Logo
ব্যর্থতা মানে স্বপ্নের মৃত্যু নয় : প্রসঙ্গ ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

বিগত এক শতাব্দীতে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি ঘটনা ঘটেছিল সম্ভবত ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালে। ১৯৪৭ ছিল দুই শতাব্দীর ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে উপমহাদেশের আযাদীর উপলক্ষ্য। ’৪৭ উপমহাদেশের মানচিত্রে শুধু একটি সীমান্তরেখা টানেনি, বরং ইতিহাসের গভীরে বসবাস করা কোটি কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, আত্মপরিচয় ও রাজনৈতিক চেতনার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষের দীর্ঘ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে যে ‘স্বাধীনতা’ এলো, তার রূপ ছিল দ্বিখণ্ডিত ও রক্তাক্ত। ওই সময় বৃহত্তর বাংলা ও পাঞ্জাবের মানুষ যত রক্ত বইয়েছে, অন্যদেরকে ততটুকু বহাতে হয়নি। ১৯৪৭ সালে জন্ম নেওয়া ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রদ্বয়ের উদ্ভব কেবল রাজনৈতিক কৌশল বা ঔপনিবেশিক নীতির ফল নয়; এর পেছনে ছিল ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস ও জাতিসত্তার এক গভীর সংঘাত ও পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া। এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত শক্তি ছিল বাংলার মুসলমান সমাজ, বিশেষত আলিম সমাজ। তাঁরা শুধু মসজিদ-মাদ্রাসায় ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণে সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তারা হয়ে উঠেছিলেন সমাজজাগরণ, শিক্ষা বিস্তার, কৃষক আন্দোলন, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগের অংশ। ১৯১৯ সালের খেলাফত আন্দোলন বাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় মূলত আলিম-উলামার হাত ধরে। আযাদীর আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা বাঙালি আলিমদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা মনীরুজ্জামান ইসলামাবাদী, পীর বাদশা মিয়া, মাওলানা আকরাম খাঁ, মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী, মাওলানা আতহার আলী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী প্রমুখ। এরপর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো নেতারা পরে মুসলিম লীগে যুক্ত হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বাংলার মাদরাসাগুলো হয়ে ওঠে রাজনৈতিক চেতনার কেন্দ্র, যেখানে তরুণ আলিমরা কেবল ধর্মীয় নয়; বরং রাজনৈতিক দায়িত্বও নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। পাকিস্তান আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল যে মুসলিম লীগ, তার অনেক নেতা উর্দুভাষী বা পাঞ্জাবী হলেও বাংলার মুসলমানদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ঘোষণার পর, বাংলার মুসলিম জনসাধারণ থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী সমর্থন এসেছিল এই আলিম সমাজ, পীর-মাশাইখ ও শিক্ষিত মুসলমানদের মিলিত প্রচেষ্টায়। এর অন্যতম কারণ ছিল, বাংলার বৃহত্তর আলিম সমাজ দ্বীনি ট্রেডিশনের দিক থেকে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (র.)-এর আদর্শিক অনুসারী ছিলেন। ফলে শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (র.)-এর ব্রিটিশবিরোধী ফাতওয়া ও তৎপরবর্তী সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.)-এর আন্দোলন বাংলার আলিম সমাজকে সমভাবে প্রভাবিত করেছিল। বস্তুত শাহ আব্দুল আযীয (র.) যে জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) যে জিহাদ পরিচালনা করেছিলেন, তা এ দেশের আলিম সমাজ অব্যাহত রেখেছেন তাঁদের বুকের রক্ত দিয়ে।

বাংলার বহু মুসলমান, বিশেষত গ্রামের কৃষক শ্রেণি, মুসলিম মধ্যবিত্ত ও আলিম সমাজ পাকিস্তান চেয়েছিলেন একটি নির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষা থেকে। তাঁদের দৃষ্টিতে, এই রাষ্ট্র হবে এমন এক ভূখণ্ড, যেখানে মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষার আলোকে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়বে। হিন্দু জমিদারি নিপীড়ন থেকে মুক্তি, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ঘুচানো এবং ইসলামী আইন ও মূল্যবোধে গঠিত একটি সমাজব্যবস্থা—এসবই ছিল পাকিস্তান ভাবনার অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণা। তাদের কল্পনায় পাকিস্তান ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, ধর্মপ্রাণ, কৃষক-মেহনতি মানুষের রাষ্ট্র, যেখানে তারা সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে। তৎকালীন সমাজে বাংলার মুসলমানদের মাঝে শিক্ষা, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোয় পিছিয়ে পড়ার যে বাস্তবতা ছিল, তার বিপরীতে পাকিস্তান একটি মুক্তির স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়। আমার দাদা, উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুযুর্গ, আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.) আযাদী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাঁর মুখ থেকে সে সময়কার কিছু ঘটনা আমি শুনেছি। সে সময় যেসব উলামা-মাশাইখ দ্বিজাতিতত্ত্বের পক্ষে ছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন ছিল, উপমহাদেশের মুসলমানদের অবর্ণনীয় ত্যাগের ফলে প্রাপ্ত এই নতুন দেশ (পাকিস্তান) সত্যিকারের একটি ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে উঠবে। বিজাতীয় আধিপত্য হতে মুক্ত থাকবে। দ্বীন, আদর্শ ও অধিকারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ কথাটিকে তাঁরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারের একটি কাঠামো হিসেবেও কল্পনা করেছিলেন।

