বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় দ্বীনি দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা এক নতুন আবশ্যকীয়তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বের চিন্তাগত উন্নতির সাথে সাড়ে চৌদ্দশ বছরের ইসলামের সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নতি তাল মিলাতে পারছে কি না সে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার যথেষ্ট কারণ আজ বিদ্যমান। গত দেড় সহস্রাব্দব্যাপী মুসলমানদের যে কেবল ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে তা কিন্তু নয়। স্বীকার করতে কষ্ট হলেও সত্য যে, অগণিত সংখ্যক সামাজিক-রাজনৈতিক এমনকি দ্বীনি অবনমনও এ উম্মাহ প্রত্যক্ষ করেছে। কেবল দ্বীনি দিক নিয়েও চিন্তা করলে থমকে যাওয়ার মতো সুদূর ও অদূর আমাদের আছে। রাসূলুল্লাহ সা. এর মুবারক যুগ শেষ হতেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিভিন্ন ভ্রান্ত গোষ্ঠী আজ তাদের রঙ হারিয়েছে বটে, তবু ভিন্ন নামে আজও বিশ্বব্যাপী তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তৎকালীন খারিজী, রাফিজী, মুতাযিলা প্রমুখ ফিরকার সাথে আজকের ওয়াহাবী-মাদখালী, আহলে কুরআন, প্রগ্রেসিভ ইসলাম প্রমুখ গোষ্ঠীর চিন্তাগত ফারাক থাকা সত্ত্বেও তাদের কর্মকাণ্ডের কুফল মুসলমানদেরকে কোনো না কোনোভাবে সইতে হচ্ছে। তাসাওউফের শিক্ষাকে বিকৃত করে কতিপয় দুনিয়ালোভী মানুষের ভণ্ডামি ও পশ্চিমাদের খেলার পুতুল হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া দায়েশ প্রমুখ দলের কারণেও ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের দায়িত্ব দাঈদের তথা দ্বীনের প্রতি আহবানকারীদের ওপর বর্তায়। উম্মাতের দাঈগণ সে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুগের বাস্তবতায় আজ দ্বীনের জাগরণ যখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদেরকে ফিরে তাকাতে হবে সেই মুবারক যুগে, যখন আরবের মরুপাহাড়ি পথে হেঁটে সত্য থেকে ক্রোশ দূরে সরে যাওয়া আরব শার্দূলদেরকে আল্লাহর তাওহীদের আহ্বান করেছিলেন সর্বশেষ নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.। পর্যালোচনা করা উচিৎ, সে সময়কার পরিবেশে কাকে কখন কিভাবে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.। উক্ত নিবন্ধে আমরা রাসূল সা. এর সীরাতের আলোকে তাঁর মাক্কী জীবনের দাওয়াতকে পর্যালোচনা করব। প্রসঙ্গত, ইসলামী দাওয়াতের পাঁচটি স্তর বা পর্যায় রয়েছে। তন্মধ্যে চারটি আমরা দেখতে পাই রাসূল সা. এর যুগে। একটি সংযুক্ত হয়েছে পরবর্তী যুগে। এখানে আমরা কেবল প্রথম দুটি স্তর বা পর্যায় নিয়ে আলোচনা করব।
প্রথম স্তরে ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের দাওয়াত। অনেকে একে গোপনীয় দাওয়াত বলেন, যা একটি ভুল ধারণা। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল,
يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ قُمْ فَأَنذِرْ وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ
-হে চাদরাবৃত ব্যক্তি, উঠুন, সতর্ক করুন এবং আপনার রবের মাহাত্ম্য বর্ণনা করুন। (সূরা আল মুদ্দাচ্ছির, আয়াত ১-৩)
