1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
রাজনৈতিক সালাফী মতবাদ: একটি পর্যালোচনা
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ৯ এপ্রিল, ২০২৫

দ্বীনী কিংবা জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে এ দেশে যখনই কোনো বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, হরতাল, ডেমোনস্ট্রেশন হয়, তখনই সালাফী-আহলে হাদীসদের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে হারামের ফাতওয়া চলে আসে। ব্যাপারটি ইদানিং বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে, যেহেতু এক দশক আগেও এ দেশে সালাফী মতবাদের প্রভাব এত বেশি ছিল না। এক দশকের ব্যবধানে এখন মসজিদ, মাহফিল, মিডিয়া, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সর্বত্র সালাফী মতবাদের ব্যাপক বিস্তার লক্ষ করা যাচ্ছে। সৌদি সরকারের তেল-বেচা টাকা, সালাফী মতাদর্শী আলিমদের শ্রম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরামহীন উপস্থিতির কারণে অন্য যেকোনো মতবাদের চাইতে সালাফী মতবাদ দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। মিছিল-মিটিংকে হারাম ফাতওয়া দেওয়ার পেছনে তাদের দলীল ও যুক্তি দুই ধরনের হয়ে থাকে। প্রথমত, তারা কিছু আয়াত ও হাদীসের রেফারেন্স দেন, যেখানে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, শাসক তথা ‘উলুল আমর’ এর আনুগত্যের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ব এর যে নির্দেশনা রয়েছে, তা উল্লেখ করে সালাফীরা তথাকথিত ‘সরকারবিরোধী’ ডেমোনস্ট্রেশনকে হারাম সাব্যস্ত করেন। তাদের বেশিরভাগ যুক্তি এতই খোঁড়া এবং একপেশে যে, এগুলোর ইলমী খ-ন নিষ্প্রয়োজন। সাধারণ বোধশক্তি থেকেই বুঝা যায়, তাদের দলীলসমূহ অপ্রাসঙ্গিকভাবে (ড়ঁঃ ড়ভ পড়হঃবীঃ) গৃহীত এবং যুক্তিগুলো অবাস্তব। কোনো কিছুকে হারাম সাব্যস্ত করার জন্য যেসব মৌলিক শর্ত, অর্থাৎ কাতঈ আস-সুবুত ও কাতঈ আদ-দালালাহ আবশ্যক, সালাফীরা সেসব মৌলিক শর্তকে আমলেই নেন না। অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটি আয়াত বা হাদীসকে বাছাই করে ফাতওয়া দিয়ে দেন। দেখা যায়, সালাফীদের ফাতওয়া আসার সাথে সাথে অনেকেই তাদের ইলমী ফিকহী জবাব দিতে উদ্যত হয়ে যান। কারণ বেশিরভাগ মানুষ সালাফী মতবাদকে একটি ইলমী ধারা মনে করেন। কিন্তু আদতে তা নয়। প্রচলিত সালাফী মতবাদের চিন্তা চেতনার মূল শেকড় না জেনে মাঝখান থেকে ইলমী জবাব দেওয়াটা নিষ্প্রয়োজন। সালাফীদের এসব ফাতওয়ার পেছনে যতটা না দ্বীনী উদ্দেশ্য, তার চেয়ে বেশি রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সেটি প্রথমে ভালোভাবে জানা প্রয়োজন।
লম্বা সময় ধরে এ উপমহাদেশে সালাফী মতবাদকে কেবলই একটি ফিকহী মাযহাব হিসেবে দেখা হয়েছে। এমনকি এখনও বেশিরভাগ মানুষ সালাফী মতবাদকে ফিকহী মাযহাব হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু আদতে তা নয়। সালাফী মতবাদ মূলত কোনো ফিকহী মাযহাব কিংবা দেওবন্দী, বেরেলভীদের মতো মাসলাক নয়। সালাফী মতবাদ মূলত একটি আকীদাভিত্তিক রাজনৈতিক মতবাদ। পরবর্তীতে নব্য-হাম্বলীদের সাথে মিলিত হয়ে আহলে হাদীস নামে এদের একটি ফিকহী মতবাদ তৈরি হয়েছে। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ এটি জানেন না, বা এ ব্যাপারে সচেতন
নন বলেই সালাফী মতবাদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও কর্মকা- নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না
