প্রতিনিয়তই আমাদের চারপাশে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিছুসংখ্যক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে, রাসূল সা. নিছক একজন মানুষ, ধর্মপ্রচারক ও দাঈ মাত্র এর বেশি কিছু নন। তাঁর সর্বোত্তম চারিত্রিক মাধুর্য ও ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠতম বৈশিষ্ট্য, তিনি যে কেবল রাসূল বা দাঈ নন বরং ব্যক্তিসত্তা হিসেবে রাব্বুল আলামীন তাকে যেসকল বিশেষ বিশেষ অনুপম বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং উম্মতকে তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলোকে অবজ্ঞা করার চেষ্টা ও লক্ষ্যণীয়। যেটি একজন প্রকৃত মুসলিমের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং এর মাধ্যমে অমুসলিমদের দৃষ্টিভঙ্গি ও তাদের ধ্যান ধারণাকেই ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। বরং রাসূল সা. এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাঁর যথাযথ শান উপস্থাপন করা, তাঁকে ভালবাসা ঈমানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার নিকট তার পিতামাতা, সন্তান-সন্তুতি ও নিজ সত্তা থেকে প্রিয়তর হবো।’ কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘আমি আপনার আলোচনাকে সমুন্নত করেছি।’ কুরআনুল কারীমে অসংখ্য অগণিত আয়াত রয়েছে যেগুলোতে তাঁর শান মানকে সমুন্নত করে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ আয়াতগুলোর কিছুসংখ্যক খুবই সুস্পষ্ট। সবগুলো আয়াতের বিবরণ ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা রাসূল সা.কে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে মহিমান্বিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ পবিত্র কুরআনুল কারীমে তাকে ‘রহমত’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আর আমি আপনাকে সারাজাহানের জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।’
সূরা তাওবার ৬১ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আর এদের মধ্য থেকে এমন লোকও রয়েছে, যারা নবী করীম সা.কে কষ্ট দেয়, আর বলে, তিনি তো সবকিছুই শুনেন। বলে দিন, তিনি তোমাদের জন্য কল্যাণকর সবকিছুই শুনেন। তিনি আল্লাহর উপর ঈমান রাখেন এবং ঈমানদারগণের (কথার) উপর বিশ্বাস রাখেন এবং তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনয়ন করেছে তাদের জন্য রহমত। আর যারা রাসূল সা.কে কষ্ট দেয়, তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সা.কে ঈমানদারদের জন্য রহমত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যারা তাকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি।
সূরা তাওবার শেষ আয়াতে তাকে ‘রাহীম’ বা অত্যধিক দয়াশীল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর রাহমানুর রাহীম গুণটি স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। আরো উল্লেখ্য যে পবিত্র কুরআন কারীমকেও আল্লাহ তাআলা ‘রহমত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সূরা ইসরার ৪২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আর আমি কুরআনে এমন বিষয় অবতীর্ণ করেছি, যা ঈমানদারদের জন্য রোগ নিরাময়কারী এবং রহমত।
কাজেই যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাহমানুর রাহীম, পবিত্র কুরআনুল কারীম রহমত, সে স্থলে রাসূলে কারীম সা.কে এক স্থানে ‘রাহমাতাল্লিল আলামীন’ বা সারা জাহানের জন্য রহমত এবং আরেকস্থানে ‘রাহমাতুল্লিল্লাযিনা আমানু’ বা ঈমানদারদের রহমত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
رحمة শব্দটি মাসদার। কোন ক্ষেত্রে যদি সিফাত উল্লেখ না করে মাসদার উল্লেখ করা হয় সেক্ষেত্রে অর্থের আধিক্যতা নিশ্চিত হয়। আবুস সুঊদ তার তাফসীরে শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেন, শব্দটি মাসদার, এর মাধ্যমে যিনি শব্দটি ধারণ করছেন তার মধ্যে এ বিষয়টির আধিক্যতা পাওয়া যায়। অর্থাৎ রাসূলে কারীম সা. সারাজাহান এবং ঈমানদারদের জন্য সর্বাধিক রহমত বা অনুগ্রহ।