এত স্পষ্ট নির্দেশনার পর একে গোপনীয় বলার সুযোগ নেই। তবে রাসূল সা. মক্কায় নবুওয়াত প্রকাশের পরবর্তীতে ৩ বছর তাঁর দাওয়াতের কার্যক্রমকে স্বীয় পরিচিত চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। এ সময় উম্মুল মুমিনীন খাদীজা, আবূ বকর সিদ্দীক, আলী ইবন আবূ তালিব, যায়িদ ইবন হারিসা রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন। পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় এ সময় রাসূল সা. আমভাবে তাওহীদের আহ্বান করেননি। এমনকি ইয়ামান থেকে আগত আমর ইবন আবাসাকে ইসলামে দীক্ষিত না করেই ফেরত পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মক্কার পরিস্থিতি অনুকূলে আসলে আগমন করার জন্য। সেসময় দারুল আরকাম নামক গৃহে রাসূল সা. একান্তে তাঁর যৎসামান্য সাহাবাকে দ্বীন শিক্ষা দিতেন। এ যুগের ব্যাপ্তি ছিল তিন বছর। আধুনিক যুগে কতিপয় সেক্যুলার ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থানের সময় উম্মাতের দাঈগণ এ ধরণের পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে কমিউনিস্ট সোভিয়েতের দুর্ভেদ্য দূর্গ বা কামাল পাশার কট্টর সেক্যুলার তুর্কীতেও আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত থেমে থাকেনি।
দ্বিতীয় পর্যায় ছিল কোনোরূপ শক্তি প্রদর্শন না করতঃ জনসম্মুখে দাওয়াত দেওয়ার যুগ। আল্লাহ আয়াত অবতীর্ণ করেন,
وَأَنذِرۡ عَشِيرَتَكَ ٱلۡأَقۡرَبِينَ
-আপনার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করুন। (সূরা শুআরা, আয়াত-২১৪)
উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ সা. জনসম্মুখে ইসলামের দাওয়াত শুরু করেন এবং এই পর্যায়ের দাওয়াত পুরো মাক্কী জীবন তথা হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। কেউ শুনুক বা না শুনুক, কবূল করুক বা না করুক, রাসূল সা. অবিরত দাওয়াত দিয়ে চলেছিলেন। আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল,
فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ
-আপনি যা সম্বন্ধে আদিষ্ট হয়েছেন তা শুনিয়ে দিন এবং মুশরিকদের পরোয়া করবেন না। (সূরা হিজর, আয়াত-৯৪)
তবে এই পর্যায়ে কোনোরূপ শক্তি প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছিল। কারণ শক্তি প্রদর্শনের সামর্থ্যও তখন ছিল না। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে এই সময় দায়িত্বের পরিধি শিখিয়ে দিয়েছেন,
فَذَكِّرۡ إِنَّمَاۤ أَنتَ مُذَكِّر لَّسۡتَ عَلَیۡهِم بِمُصَیۡطِرٍ
-আপনি স্মরণ করিয়ে দিন। আপনি কেবল স্মরণকারী। আপনি তাদের ওপর জবরদস্তিকারী নন। (সূরা আল গাশিআহ, আয়াত ২১-২২)
এ পর্যায়ে দাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল সা. বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কৌশল হাতে নিয়েছিলেন। প্রথমদিকের কৌশল ও ফলাফলের চেয়ে শেষদিকের কৌশল ও ফলাফল ছিল অনেক ভিন্ন এবং আপন আঙ্গিকে যথাযোগ্য। বাইহাকীর বর্ণনা অনুযায়ী, আলী (রা.) বলেছেন, দাওয়াতী জীবনের প্রথমদিকে একবার রাসূল সা. আপন গোত্র বনূ হাশিমের লোকদের নিজগৃহে আহ্বান করলেন এবং খাবারের আয়োজন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল পানাহারের পর দ্বীনের দাওয়াত দেবেন। অথচ তারা খেয়েদেয়ে চলে গেল, কিন্তু তাদের শোরগোলের কারণে রাসূল সা. কিছু বলতে পারলেন না। পরে আরেকদিন তাদেরকে দাওয়াত করলেন এবং পানাহার শেষে দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। প্রায় কেউই তখন ইসলাম কবুল করেনি। তবে বাকি লোকজন তা সহজভাবে নিলেও রাসূল সা. এর চাচা আবূ লাহাব তাঁকে তিরস্কার করেছিল।
এরপর আল্লাহর নির্দেশ আসল,
وَقُلْ إِنِّي أَنَا النَّذِيرُ الْمُبِينُ
-বলুন, আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী। (সূরা হিজর, আয়াত-৮৯)
