ পরিলক্ষিত হলেও এক জায়গাতে তারা এক। এ সকল ইজমই ভয় পায় ইসলামী চেতনাকে। তাই কোন জনপদে ইসলামী চেতনা জাগরণের এক অবিস্মরণীয় স্লোগান ‘আল্লাহু আকবার’ উচ্চারিত হলে তাদের মাঝে একধরণের অসহিষ্ণুতা তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দুশ্চিন্তার বিষয় শুধু এটুকুই যে আমাদের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতরে-বাহিরে এসব শক্তি এখন এতোটা সংঘবদ্ধ ও ক্রিয়াশীল যে তাদের কাছে নতি স্বীকার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের চিন্তা-চেতনার বিপক্ষে যায় এমন অবস্থান নিতেও তারা পিছপা হচ্ছেন না।
ব্রিটিশ বেনিয়াদের সময় থেকে এদেশের মানুষের মন থেকে ইসলামী কৃষ্টি-কালচার, মূল্যবোধ মুছে ফেলার যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আগে যেসব চক্রান্ত গোপনে হতো এখন তা প্রকাশ্যে হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, কোনকিছুই এদেশের মাটি ও মানুষ থেকে ইসলামকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। বরং ইসলাম ও এদেশের মানুষের অবিচ্ছিন্নতা বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে পরিপূর্ণরূপে ইসলাম চর্চার চেষ্টা যারা করেন তারা তো বটেই, যারা এতোটা সচেষ্ট নন তারাও ইসলামের নানা পরিভাষা ব্যবহারে অব্যস্ত হয়ে উঠেছেন কালের আবর্তে। তাই আজও সালাম না দেওয়ায় মসজিদের খতীব সাহেবের উপর সরকারি কর্মকর্তা গোসসা হন, মুরতাদদের জানাযা পড়ানো যাবে না বললে নাস্তিকরাও কষ্ট পান।
বিএনপির কিংবা আওয়ামীলীগের মঞ্চে নারায়ে তাকবীর থাকুক বা না থাকুক এ স্লোগান বাংলাদেশের মুসলমানদের হৃদয়ে, মাহফিলের প্যান্ডালে, মীলাদুন্নবীর র্যালিতে, রাজপথের আন্দোলনে বাজবে হাজার বছর ধরে। রাম-বামদের বাহারী স্লোগানের ভিড়ে নারায়ে তাকবীর হারিয়ে যাওয়ার নয়। নারায়ে তাকবীর এক অনুভূতির নাম। এ অনুভূতি অন্য কোন শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা সম্ভব হবে না। নানা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা ধর্মপ্রাণ মুসলমান তাদের একবার নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করা উচিত আমি দিনে পাঁচবার যে তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করি সে তাকবীর যেসব রাজনৈতিক দলের মঞ্চে উচ্চারণ করতে বারণ, অথবা যেসব দল এ স্লোগানকে নিজেদের মনে করে না সেসব দল কতটুকু আমার অস্তিত্বকে স্বীকার করছে?