রাহমাতুল্লিল আলামীন হিসেবে তিনি কেবলমাত্র একটি বিশেষ জগতের রহমত নন; বরং তিনি ব্যাপকভাবে সমগ্র জগতের জন্য রহমত। মানবজাতির জন্য যেমনিভাবে রহমত তেমনি অন্যান্য সকল জগতের জন্যও তিনি রহমত। কাজেই জিন, ইনসান, ফিরিশতা, প্রাণীজগত, তৃণলতা ও অন্যান্য জগতের জন্যও তিনি রহমত বা অনুগ্রহ। এ ব্যাপারটি নিছক তিনি একজন নবী, প্রচারক বা দাঈ হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাঁর সম্মান ও মর্যাদাকেই নির্দেশ করে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا- لِتُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَتُعَزِّرُوهُ وَتُوَقِّرُوهُ وَتُسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
নিশ্চয়ই আমি আপনাকে প্রত্যক্ষ সাক্ষী, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী হিসেবে পাঠিয়েছি। যাতে তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনয়ন কর, তাঁকে সাহায্য কর, তাঁকে সীমাহীন সম্মান ও মর্যাদা প্রদান কর এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবীহ পাঠ কর। (সূরা ফাতহ, আয়াত ৮-৯)
এ আয়াতে وَتُوَقِّرُوهُ (যাতে তোমরা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর) শব্দের মাধ্যমে সে বিষয়টিকেই বুঝানো হয়েছে। এ তো কেবলমাত্র রহমত শব্দটির ব্যাখ্যার যৎসামান্য অংশ। উলামায়ে কিরাম পবিত্র কুরআন কারীম ও হাদীসে উল্লিখিত রাসূলুল্লাহ সা. এর গুণবাচক নামের সংখ্যা প্রায় দুইশ পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ প্রায় এক হাজার নামের কথা বলেছেন। এ নামগুলো বিশ্লেষণ করলে আমাদের নিকট উদ্ভাসিত হবে যে, তিনি কেবলমাত্র একজন নবী বা ধর্মপ্রচারকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না বরং তারও অধিক।
হযরত যাইনাব বিনতু জাহাশ (রা.) কে যখন রাসূল সা. তাঁর পালকপুত্র হযরত যায়িদ বিন হারিসা (রা.) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তাব দেন তখন যাইনাব ও তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ (রা.) একত্রে এ প্রস্তাবকে অস্বীকার করেন। হযরত যাইনাব ছিলেন রূপসী, সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ কুরাইশ বংশীয়া এবং রাসূল সা. এর ফুফাতে বোন। অপরদিকে যায়িদ বিন হারিসা ছিলেন কালোবর্ণের কৃতদাস। কিন্তু যেহেতু এ বিবাহের প্রস্তাবকারী স্বয়ং রাসূল সা. কাজেই এ বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা তাদের জন্য কোনভাবেই সমীচীন হয়নি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং তা পছন্দ করেননি। পবিত্র কুরআন কারীমের আয়াত অবতীর্ণ হয়।
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
-আর কোন মুমিন পুরুষ ও কোন মুমিন নারীর জন্য যখন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল সা. কোন কাজের ফায়সালা প্রদান করেন, তখন তাদের জন্য নিজের (এ) কাজে (করা এবং না করার) কোন স্বাধীনতা থাকে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সা. এর নাফরমানী করে, তবে সে অবশ্যই প্রকাশ্য গুমরাহীতে নিমজ্জিত। (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৬)
পরবর্তী সময়ে যেদিন রাসূল সা. হযরত যাইনাব বিনতু জাহাশকে বিবাহ করেন, সে দিন তিনি সাহাবীদেরকে তাঁর গৃহে দাওয়াত করেন। তারা এসে খাবার গ্রহণ করেন এবং খাবার দাবার শেষে খোশগল্পে মশগুল হয়ে পড়েন। রাসূল সা. এর আকাঙ্খা তারা যেন উঠে যান। সবাই উঠে চলে গেলেন তিনজন ব্যতীত। তারা গল্পে মশগুল হয়েই রইলেন। সর্বশেষে একটু দেরী করেই তারা উঠলেন। এভাবে খাবার দাবার গ্রহণের পর বিনা প্রয়োজনে গল্পগুজবে মশগুল থাকা নবী করীম সা. এর নিকট অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু লজ্জার কারণে সরাসরি তিনি তাদেরকে উঠে যেতেও বলতে পারছিলেন না। এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই নি¤েœর আয়াত অবতীর্ণ হয়।