বললেই চলে। বহু খোঁজাখুঁজি করে সালাফীদের ব্যাপারে ইন্টারনেটে যে সকল গবেষণাপত্র পাওয়া যায়, সে সবগুলোই সালাফীদের ইলমী-ফিকহী চিন্তাধারা নিয়ে লিখিত। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনে সালাফী মতবাদের মতামত ও ভূমিকা যাচাই করতে হলে কেবল ইলমী-ফিকহী দিক থেকে যাচাই করলেই হবে না। বরং সবার আগে তাদের আকীদাগত ও রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে সামনে আনতে হবে।
গোড়ার দিক থেকে হিসেব করলে প্রচলিত সালাফী মতবাদ তিন ধাপে জন্ম নিয়েছে। সালাফী ধারার প্রথম মতবাদ হচ্ছে নজ্দী মতবাদ। আরব উপদ্বীপের নজ্দ প্রদেশের অধিবাসী মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের (১৭০৩-১৭৯২) মাধ্যমে এ মতবাদের সূচনা হয়েছিল। ১৮শ শতকে ইবনে আবদুল ওয়াহাব এমন এক অভিনব এবং অভূতপূর্ব আকীদা নিয়ে হাজির হন, যা ইতিপূর্বে উম্মতের মধ্যে ছিল না। তিনি দাবি করেছিলেন, তার পূর্বে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদকে কেউ বুঝতে পারেনি। ইবনে আবদুল ওয়াহাবের লেখা পাঠ করে তাকে পুরোপুরিভাবে বুঝা সম্ভব নয়। তার লেখা এবং তার কর্মকা-ের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। স্বপ্রণোদিত তাওহীদের আলোকে উসমানী (অটোমান) সালতানাত ও এর অধীন সমস্ত মুসলিম উম্মাহকে তিনি মুশরিক ফাতওয়া দেন। তিনি তার দলবল নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছিলেন। আরবের দিরিয়াহ এলাকার গোত্র প্রধান মুহাম্মদ ইবনে সৌদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সাথে সে যুদ্ধে শরীক হন। যুদ্ধের পর বিজিত এলাকাজুড়ে তাদের কট্টরপন্থি শাসন কায়িম হয়। সামান্যতম মতভিন্নতার কারণেও ইবনে আবদুল ওয়াহাব ও ইবনে সৌদের দল খুনখারাবি করতে পিছপা হতো না। উভয়ের মধ্যে চুক্তি হয়, রাষ্ট্রীয় বিষয়সমূহ দেখভাল করবে ইবনে সৌদের বংশধর এবং ধর্মীয় বিষয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে ইবনে আবদুল ওয়াহাবের বংশধরের কাছে। কালক্রমে তিন দফা ভাঙ্গাগড়া ও সীমাহীন সংঘাতের মধ্য দিয়ে বাদশা আবদুল আযীয নজদী মতবাদের ভিত্তিতে ১৯০২ সালে সৌদি রাষ্ট্র কায়িম করেন। বিভিন্ন এলাকা দখল এবং আন্তঃকলহ নিরসনের পর ১৯৩২ সালে আধুনিক সৌদি আরব প্রতিষ্ঠিত হয়।
সালাফী ধারার দ্বিতীয় মতবাদ হচ্ছে আধুনিক রাজনৈতিক সালাফী মতবাদ। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জামাল-উদ-দীন আফগানি (১৮৩৮-১৮৯৭), মুহাম্মদ আবদুহু (১৮৪৯-১৯০৫), শায়খ রশীদ রিদ্বা (১৮৬৫-১৯৩৫) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের হাতে আধুনিক সালাফী রাজনৈতিক মতবাদের জন্ম হয়েছিল। এরা সরাসরি নজদী মতবাদের সাথে যুক্ত ছিলেন না। তাদের মূল চিন্তা চেতনা ছিল ইউরোপীয় সা¤্রাজ্যবাদের বিরোধিতা। মুসলিম বিশ্বকে কলোনি বানিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র যখন উম্মাহকে ভাগ-বাটোয়ারা করতে উদ্যত হচ্ছিল, তখন তারা এর বিরুদ্ধাচরণ করতে দাঁড়িয়েছিলেন। এছাড়া ইসলামের বিশ্বজনীন
ধারণা (চধহ-ওংষধসরংস) এবং বিশ্বজুড়ে ইসলামী খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করাও ছিল তাদের মুখ্য প্রতিপাদ্য। এ ধারার আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে আল-ইখওয়ানুল মুসলিমুন বা মুসলিম ব্রাদারহুড। বারবার যুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও এ সংগঠনটি আজও মিশর, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে মুসলিম ব্রাদারহুড নিজেদেরকে নির্দিষ্ট কোনো আকীদায় আবদ্ধ না করে বরং একটি বড় ছাতা বানিয়ে নিয়েছে। তারা নিজেদের ভেতর সালাফী, সূফী, মাযহাবী, লা-মাযহাবী সবাইকে সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
