আসিলেন, নূরের হাসি চোখে, চাঁদের হাসি মুখে, নবী আসিলেন; ফুলের গন্ধ গায় মাখিয়া দিন দুনিয়ার বাদশা আসিলেন। আসিলেন তো, কিন্তু কেমন করিয়া? ফকির হইয়া; দুনিয়ার যত অনাথ, এতিম তাদের সঙ্গে এক হইয়া, তাদের ব্যথার ব্যথী হইয়া।
কেন? -কোল জুড়িয়া বুক ভরিয়া এমন চাঁদপারা ধন, এমন সোনার রতন, তবু আমেনা মায়ের চোখের কোণে পানি কেন, কেমন করিয়া বলিব, কেন? -নূরনবী যে বাপহারা হইয়া আসিয়াছেন। মায়ের কোলে ত সোনার চাঁদ, কিন্তু বাবা গিয়াছিলেন বাণিজ্যে; বাণিজ্যেই তিনি মারা যান। সে নবীর জন্মের ছয় মাস আগে।
তারপর কি হইল? নূরনবীর দাদা আবদুল মোত্তালেব, তিনি করিলেন কি, হালিমা নামে একজন ধাই, তাঁর কাছে নবীকে সঁপিয়া দিলেন। হালিমা তাঁকে পালন করিবেন, দেশের তাই ছিল তখন নিয়ম। ছেলে হইলে ধাইমাতে পালন করিত। হইলও তাই; হালিমা নবীকে বুকে চাপিয়া বাড়ী লইয়া গেলেন। মক্কা শরীফ হইতে সে অনেক দূরে। হজরত ত এদিকে মায়ের কোল ছাড়া হইলেন, ওদিকে আবার হালিমার কি হইল, তাই শুন। সে কিন্তু বড় খুশীর কথা।
হালিমার একটি রোগা মরা গাধা ছিল। শুকাইয়া হাড় হইয়া গিয়াছিল, চাহিতে চাহিতে পড়িয়া যাইত, আজ মরে কি কাল মরে এইরূপ অবস্থা। সেই গাধার পিঠে যখন হযরতকে লইয়া হালিমা সওয়ার হইলেন, তখন সেই রোগা মরা গাধা লাফাইয়া চলিল। তার গায়ে যেন হাতির বল হইল। রাজপুত্রের পক্ষীরাজ ঘোড়ার মত সে যেন উড়িয়া চলিল। মোটা তাজা সকল গাধার আগে সে বাড়ী পৌঁছিল।
আরও অনেক কিছু অবাক কা- ঘটিল। হালিমার দেশে আকাল পড়িয়া সকলের বড় কষ্ট হইয়াছিল। গাছপালা শুকাইয়া গিয়াছিল। মাঠে ঘাস ছিল না, কুয়ার পানি ছিল না, ছাগল ভেড়া খাইতে পাইত না। এমন সময় হজরত সেখানে যান। আর অমনি হালিমার ঘরে সুখ উথলিয়া উঠিল, চারিদিকে সুলক্ষণ দেখা দিল। ক্ষেত খামারে ফসল হইল। যব গমে হালিমার ঘর ভরিয়া গেল। কুয়া নালিতে পানি হইল। গাছে গাছে গোছায় গোছায় রাঙ্গা রাঙ্গা খেজুর খোরমা পাকিয়া উঠিল। ছাগল, ভেড়া, উট, গাধা খাইয়া তাজা হইল। লোকের কষ্ট গেল। যেন রাজপুত্র আসায় গল্পের সেই ঘুমন্ত পুরীর সকলে চোখের পলকে চোখ মেলিয়া জাগিয়া উঠিল, যেন সিংহাসনে রাজা, হাতিশালে হাতি, আর ঘোড়াশালে ঘোড়া জাগিল; যেন হাট বাজারে হাই তুলিয়া দোকানী পসারী জাগিয়া উঠিল।
কেন এমন হইল জান? তিনি যে আল্লার দয়ার মত পৃথিবীতে আসিয়াছেন। তাই তিনি যেখানে যাইতেন সেখানেই মঙ্গল হইত, সেখানেই হাসি ফুটিত।
