আরবী قرب বা قربان শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে قربانى (কুরবানী) হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। যার অর্থ হলো নৈকট্য, সান্নিধ্য। পারিভাষিক অর্থে ঈদুল আদহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামী তরীকায় যে পশু যবেহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এই শব্দটি বিভিন্ন সমার্থক শব্দের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন: (১) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন’ (সূরা কাউসার, আয়াত-২)। এখানে النحر শব্দটি কুরবানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। (২) لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানীর বিধান রেখেছি’ (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৪)। এখানে منسك শব্দটি কুরবানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। (৩) হাদীসে কুরবানীর ঈদকে عيد الاضحى বলা হয়েছে। এই প্রবন্ধে কুরবানীর শিক্ষা, সুন্নাহর আলোকে কুরবানী ও কুরবানী নিয়ে নাস্তিকদের কিছু প্রশ্নের জবাব সংক্ষেপে লিখার চেষ্টা করব। ইন শা আল্লাহ!
কুরবানীর কিছু শিক্ষা
০১। কুরবানী আমাদেরকে ত্যাগ ও উৎসর্গের শিক্ষা দেয়। আমাদের উপর ইসলামের যে বিধানই আবশ্যক হোক, আমাদের তা পালন করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে। কুরবানীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যদি আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখবো, ইবরাহীম (আ.) মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে সকল ইচ্ছা আকাঙ্খাকে কুরবানীর জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত নি:সন্তান থাকার পর বার্ধক্যে উপনীত হন। তবুও আল্লাহর প্রতি অশেষ বিশ্বাস আর আস্থার কারণে একটি সন্তান লাভের আশায় তাঁর দরবারে দুআ করেন। তিনি কবূল করলেন এবং একটি সন্তান দান করলেন যার নাম ছিল ইসমাঈল (আ.)। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ.) কে বহু পরীক্ষা করছেন। এবার পরীক্ষার বিষয় হলো সন্তানের প্রতি ভালোবাসা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা অপেক্ষায় বেশি না কম। নির্দেশ এলো প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাহে কুরবানী করার। ইবরাহীম (আ.) নির্দেশ পাওয়ার পর ছুটে চললেন মক্কায়, দেখলেন ছেলে শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করতে যাচ্ছেন। পিতার কাজে সহযোগিতার করতে পারে এমন সুন্দর সন্তান। এই বয়সের সন্তান দেখে পিতার চক্ষু শীতল হয়। সারাক্ষণ সাথে রাখতে, অনেক কিছু শিখাতে চায় প্রতিটি পিতার মন। কিন্তু মহান আল্লাহ যিনি এই সন্তান দিয়েছেন, তিনিই চেয়েছেন। সুতরাং সকল বাধা উপেক্ষা করে তিনি কুরবানীর জন্য পুত্রকে আল্লাহর দরবারে পেশ করতে মনস্থ করেন। ছেলের মতামত জানতে চাইলে যোগ্য সন্তানের মতই বললেন, হে আমার পিতা! আপনি আপনার রবের নির্দেশ বাস্তবায়ন করুন, আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের মধ্যেই পাবেন।
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ
-অতঃপর যখন তিনি (ইসমাঈল) তাঁর (পিতার) সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলেন, তখন (ইবরাহীম) তাকে বললেন, প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী? তিনি (ইসমাঈল) বললেন, প্রিয় বাবা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তা পালন করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারীই পাবেন। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০২)
দৃশ্যটা একটু কল্পনা করুন, আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নে কতটা আবেগ, আর রবের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে পরে এমনটি হতে পারে। আল্লাহ এটাই দেখতে চেয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে জান্নাত থেকে একটি পশু পাঠিয়ে কুরবানীর ব্যবস্থা করলেন। ইবরাহীম (আ.) তাঁর অন্তরে আল্লাহ প্রেম ছাড়া অন্য কিছুই স্থান দেননি। তাই তিনি এমন কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হন। জীবনের প্রতিটি ধাপে দুনিয়ার সবকিছুর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রাধান্য দেওয়াই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।