সালাফী ধারার তৃতীয় মতবাদ হচ্ছে সৌদি-ভিত্তিক নব্য-সালাফী মতবাদ। সৌদি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বাদশাহ আবদুল আযীয যখন পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক তৈরি এবং সৌদি আরবে পশ্চিমাকরণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তখন আসল বা প্রাচীন নজদী মতবাদের অনুসারীরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। নজদীদের কট্টরপন্থা রুখে দেওয়ার জন্য সৌদি রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ৭০ ও ৮০’র দশকে নব্য-সালাফীবাদের সূচনা হয়। এদেরকে তৈরি করার পেছনে বাদশাহ আবদুল আযীয এবং তার দুই পুত্র বাদশাহ ফায়সাল ও বাদশাহ ফাহাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। তবে এরা কোনো স্বতন্ত্র দল নয়, বরং এরা কট্টরপন্থি নজদীদের প্রতিরূপ। এদের মধ্যে নানাবিধ ধারা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে,
১. অরাজনৈতিক ইলমী সালাফী মতবাদ। এ ধারার অনুসারীরা কখনও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের মূল কাজ হচ্ছে সালাফী ধারার ইলমী প্রচারকার্য। আধুনিক সালাফী মতবাদকে একটি ইলমী ভিত্তি দেওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তাদেরই। এ ধারার মূল খুঁটি ছিলেন আরব জাহানের সুপরিচিত প-িত নাসিরুদ্দীন আলবানী, যাকে আধুনিক সালাফী মতবাদের ইলমী জনক বললেও ভুল হবে না।
২. সৌদি-সমর্থক সালাফী মতবাদ। এ ধারার অনুসারীদের কার্যক্রমও ইলমী প্রচার-প্রসার। তবে তা শুধু নিরেট ইলমী নয়। বরং তাদের মূল লক্ষ্য সৌদি রাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষা। বলা যায়, এরা কোনো মৌলিক ধারা নয়। বরং সৌদি রাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষা করার জন্য অরাজনৈতিক ইলমী সালাফী মতবাদের ভেতর থেকে এদেরকে বের করা হয়েছে। পার্থক্য হচ্ছে, অরাজনৈতিক ইলমী সালাফী ধারার অনুসারীরা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর সৌদি সমর্থক সালাফী ধারার অনুসারীরা সৌদি রাজতন্ত্রকে সমর্থন ও টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে। এদের কাছে ইবনে আবদুল ওয়াহাবের চেয়ে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (র.) ও শায়খ ইবনে তাইমিয়া অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ এদেরকে তৈরি করা হয়েছিল ইবনে আবদুল ওয়াহাবের কট্টরপন্থি মতবাদকে আটকানো এবং এর পুনব্যাখ্যা করার জন্য। বলা যায়, সৌদি সমর্থক সালাফী ধারার মুখপাত্র ছিলেন সাবেক সৌদি গ্রান্ড মুফতি মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহিম আলে-শায়খ, সাবেক সৌদি গ্রান্ড মুফতি আবদুল আযীয ইবনে বায, সালেহ ইবনুল উসাইমিন, সালেহ আল-ফাউযান এবং বর্তমান গ্রান্ড মুফতি আবদুল আযীয আলে-শায়খ প্রমুখ।
৩. হারাকী সালাফী মতবাদ। হারাকী নামটি এসেছে ‘হারাকাত’ শব্দ থেকে, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘নড়াচড়া’। এ ধারার অনুসারীরা সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা করেন, প্রতিবাদ করেন। অবশ্য তারা সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন না কিংবা সালাফী মতবাদকেও ত্যাগ করেন না। সালাফী মতবাদের ভেতরে থেকেই তারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেন। হারাকী সালাফী ধারার মূল স্তম্ভ সাফার আল হাওয়ালী (এক সময় কারাগারে বন্দী ছিলেন) এবং সালমান আল আওদা (বর্তমানে কারাগারে বন্দী)। ‘সাহওয়া মুভমেন্ট’ নামে তাদের একটি আন্দোলন রয়েছে, যা সৌদি রাজতন্ত্রের বিভিন্ন নীতি ও পশ্চিমাদের সাথে সৌদি সরকারের দহরম মহরমের সমালোচনা করতো। বর্তমান সৌদি সরকারের চরম রোষানলে পড়ে এরা অনেকটাই নীরব।