তবে ১৯৪৭-এ রাষ্ট্র পাওয়ার পর যে বাস্তবতা দেখা দিল, তা ছিল অনেকটাই ভিন্ন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণে পূর্ববাংলার মানুষের, বিশেষ করে আলিম সমাজের কোনো দৃশ্যমান প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার বদলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে দ্বৈরথ, এবং পশ্চিম পাকিস্তান-কেন্দ্রিক নীতিনির্ধারণে পূর্ববাংলার মানুষের আকাঙ্ক্ষা ম্লান হতে শুরু করে। মুসলিম পরিচয়ের পাশাপাশি বাংলার মানুষ নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচিতিকেও ধারণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্র তা মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে আইয়ূব খানের ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তান যে পথে হেঁটেছিল, তাতে অনেক আলেম ও বুদ্ধিজীবী, যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলেন, তাঁরাও পরে হতাশ হয়ে পড়েন।

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে যে, কেন বাংলার মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হলো না? অনেক কারণ আছে, তবে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে ঔপনিবেশিকতার ছাপ। ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় ঠিকই ধর্মের ভিত্তিতে, কিন্তু তার রাজনৈতিক কাঠামো ঔপনিবেশিকতার ছায়া থেকে বের হতে অপারগ ছিল।

তবে তার মানে এই নয় যে, ইসলামী মূল্যবোধ, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষা, শোষণ থেকে মুক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে তাড়িত হয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হওয়া বাংলার মুসলমান, বিশেষত উলামা-মাশাইখের স্বপ্ন ভুল ছিল। যারা উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ ও বিংশ শতকের শুরুর দিকে বৃহত্তর বাংলা অঞ্চলে উচ্চশ্রেণির হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যাপারে পড়েছেন, তাদের মনে সংশয় থাকার কথা নয় যে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে মুসলমানদের শিক্ষা ও ভোটাধিকার নিয়ে ব্রিটিশদের সাথে মুসলিম নেতৃবৃন্দের আলাপ-আলোচনা, ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠন, ১৯১৯ সালের খেলাফত আন্দোলন ও সর্বোপরি একটি ইসলামী রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে বাংলার মুসলমানরা যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন যৌক্তিক ছিল। অন্তত আজকে ভারতীয় মুসলমানদের করুণ দশা দেখার পর দাবি করেই বলতে পারি যে, সেই স্বপ্ন আজও যৌক্তিকতা হারায়নি।

সময় পেরিয়ে আসে ১৯৭১ সাল, বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক সংগ্রাম। ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’— এই তিনটি আদর্শ ছিল নতুন রাষ্ট্র গঠনের মৌলভিত্তি। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক শৃঙ্খল মোচনের জন্য ছিল না, বরং একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের স্বপ্ন ছিল এর অন্তরে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই স্বপ্ন কীভাবে ধূলিসাৎ হলো, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে একটি সফল রাষ্ট্র গড়ার প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই দেখা যায় চরম অদক্ষতা, দলীয় প্রভাব-প্রতিপত্তির অপব্যবহার এবং সর্বোপরি সীমাহীন দুর্নীতির বিস্তার। সরকারি প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শুরু হয় আওয়ামীলীগের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ। “লয়্যালটি হলো মেরিট” এই দর্শনে নিয়োগ, পদোন্নতি ও সুযোগ বণ্টিত হতে থাকে। দলীয় পরিচয়বিহীন সাধারণ নাগরিক রাষ্ট্রের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে থাকেন। রাজনৈতিক মতভেদকে শত্রু মনে করা শুরু হয়, যার ফলাফল ছিল গণতন্ত্রের বিকাশে স্থবিরতা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য ও দান আসতে থাকে ব্যাপক হারে। এই অর্থ ও সম্পদ গরিব মানুষের দুঃখ মোচনে না গিয়ে চলে যায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমলা ও দলীয় ব্যবসায়ীদের হাতে। চাল, তেল, বস্ত্র, পুনর্বাসন সবখানেই ছিল কমিশন, সিন্ডিকেট ও কালোবাজারির জয়জয়কার। সেসময়ের অনেক বিদেশি কূটনীতিক এবং প্রতিবেদক লিখেছিলেন, “Corruption is becoming a national character.” স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আশা ছিল, সবার জন্য সমান মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো বটেই; প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অবহেলায় ফেলে রেখে এক শ্রেণির ‘নকল মুক্তিযোদ্ধা’ হয়ে ওঠেন রাজনীতি ও সুযোগের মালিক। ১৯৭৪ সালে ‘বিশেষ ক্ষমতা আইন’ এবং পরে ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্নকে চুরমার করে দেয়। অসংখ্য পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়, বিরোধী মত দমন করা হয়, বন্দি করা হয় অনেক বুদ্ধিজীবীকে। যে রাষ্ট্র মানুষের কথা বলার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল, সে রাষ্ট্রই হয়ে ওঠে ভয় ও চুপচাপ থাকার জায়গা। সাম্যের গান গেয়ে দেশ স্বাধীন করা কৃষক-শ্রমিক-নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগেনি। বড় ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতাদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও, খাদ্য সংকটে ১৯৭৪ সালে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ না খেয়ে থাকেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। দুর্নীতি, চোরাচালান ও মজুদদারির ফলে সেই দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ রূপ নেয়।