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتَ النَّبِيِّ إِلَّا أَنْ يُؤْذَنَ لَكُمْ إِلَى طَعَامٍ غَيْرَ نَاظِرِينَ إِنَاهُ وَلَكِنْ إِذَا دُعِيتُمْ فَادْخُلُوا فَإِذَا طَعِمْتُمْ فَانْتَشِرُوا وَلَا مُسْتَأْنِسِينَ لِحَدِيثٍ إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ يُؤْذِي النَّبِيَّ فَيَسْتَحْيِي مِنْكُمْ وَاللَّهُ لَا يَسْتَحْيِي مِنَ الْحَقِّ وَإِذَا سَأَلْتُمُوهُنَّ مَتَاعًا فَاسْأَلُوهُنَّ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ ذَلِكُمْ أَطْهَرُ لِقُلُوبِكُمْ وَقُلُوبِهِنَّ وَمَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُؤْذُوا رَسُولَ اللَّهِ وَلَا أَنْ تَنْكِحُوا أَزْوَاجَهُ مِنْ بَعْدِهِ أَبَدًا إِنَّ ذَلِكُمْ كَانَ عِنْدَ اللَّهِ عَظِيمًا
-হে ঈমানদারগণ! তোমাদেরকে খাবারের অনুমতি দেওয়া ব্যতীত, নবী করীম সা. এর গৃহসমূহে প্রবেশ করো না। (অতঃপর সময়ের পূর্বে পৌঁছে) খাবার রান্না হওয়ার অপেক্ষাকারী হয়ো না। হ্যাঁ, যদি তোমাদের আহ্বান করা হয়, তখন ভিতরে আগমন কর। অতঃপর যখন খাবার খেয়ে নাও, তখন (সেখান থেকে ওঠে) ততক্ষণাৎ ছড়িয়ে পড় এবং সেখানে কথাবার্তায় মশগুল হয়ে উপবেশনকারী হয়ো না। নিশ্চয়ই তোমাদের এ বিষয়টি (অর্থাৎ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বসে থাকা) নবী করীম সা.কে কষ্ট দেয়। আর তিনি তোমাদেরকে (ওঠে যাওয়ার জন্য বলতে) লজ্জা পান। আল্লাহ সত্য বিষয়ে লজ্জা করেন না। আর যখন তোমরা তাদের (অর্থাৎ তাঁর স্ত্রীগণের) নিকট কোন সামগ্রী চাও তখন পর্দার পশ্চাত থেকে চাও। এটি তোমাদের এবং তাদের অন্তরসমূহের জন্য বড়ই পবিত্রতার কারণ। আর তোমাদের জন্য সমীচীন নয় যে, তোমরা রাসূলুল্লাহ সা.কে কষ্ট দাও, আর এও সমীচীন নয় যে, তোমরা তাঁর পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রীগণকে বিবাহ করবে। আর এ বিধান অনন্তকাল পর্যন্ত। নিশ্চয় তা আল্লাহ্র নিকট বড় গুনাহ। (সূরা আহযাব, আয়াত-৫৩)
বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীস, জনৈক আনসারী সাহাবী নবী করীম সা. এর নিকট নালিশ নিয়ে আসেন যে, যুবাইর (রা.) যে নালার পানি দিয়ে খেজুর বাগানে সেচ দিচ্ছেন তা যেন তিনি বাঁধ দিয়ে আটকে না রেখে ছেড়ে দেন, যাতে আনসারী তার বাগানে সেচ দেওয়ার জন্য পানি পেতে পারেন। হযরত যুবাইর (রা.) তা করতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে তারা দুজনে নবী করীম সা. এর নিকট বিবাদে জড়িয়ে যান। নবী করীম সা. হযরত যুবাইর (রা.) কে বলেন, হে যুবাইর! তুমি প্রথমে তোমার বাগানে সেচ দাও। এরপর তোমার প্রতিবেশী আনসারীর দিকে পানি ছেড়ে দাও। এ সিদ্ধান্তে আনসারী অসন্তুষ্ট হয়ে নবী করীম সা.কে সম্বোধন করেন বলেন, সে তো আপনার ফুফাতো ভাই, তাই আপনি তার পক্ষে ফায়সালা করলেন। এতে নবী করীম সা. ক্রোধান্বিত হন এবং বলেন, হে যুবাইর! তুমি নিজের জমিতে সেচ দিয়ে পানি আটকে রাখ যাতে তা বাঁধ পর্যন্ত পৌছে যায়। হযরত যুবাইর (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম! আমার ধারণা কুরআনের এ আয়াতটি তাঁর ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়।
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
-আর আপনার প্রতিপালকের কসম! এ সকল লোক মুসলমান হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজেদের মাঝে সংঘটিত মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে আপনাকে বিচারক নিরূপণ করে নেয়; অতঃপর আপনার নিকট থেকে প্রদত্ত ফায়সালায় নিজেদের অন্তরে কোন ধরণের সংকীর্ণতা অনুভব করে না এবং (আপনার নির্দেশকে) সন্তুষ্টচিত্তে সম্পূর্ণ আনুগত্যের সাথে গ্রহণ করে নেয়। (সূরা নিসা, আয়াত-৬৫)