০২। কুরবানী আমাদেরকে ইসলাহে নিয়্যাত ও তাকওয়ার শিক্ষা দেয়। নিয়্যাতের কারণেই কাজ ভালো বা খারাপ হয়। আপনি অনেক টাকা দান করলেন, মাদরাসা বানালেন বা শহীদ হলেন, যদি আপনার এর দ্বারা দুনিয়াবী উদ্দেশ্য থাকে তাহলে এগুলো ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে না। অন্যদিকে যদি একটা সাধারণ কাজেও ভালো নিয়্যাত থাকে, সেটাই ভালো কাজ হিসেবে গণ্য হবে। আল্লাহ কুরবানীর বিষয়ে বলেছেন,
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ
-আল্লাহর কাছে তোমাদের পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না (তিনি তা গ্রহণ করেন না), বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৭)
গরু বা ছাগল যত বড়ই হোক, সেইটা গ্রহণ করবেন না। গ্রহণ করবেন তাকওয়া, সহীহ নিয়্যাত। সুতরাং আমাদেরও প্রতিটি কাজে নিয়্যাত সহীহ করতে হবে। কাজ যতই ছোট হোক, অবশ্যই নিয়্যাত সহীহ করতে হবে।
০৩। কুরবানীর ইতিহাস আমাদেরকে আলাপ-আলোচনা ও পরামর্শ করতে শিক্ষা দেয়। ইবরাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.) কে যবেহ করার বিষয়ে দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি নবী, আদেশ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তবুও প্রয়োগের আগে তিনি ছেলের অনুমতি নিয়েছেন “প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, তোমাকে আমি যবেহ করছি, এখন তোমার অভিমত কী?” দায়িত্বশীলরা তাদের অধীনস্থদের সাথে অনুমতি ও পরামর্শ গ্রহণ করবে এটা কুরবানীর অন্যতম শিক্ষা।
০৪। কুরবানী আমাদের সামাজিকতা শিক্ষা দেয়। হাদীসে আছে, প্রথমে কুরবানীর গোশত তিনদিনের বেশি জমিয়ে রাখার অনুমতি ছিলো না। কেন ছিলো না? যাতে মানুষের মধ্যে সামাজিক দায়বোধ গড়ে উঠে, নিজের ভাইকে ক্ষুধার্ত রেখে আপনি যে খেতে পারবেন না, এই শিক্ষা দেবার জন্যই তিনদিনের বেশি জমিয়ে রাখার অনুমতি ছিল না। যদিও উলামায়ে কিরাম পরবর্তীতে গোশত জমিয়ে রাখার অনুমতি দিয়েছেন, তবে তা সামাজিকভাবে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের অধিকার আদায়ের পর।
০৫। কুরবানী আমাদেরকে সবরের শিক্ষা দেয়। আমরা যদি ত্যাগ স্বীকার করতে চাই, নিয়্যাত শুদ্ধ করতে চাই বা আমার অধীনস্থের উপর ইসলামী বিধান প্রয়োগ করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে সবর করতে হবে। আমাদের নানা বাধা আছে, যেমন: নাফসানী খাহিশাত, শয়তানে মালউন, দুষ্ট মানুষ, কঠিন পরিবেশ, এ সবই আমাদের সামনে বাধা সৃষ্টি করে। এসব বাধার সামনে অটল থাকার জন্য আমাদের সবর করতে হবে। প্রিয় সন্তানকে যবেহ করার মত ত্যাগ স্বীকার করতে ইবরাহীম (আ.)-কেও সবর করতে হয়েছে। ইবরাহীম (আ.) সত্যি সত্যি যবেহ করতে উদ্যত না হয়ে স্বপ্নের তাবীল করতে পারতেন। আমরা হলে তো মনে হয় তা-ই করতাম। কিন্তু তিনি কোনো ধরনের তাবীল করেননি। নিয়্যাতকে খালিস করেছেন, আমার আল্লাহর আদেশ তা স্বপ্নেই হোক সেটাই পালন করতেই হবে। এই যে তিনি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সবর করেছেন। এটা আমাদের জন্য এক অনন্য শিক্ষা হয়ে আছে। আমাদেরকেও জীবনে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে অনেক সবরের পরিচয় দিতে হবে।
সুন্নাহর আলোকে কুরবানী
০১। আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
من وجد سعة فلم يضح، فلا يقربن مصلانا
-যার সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানী করল না (অর্থাৎ কুরবানী করার সংকল্প তার নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৮২৭৩)
০২। আলী (রা.) বলেন,
أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نستشرف العين والأذنين، ولا نضحي بعوراء، ولا مقابلة، ولا مدابرة، ولا خرقاء، ولا شرقاء
-আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা যেন (কুরবানী পশুর) চোখ ও কান ভালো করে দেখে নিই। আমরা যেন অন্ধ, কানের অগ্র বা শেষ ভাগের অংশ কাটা, যার কানের পাশের দিক ফাঁড়া যা গোলাকার ছিদ্র রয়েছে- এমন পশুর দ্বারা কুরবানী না করি। (সুনান আবূ দাউদ, হাদীস-২৮০৪)
০৩। বারা ইবন আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لا يضحى بالعرجاء بين ظلعها، ولا بالعوراء بين عورها، ولا بالمريضة بين مرضها، ولا بالعجفاء التي لا تنقي
-খোঁড়া জন্তু যার খোঁড়ামী স্পষ্টভাবে প্রকাশিত, অন্ধ পশু যার অন্ধত্ব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত, রুগ্ন পশু যার রোগ দৃশ্যমান এবং ক্ষীণকায় পশু যার হারের মজ্জা পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে তা দ্বারা কুরবানী করা যাবে না। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-১৪৯৭)
