উপমহাদেশে ইসলাম
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রথম আগমন ঘটেছিল ৮ম শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে। উমাইয়া শাসনামলে সেনাপতি মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের হাত ধরে ইসলামের বিজয় মশাল সাগরপাড়ের সিন্ধু ভূমিতে এক ঝলক আলো ফেলেছিল। কিন্তু প্রথম আগমনটি স্থায়ী হতে পারেনি। পাহাড়ি জলধারার মতো দ্রুতবেগে এসে, সেটি আবার মিলিয়ে গিয়েছিল সময়ের প্রতিকূল স্রোতে। তবে ক্ষণিকের এ আলোড়ন পরবর্তীদের স্থায়ী আগমনের পথকে সুগম করে দিয়েছিল। ইরান আফগানিস্তানের পাহাড় মাড়িয়ে, কখনো আবার ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে উপমহাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন মহান সব সূফী শায়খ ও মুসলিম ব্যবসায়ীগণ। তাদের দ্বীনদারী, একনিষ্ঠ পরিশ্রম ও উত্তম চরিত্র হিন্দুস্তানের পৌত্তলিক-গৌড়ে কালিমা তায়্যিবার ধ্বনিকে বজ্রকণ্ঠে
প্রতিধ্বনিত করেছিল। এ উপমহাদেশের মুসলমানদের মুসলিম সত্তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে প্রখ্যাত সব ওলী-আউলিয়ার নাম। সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী বলেছেন, “ভারতবর্ষে যত মানুষ ইসলাম গ্রহণ করবে ও ইসলামের ওপর চলবে, তার একটি সাওয়াব খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (র.) এর আমলনামায় যাবে।”
ত্রয়োদশ শতাব্দীর সূচনালেগ্ন সুলতান মুহাম্মদ ঘুরীর হাত ধরে উপমহাদেশের বুকে দ্বিতীয়বার ইসলামী শক্তির আগমন ঘটেছিল। সেবার আর পাহাড়ি জলধারা নয়; বহমান নদীর মতো স্থায়ীভাবে হিন্দুস্তানের মাটিতে পদচিহ্ন ফেলেছিল মুসলমানরা। তবে শক্তিশালী মামলুক, খিলজি, সায়্যিদ, মোঘল প্রমুখ মুসলিম রাজবংশ এ মাটিতে শাসন করলেও ইসলাম প্রচারে তাদের ভূমিকা খুবই নগণ্য। সে কাজটি তখনও সূফী শায়খরাই করে গেছেন।
তাজদীদের পথ পরিক্রমা
প্রথমদিকের মুত্তাকী সূফী শায়খরা দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর ধীরে ধীরে তাসাউফের নামে অনেক বাতিল আকীদা এসে উপমহাদেশের মুসলমানদের ভেতর প্রবেশ করেছিল। একইসাথে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুরু হয়েছিল দ্বীনকে ধ্বংস করার এক অভিনব ষড়যন্ত্র। ‘দ্বীনে ইলাহি’ নামক এক কুফরি আকীদা প্রচার করা হচ্ছিল খোদ মোঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজদরবার থেকে। আল্লাহ তখন তার প্রিয় বান্দা ইমাম আহমদ সিরহিন্দী (র.) (১৫৬৪-১৬২৪) এর মাধ্যমে উভয় দিক থেকে সমাগত ষড়যন্ত্র থেকে তার দ্বীনের পবিত্রতাকে রক্ষা করেছিলেন। ইমাম সিরহিন্দী একদিকে তাসাওউফের নামে প্রবিষ্ট বাতিল আকীদাকে দফারফা করে তাসাওউফকে সুন্নাতের সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর ফিরিয়ে এনেছিলেন। অপরদিকে তার ইলমি ও তাজদীদি কর্মসূচি ‘দ্বীনে ইলাহী’ নামক কুফরি মতবাদকে দুনিয়া থেকে চিরতরে বিদায় করে দিয়েছিল।
আজ অবধি তিনি মুসলমানদের কাছে মুজাদ্দিদে আলফে সানী বা হিজরী দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক হিসেবে অমর হয়ে আছেন।
