Logo
কুরআন তিলাওয়াতের বাহ্যিক নীতিমালা
ইমাদ উদ্দীন তালুকদার
  • ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সপ্তম নিয়ম: তিলাওয়াতে সাজদা

একজন মানুষকে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের অধিকারের প্রতি যত্নশীল থাকা উচিত। অর্থাৎ, যখন সে সিজদার কোনো আয়াত তিলাওয়াত করবে, তখন সে সিজদা করবে। একইভাবে, যদি সে অন্য কারো তিলাওয়াতকৃত আয়াত শুনে থাকে এবং সেখানে সিজদা আসে, তখনও তাকে সিজদা করতে হবে। তবে সিজদা শুধুমাত্র তখনই করা যায় যখন ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় থাকে।

কুরআনে মোট সিজদার আয়াত ১৪টি, আর সুরা হজে ২টি সিজদা রয়েছে তবে সোয়াদ সুরায় সিজদা নেই।[১] সিজদার পদ্ধতি হলো, আদায়ের ন্যূনতম শর্ত অন্তত সেজদার জন্য মাথা মাটিতে রাখা আর পূর্ণাঙ্গ হলো, “আল্লাহু আকবার” বলার মাধ্যমে সিজদা করা এবং আয়াতের অর্থ অনুযায়ী দুয়া করা।

উদাহরণস্বরূপ:

যখন কেউ এ আয়াত পড়বে[২]Ñ

خَرُّوا سُجَّدًا وَسَبَّحُوا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لَا يَسْتَكْبِرُونَ

তখন ব্যক্তি পড়বে-

اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ السَّاجِدِينَ لِوَجْهِكَ، الْمُسَبِّحِينَ بِحَمْدِكَ، وَأَعُوذُ بِكَ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْتَكْبِرِينَ عَنْ أَمْرِكَ

“হে আল্লাহ, আমাকে সেই বান্দাদের মধ্যে করো যারা তোমায় সিজদা করে এবং যারা তোমার তাসবীহ পড়ে। আমাকে রক্ষা করো যে আমি তোমার আদেশ অগ্রাহ্য করে অহংকারীদের শামিল হওয়া থেকে।”

যখন কেউ এই আয়াত পড়বে[৩]Ñ

وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا

তখন ব্যক্তি এই দুআ পড়বে-

اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ البَاكِينَ إِلَيْكَ وَالخَاشِعِينَ لَكَ

“হে আল্লাহ, আমাকে তোমার কাছে ক্রন্দনকারী এবং তোমার জন্য বিনয়ীদের অন্তর্ভূক্ত করো ।”

এরকম করে প্রতিটি সিজদার আয়াতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দুআ করা।

এই সেজদার জন্য নামাজের শর্তগুলোই প্রযোজ্য। যেমন, আউরাহ ঢেকে রাখা, কিবলামুখী হওয়া, পোশাক ও শরীরের পবিত্রতা, ও নাপাকি থেকে মুক্ত থাকা। আর যে ব্যক্তি সেজদার আয়াত শুনার সময় পবিত্র অবস্থায় না থাকে সে যখন পবিত্র হবে, তখন সেজদা করবে। এই সেজদার পরিপূর্ণতা সম্পর্কে বলা হয় যে, ‘তাকবীর তাহরিমা’ (হাত উঠিয়ে) বলবে, তারপর সেজদায় যাওয়ার জন্য তাকবীর বলবে, তারপর উঠার সময় তাকবীর বলবে, তারপর সালাম ফিরাবে। আর কেউ কেউ এতে আরও যুক্ত করেছেন, তাশাহহুদও পড়তে হবে। তবে এর কোনো ভিত্তি নেই; এটি শুধু নামাজের সেজদার সঙ্গে কিয়াস (অনুরূপ তুলনা) করা, যা বাস্তবসম্মত নয় ও দুর্বল। কারণ সেজদার ব্যাপারে সরাসরি নির্দেশ এসেছে সুতরাং সেজদার ক্ষেত্রে সেই নির্দেশই অনুসরণ করা উচিত। আর সেজদায় যাওয়ার তাকবীরটি শুরুর সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ, আর এর অতিরিক্ত বিষয়গুলো দুর্বল ও দূরবর্তী।[৪] “অতঃপর, মুছাল্লির উচিত ইমাম সেজদা করলে সেজদা করা, কিন্তু সে মা’মুম অবস্থায় (ইমামের পেছনে নামাজ পড়ার সময়) নিজের তিলাওয়াতের জন্য সেজদা করবে না।

অষ্টম নিয়ম: তিলাওয়াত শুরু ও শেষ করা

তিলাওয়াত শুরু করার সময় পড়বে,

أَعُوذُ بِاللَّهِ السَّمِيعِ الْعَلِيمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ، رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونَ

অর্থাৎ, আমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকটে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, রব! আমি শয়তানদের কুমন্ত্রণা, এবং তাদের উপস্থিতি থেকেও আপনার নিকট আশ্রয় চাই।