০৪। আম্মাজান আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য একটি দুম্বা আনতে বললেন, যার শিং রয়েছে, যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। এ রকম একটি দুম্বা আনা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আয়িশা! আমাকে ছুরি দাও। আরো বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। তিনি ধারালো করে দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুম্বাটি মাটিতে শায়িত করলেন। এরপর বিসমিল্লাহ বলে যবেহ করলেন এবং বললেন-
بِاسْمِ اللهِ، اللهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ، وَآلِ مُحَمَّدٍ، وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ
-ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল করুন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১৯৬৭)
অন্য হাদীসে এসেছে যে, কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআ পড়েছেন,
بِسْمِ اللهِ مِنْكَ وَلَكَ اللهُمَّ تَقَبَّلَ مِنْ مُحَمَّدٍ
-আল্লাহর নামে। ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে। ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে কবূল করুন। (আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদীস-১১৩২৯)
০৫। উম্মে সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِذَا دَخَلَتِ الْعَشْرُ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعَرِهِ وَبَشَرِهِ شَيْئًا
-যখন যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন উপস্থিত হয়, আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, তবে সে যেন নখ, চুল ইত্যাদি কর্তন না করে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-১৯৭৭)
আব্দুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে দ্বীন বিষয়ে জানতে এসেছিল। ফিরে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘আমাকে ইয়াওমুল আদহার আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে) এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। লোকটি বলল, আমার কাছে যদি শুধু একটি দুধের পশু থাকে আমি কি তা-ই কুরবানী করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
لا، ولكن تأخذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فتلك تمام أضحيتك عند الله عز وجل
-বরং তুমি সেদিন তোমার মাথার চুল কাটবে (মুণ্ডাবে বা ছোট করবে) নখ কাটবে, মোচ কাটবে এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। (আবূ দাউদ, হাদীস-২৭৮৯)
সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত কুরবানী করেছেন, কোনো বছর বাদ দেননি। কখনো কখনো কুরবানী করার জন্য সাহাবীদের মধ্যে কুরবানীর পশু বণ্টন করেছেন। হযরত আলী (রা.) কে আদেশ করেছেন যেন (ইন্তিকালের পরেও) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করা হয়। যেমন, হযরত আলী (রা.) বলেন,
أمرني رسول الله صلى الله عليه وسلم أن أضحي عنه بكبشين، فأنا أحب أن أفعله (مسند أحمد، ح/১২৭৯
কুরবানী নিয়ে নাস্তিকদের বিভিন্ন সংশয়ের সংক্ষিপ্ত জবাব
০১। নাস্তিকরা বলে যে, আমরা মুসলমানরা নাকি ঈদুল আদহার নামায পড়ে উৎসব করে পশু হত্যায় মেতে উঠি। আচ্ছা ধরেন, কোনো নাস্তিকের বোনের বিয়ে ঠিক হল। বোনের বিয়ের উপলক্ষ্যে সে একটা গরু কিনল। তো তার পরিবারের সকলেই কিন্তু খুশি মনে আনন্দ সহকারে ঐ গরুটাকে জবাই করে রান্না করবে যাতে তার বোনের বিয়েতে যারা আসবে তাদের কে এই গরুর মাংস দ্বারা আপ্যায়ন করতে পারে। এই যে খুশি মনে গরুটিকে জবাই করা হবে এতে কি কোন অন্যায় থাকার কথা? গ্রাম এলাকায় ঘরে কোন মেহমান আসলে মেহমানের সম্মানার্থে কিন্তু ঠিকই ঘরের বড় মোরগটাকে জবাই করে। এই মোরগ যবাই কিন্তু তারা সবাই আনন্দ সহকারেই করে। কারণ এর দ্বারা ঘরের মেহমান কে ভালোভাবে আপ্যায়ন করা যাবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গরু-ছাগল-মুরগি যবেহ করা হয়। এইটা কি অন্যায়? এই যে বোনের বিয়ের উপলক্ষ্যে খুশি মনে একটা গরু জবাই দেওয়া বা মেহমানের সম্মানার্থে ঘরের বড় মোরগটাকে যবাই করা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পশু যবেহ করা, এই সবই মানব জীবনের একটা স্বাভাবিক দিক। আর এই বিষয়গুলোতে যদি কোন দোষ না থাকে, তাইলে শুধু কুরবানীর সময় পশুর প্রতি এতো দরদ উতলে উঠে কেনো?