৪. তাকফীরী সালাফী মতবাদ। এ ধারার অনুসারীরা নব্য-সালাফী মতবাদের ভেতর থেকে সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এদের মধ্যে নজদী কট্টরপন্থা পুরোপুরিভাবে বিদ্যমান। এ ধারার অনুসারীদের কর্মকা- প্রাচীন ‘খারিজী মতবাদের অনুরূপ, যার উপস্থিতি ইবনে আবদুল ওয়াহাব ও তার অনুসারীদের আসল নজদী আন্দোলনের মধ্যে ছিল। তারা পৃথিবীর যাবতীয় শাসন ব্যবস্থাকে কুফরী মনে করে (তাকফীর), এবং কোনোরূপ ফলাফল বিবেচনা না করেই সর্বাবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধকে ফরয মনে করে, সেটি যেখানে এবং যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন। তবে তাকফীরী সালাফী মতবাদটি নব্য-সালাফী মতবাদের ভেতর থেকে সৃষ্টি হলেও এরা মূলত পশ্চিমা যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলোর সা¤্রাজ্যবাদী নীতির উপজাত। পশ্চিমারা মুসলিম বিশ্বে যে ভয়াবহ পরিমাণ বিশৃঙ্খলা ছড়িয়েছে, সেই বিশৃঙ্খলা মুসলিম, বিশেষত আরব বিশ্বে একটি চড়বিৎ াধপঁঁস বা কর্তৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। কর্তৃত্বের এ শূন্যতাকে পূরণ করতে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন। এদের মতবাদই হচ্ছে তাকফীরী সালাফী মতবাদ। প্রচলিত আল-কায়েদা ও আইএস এ ধারার উদাহরণ।
এ চারটি ধারার মধ্যে ৪র্থ ধারাটি এখন মৃতপ্রায়। পশ্চিমা এবং তাদের মদদপুষ্ট মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ক্রমাগত প্রতিরোধের মুখে আল-কায়েদা ও আইএস প্রমুখ জঙ্গি সংগঠনগুলো বর্তমানে অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে এরা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। ৩য় ধারার হর্তাকর্তারা সৌদি রাজতন্ত্রের রোষানলে পড়ে এখন নীরব। ১ম ধারাটি ২য় ধারার মধ্যে মিশে গেছে। অতএব, বর্তমানে সবচেয়ে কার্যকরী এবং প্রভাবশালী ধারা হচ্ছে ২য় ধারাটি, অর্থাৎ সৌদি-সমর্থক সালাফী মতবাদ। পৃথিবীতে সালাফী মতবাদ ও আহলে হাদীসের ফিকহী ধারাকে ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে বড় কৃতিত্ব তাদেরই।
এই সৌদি-সমর্থক সালাফী মতবাদ থেকে পরবর্তীতে আরেকটি কট্টরপন্থি ধারা বের হয়েছে, যাদেরকে ‘মাদখালী’ বলা হয়। মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক রাবী’ আল মাদখালীর চিন্তাধারা থেকে এ মতবাদের জন্ম হয়েছে। এদের জন্ম মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরোধিতা থেকে। মুসলিম ব্রাদারহুড যখন আরবের বিভিন্ন রাষ্ট্রের টুটি চেপে ধরা শাসকদেরকে সরিয়ে ইসলামী খিলাফাত কায়িম করতে চাইছিল, তখন সৌদি-সমর্থক নব-সালাফী মতবাদের কোল থেকে জন্ম নিয়েছিল মাদখালি মতবাদ। এরা প্রধানত মুসলিম ব্রাদারহুড এবং পরে পৃথিবীর বাকি সব ইসলামী আন্দোলনকে সমূলে গোমরাহ-বিদআতি মনে করে। তাদের আকীদা হচ্ছে, সর্বাবস্থায় তাঁরা শাসকের আনুগত্যকে ফরয মনে করে, চাই শাসক যালিম হোক, ফাসিক হোক, খুনি হোক, যত অন্যায়-অবিচারই করুক। যদি শাসক প্রকাশ্য কুফরের (كفر بواح) হুকুম না দেয়, তাহলে কোনোভাবেই শাসকের বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করা যাবে না।