এরপর তিলাওয়াত করবেন, قل أعوذ برب الناس তথা সুরা নাস এবং الحمد لله তথা সূরা ফাতিহা। এই দুটি সূরা পাঠ করা এখানে আদব ও উত্তম আমলের অন্তভূর্ক্ত। তিলাওয়াত সমাপ্ত হলে পড়া উচিত বলা,

صَدَقَ اللَّهُ تَعَالَى وَبَلَّغَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، اللَّهُمَّ انْفَعْنَا بِهِ وَبَارِكْ لَنَا فِيهِ، الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، وَأَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الْحَيَّ الْقَيُّومَ

—“আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন এবং আল্লাহর রাসূল ব তা যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। হে আল্লাহ! কুরআন দ্বারা আমাদের উপকৃত করুন এবং এতে আমাাদের বরকত দান করুন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টির প্রতিপালক। এবং আমি ক্ষমা চাই সেই চিরঞ্জীব স্বত্তা আল্লাহর নিকট।”

যখন তিলাওয়াত চলাকালীন কোনো তাসবীহ তথা আল্লাহর পবিত্রতার আয়াত পাবে, তাহলে তাসবীহ ও তাকবীর বলবে; যখন কোনো আয়াতে দোয়া বা ইস্তিগফার পায়, তাহলে দোয়া এবং ইস্তিগফার করবে; যদি কোনো আয়াত কিছু চাওয়া বা প্রার্থনা সম্পর্কিত আসে, তাহলে প্রার্থনা করবে; যদি কোনো আয়াত ভীতিপ্রদর্শন সম্পর্কিত আসে, তাহলে ইস্তিয়াযা তথা আউযুবিল্লাহ পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয়। এই আযকার সে মুখ উচ্চারণ করে পড়বে অথবা মনে মনে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ সে বলতে পােও,

سُبْحَانَ اللَّهِ، نَعُوذُ بِاللَّهِ، اللَّهُمَّ ارْزُقْنَا، اللَّهُمَّ ارْحَمْنَا

হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবী করীম ব—এর সঙ্গে নামাজ পড়েছি (রাতের বেলা নফল নামাজের সময়)। তিনি সূরা আল—বাকারা পড়া শুরু করলেন, রহমতের পড়লে দোয়া করেন, আয়াতে আজাব পার হলে আশ্রয় চাইলেন, আর যখন আয়াতে তানযীহ (পরিপূর্ণ পবিত্রতা) পড়েন, তখন তাসবীহ বলতেন। পড়া শেষ করলে তিনি যা বলতেন, সেটা হলো,

اللَّهُمَّ ارْحَمْنِي بِالْقُرْآنِ، وَاجْعَلْهُ لِي إِمَامًا وَنُورًا وَهُدًى وَرَحْمَةً، اللَّهُمَّ ذَكِّرْنِي مِنْهُ مَا نَسِيتُ، وَعَلِّمْنِي مِنْهُ مَا جَهِلْتُ، وَارْزُقْنِي تِلَاوَتَهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ، وَاجْعَلْهُ لِي حُجَّةً يَا رَبَّ الْعَالَمِينَ

অর্থাৎ: “হে আল্লাহ! কোরআনের মাধ্যমে আমার উপর রহম করো, এটিকে আমার জন্য নির্দেশক, আলোর উৎস, হেদায়েত এবং করুণার কারণ বানাও। হে আল্লাহ! এতে যা আমি ভুলে গিয়েছি তা আমাকে স্মরণ করাও, যা আমি জানি না তা আমাকে শিখিয়ে দাও। দিনরাত আমাকে কোরআন তেলাওয়াত করার তাওফীক দাও। এটিকে আমার জন্য সাক্ষ্য বানাও, হে জগতের প্রতিপালক।”[৫]

[১] ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ ও ইমাম শাফিয়ী রাহিমাহুল্লাহের মত সুরা হাজ্জে সিজদার আয়াত হচ্ছে ২টি। আর ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ, সাহেবাইন তথা হানাফী মাযহাবের মত অনুয়ায়ী এখানে সিজদা ১টি এবং অন্যটি হচ্ছে সুরা স্বোয়াদে। —ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন বি—শারহি ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন ৪/৪৮০; আল—কাউলুস সাদীদ ফিল কিরআতি ওয়াত তাজভীদ।

[২] সূরা সাজদা, আয়াত: ১৫

[৩] সূরা ইসরা, আয়াত: ১০৯

[৪] তাই নিয়ত করে আল্লাহু বলেই সিজদা করবে এবং রুকুর তাসবীহ পড়ে দাঁড়িয়ে যাবেÑ এটাই হচ্ছে নিয়ম, অতিরিক্ত কিছুর প্রয়োজন নেই।—আল—মাবসুত লিস—সারাখসী ২/১০, আল—বাহরুর রায়েক ২/১২৬, আদ্দুররুল মুখতার ২/১০৭

[৫] ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং—৭৭২; সুনান তিরমিযী, হাদীস নং—২৬২;

ফেইসবুকে আমরা...