০২। কুরবানী আসলে নাস্তিকরা আরেকটি আপত্তি করে যে, পশুকে “জবাই করা” নাকি নিষ্ঠুরতা। যদিও নাস্তিকরা খাওয়ার সময় গরু, ছাগলের গোশত পেট ভরেই খায়। এটা তাদের কাছে দোষের কিছু না। তো যাই হোক “পশু জবাই করা” নিষ্ঠুরতা কিনা পর্যালোচনা করে দেখা যাক। ইসলাম প্রাণী সমূহকে খাওয়ার উপযোগী বানানোর জন্য যে মৌলিক শর্ত দিয়েছে তা হচ্ছে শরীরের সমস্ত রক্ত বের হয়ে যাওয়া। এ জন্য স্বাভাবিকভাবে ঘাড়ের সামনের দিকটার রক্ত প্রবাহের চারটির প্রধান রগ এর সঙ্গে কন্ঠনালীও কাটতে হবে। উক্ত প্রাণীর গলা, সামনের অৎঃবৎু বা ধমণী কেটে ফেলার কারণে রক্তের সাথে জীবাণুসহ সকল প্রকার বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি গোশত পেশীসহ অন্যান্য ড়ৎমধহ বা অঙ্গ প্রতঙ্গে স্থানান্তরিত হওয়ার সুযোগ পায় না। আর এ কারণেই যবেহকৃত প্রাণীর চর্বি, গোশত ও অস্থিমজ্জা তথা অন্যান্য অঙ্গ জীবাণুমুক্ত থেকে যায়। আর মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি ও বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য এই পদ্ধতির ব্যবস্থা করেছেন। এই নিয়মের খিলাফ যে কোন নিয়মে যবেহ করলে, উক্ত প্রাণীর দেহাভ্যন্তরে জীবাণু এবং অন্যান্য আবর্জনা থেকে যায়, যার গোশত চর্বি ইত্যাদির সাথে ভক্ষণের ফলে জটিল রোগ হতে পারে। ইউরোপের দেশগুলোতে লোকেরা প্রাণীকে কাঠের ফ্রেমে দাঁড় করিয়ে উপর থেকে একটি ভারী ছোরা ফেলে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলত। গবেষণায় জানা গেছে যে, এভাবে মেশিনে কাটা গোশত খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু তার ভিতরে রক্ত থেকে যায়। তারপর তারা পশু জবাইয়ের আধুনিক পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। পশুটির মাথায় বিদ্যুতের শক দেওয়া হয় এবং পশুটি যখন বেহুঁশ হয়ে যায় তখন তার পায়ে শিকল লাগিয়ে উলটো করে লটকে দেওয়া হয়। অতঃপর ঐ বেহুঁশ প্রাণীর গলায় ধারাল মেশিন চালিয়ে জবাই করা হয়। এই আধুনিক পদ্ধতিতে জবাই করার ক্ষেত্রে পশুকে বেহুঁশ করার জন্য বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা হয়। এর কারণে হিষ্টামিনের সৃষ্টি হয় যা ভক্ষণে মানব শরীরের ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। তাই প্রমাণ হলো জবাই করা ইসলামী পদ্ধতি প্রাণীর জন্য আরামদায়ক এবং আহারকারীদের জন্য অধিক নিরাপদ।
০৩। নাস্তিকদের একটি প্রশ্ন হলো, প্রতি বছর কুরবানীর সময় শুধু বাংলাদেশেই প্রায় লক্ষাধিক গরু-ছাগল কুরবানী করা হয়। এই পশুগুলোকে ক্রয় করতে গিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকাটা কুরবানীর পেছনে খরচ না করে দেশের প্রায় ৫০ লক্ষ সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের মাঝে বিতরণ করে দিলে পরিবারপ্রতি অনেক টাকাই পেতো। ফলে পুনর্বাসন, স্বাস্থ্য, কিংবা উন্নয়নমূলক কোন খাতে টাকাটা ব্যয় হত আর ফলস্বরূপ দেশের জন্য আরো উত্তম কিছু হত।
আমি এই প্রশ্নের সরল কিছু উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি,