তখন রাসূল সা. মক্কা শরীফের সাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মক্কাবাসীর উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “যদি আমি বলি, পাহাড়ের অপরপ্রান্তে শত্রুবাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ করতে প্রস্তুত, তবে কি তোমরা আমার কথায় বিশ্বাস করবে?” সমবেত মক্কাবাসী জবাব দিল, “হ্যা বিশ্বাস করব। কারণ তুমি সদা সত্যবাদী।” মক্কাবাসীর এহেন আস্থাকে পুঁজি করে রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করল। আবূ লাহাব হাত উঁচিয়ে বলল, “হে মুহাম্মাদ, তুমি ধ্বংস হও। তুমি কি এজন্য আমাদেরকে সমবেত করেছ?” আল্লাহ তাআলা তার কটুক্তির জবাব দিয়ে পবিত্র কুরআনের সূরা লাহাব নাযিল করেছিলেন। (সহীহ বুখারী)
একদিকে রাসূল সা. দাওয়াত দিচ্ছিলেন। অপরদিকে আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাসূল সা. ও আবূ বকরের দাওয়াতে সে সময় ইসলামের ছায়াতলে এসেছিলেন আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ, আম্মার, ইয়াসির, সুমাইয়া, বিলাল, উসমান ইবন আফফান, যুবাইর ইবন আওয়াম, আব্দুর রাহমান ইবন আউফ, সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস, তালহা ইবন উবাইদুল্লাহ, আবু উবাইদা ইবন জাররাহ, আরকাম, আবূ সালামা, উসমান ইবন মাযউন, উবাইদা ইবন হারিস, সাঈদ ইবন যায়িদ, জাফর ইবন আবূ তালিব, উম্মুল ফযল, আবূ হুযাইফা, সুহাইব আর রূমী (রা.) প্রমুখ সাহাবা। যখন তাঁদের সংখ্যা চল্লিশের কোটায় পৌঁছেছিল, তখন আল্লাহ তাঁদের ব্যাপারে সন্তুষ্টির আভাস দিয়ে আয়াত নাযিল করেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ
-হে নবী! আপনার এবং আপনার অনুগামী মুমিনদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। (সূরা আনফাল, আয়াত-৬৪)
কুরাইশরা এ অবস্থায় রাসূল সা. এর অভিভাবক আবূ তালিবের কাছে এসে অভিযোগ করল। স্বয়ং রাসূল সা. এর নিকট প্রলোভন ভরা প্রস্তাব প্রেরণ করল। ভয় দেখালো এবং শেষ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর শীআবে আবূ তালিব নামক উপত্যকায় বয়কট করে রাখল। তবে কোনো কিছুতেই দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না আল্লাহর নবী সা.। তবে মাঝেমাঝে তাঁর মধ্যেও ক্লান্তি আসত এই ভেবে যে, কেন তারা সত্যকে উপলব্ধি করতে পারছে না? কষ্ট পেতেন আল্লাহর নবী সা.। এই যাতনার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
فَلَعَلَّكَ بَاخِعٌ نَّفْسَكَ عَلَىٰ آثَارِهِمْ إِن لَّمْ يُؤْمِنُوا بِهَٰذَا الْحَدِيثِ أَسَفًا
-তারা এই (কুরআনের) বাণীতে ঈমান না আনলে সম্ভবত তাদের পেছনে ঘুরে আপনি দুঃখে নিজেকে বিনাশ করে ফেলবেন। (সূরা কাহাফ, আয়াত-৬)
প্রিয় হাবীবের পেরেশানি দূর করতে রাব্বুল আলামীন বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন,
كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ
-আপনি তাদেরকে যেদিকে আহবান করছেন, তা (কবূল করা) তাদের কাছে খুব দুঃসাধ্য মনে হয়। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাঁর জন্য বাছাই করেন, আর যে (হিদায়াত লাভের) চেষ্টা করে, তাকে হিদায়াত প্রদান করেন। (সূরা আশ-শূরা, আয়াত-১৩)