ইমাম সিরহিন্দীর সমসাময়িক ছিলেন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ আবদুল হক দেহলভী (র.)। ইমাম সিরহিন্দী যখন কুফরের কালিমা ঝেড়ে ইসলামকে এবং বিদআত সরিয়ে সুন্নাতকে পুনর্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, শায়খ আবদুল হক তখন উপমহাদেশের উর্বর মাটিতে হাদীসে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বীজ বপন করছিলেন। ইমাম সিরহিন্দীর তাজদীদ (সংস্কার) ও শায়খ আবদুল হকের ইলমি খিদমাত পরবর্তী শতাব্দীতে এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। সিন্ধুসদৃশ সেই বিন্দুর নাম ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) (১৭০৩-১৭৬২)।
উপমহাদেশ তো বটেই, সেই যুগে পুরো মুসলিম দুনিয়ায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র তুলনার বহুবিদ্যাজ্ঞ (Polymath) দ্বিতীয়জন ছিলেন না। খ্যাতিমান আলিমে দ্বীন ও দার্শনিক ড. ইসরার আহমদ বলেছেন, “ইমাম গাযালী (র.) ও ইমাম ইবনু তাইমিয়াকে একত্রিত করে যে ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে পারে, আমার নিকট শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) তার চেয়েও বড়। সাহাবায়ে কিরামের পর মুসলিম দুনিয়ায় এরকম বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী দ্বিতীয়জন আসেননি।” সামনে এগুনোর পূর্বে উপমহাদেশের এ সর্বশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদকে সংক্ষিপ্তভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর প্রধান কৃতিত্ব ছিল, তিনি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর কিতাব ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রসার করেছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের ফার্সি অনুবাদ করে কালামে ইলাহিকে জনসাধারণের উপলব্ধির দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে তার পুত্রদের দ্বারা কৃত উর্দু অনুবাদ উপমহাদেশের কোণায় কোণায় কুরআনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছিল। একইসাথে তিনি শায়খ আবদুল হক দেহলভী (র.) এর হাতে প্রোথিত ইলমে হাদীসের বীজকে সযত্নে লালন করে সুবিশাল মহীরুহে পরিণত করেছিলেন। মুয়াত্তা ও মিশকাতের মতো বিশ্বখ্যাত হাদীসের কিতাবের ব্যাখ্যা রচনা করার মাধ্যমে উপমহাদেশে ইলমুল হাদীস অধ্যয়নকে তিনি স্থায়িত্ব এনে দিয়েছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) তুলনামূলক ফিকহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছিলেন। তিনি হানাফি ও শাফিঈ মাযহাবের মধ্যকার দূরত্বকে সুশৃঙ্খলভাবে নিরসনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং মুজতাহিদ ইমামদের মতপার্থক্যের কারণসমূহ ব্যাখ্যা করেছেন। যুগের প্রয়োজনে ইমামদের উসূলের ওপর ভিত্তি করে ইজতিহাদের তথা গবেষণার রুদ্ধ দরজাকে তিনি পুনরায় উন্মুক্ত করেছেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও বাতিলের মুকাবিলা করার জন্য জ্ঞানভিত্তিক প্রজ্ঞাপূর্ণ ঈমানের বিকল্প নেই। এজন্য তিনি তার লেখনিতে ঈমানের শাখা-প্রশাখা এবং ইসলামী শরীআতের হিকমত (Purpose And Objectives) খুলে খুলে বর্ণনা করেছেন। তার ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ এমন এক অদ্বিতীয় রচনা, যার উদাহরণ পুরো ইসলামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাসাওউফের জগতেও শাহ ওয়ালিউল্লাহ এক বিস্ময়কর নাম। পিতার কাছেই তিনি তাসাউফের দীক্ষা পেয়েছিলেন। তাসাউফের তাত্ত্বিক জটিলতাকে তিনি সহজবোধ্য করেছেন, মুসলিম মননে আল্লাহর মারিফাতের নীর সিঞ্চন করেছেন, আত্মিক পরিশুদ্ধতাকে মুসলিম পরিচয় গঠনের পাথেয় বানিয়ে