বাড়িয়ে বলছি না, এটি তাদের আকীদার অংশ। এমনকি এ কারণে তারা ইমাম হুসাইন ইবনে আলী ও আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) কে বিদ্রোহী এবং অপরাধী মনে করে (নাউযুবিল্লাহ), কারণ তারা তৎকালীন ‘শাসক’ ইয়াযিদের বিরুদ্ধে কিয়াম করেছিলেন। আহলে বায়তের প্রতি তাদের বিদ্বেষের মূল শেকড় গেঁথে আছে এখানেই। সৌদি রাজতন্ত্রের অকুণ্ঠ সমর্থনে এ মতবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সৌদি সালাফী আলিমরা রাজতন্ত্রের পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে এদেরকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে বড় করেন। এক সময় সৌদি আরবে এদের প্রভাব ছিল কল্পনাতীত।
এবার যদি ভারতীয় উপমহাদেশের কথা ধরি, তাহলে ভারতীয় উপমহাদেশে আহলে হাদীস মতবাদের প্রথমদিকে মূল প্রবক্তা আবদুল হক বেনারসী। তবে উপমহাদেশে আহলে হাদীসকে শক্ত ভিত্তি দিয়েছেন সায়্যিদ নাযির হুসাইন, সিদ্দীক হাসান খান, আবদুল্লাহ গজনবী, সানাউল্লাহ অমৃতসরী ও হুসাইন বাটালভী প্রমুখ। এরা সবাই মাদখালি মতবাদ তৈরি হওয়ার আগেই গত হয়েছেন। তবে পরবর্তীতে সৌদি পৃষ্ঠপোষকতায় সালাফী আলিমরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক সালাফী মতবাদ রপ্তানি করেছেন, তখন মাদখালি মতবাদটি আপনাআপনি সাথে চলে এসেছে। কিছু বিচ্ছিন্নতা হয়তো পাওয়া যাবে, নইলে ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহৎ সালাফী-আহলে হাদীস ঘরানা রাজনৈতিক আদর্শগত দিক থেকে একশভাগ তাবদী (অন্যকে বিদআতি ফাতওয়া দেওয়া) ও মাদখালি। তারা শাসকের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কোনোরূপ প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করাকে হারাম মনে করেন।
মোটকথা, সালাফী মতবাদ বর্তমানে দুটি বড় ধারায় বিভক্ত। একটি ধারা সালাফী-আহলে হাদীস-মাদখালি। অর্থাৎ আকীদার দিক থেকে সালাফী, ফিকহী দিক থেকে আহলে হাদীস এবং রাজনৈতিক দিক থেকে মাদখালি। এরা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। আরেকটি ধারা আইএস প্রমুখ দলের। অর্থাৎ আকীদার দিক থেকে সালাফী, ফিকহী দিক থেকে আহলে হাদীস এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় সন্ত্রাসী। যদিও সন্ত্রাসী শব্দটা ব্যবহার করা কতটুকু যৌক্তিক কিংবা তাদেরকে সন্ত্রাসী বানানোর পেছনে পশ্চিমাদের ভূমিকা কতটুকু- সেটিও বিবেচ্য। তবুও তাদের পরিচয় দেওয়ার জন্য প্রচলিত শব্দটি ব্যবহার করা ছাড়া উপায় ছিল না। তবে এ দুটি ধারার মধ্যে সালাফী-আহলে হাদীস-মাদখালী ধারাটি যেহেতু অধিকতর প্রভাবশালী, এবং তারা সরকারের আনুগত্যকে সর্বাবস্থায় ফরয মনে করে, তাই তারা যেকোনো প্রশ্নে সরকারের বিরুদ্ধে যেতে রাজি নয়। এমনকি দ্বীনী কিংবা জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে যখন কোনো বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, হরতাল, ডেমোনস্ট্রেশন হয়, তারা সেটিকে সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের বিপরীত হিসেবে দেখে। তাই দাবি করেই বলা যায়, যতক্ষণ সালাফী মতবাদের ভেতর মাদখালি ধারাটি তাদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হিসেবে কার্যকরী থাকবে, ততদিন মজলুম মুসলমানদের অধিকার আদায় অথবা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দূরূহ। অপরদিকে সালাফী মতবাদের সন্ত্রাসী ধারার কথা যদি ধরি, তাহলে তাদের চিন্তাধারা ও কার্যক্রমও সমর্থনযোগ্য নয়। তাই সালাফী মতবাদের অনুসারীদের কাছ থেকে আপাতত দ্বীনী কিংবা উম্মাহ’র স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে কিছুই আশা করা যায় না।

ফেইসবুকে আমরা...