৬ষ্ঠ হিজরীতে মক্কার অদূরে হুদাইবিয়া নামক জায়গায় রাসূলুল্লাহ e ও মক্কাবাসীর মধ্যে একটি সন্ধি হয়। সন্ধির অন্যতম শর্ত ছিল, “মক্কা থেকে ইসলাম কবূল করে কেউ মদীনায় আসলে তাকে আবার মক্কায় ফেরত পাঠাতে হবে। কিন্তু মদীনা থেকে কেউ মক্কায় গেলে মক্কাবাসী তাকে ফেরত পাঠাবে না।” শর্তটি ছিল কুরাইশদের। সাহাবীরা কেউ এ শর্ত মানতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ e মেনে নিলেন।
চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পরই সেখানে এসে হাজির হলেন আবূ জান্দাল ইবন সুহাইল (রা.)। কেবল ইসলাম কবূল করার কারণে মক্কার এ তরুণ বহুদিন নিজঘরে আপন পিতার দ্বারা শিকলবন্দি ছিলেন। আজই তিনি শিকল ভেঙ্গে এসেছেন, নবীর সাথে যাবেন বলে। কিন্তু বাধ সাধলো তাঁর পিতার জাহিলি অহমিকা। আবূ জান্দালের পিতা আর কেউ নন; মক্কার কুরাইশদের পক্ষে হুদাইবিয়ার সন্ধিতে সাক্ষরকারী সুহাইল ইবন আমর। রাসূল e আবূ জান্দালকে সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য বহু অনুরোধ করলেন। কিন্তু তাতে সুহাইল ইবন আমরের মন গললো না। তখন রাসূল e বললেন, “ফিরে যাও আবূ জান্দাল। আল্লাহ তোমার এবং তোমার মতো মযলুমদের জন্য একটি পথ বের করে দেবেন।” চোখ মুছতে মুছতে মযলুম সাহাবী আবূ জান্দাল (রা.) পিতার কারাগারে ফিরে গেলেন।
ক’দিন পর মদীনায় এসে হাজির হলেন আরেক মযলুম সাহাবী আবূ বাসীর (রা.)। নিজ গোত্রের অত্যাচারের পিঞ্জর ভেঙ্গে বুকভরা আশা নিয়ে তিনি রাসূলের কাছে এসেছেন। তিনি মদীনায় পৌঁছাতেই পেছনে এসে উপস্থিত মক্কার দুই ব্যক্তি। তারা রাসূল e-কে বলল, আমরা আবূ বাসীরকে নিতে এসেছি। চুক্তি অনুযায়ী আপনি তাকে ফেরত দিন। ওদিকে আবূ বাসীর অনড়। তিনি ওই যুলমের মধ্যে আর ফেরত যাবেন না। রাসূল e তাঁকে বুঝালেন, “দেখ, আমাকে চুক্তি রক্ষা করতেই হবে। তুমি ফেরত যাও। আল্লাহ তোমার জন্য একটি পথ বের করে দেবেন।”
সাহাবীদের চোখ অশ্রুসিক্ত। অনেক কিছু করতে পারতেন, কিন্তু রাসূল e করার অনুমতি দেবেন না। প্রিয়নবীর আদেশ মাথায় নিয়ে আবূ বাসীর ফিরে চললেন। যুল হুলাইফা এলাকায় যাওয়ার পর সঙ্গীদের একজনকে তিনি বললেন, “তোমার তরবারীটি খুব সুন্দর। একবার হাতে নিয়ে দেখা যাবে?” তরবারী হাতে নিয়েই চালিয়ে দিলেন তরবারীর মালিকের ওপর। সাথে থাকা অন্যজন ভয়ে মদীনায় চলে আসল। পেছনে আসলেন আবূ বাসীর। ঘটনা শুনে রাসূল e বললেন, “আফসোস, আবূ বাসীর তো যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিল। যদি তার সাথে কিছু লোক থাকত!” আবূ বাসীর বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি চুক্তির যিম্মাদারি থেকে মুক্ত। আপনি আমাকে ফেরত পাঠিয়েছেন। এখন আমার দায়িত্ব আমার নিজের কাছে।”