বিরোধীরা বসে ছিল না। যে যার মত বাধা সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। তবে সব শত্রু সমান ছিল না। একদিকে ওয়ালিদ ইবন মুগীরা, আবূ সুফিয়ান, হাকিম ইবন উমাইয়া, আবুল বুখতুরী প্রমুখ ভদ্র শত্রু ছিল, যারা শত্রুতা করা সত্ত্বেও সামাজিকতার সীমা পার করে কখনও নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেনি। অপরদিকে ছিল আবূ লাহাব, আবূ জাহল, উম্মু জামিল, উকবা ইবন আবূ মুয়ীত, উমাইয়া ইবন খালফ, উবাই ইবন খালফ, আস ইবন ওয়াইল প্রমুখ নিকৃষ্ট লোক। এরা নিকৃষ্ট কূটকৌশল ও শারীরিক নির্যাতনেও পিছপা হতো না। আর উতবা ইবনে রাবিআ, তার ভাই শাইবা, পুত্র ওলীদ, নযর ইবন হারিস প্রমুখ ছিল মধ্যম পর্যায়ের। আবূ তালিব যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন রাসূল সা. এর ওপর শারীরিক আঘাত আসেনি। তবে সাহাবীদের মধ্যে যারা সমাজে দুর্বল অবস্থানে ছিলেন, তাঁদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে। সুমাইয়া, ইয়াসির, আম্মার, বিলাল, সুহাইব আর রূমী, খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা.) প্রমুখ সাহাবা অচিন্তনীয় পাশবিকতার শিকার হয়েছেন। সুমাইয়া (রা.) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ। তিনি ও তাঁর স্বামী ইয়াসির (রা.)-কে নির্মমভাবে শহীদ করেছে এ উম্মাতের ফিরআউন আবূ জাহল। বণিক সর্দার উমাইয়ার হাতে নিপীড়িত হয়েছেন বিলাল (রা.)। মক্কার পাথুরে রাস্তায় টানাহ্যাঁচড়া করার সময় তাঁর মুখ থেকে বেরিয়েছে আল্লাহর তাওহীদের জয়গান। এভাবে খাব্বাব ইবনুল আরাত (রা.) এর পিঠের ওপর গনগনে লোহা দিয়ে দাগ দেওয়া হয়েছে। তবু পেছনে ফিরে পাল্টা আঘাতের অনুমতি ছিল না। কারণ সময়টি প্রতিঘাতের ছিল না। সময়টি ছিল ধৈর্য পরীক্ষা।
এমতাবস্থায় হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা.) ও উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ইসলাম কবূল করলে আরও প্রকাশ্যে ও ব্যাপকভাবে দাওয়াত শুরু হয়। তবে একটি ভুল ধারণা আমাদের মধ্যে রয়েছে যে, দ্বীনের কার্যক্রমকে প্রথমবার প্রকাশ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন উমর (রা.)। তা নয়; বরং আবূ বকর (রা.) তাঁর পূর্ব থেকেই অনেকাংশে প্রকাশ্যে দ্বীনের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। তবে এটি সত্য যে, উমর (রা.) এর আগমন ইসলাম ও মক্কার ছোট্ট মুসলিম দলকে অকল্পনীয় শক্তিমত্তা প্রদান করেছিল।
অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নবুয়তের ৫ম বর্ষে কতিপয় সাহাবা আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। মূলত প্রথম হিজরতের পরই হামযা (রা.) এবং উমর (রা.) ইসলাম কবূল করেন। এরপর ধীরে ধীরে আরো অনেকেই আবিসিনিয়ার পথে পা বাড়ান।
আবূ তালিবের মৃত্যুর পর স্বয়ং রাসূল সা. এর ওপর নেমে আসে শারীরিক নির্যাতন। আবূ জাহল, উমাইয়া, উবাই ইবন খালফ, উকবা ইবন আবূ মুয়ীত প্রমুখ পাষাণ হৃদয় পাপিষ্ঠরা নামাযে বাধা দেওয়া, তিলাওয়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি করা, পথে কাঁটা বিছানো, পেছন থেকে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করার চেষ্টা, এমনকি সিজদারত অবস্থায় পিঠের ওপর মরা উটের পঁচা নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিতেও বাদ রাখেনি। আল্লাহর হাবীব সা. এর ওপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল তাঁরই শহরবাসী।
গৃহাভ্যন্তরে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজা (রা.) এবং বাইরের অভিভাবক আবূ তালিবের ইন্তিকালের পর মক্কাবাসীর কঠোর মানসিকতা দেখে রাসূল পার্শ্ববর্তী শহর তায়িফ শহরে তাঁর দাওয়াতের নতুন ভিত গড়তে চাইলেন। কিন্তু নির্মম তায়িফবাসী আল্লাহর নবী সা.-কে প্রথমে মৌখিক এবং পরে পাথরের আঘাতে জর্জরিত করল। পাষাণ্ডতার এহেন নিদর্শন আরবের ভূমি খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছিল। এরপর নির্দেশ আসে হিজরতের।