একবার বনী তামীম গোত্রের কিছু লোক নবী করীম সা. এর খিদমতে হাযির হয়। এ গোত্রের শাসনকর্তা কাকে নিযুক্ত করা হবে এ নিয়ে আলোচনা চলছিল। হযরত আবূ বকর (রা.) কা’কা বিন মা’বাদ বিন যুরারা এর নাম প্রস্তাব করেন। অপরদিকে হযরত উমর (রা.) আকরা বিন হাবিসের নাম প্রস্তাব করেন। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে বাক্যালাপ উঁচু হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতেই নি¤েœর আয়াত অবতীর্ণ হয়।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَرْفَعُوا أَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَلَا تَجْهَرُوا لَهُ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ أَنْ تَحْبَطَ أَعْمَالُكُمْ وَأَنْتُمْ لَا تَشْعُرُونَ- إِنَّ الَّذِينَ يَغُضُّونَ أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ أُولَئِكَ الَّذِينَ امْتَحَنَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ لِلتَّقْوَى لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ عَظِيمٌ
-হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বরকে নবী করীম সা. এর কণ্ঠস্বর থেকে উঁচু করো না। আর তাঁর সাথে এমন উচ্চস্বরে কথা বলো না, যেমন উচ্চস্বরে তোমরা একে অপরের সাথে কথা বল। যাতে তোমাদের সকল আমলই ধ্বংস হয়ে না যায়, আর তোমরা টেরও পাবে না। নিশ্চয়ই যারা রাসূলুল্লাহ সা. এর সমীপে তাদের আওয়াজকে নিচু রাখে, তারাই এমন লোক, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ তাকওয়ার জন্য মনোনীত করে একনিষ্ট করে দিয়েছেন। তাদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা এবং মহা প্রতিদান। (সূরা হুজুরাত, আয়াত ১-৩)
কুরতুবী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের উলামায়ে কিরাম বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا
আয়াতখানা নবী করীম সা.কে কষ্ট দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়। তিনি উম্মাহাতুল মুমিনীনদের কয়েকজনের আচরণে মর্মাহত হন। কেউ কেউ বলেন, তারা নবী করীম সা. এর নিকট প্রাপ্য খোরপোষের চেয়ে আরো বেশি দাবি করে বসেন। আবার কেউ কেউ বলেন উম্মাহাতুল মুমিনীনদের পরস্পরের আত্মগরিমার কারণে তিনি কষ্ট পান। ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে কারীমাগুলো অবতীর্ণ করেন।
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ إِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا فَتَعَالَيْنَ أُمَتِّعْكُنَّ وَأُسَرِّحْكُنَّ سَرَاحًا جَمِيلًا- وَإِنْ كُنْتُنَّ تُرِدْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَالدَّارَ الْآخِرَةَ فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا
-হে নবী! আপনার স্ত্রীদেরকে বলে দিন, যদি তোমরা দুনিয়া এবং এর সৌন্দর্য ও সাজসজ্জার কামনাকারী হও, তবে আস আমি তোমাদেরকে মাল ও সম্পদ দিয়ে দেই এবং তোমাদেরকে সুন্দর পন্থায় মুক্ত করে দেই। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি এবং পরকালের কামনাকারী হও, তবে অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে নেককার স্ত্রীদের জন্য অনেক বড় প্রতিদান প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা আহযাব, আয়াত ২৮-২৯)
এ আয়াতগুলোর মাধ্যমে যে বিষয়গুলো সহজেই অনুমেয় তা হলো, রাসূল সা. এর সম্মান প্রদর্শন, তাঁকে সাহায্য করা, তাঁর সিদ্ধান্ত ও ফায়সালাকে অবনত মস্তকে মেনে নেওয়া, তাঁর সমীপে নিচুস্বরে কথা বলা বা এ জাতীয় আরো বিষয়গুলো রয়েছে সেগুলো কেবলমাত্র শরীআতের বিধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এ আয়াত ও বিধানগুলোর মাধ্যমে নবী করীম সা. এর সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করা। পবিত্র কুরআন কারীমের বর্ণনাভঙ্গির দিকে লক্ষ্য করলেও এ বিষয়গুলো আমাদের স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পবিত্র কুরআন কারীম শুধুমাত্র এমন আসমানী কিতাব নয় যেখানে শরীআতের বিধানই বর্ণনা করা হয়েছে। বরং যারা তাকে কষ্ট দেয়, তাকে অবজ্ঞা করে, তার ইচ্ছা অনিচ্ছার পরোয়া করে না, তাঁর সম্মুখে কণ্ঠ উঁচু করে, তাঁর সাথে বেয়াদবী করে, তাকে পাগল বা নির্বংশ করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা এবং তাদের পরবর্তীতে কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী কেউই যেন এ আচরণ করার সাহস না পায়।