আবূ বাসীর জানতেন, চুক্তির কারণে রাসূল e তাঁকে মদীনায় রাখবেন না। আবার মক্কায় ফিরে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। তিনি চললেন সমুদ্রের দিকে। আল-ঈস নামক উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। ওই পথ দিয়ে কুরাইশদের ব্যবসায়ী কাফেলা সিরিয়ায় যাওয়া-আসা করত। আবূ বাসীরের কাছে তখন না ছিল ঘর-পরিবার, না খাদ্য, না পোশাক, না নিরাপত্তা। অবর্ণনীয় কষ্টে দিনগুলো কাটছিল। ক’দিন পর আবূ জান্দাল আবার পিতার শিকল ভেঙ্গে বের হলেন। মদীনায় না গিয়ে সোজা আল-ঈসে এসে আবূ বাসীরের সাথে যোগ দিলেন। বছরখানেকের মধ্যে মক্কা ও এর আশপাশ থেকে সত্তুরের অধিক মযলুম মুসলমান হিজরত করে আল-ঈসে চলে আসলেন। আবূ বাসীর ও আবূ জান্দাল সংকল্প করলেন, যাদের কারণে আমরা আমাদের নবীর কাছে যেতে পারছি না, তাদেরকেও আমরা শান্তিতে থাকতে দেব না। এরপর যখনই কুরাইশদের কোনো ক্যারাভান ওই পথ দিয়ে পার হতো, আবূ বাসীরের বাহিনী এসে তাদের ওপর হামলা করত এবং সবকিছু তছনছ করে দিত। মক্কাবাসী পড়ল মহা যন্ত্রণায়। এদের সাথে যে যুদ্ধ করবে, তারও উপায় নেই। এদের কোনো ঠিকানাই নেই। আজ এখানে, তো কাল ওখানে। আবার বিচারও দেয়া যাচ্ছে না, যেহেতু তাঁরা রাসূল e এর জিম্মাদারি থেকে মুক্ত। বাধ্য হয়ে কুরাইশ নেতৃবৃন্দ রাসূল e এর কাছে আবূ বাসীর ও তাঁর বাহিনীকে ফেরত আনার অনুরোধ করল। রাসূল e অনুরোধ মেনে নিলেন এবং ওদেরকে ফিরিয়ে আনতে পত্র পাঠালেন।
বছর-দেড় বছর ধরে প্রতিকূল পরিবেশে দিন কাটিয়ে আবূ বাসীর তখন চরম অসুস্থ। আবূ জান্দাল বলেছেন, যেদিন রাসূল e এর পত্র এসে পৌঁছাল, আবূ বাসীর সেদিন শয্যাশায়ী। বাহকের হাত থেকে রাসূল e এর পত্র নিয়ে তিনি চুমু খেলেন। এরপর পত্রটি জড়িয়ে ধরেই পৃথিবীকে বিদায় জানালেন মযলুম সাহাবী আবূ বাসীর (রা.)। যে কারণে তাঁর এতো ত্যাগ, সে ত্যাগের ফল অন্যরা ভোগ করলেও তিনি নিজে করতে পারেননি। এ জীবনে প্রিয়নবীর সাথে থাকা হয়নি আবূ বাসীরের। চির-বিদ্রোহী সাহাবী আবূ বাসীর (রা.) প্রিয় নবীর সাথে সাক্ষাৎ না করেই আল-ঈসে সমাহিত হয়ে রইলেন। ঘটনাটি সহীহ বুখারী, সুনান আবূ দাঊদ, বাইহাকীসহ বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।
এর আগে, ৪র্থ হিজরীর একেবারে শুরুর দিকের কথা। সাহাবীরা তখনও উহুদ যুদ্ধের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেননি। এমতাবস্থায় জানা গেল, হুযায়ল গোত্রের নেতা খালিদ ইবন সুফইয়ান গোপনে মদীনায় আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র করছে। এ লক্ষ্যে সে বেদুঈন গোত্রগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তার দল ভারি করছে। সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ e তাঁর সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন উনাইসকে খালিদ ইবন সুফইয়ানের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য প্রেরণ করলেন। অমিত সাহসী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন উনাইস মরুভূমি পাড়ি দিয়ে একাকী হুযায়ল গোত্রের আবাসভূমিতে পৌঁছালেন। এরপর সুযোগ বুঝে এক সুকৌশলী অভিযানের মাধ্যমে তিনি খালিদ ইবন সুফইয়ানকে হত্যা করতে সমর্থ হলেন। খালিদ ইবন সুফইয়ানকে হত্যা করার সাথে সাথে হুযায়ল গোত্রের ষড়যন্ত্র ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। সফলভাবে কার্য সম্পাদন করে আবদুল্লাহ ইবন উনাইস যখন মদীনায় ফিরলেন, তখন রাসূলুল্লাহ e উপহারস্বরূপ তাঁকে নিজের লাঠি মুবারক দান করেছিলেন। বলেছিলেন, “এই লাঠি তোমার কাছে রেখ। এর দ্বারা কিয়ামতের দিন আমি তোমাকে পরিচয় করব।” আবদুল্লাহ ইবন উনাইস (রা.) জীবনভর এই লাঠি হাতছাড়া করেননি। এমনকি ইন্তিকালের আগে তিনি ওসীয়ত করে গিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ e এর লাঠি যেন তাঁর সাথে তাঁর কবরে দিয়ে দেওয়া হয়। তাই তাঁকে দাফন করার সময় ওই লাঠিও তাঁর সাথে কবরে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হওয়ার কারণে হুযাইল গোত্র চরম ক্রোধান্বিত হলো এবং সাহাবীদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার পণ করল। সম্মুখযুদ্ধে মুসলমানদেরকে পরাজিত করার সামর্থ তাদের ছিল না। তাই তারা একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিল। তারা তাদের পার্শ্ববর্তী আদ্বাল ও কাররাহ নামক দুটি বেদুইন গোত্রের কিছু লোককে টাকা-পয়সা দিয়ে মদীনায় পাঠাল। এদের দায়িত্ব ছিল, কৌশলে কয়েকজন সাহাবীকে মদীনা থেকে বের করে এনে হুযায়ল গোত্রের হাতে তুলে দেয়া। ওই ভাড়াটে লোকেরা মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবূল করার ভান করল এবং কয়েকজন সাহাবীকে নিজেদের এলাকায় নিয়ে আসতে চাইলো। তারা রাসূলুল্লাহ e-কে বলল, আমাদেরকে কুরআন শেখানোর জন্য আপনি আপনার কয়েকজন সাহাবী আমাদের সাথে দিয়ে দিন। তাদের আগ্রহ দেখে রাসূলুল্লাহ e তাঁর প্রিয় সাহাবী আসিম ইবন সাবিত (রা.) এর নেতৃত্বে ১০ জন সাহাবীকে তাদের সাথে প্রেরণ করলেন। মদীনা শরীফ থেকে রওয়ানা দিয়ে সাহাবীরা যখন আর-রাজী নামক কূপের পাশে পৌঁছলেন, তখনই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত কয়েকশো মানুষ তাঁদেরকে ঘেরাও করল। বুঝতে বাকি রইল না যে এটি কাফিরদের পাতানো ফাঁদ। সাহাবীরা তৎক্ষণাৎ পাশের একটি ছোট বালুর টিলায় আশ্রয় নিলেন এবং হাতে যা কিছু সরঞ্জাম ছিল, তাই নিয়ে কাফিরদের মুকাবিলা করতে শুরু করলেন।
ওই এলাকায় সুলাফা নামক এক মহিলা ছিল, যার দুই ছেলেকে সাহাবীদের দলনেতা আসিম ইবন সাবিত (রা.) উহুদ যুদ্ধে হত্যা করেছিলেন। তাই সুলাফা শপথ করেছিল, সে আসিমের মাথার খুলিতে মদ পান করবে। সে ঘোষণা দিয়েছিল, যে আসিমের মাথা এনে দিতে পারবে তাকে একশটি উট পুরস্কার দেয়া হবে। আসিম সেটি জানতেন। যুদ্ধ চলাকালীন যখন তিনি বুঝতে পারলেন আর বেঁচে ফেরা সম্ভব হবে না, তখন আল্লাহর দরবারে হাত উঠালেন, “হে আল্লাহ, আমাদের নবীর কাছে তুমি আমাদের সংবাদ পৌঁছে দিও। জানিয়ে দিও, আমরা লড়াই করে শহীদ হয়েছি। হে আল্লাহ, এই দিনের বেলা আমি তোমার জন্য আমার প্রাণ কুরবান করছি। অতএব রাতের বেলা তুমি আমার দেহকে রক্ষা করো। আমি আমার মাথার খুলিকে ওই মহিলার মদের পেয়ালা বানাতে চাই না।”