হযরত বাড়িতে থাকেন, আর হালিমার ছেলেরা মাঠে মাঠে ছাগল চরায়। হযরতের কাছে এটা মোটেই ভাল লাগিল না। তিনি মজার সুখে বাড়ি বসিয়া থাকিবেন, আর তার দুধ-ভাইরা মাঠে মাঠে কষ্ট করিয়া বেড়াইবে, তাও কি হয়। হজরত ধাইমাকে বললেন, ‘আমার দুধ ভাইরা কোথায় যায়, কি করে? আমিও তাদের সাথে যা’বো। তারা যা করে তাই করব।” হালিমা অনেক বুঝাইলেন, কিন্তু হযরত মানিলেন না। তারপর হইতে দুধ ভাইদের সাথে মাঠে যাইয়া ছাগল চরাইতেন। এমন করে চার বছর গেল।
তারপর হালিমা বিবি হযরতকে লইয়া আমেনা মায়ের কোলে দিয়া আসিলেন। আমেনা বিবি বুকের ধন বুকে তুলিয়া লইলেন। খুশী হইয়া হালিমাকে সাধ্যমত টাকা-কড়ি, কাপড়-চোপড় বখ্শিস দিলেন। ছেলে দেখিয়া তার মনে আনন্দ ধরে না। সুন্দর শিশু মধুর দেহ, হাত পা যেন ননী দিয়া গড়া; চোখ দুটি ভাসা ভাসা, মায়া মমতায় ভরা, মুখে হাসি পোরা, রূপের ঝলক, পুণ্যের চমক। আমেনা বিবি হজরতকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরিলেন, চোখে মুখে হাজার হাজার চুমো দিলেন। কত আদর, কত সোহাগ করিলেন।
কিন্তু হজরত বেশি দিন এ সোহাগ ভোগ করিতে পারিলেন না। ছয় বছরের সময় আমেনা জননী হজরতকে ছাড়িয়া গেলেন। ছয় বছরেই আমাদের নবী বাপ-মা হারা অনাথ হইলেন। তোমরা বাপের গলা জড়াইয়া ধরিয়া কত সুখ পাও, মায়ের বুকে মাথা রাখিয়া কত মজা পাও; বাপ তোমাদিগকে কত রকম মিঠাই সন্দেশ কিনিয়া দেন, তোমরা কত সুখে খাইয়া বেড়াও; তোমাদের মা তোমাদের কত সোহাগ করেন, কত যত্ন করেন, কত কষ্ট দূর করেন।
কিন্তু অতি ছোট কালেই হজরতের এ সব সুখ মিটিয়া গিয়াছিল। সুখ করিতে তিনি দুনিয়ায় আসেন নাই। যাতে লোকের ব্যথার ব্যথী হইতে পারেন এই জন্যই তাঁর আসা। তিনি “রহমতুল্লিল আ’লামিন”- মানুষের কাছে মঙ্গল আর দয়া।
নিজে দুঃখে না পড়িলে ত পরের দুঃখ বুঝা যায় না! আগুনে পোড়ার কি যন্ত্রণা, যার গায়ে কখনও আগুন লাগে নাই, সে কি তা জানিতে পারে? যে রোজ দুই বেলা কোরমা পোলাও খায়, চাহিবার আগেই খাবার পায়, সে কি কখনও ক্ষুধার কষ্ট বুঝিতে পারে? সে কি বুঝিতে পারে ঐ যে দুয়ারে দুয়ারে দুঃখী কাঙ্গাল ভাতের জন্য কাঁদিয়া বেড়ায়, তাদের কি কষ্ট! তা’ বুঝিতে হইলে নিজে আগে ক্ষুধা সহিতে হয়; তবেই তাদের ব্যথার ব্যথী হওয়া যায়।
পরের ব্যথা বুঝবে যে
ব্যথা আগে সইবে সে।
এইজন্যই আল্লাতা’লা নূরনবীকে ছেলেবেলা হইতেই অনাথ করেন, কাঙ্গাল করিয়া দুঃখে ফেলেন। মানুষের যত রকম দুঃখ-কষ্ট হইতে পারে, সব রকম কষ্টই তিনি সহিয়াছিলেন। সেসব ক্রমে ক্রমে জানিতে পারিবে।
মা বাপ তো গেলেন। এখন থাকিলেন কেবল বুড়ো দাদা আবদুল মোত্তালেব। তিনি কি করিলেন, চোখের পানি ফেলিতে ফেলিতে হজরতকে বুকে তুলিয়া লইলেন। বুকে পিঠে করিয়া মানুষ করিতে লাগিলেন।