ক. প্রথমেই একটি প্রশ্ন করি, কুরবানীর ঈদে পশু কেনা-বেচার কারণে যে টাকা হাতবদল হয় সেটা কি কালোটাকা না সাদাটাকা? এর পুরোটা সাদাটাকা। প্রতিটি পশু হাট থেকে কেনার সময় দামের ৫ থেকে ৬ শতাংশ টাকা হাসিল হিসেবে সরকারি খাতে চলে যায় আর বাকি টাকা পশু বিক্রেতাদের হাতে থাকে। এরা অধিকাংশই এদেশের প্রান্তিক মানুষ। মানে কুরবানীর টাকা ৯৫ শতাংশ টাকা মাত্র এক সপ্তাহে এদেশের প্রান্তিক মানুষদের হাতে পোঁছে যায় এক কুরবানীর ঈদ উপলক্ষে। কতগুলো পরিবারে এই টাকা পৌঁছে যাচ্ছে তার কোন ধারণা আছে তাদের? ধরে নিলাম, প্রতিটি প্রান্তিক পরিবার প্রায় ৫০ হাজার টাকা করে হাতে পায়। অর্থাৎ এদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ প্রান্তিক পরিবারের হাতে মাত্র এক সপ্তাহে প্রায় ৫০ হাজার করে টাকা পৌঁছে যায় কুরবানীর ঈদ উপলক্ষ্যে। এবার নাস্তিকদের প্রস্তাবনায় ফিরে যাই। কুরবানীর টাকা দেশের ৫০ লক্ষ পশ্চাৎপদ পরিবারের মাঝে বিতরণ করতে চায় তারা। তো তারা এটা কীভাবে করবেন? কাকে দায়িত্ব দেবেন? কাকে বিশ্বাস করতে পারবেন যে পাওনা টাকাগুলো প্রাপ্যহাতে এক সপ্তাহে যথাযথভাবে পৌঁছে যাবে?
খ. কুরবানীর গোশতের এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে আর এক-তৃতীয়াংশ দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়। কুরবানীর উপলক্ষ্য ছাড়া অন্য কোন উপায়ে এটার একটি বিকল্প বলে দেখান তো! শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীতে এই একদিন উপলক্ষ্যে যে পরিমাণ খাবার (গোশত) বিতরণ করা হয়, সেটির সেক্যুলার একটি বিকল্প কেউ বলতে পারবে?
গ. কুরবানীর গোশত তো মুসলমানরা একা খায় না, অপরকে দুই-তৃতীয়াংশ দিয়ে তারপর খায়। তারা টাকার হিসাব যদি করবেই তাহলে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ না খেয়ে সেই টাকাটা মানুষকে দিয়ে দেবার দাবি করে না কেনো? সরকারি প্রটোকলের ব্যয়ের হিসেব চেয়ে তারা প্রতিবাদ করে না কেনো? কালোটাকার হিসেব চেয়ে তারা প্রতিবাদ করে না কেনো? ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ শে মার্চ, ১৬ ই ডিসেম্বর রাস্তা-মিনার-সৌধ রঙ করে ফুলের তোড়া বিছিয়ে যে খরচ করা হয় সে টাকা গরীব-দুস্থদের স্বাস্থ্য কিংবা পুনর্বাসন খাতে দিয়ে দেবার দাবিতে কোন প্রস্তাবনা পেশ তারা করে না কেনো? এগুলোর কোনটিই তারা করে না, কখনও করবেও না।
০৪। নাস্তিকরা আরেকটি আপত্তি হলো, কুরবানীর পশুর হাটের কারণে পরিবেশ দূষণ হয়, বিভিন্ন শহরের রাস্তায় যানজট লাগে। একটা কথা আছে বাংলা সাহিত্যে ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাকা’। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা। নাস্তিকতার নামে ক্রমাগত মিথ্যা চর্চা করতে করতে বর্তমানে নাস্তিকরা এখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে ইসলামের বিরোধিতা করতে যেয়ে অদ্ভুদ সব যুক্তি দিচ্ছে আর নিজেরা এইসব হাস্যকর কথা বার্তা বলে আমাদের কাছে সার্কাসের জোকারে পরিণত হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ আর যানজট কি শুধু কুরবানীর সময়েই হয়ে থাকে?