যুদ্ধ শেষে রাতের বেলা কাফিররা আসিম (রা.) এর দেহটি খুঁজতে শুরু করল। সবার মনে মনে একশো উট পুরস্কার পাওয়ার লোভ। এক সময় তারা টিলার ওপর তাঁর দেহ খুঁজে পেল। যেইমাত্র তারা দেহটি তুলার জন্য সামনে অগ্রসর হলো, ঠিক ওই সময় এক ঝাক মৌমাছি বা বোলতা এসে আসিমের দেহের ওপর ভীড় করল, যেন তারা দেহটিকে পাহারা দিচ্ছে। কাফিররা ব্যর্থ হয়ে আপাতত ক্ষান্ত দিলো। ভাবলো, দিনের বেলা এসে আসিমের মাথা কেটে নেওয়া যাবে। পরদিন সকালে তারা যখন তাঁর মাথা কাটতে গেল, তখন আচমকা এক পশলা বৃষ্টি হলো। বৃষ্টির পানিতে মরুভূমির বালুতে একটি খরস্রোতা নদী উৎপন্ন হলো এবং সোজা বয়ে চলে টিলার ওপরে উঠে আসিমের দেহকে ভাসিয়ে নিয়ে মরুভূমিতে গায়েব হয়ে গেল। আসিম আল্লাহর কাছে যে আকুতি জানিয়েছিলেন, আল্লাহ তাঁর বান্দার সেই আকুতির মান রেখেছিলেন। বিনা মেঘে মরুভূমিতে নদী তৈরি করে আল্লাহ তাঁর বান্দার দেহটি চিরতরে সরিয়ে নিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। আজকের দিন পর্যন্ত কেউ জানে না, আসিম ইবন সাবিত (রা.) এর দেহটি কোথায় আছে।
অবশেষে এক অসম যুদ্ধ শেষ হলো। ১০ জনের মধ্যে ৮ জন সাহাবী তথায় শাহাদাত বরণ করলেন। বাকি দুজন, খুবাইব (রা.) ও যায়িদ (রা.)-কে কাফিররা বন্দি করল। খুবাইবকে তারা বিক্রি করে দিলো একটি গোত্রের কাছে, যারা পরবর্তীতে তাঁকে শহীদ করেছিল। একইভাবে যায়িদকে তারা বিক্রি করে দিলো মক্কার কুরাইশদের কাছে। কুরাইশ নেতা সাফওয়ান ইবন উমাইয়া যায়িদ (রা.)-কে কিনে নিয়ে গেল হত্যা করার জন্য। মক্কায় তাঁকে বন্দি অবস্থায় দেখে কুরাইশ নেতা আবূ সুফইয়ান তাঁকে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি, সত্য কথা বলো। তোমার কি মনে হচ্ছে না যে, যদি তোমার পরিবর্তে তোমার নবী এখানে বন্দি থাকতেন, আর তুমি তোমার পরিবারের সাথে থাকতে, তাহলে কত ভালো হতো?” যায়িদ (রা.) জবাব দিলেন, “আল্লাহর কসম, আমার নবী বন্দি হওয়া তো দূরের কথা, তাঁর পায়ে একটি কাঁটা বিদ্ধ হওয়ার চাইতেও আমি আমার বন্দিত্বকে অধিক পছন্দ করি।” জবাব শুনে আবূ সুফইয়ান বলেছিলেন, “মুহাম্মাদ e এর সাহাবীরা তাঁকে যতটা ভালোবাসে, দুনিয়ার কোনো মানুষ অন্য মানুষকে ততটা ভালোবাসে না।”
সাহাবায়ে কিরামের পুরো জীবন আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল e ও আল্লাহর দ্বীনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও অটুট অঙ্গীকারে পূর্ণ ছিল। তাঁদের অপরিসীম ত্যাগ ও কুরবানীর ফলে আজ আমরা ইসলাম পেয়েছি। তাঁরা ক্ষুধার কষ্টে পেটে পাথর বেঁধেছেন বলে, তাঁরা মরুভূমির উত্তপ্ত গরমে শরীরের হাড় গলিয়েছেন বলে, তাঁরা ঘোড়ায় চড়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়েছেন বলে, তাঁরা তাঁদের তাজা রক্তে কাফিরদের তরবারী রাঙিয়েছেন বলে আজ আমরা মুসলমান হওয়ার বড়াই করতে পারছি। তাঁদের এই ত্যাগ ও কুরবানীর বিনিময় দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব-ই নয়। এই বিনিময় স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দেবেন, হাশরের ময়দানে দেবেন।