হাজির করেছেন। সর্বোপরি ইমাম গাযালী ও ইমাম আহমদ সিরহিন্দীর পথ ধরে কুরআন-সুন্নাহ’র আলোকে তাসাওউফকে দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে উপস্থাপন করার সমুদয় কৃতিত্ব শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর, অন্তত উপমহাদেশের বুকে। এছাড়াও তিনি একটি তথা ‘সমন্বিত মুসলিম মানস’ (Comprehensive Muslim Mindset) গঠন করার লক্ষ্যে ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিকসমূহ সূচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া ইসলামী খিলাফতের স্বপ্নকে যুগের উপযোগী সংস্করণে পুনরায় হাজির করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) পরবর্তীদের জন্য দ্বীনী খিদমতের পথকে সুগম করে গেছেন।
বালাকোট যুদ্ধের ভূমিকায় শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) এর কৃতিত্ব
আলোচনা করার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, বালাকোট থেকে শুরু করে আজকের যুগ পর্যন্ত এ উপমহাদেশে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের যত খিদমাত হয়েছে, সবই শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর সাদাকাহ জারিয়াহ। বালাকোটের মহাবীর, ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার, আমীরুল মুমিনীন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (র.) সরাসরি শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর রূহানী সন্তান বললে অত্যুক্তি হবে না। সায়্যিদ আহমদ (র.) কখনও ‘আমীরুল মুমিনীন’ হতে পারতেন না, যদি তার পেছনে ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর ইলমি ও তাজদীদি খিদমাতের ভর না থাকত।
নব উদ্যমের সূচনা
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর সন্তানরা একনিষ্ঠভাবে পিতার খিদমাত সামনে এগিয়ে নিয়ে চলছিলেন। একই সময় ভারতের বিভিন্ন কোণায় মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিল ইসলাম-বিধ্বংসী সর্পকুল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতি নিয়ে বহু আগে থেকে উপমহাদেশের সমুদ্রতটে ব্যবসা করছিল ইংরেজ বেনিয়ারা। কিন্তু কেবল ব্যবসার নিয়ত কখনও তাদের ছিল না। তাদের চোখ ছিল ভারতের সিংহাসনে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে ক্ষয়িষ্ণু মোঘল রাজদরবার চলছিল এক প্রকার দান-দক্ষিণা নিয়ে। ইংরেজদের বাড়ন্ত শক্তিকে মুকাবিলা করার সামর্থ মোঘলদের ছিল না। ওদিকে মহারাষ্ট্রের কট্টরপন্থী হিন্দু রাজা ছত্রপতি শিবাজী মুসলমানদের হাত থেকে ভারতের ক্ষমতা দখল করার চেষ্টায় বহুবার ব্যর্থ হয়েছিল। তার বংশধররাও মোঘলদের ক্ষয়িষ্ণু শক্তিবলয়ে বারবার আঘাত হানছিল। এমনকি আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে মারাঠা সেনাপতি সদাশিব রাও-এর বিশাল বাহিনী ক্ষণিকের জন্য দিল্লী দখল করে ফেলেছিল। ভারতের কোনো মুসলিম রাজা বা নবাবের শক্তি ছিল না মারাঠাদেরকে আটকানোর। তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ পত্র লিখে আফগান শাসক আহমদ শাহ আবদালিকে ভারত আক্রমণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৭৬১ সালে পানিপথের ৩য় যুদ্ধে আবদালির মুসলিম বাহিনীর হাতে মারাঠা বাহিনী পরাজিত না হলে তখনই ভারতের বুকে মুসলমানদের গণকবর রচিত হয়ে যেত। এছাড়াও উত্তর-পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব ছিল শিখদের হাতে, যারা ছিল কট্টর মুসলিম-বিদ্বেষী এবং মারাঠাদের সহায়ক। ত্রিমুখী শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করাতো দুরের কথা; ভারতের মাটিতে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করাও বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিক এরকম একটি টালমাটাল সময়ে, ১৮০৬ সালে উত্তর প্রদেশের রায় বেরেলি থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লীতে পা রাখেন এক সাহসী তরুণ। ২০ বছর বয়সী সে তরুণের নাম ছিল সায়্যিদ আহমদ (র.)। পিতার নাম সায়্যিদ ইরফান। রায় বেরেলিতে প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করার পর ইলমে মারিফাত অর্জনের তৃষ্ণা মেটাতে সায়্যিদ আহমদ (র.) বেছে নিয়েছিলেন ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর আঙ্গিনা। দিল্লীতে এসে তিনি বায়আত করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) এর বড় পুত্র ও খলীফা শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (র.) এর হাতে। পাঁচ বছর দিল্লীতে অবস্থানকালে ইমামুল হিন্দ ও তার সন্তানদের বিপ্লবী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ চিন্তাধারা সায়্যিদ আহমদ (র.)কে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। এক দিকে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা, আরেকদিকে সমাজে ছড়িয়ে থাকা শিরক-বিদআতকে অপনোদন করে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার তীব্র স্পৃহা জেগেছিল ২৫ বছর বয়সী এ মুজাদ্দিদে যামানের মনে।
প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচি
আলতাফ কাদির তার Sayyid Ahmad Barailvi গ্রন্থে লিখেছেন, দীর্ঘ সাত বছর সায়্যিদ আহমদ (র.) আমির খান নামক এক যোদ্ধার সাথে বিভিন্ন অভিযানে যোগদান করেন। সাত বছর পর সায়্যিদ আহমদ বুঝতে পারেন তিনি ভুল মানুষের সাথে পথ চলছেন। আমির খানের একমাত্র উদ্দেশ্য বিভিন্ন জায়গায় হামলা করে সম্পদ আহরণ করা এবং নিজেকে নবাবদের কাতারে শামিল করা। ওদিকে মারাঠা সা¤্রাজ্য ততদিনে বুঝতে পেরেছিল যে, ভারতের ক্ষমতা দখল করার পথে মুসলমানরা তাদের বাধা নয়; বাধা বাড়ন্ত ইংরেজ বেনিয়া শক্তি। ফলাফলস্বরূপ মুসলমানদের পিছু ছেড়ে মারাঠারা একের পর এক ইংরেজ কোম্পানির সাথে যুদ্ধে জড়াচ্ছিল। ১৮১৮ সালে ৩য় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিজয়ী হয়। আমির খান তখন ইংরেজদের সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে নবাব খেতাব পাওয়ার স্বাদ পূর্ণ করে। প্রসঙ্গত, বেশিরভাগ মুসলিম নবাবদের মূল লক্ষ্যই ছিল ইংরেজদেরকে খুশি করা।
আমির খানের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে সায়্যিদ আহমদ (র.) মনোনিবেশ করেন ভারতের মুসলিম সমাজের দিকে। কারণ মারাঠাদেরকে ঘায়েল করে ইংরেজরা তখন ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি। হাতে যেটুকু শক্তি আছে, তা নিয়ে ইংরেজ কোম্পানির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। প্রস্তুতি ও লোকবল বৃদ্ধির আশায় মুসলিম সমাজে হাত দিয়ে সায়্যিদ আহমদ (র.) প্রচ- হতাশ হন। তিনি উপলব্ধি করেন, বেশিরভাগ মুসলমান কেবল নামেই মুসলমান। ইসলামের মূল শিক্ষা ভুলে এরা ডুবে আছে নিজেদের বানানো রসম-রেওয়াজের মধ্যে। বারবারা যেটক্যাল্ফ তার Islamic revival in British India গ্রন্থে লিখেছেন, সে সময়টি ছিল সায়্যিদ আহমদের জন্য পরিপক্কতা অর্জনের সময়। অর্থাৎ তিনি অমুসলিমদের সাথে জিহাদের পণ করে মাঠে নামলেও এটি খেয়াল করেননি যে, তার ঘরেই হাজার সমস্যা।