আজ স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। ২৬শে মার্চ ও ১৬ই ডিসেম্বরের নান্দনিক কুচকাওয়াজের ভিড়ে আমরা ভুলে গেছি, যে ন্যুনতম নাগরিক অধিকার আমরা এ রাষ্ট্রের কাছে চাই, সেটি পাওয়া হয়নি। সাধারণ নাগরিকের পক্ষে এ দেশে অধিকার পাওয়া অসম্ভব, যতক্ষণ না কারও বড় কোনো রাজনৈতিক পরিচয় থাকবে। এটি একটি প্রায়-ব্যর্থ রাষ্ট্রের উদাহরণ নয় কি? তবুও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, এতসব ব্যর্থতার পরও ১৯৭১ এর সংগ্রাম ও স্বপ্ন এবং সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের মৃত্যু ঘটেনি।

গত বছর আমাদের জাতীয় জীবনে আসে আরেক মোড় পরিবর্তনকারী অধ্যায়— জুলাই গণঅভ্যুত্থান। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পনের বছরের আওয়ামী স্বৈরশাসনের। এক বছর আগে বাংলাদেশের জনগণ বৈষম্য, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, স্বৈরাচার, প্রাতিষ্ঠানিক ইসলামবিদ্বেষ ও ভারতীয় আধিপত্যের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে রাস্তায় নেমে রক্ত দিয়েছিল। সেই রক্ত স্বৈরাচারের মসনদকে উলটে দিয়েছিল সত্য; কিন্তু স্বৈরাচারী মানসিকতার পরিবর্তন কি ঘটেছে? এমন তো নয় যে, স্বৈরাচার কেবল হাসিনার একক বৈশিষ্ট্য। আমাদের রাষ্ট্রের যে কাঠামো, তাতে যে কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার বহু স্বপ্ন দেখিয়ে দায়িত্ব নিয়েছিল। আজ সেসব স্বপ্নের অনেকটাই ফিকে হতে দেখা যাচ্ছে। এটি কি শুধুই ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ব্যর্থতা? এই ভঙ্গুর ব্যবস্থায় ক্ষমতা গ্রহণ করে ইউনুস না পেয়েছেন প্রশাসনের সহযোগিতা, না পুলিশ-আর্মির, না রাজনৈতিক দলগুলোর, না সংবাদমাধ্যমের। বরং সবাই যার যার স্বার্থরক্ষা ও আখের গোছাতেই ব্যস্ত ছিল। বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রশাসন দখল ও ক্ষমতা লাভের জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল, আজও তারা সেই প্রচেষ্টায় রত। তাই, ইউনুস একা না; ব্যর্থতা যা হয়েছে, তার দায় পুরো জাতির। আমরা এখনও একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী (Polity) হয়ে উঠতে পারিনি। তাই আমাদের দ্বারা একটি সফল রাষ্ট্রও গঠিত হচ্ছে না। যতই ৪৭, ৭১, ২৪ আমাদের ওপর দিয়ে আসুক, আমরা যদি একটি সফল রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্ক্ষা না করি, তাইলে কোনো জাদুকর এসে আমাদেরকে আজকের দুরাবস্থা থেকে টেনে তুলতে পারবে না।

শেষ করছি প্রবন্ধের মূলভাবটি পুনঃব্যক্ত করে। ১৯৪৭ ও ১৯৭১ সালের সংগ্রামের ফলাফল খুব যে সফল নয়, তা তো আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। তবুও জানি এবং বিশ্বাস করি যে, ৪৭ ও ৭১ এর স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা মিথ্যা ছিল না৷ অতএব আজকের ব্যর্থতার পরও ওই একই সূত্র ধরে বলতে চাই, ২৪ তথা জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা মিথ্যা ছিল না। আমরা জাতি হিসেবে আবারও ব্যর্থতায় আচ্ছাদিত হতে পারি। তবে এই ব্যর্থতা আমাদের জাতীয় স্বপ্নের মৃত্যু ঘটাতে পারবে না। এই দৃঢ়বিশ্বাসটি আমাদের রাখতেই হবে।

 

ফেইসবুকে আমরা...