হিজরতের পূর্বে রাসূল সা. সময় সময় বিভিন্ন স্থান থেকে আগত হাজীদেরকে নীরবে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁর সাথে ছিলেন আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) ও চাচা আব্বাস (রা.), যদিও তিনি তখনও প্রকাশ্যে ইসলাম কবূল করেননি। রাসূল সা. চাইতেন, যদি এক বা একাধিক গোত্র ইসলাম কবূল করে নেয়, তাহলে মক্কা ছেড়ে ওখানে চলে যাবেন। আবূ বকর (রা.) মূলত বড় এবং শক্তিশালী গোত্রগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন। কিন্তু বনূ কিন্দা, বনূ হাওয়াযিন প্রমুখ বড় বড় গোত্র দাওয়াত কবূল করতে রাজি নয়। এমতাবস্থায় রাসূল সা. কিছুটা দূরে ছয়জন যুবককে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কারা? তাঁরা জবাব দিলেন, আমরা খাযরাজ। মাত্র ছয় যুবক, তাও শক্তিশালী কোনো গোত্রের নয়। বসতি তৎকালীন ইয়াসরিব শহরে। ইয়াসরিবকে রাসূল সা. বিকল্প জায়গা হিসেবে কখনও ভাবেননি। তবুও তিনি তাঁদেরকে আন্তরিকভাবে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। ওই ছয় যুবক ইসলাম কবূল করলেন। তাঁদের মুখপাত্র ছিলেন আসআদ ইবন যুরারা (রা.)। এই আসআদ ইবন যুরারা ছিলেন রাসূল সা.-কে মদীনায় নেওয়ার প্রধান কুশলী।
মাক্কী জীবনের শেষ দুই বছর এক কঠিন পরীক্ষা হয়ে এসেছিল। ফলস্বরূপ রাসূল সা. ও পুনঃপুন দাওয়াতের কৌশল, স্থান ও পাত্র পরিবর্তন করেছেন। দেখা যায়, প্রথম ১০ বছরব্যাপী দাওয়াতী সময়ে রাসূল সা. ওয়ালিদ ইবন মুগীরার সাথে যতবার তাত্ত্বিক ও কৌশলগত তর্কে জড়িয়েছিলেন, আবূ জাহল কিংবা আবূ লাহাবের সাথে এর কানাকড়িও নয়। কারণ ওয়ালিদ অন্য সবার চেয়ে জ্ঞানী ছিল। ইসলাম কবূল না করা ব্যক্তিদের মধ্যে মুতঈম ইবন আদী শত-সহস্রগুণে ভাল ছিলেন উকবা ইবন আবু মুয়ীত কিংবা নযর ইবনে হারিস থেকে। আর আবূ তালিবের তো তুলনাই হয় না। সম্রাট হিরাক্লিয়াস, খসরু পারওয়াজ, নাজাশী কিংবা মুক্বাওকিস কোনো প্রমুখ বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সম্রাটরা সম-মেজাজের ছিলেন না। সুতরাং তাদের নিকট প্রেরিত চিঠিও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। এ সবকিছুই দাওয়াতের কৌশল। উম্মাতের জন্য রাসূলে আকরাম সা. নিজ হাতে এই কর্মসূচি প্রণয়ন করে গেছেন।
নববী দাওয়াতের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে মাহাত্ম্যপূর্ণ আখ্যান এখানে সমাপ্ত হয়েছিল। হিজরতের পর পরিস্থিতি সুবিধাজনক প্রান্তে মোড় নিয়েছিল। মাক্কী জীবনের ওই ১০ বছর ও তৎকালীন ইসলামী দাওয়াতের কৌশলের সাথে বর্তমান সময়ের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্র ও পরিস্থিতির তুলনামূলক বিচার করা একান্ত প্রয়োজন। আলোচনাটি সঙ্গত কারণেই পূর্ণাঙ্গতা বিবর্জিত। কিন্তু দাঈ মাত্রই সীরাতের মনযোগী পাঠক, এই সুধারণা মাথায় রেখে বলছি, বর্তমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘিষ্ঠ দেশগুলোতে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদেরকে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি তথা মানুষের অবস্থা, সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক চাপ ও বিরোধীগোষ্ঠীর সক্ষমতা, এমনকি ভৌগলিক অবস্থান উপলব্ধি করেই দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেখানে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা. এর দাওয়াতে মক্কাবাসী এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল, সেখানে পরবর্তী দাঈগণের পথ যে পুষ্পশোভিত হবে এমনটি ভাবা বোকামি। যেখানে রাসূলুল্লাহ সা. সুদীর্ঘ ২৩ বছর দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে গেছেন সেখানে আপনি-আমি একদিনেই বিশ্বজয় করে ফেলব, এমনটি ভাবাও অবান্তর। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ তার সহজাত ধর্ম, স্বভাব-সংস্কৃতি ও ধ্যান-ধারণাকে ভালোবাসে। তাই দাঈদেরকে সংযত হয়ে, অন্যের মতামতকে যৌক্তিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ইসলাম কেবল তরবারির ঝনঝনানি কিংবা কেবল মিষ্টি বুলির ওপর ভর করে এ পর্যন্ত আসেনি। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সুষ্ঠু ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদক্ষেপ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। প্রজ্ঞা, উত্তম কথা এবং নিরাপদ বিতর্ক ইসলামের মাহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম, যেভাবে আল্লাহ কুরআনে শিখিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিটি রাষ্ট্র জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ। আজ প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি ব্যক্তিস্বাধীনতার মনোভাব আছে। ভালো-খারাপের কথা বলছি না। তবে এগুলো আজ সত্য। একসময় মানুষ গোত্রভিত্তিক চিন্তা করত। আজ মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা করে। সেই চিন্তাকে প্রকাশ করার মতো ব্যক্তিগত মিডিয়াও সবার হাতে বিদ্যমান। তাই আজকের যুগে দাওয়াতের মৌলিকত্ব তো আগের মতো থাকবে; কিন্তু এর কৌশল পরিবর্তন হতে পারে। এবং এই পরিবর্তনশীল কৌশলের জন্য প্রয়োজনীয় উদাহরণও আমরা সীরাত থেকে পেয়ে যাব। সীরাতুন্নবী কেবল রাসূল সা. এর জীবনীই নয়; সীরাত ইসলামেরও বেড়ে উঠার কাহিনি। শারীরিক আঘাত-প্রতিঘাতে যাওয়ার পূর্বে সক্ষমতা, যৌক্তিকতা, পরিস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট শর্তাবলী পূরণ হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা অত্যাবশ্যক। মাদানী জীবনের দাওয়াতে রাসূলুল্লাহ সা. প্রতিটি যুদ্ধের পূর্বে, হোক তা আক্রমণাত্মক হোক রক্ষণাত্মক, উপরোক্ত উপাদানসমূহ খতিয়ে দেখেছেন। এবং মনে রাখতে হবে, যুদ্ধের নির্দেশ কিন্তু মাদানী জীবনেই এসেছিল, যখন ইসলাম পায়ের তলে মাটি পেয়েছে, যখন সক্ষমতা অর্জন করেছে, যখন বিজয়ী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। মাক্কী জীবনের শেষদিকে পরিস্থিতি প্রতিকূলে থাকায় খোদ রাসূলুল্লাহ সা.-কে হত্যা চেষ্টার পরও কুরাইশদেরকে প্রতিঘাত করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সেখানে আজকের ইসলাম যে কোনোভাবেই বিজয়ী শক্তি নয়, তা তো মুসলিম মাত্রই জানেন। সুতরাং মাদানী জীবনের সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে মাক্কী জীবনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, কৌশল ও অধ্যবসায়ের অনুশীলন অপরিহার্য। তবেই উম্মাতের সুদিন ফিরবে।
আলোচনার মোদ্দাকথা হলো, আল্লাহর উপর অটল অবিচল আস্থা রাখা, দৃঢ় সংকল্প নিয়ে অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, প্রয়োজনে কর্মকৌশল পরিবর্তন করা, অযথা উগ্রপন্থা পরিহার করা, বিরোধী মতের বিভিন্নতা বুঝতে পারা, শত্রুকে তার অবস্থান ও চরিত্র অনুযায়ী মুকাবিলা করা আজকের দিনে সাফল্যের মূলসূত্র হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সা. এর মাক্কী জীবনের দাওয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা লাভ করতে পারি।