ইতিহাসবিদ অলিভিয়ার রয় লিখেছেন, সায়্যিদ আহমদ (র.) তখন মুসলিম সমাজে প্রচলিত শিরক-বিদআতের অপনোদনে মনোনিবেশ করেন। তিনি এ আন্দোলনের নাম দেন ‘তরিকায়ে মুহাম্মাদিয়া’। দুনিয়ালোভী মৌলভীদের কাছে না গিয়ে সাধারণ জনগণের দ্বারে দ্বারে তিনি ইসলামের মূল শিক্ষা পৌঁছে দিতে শুরু করেন। এর ফল আসে আশার চেয়েও বেশি। সাধারণ মুসলমানরা দলে দলে তার দিকে হাত বাড়ায়। সায়্যিদ আহমদ (র.) উপমহাদেশের মুসলমানদের অঘোষিত আমির হয়ে দাঁড়ান।
তার এ আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ইংরেজদের মাথায় চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল। ফলাফলস্বরূপ তারা তাকে ‘ওয়াহাবি’ বলে আখ্যায়িত করতে শুরু করে। সুচতুর ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল, এই খেতাব সায়্যিদ আহমদের উত্তাল ঢেউকে থামিয়ে দেবে। কিন্তু তাদের সে কূটকৌশল সফল হয়নি। বারবারা যেটক্যাল্ফ লিখেছেন, সায়্যিদ আহমদ (র.) তিনটি জিনিসকে ইসলামের বিশুদ্ধ আকীদার সাথে সাংঘর্ষিক মনে করতেন। একটি হচ্ছে সূফীবাদের নামে ভ্রান্ত মতবাদ, আরেকটি শিয়াদের ভ্রান্ত আকীদা, আরেকটি হিন্দুদের রসম-রেওয়াজ। শিয়া ও ভ্রান্ত সূফীদের বিরুদ্ধে লাগাতার তিন বছর তিনি হাজার হাজার মুরিদীনসহ উত্তর ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছিলেন।
১৮২১ সালে সায়্যিদ আহমদ (র.) হজ্জ করতে যান। দুই বছর পর ফিরে এসে তিনি আবার দ্বীন কায়িমের স্বপ্নে মাঠে নেমে পড়েন। মারাঠা শক্তি তখন হিসাবের ভেতরেই ছিল না। অপরদিকে ইংরেজরা ছিল ধারণার চেয়েও বড় শক্তি। সায়্যিদ আহমদ (র.) তৎকালীন ভারতের অভ্যন্তরে যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করেননি। এটি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচায়ক। তিনি তাঁর কৌশলকে খানিকটা পরিবর্তন করে পাঞ্জাবকে তার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করেন। কারণ ভৌগলিক দিক থেকে হিসাব করলে, পশ্চিমে মরক্কো থেকে শুরু হয়ে মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র পূর্বদিকে একেবারে আফগানিস্তান পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে ছেয়ে আছে। এরপর পূর্বদিকে এগুলে সামনে পড়ে এক বিশাল বাধা, বৃহত্তর পাঞ্জাব। কিছু সীমান্ত এলাকা ব্যতীত পুরো পাঞ্জাবে তখন শিখদের আধিপত্য ছিল। এরপর আবার শুরু হয় মুসলমানদের আবাসভূমি (বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক)। এ দিক থেকে চিন্তা করে সায়্যিদ আহমদ (র.) পাঞ্জাব বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, পাঞ্জাব বিজয় করতে পারলে একদিকে যেমন ভারতের মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত হয়ে যাবে, অপরদিকে পাঞ্জাবকে দুর্গ বানিয়ে পূর্বদিক (বাঙাল এলাকা) থেকে ধেয়ে আসা ইংরেজ শক্তির মুকাবিলা করাও সম্ভব হবে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, পরিকল্পনাটি যুগোপযোগী ছিল।
ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা
আলতাফ কাদির লিখেছেন, সায়্যিদ আহমদ (র.) আট হাজার মুজাহিদ সঙ্গে নিয়ে পাঞ্জাবের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তবে তিনি সরাসরি পাঞ্জাব যাননি। বর্তমান ভারত ও পাকিস্তান পুরোটা ঘুরে লোকবল সংগ্রহ এবং জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচার করে করে তিনি আফগানিস্তানে পৌঁছান। কান্দাহার, কাবুল অতিক্রম করে নওশহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে শিখ রাজা বুখ্য সিং-এর বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। সে যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের সাহস, আগ্রহ-উদ্দীপনা শতগুণে বেড়ে যায়। ১৮২৬ সালে তিনি পাখতুন জাতিগোষ্ঠীর বাসস্থান পেশাওয়ারে পৌঁছান। পাখতুনদের নেতৃত্ব ছিল পাঠানদের হাতে। সায়্যিদ আহমদ (র.) সেখানে গিয়েই ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়ন করেন। পাঠানদেরকে সরিয়ে তার সাথে আগত আলিমদের হাতে তিনি নেতৃত্ব তুলে দেন। এরপর পাঞ্জাবের রাজা রনজিত সিং-এর কাছে পত্র পাঠান। পত্রে লেখা ছিল- হয় ইসলাম কবূল করো, নয় জিযিয়া দাও, নয় তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে, এ পদক্ষেপ সঠিক ছিল বলে অনুমিত হয় না। সীমান্ত এলাকার মানুষ যে ইসলামী অনুশাসনে অভ্যস্ত নয় এ বিষয়টি হয়তো তিনি বিবেচনায় আনেননি। বংশ পরম্পরায় মুসলমান হলেও এদের কাছে ইসলাম ছিল নিজেদের বানানো কিছু রসম-রেওয়াজ। তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারতে যেভাবে দাওয়াতি কার্যক্রম চালিয়েছিলেন, পেশাওয়ারেও সেরকম কার্যক্রম চালালে অবস্থা ভিন্ন হতে পারতো। সেটি না করেই তিনি তাদেরকে ইসলামী অনুশাসন মানতে বাধ্য করেছেন, যা তাঁর জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। তাছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের ক্ষমতাধর পাঠানরা তাদের ক্ষমতা বেদখল হওয়া মেনে নিতে পারেনি। তাই এদের পক্ষ থেকে বারবার বিদ্রোহ করা হয়েছে। এতে সায়্যিদ আহমদের সময় ও শক্তি দুটিই নষ্ট হয়েছে।
১৮৩০ সাল পর্যন্ত সায়্যিদ আহমদ (র.) পুরো পেশাওয়ারের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন মুসলমানরা তাকে ‘আমীরুল মুমিনীন’ খেতাবে ভূষিত করে। তবে পাঠানদের বিরোধিতাকে তিনি কাবু করতে পারেননি। সেই বছর পাখতুনদের অতর্কিত হামলায় সায়্যিদ আহমদের বাহিনীতে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। বাধ্য হয়ে বরফঢাকা শীতকালে তিনি পেশাওয়ার ত্যাগ করে কাশ্মীরের দিকে পা বাড়ান। কিন্তু কাশ্মীরে তিনি পৌঁছাতে পারেননি।
বালাকোট যুদ্ধ
১৮৩১ সালের ৬ই মে জুমুআর দিন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) এর সৈন্যরা শিখ রাজা রনজিত সিং-এর পুত্র শের সিং-এর নেতৃত্বাধীন দশ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হয়। ততদিনে সায়্যিদ আহমদের হাতে বাকি ছিল মাত্র ছয় থেকে সাতশ সৈন্য। যৎসামান্য এ রসদ নিয়ে তিনি কাশ্মীরের মানসেহরা জেলার পাহাড়ঘেরা বালাকোট প্রান্তরে যুদ্ধ শুরু করেন। স্থানীয় মুসলমানরা বিশ্বাসঘাতকতা করে শিখদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। যেসব সামন্ত ও পাঠানরা শিখদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সায়্যিদ আহমদ (র.)কে আহ্বান করেছিল, তারাই পরবর্তীতে মুসলমানদেরকে সাহায্য না করে গোপনে শিখদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। দুই ঘণ্টা স্থায়ী বালাকোটের সে যুদ্ধ ছিল কারবালা যুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়। মুসলিম বাহিনী চুড়ান্ত বীরত্বের পরিচয় দিয়ে ছোট ছোট দল বানিয়ে শিখদের আক্রমণ করতে থাকে। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক পর্যায়ে শিখদের অতর্কিত আক্রমণে শাহাদাত বরণ করেন আমীরুল মুমিনীন সায়্যিদ আহমদ (র.)। মেটিকোট ঝর্ণার পাশে পড়ে থাকা তার দেহটি প্রথমে কারও নজরে আসেনি। সৈন্যরা তার খুঁজে সবটুকু শক্তি নিয়ে তখনও লড়াই করে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে শিখদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে কিছু স্থানীয় মুসলমান কৌশলে সায়্যিদ আহমদের সৈন্যদেরকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আসার আহ্বান জানায়। দিশেহারা সৈন্যরা সেনাপতির খুঁজে পাহাড়ের চূড়ায় উঠামাত্র আগে থেকে সেখানে লুকিয়া থাকা শিখ সৈন্যরা তাদের ওপর মুহুর্মুহু আক্রমণ চালায়। এতেই মুসলিম বাহিনী পরাজয় বরণ করতে হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিমের অর্ন্ধ্র-প্রদেশ থেকে মর্দান পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা এক বীর মুজাহিদ যেন অভিমান নিয়েই চলে যান মালিক-মাওলার স্মরণে।
মাত্র ৪৫ বছরের জীবনে সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) যে তুলনাহীন কাজ সম্পন্ন করে দেখিয়েছেন, তার প্রভাব কল্পনার চেয়েও সুদূরপ্রসারী। সায়্যিদ আহমদ (র.) এর তাজদীদ, তাঁর জিহাদ, তাঁর তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া যুগ যুগ ধরে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে ইসলামের প্রচার-প্রসার, শিরক-বিদআতের অপসারণ ও আত্মশুদ্ধির মূল অনুপ্রেরণা হয়ে আসছে। সায়্যিদ আহমদ (র.) এর প্রধান দুই খলীফা হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (র.) ও হযরত মাওলানা নূর মুহাম্মদ নিযামপুরী (র.) এর সিলসিলাহ বৃহত্তর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম এলাকায় ইংরেজদের প্রতিরোধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, ইসলাম প্রচার, হিন্দুয়ানি রসম-রেওয়াজ অপসারণ, মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, ইলমে দ্বীন চর্চা, বাতিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদসহ সর্বোপরি ইসলামের যে পরিমাণ খিদমাত আঞ্জাম দিয়েছে, অন্যরা কেউ এর সিকিভাগও করতে পারেননি। এক্ষেত্রে মাওলানা কারামত আলী (র.) এর নামটি সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। ১৮৩১ সালে বালাকোট যুদ্ধে সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) শাহাদাতবরণ করলেও তাঁর আদর্শ মরেনি, তাঁর চেতনা লুপ্ত হয়নি। বরং সেদিন থেকে আজ অবধি এ উপমহাদেশের বুকে যতগুলো ইসলামী আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে আর হবে, সবগুলোই মহান বালাকোট আন্দোলনের প্রতিধ্বনি। সহস্রাব্দের ঘুনে ধরা মুসলিম সমাজে ইসলামী দাওয়াত, খিলাফত, জিহাদ ইত্যাদি শব্দগুলোকে নতুন করে চিনিয়েছেন সায়্যিদ আহমদ (র.)। ক্ষণিকের জন্য হলেও দ্বীন কায়িমের স্বপ্নকে সার্থক করেছেন সায়্যিদ আহমদ (র.)। আল্লাহর জন্য শাহাদাতের অর্থ কী- সেটি দেখিয়েছেন সায়্যিদ আহমদ (র.)। এ উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য ইসলামী চেতনার বাতিঘর হয়ে আছেন হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.)।