তোমরা মনে করিতেছ নূরনবী বুঝি এইবার দাদার কাঁধে চড়িয়া খুব কিছুদিন মজা করিবেন-তা’ নয়। দাদারও ডাক পড়িল। দুই বছর ঘুরিতে না ঘুরিতে আবদুল মোত্তালেব নবীকে ছাড়িয়া গেলেন। মায়ের বুক, বাপের কোল, দাদার পিঠ সবই শেষ হইয়া গেল। আট বছর বয়সেই সব ফুরাইল।
তারপর? তারপর আর কি হইবে, আবদুল্লার আপন ভাই আবু তালেব, তিনি হযরতের ভার নিলেন; পরম যত্নে হজরতকে পালন করিতে লাগিলেন। নূরনবীর চাচাদের মধ্যে তিনি বড়ই ভাল লোক ছিলেন। তিনি নূরনবীকে প্রাণের সঙ্গে ভালবাসিতেন। হজরত যাতে মা বাপের কষ্ট না বুঝিতে পারেন, সর্বদা সেই দিকে নজর রাখিতেন। তিনি নিজে বড়ই গরীব ছিলেন, তবুও নিজে কষ্ট করিয়া হজরতকে পালন করিতেন।
গরীবের ঘরে গরীবের যতেœ হজরত বাড়িয়া উঠিতে লাগিলেন। তোমরা যেমন দিনরাত খেলাধূলা, আমোদ-আহ্লাদ করিয়া বেড়াও, নূরনবী তেমন হাসিখেলা লইয়া থাকিতেন না। খেলিবার জন্য তিনি আসেন নাই। আশেপাশে মানুষের কষ্ট দেখিয়া তাঁর মন কাঁদিয়া উঠিত। চারিদিকে এত অন্যায়, অত্যাচার, মারামারি, কাটাকাটি দেখিয়া তাঁর প্রাণ বেদনায় ভরিয়া উঠিত। তিনি আপন মনে নিরালায় গম্ভীর হইয়া বসিয়া থাকিতেন। বসিয়া বসিয়া আপন মনে ভাবিতেন। কি যে ভাবিতেন, তা তিনিই জানিতেন। আর কেউ তার খবর রাখিত না। কখনো কখনো তিনি বাড়ী হইতে বাহির হইতেন; অনেক দূরে মাঠ, সেই মাঠের মধ্যে চলিয়া যাইতেন; আর খোলা ময়দানে দাঁড়াইয়া আল্লার সৃষ্টি দেখিতেন।
মাথার উপর ঐ সীমাহীন আকাশ, নীল আর নীল, যত দূর চোখ যায় তত দূর নীল, কত বড়Ñকত বড় এ; কোথা হইতে আসিয়াছে, কোথায় মিশিয়াছে! চারদিকে স্বভাবের সবুজ শোভা, আকাশ ছাপিয়া ভুবন ভরিয়া আলোর মালা। এই অপার শোভার মধ্যে তাঁর মন একেবারে ডুবিয়া যাইত! তিনি অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিতেন। কি যেন দেখিতেন, কার যেন ডাক শুনা যাইত; কি যেন দুঃখের সুরে প্রাণ কাঁদিয়া উঠিত। তিনি আকুল হইয়া পড়িতেন।
মাঠের ছেলেপেলেরা তাঁর মিষ্টিমধুর কথা শুনিয়া মজিয়া যাইত, তাঁর সঙ্গে খেলিতে চাহিত। কিন্তু তিনি ত আর খেলার জন্য আসেন নাই যে দলে মিশিয়া খেলা করিবেন। তিনি বলিতেন “ওগো না, মিছে আমোদ-আহ্লাদ করার জন্য মানুষের সৃষ্টি হয়নি, বড় কাজের জন্য তার জন্ম।”
কটু কথা কাহাকে বলে, কেমন করিয়া গালি দিতে হয়, তাহা তিনি মোটেই জানিতেন না। সকলের সঙ্গেই হাসিয়া কথা বলিতেন। সে হাসিতে জোছনা ফুটিত, মধু ঝরিত। সেই মিষ্ট কথা যে শুনিত, সে মুগ্ধ হইত, সেই তাঁকে ভালবাসিত।
তোমরা কি সকলের সঙ্গে তেমন মিষ্ট কথা বলিবে? কেবল খেলার কথা না ভাবিয়া কাজের কথা ভাবিবে? তাহা হইলে তিনি তোমাদিগকে ভালবাসিতেন।