ক. উৎসব পার্বণে যানজট হবেই। দুর্গামূর্তিকে যারা বুড়ি গঙ্গায় নেবে তারাও যানজট লাগায়। পূজামন্ডপ ঘিরেও যানজট লাগে। কই তখন তো তারা কিছু বলে না?
খ. পহেলা বৈশাখে সারা বাংলাদেশের সবচেয়ে মুমূর্ষু রোগীদের পাঠানো স্থান ঢাকা মেডিকেল, পিজি হাসপাতালে ও বারডেমসহ গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে আগত সবগুলো রাস্তাই ব্যারিকেড দিয়ে আটকানো থাকে, চতুর্দিকে থাকে হারাম বৈশাখপ্রেমী অজস্র মানুষের ভীড়, সেখানে অ্যাম্বুলেন্স চলা তো দূরের কথা, পিঁপড়াও হাঁটতে পারেনা, তা নিয়ে নাস্তিকরা কেন প্রতিবেদন করে না? কেন এর বিরুদ্ধে বলে না। কুরবানী পশুর হাটের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী তখন কেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকে? তখন কি মানুষের দুর্ভোগ আর রোগীর কষ্ট হয়না?
গ. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে অবস্থানের কারণে বারডেম, পিজি, ঢাকা মেডিকেলের রোগীরা টানা ৬ দিন ধরে অবরুদ্ধ ছিল। ব্যস্ত হাসপাতালগুলোর পাশে, সামনে অনবরত মাইক বাজানোর কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। বিড়ম্বনায় পড়ছেন হোটেল রূপসী বাংলার দেশি-বিদেশি অতিথিরা। তখন তাদের এই দরদ কই ছিল?
ঘ. যখন রথযাত্রা হয় তখন পুরো ঢাকা শহর থমকে যায়। তখন কেন এর বিরুদ্ধে কথা বলে না?
ঙ. ঢাকা শহরের ভিতরে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা কি শুধু কুরবানীর সময়েই হয়ে থাকে? সারাবছরে যে জনগণ নাক মুখ চেপে রাস্তা দিয়ে হাঁটে তা কী কারণে?
চ. ঢাকার আশে পাশের নদ-নদী মৃত প্রায়। তা কি কুরবানীর কারণে?
ছ. হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরেও হাতিরঝিল প্রকল্পে ময়লা আবর্জনা কি কুরবানীর কারণে?
এই রকম করে নাস্তিকদের প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেওয়া সম্ভব। আসলে এরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবের সময় সবসময় বলবে, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব আসলে তখনই তারা পল্টি মারে।
পরিশেষে বলতে চাই যে, কুরবানীর মূল শিক্ষা আমাদের উদ্দেশ্য যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। আমরা একটি পশু কুরবানী দিয়ে তার গোশত ভক্ষণে রসনা তৃপ্ত করি। আল্লাহ ভীতি কিংবা মহান রবের নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান আজ কোথায়? তা কখনো ভেবে দেখেছি? কুরবানী দিলে গোশত পাওয়া যায়, বাজারের সবচেয়ে দামি পশুটা কিনতে পারলে পত্রিকায় কভারেজ পাওয়া যায়, এই সব কি আমাদের সমাজের পরিচিত দিক নয়? কেননা আমরা আমাদের মনের পশুত্বকে কুরবানী দিতে ব্যার্থ হই বারবার। তাইতো প্রতি বছর কুরবানী আমরা দেই কিন্তু এ থেকে শিক্ষা নিতে ভুলে যাই। আসুন, এবার আমরা শুধু একটি পশু নয়, বরং এর সাথে আমাদের অন্তরে লুকানো পশুত্বকে কুরবানী করার মাধ্যমে ঈদুল আদহা উদযাপন করি। শেষ করতে চাই পবিত্র কুরআনের সূরা আনআম এর ১৬২ নং আয়াত দিয়ে,
قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ
-আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন ও মরণ বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। আমীন!