Logo
প্রাণীর মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ : ইসলাম বনাম প্রগতিশীলতা
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশসহ প্রায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেই সম্মানার্থে বা স্মরণার্থে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভাস্কর্য নির্মাণ করার প্রবণতা রয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে এসব ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতির সামনে ফুলেল শ্রদ্ধা প্রদর্শন, নীরবতা পালন, আবার কখনো মুনাজাত করতে দেখা যায়। আবার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অন্যান্য প্রাণীর ভাস্কর্য ইতিউতি চোখে পড়ে। যদিও প্রচলিত সেক্যুলার কালচারে এ বিষয়টি নন্দনতত্ত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য প্রতীকে পরিণত হয়েছে, কিন্তু ইসলামী শরীআতের দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ বা অন্য যে কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হারাম। এ প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলাপ করব।
পবিত্র কুরআনে নূহ (আ.)-এর সময়কার মুশরিকদের একটি উক্তি বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
وَقَالُوْا لَا تَذَرُنَّ اٰلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَّلَا سُوَاعًا وَّلَا یَغُوْثَ وَیَعُوْقَ وَنَسْرًاۚ
-এবং তারা বলেছিল, তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করো না এবং ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসরকেও পরিত্যাগ করো না। (সূরা নূহ, আয়াত-২৩)
উক্ত আয়াতের তাফসীরে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস রয়েছে। হাদীসের শেষাংশ এরূপ-
أَسْمَاءُ رِجَالٍ صَالِحِينَ مِنْ قَوْمِ نُوحٍ فَلَمَّا هَلَكُوا أَوْحَى الشَّيْطَانُ إِلَى قَوْمِهِمْ أَنِ انْصِبُوا إِلَى مَجَالِسِهِمُ الَّتِي كَانُوا يَجْلِسُونَ أَنْصَابًا وَسَمُّوهَا بِأَسْمَائِهِمْ فَفَعَلُوا فَلَمْ تُعْبَدْ حَتَّى إِذَا هَلَكَ أُولَئِكَ وَتَنَسَّخَ الْعِلْمُ عُبِدَتْ‏
-(আয়াতে উল্লিখিত নামগুলো) নূহ (আ.)-এর সময়কার কতিপয় পুণ্যবান লোকের নাম ছিল। তারা মারা যাওয়ার পর শয়তান তাদের গোত্রের লোকদের মনে এ কথা ঢেলে দিল যে, তারা যেখানে বসে মজলিস করত, সেখানে তোমরা প্রতিকৃতি নির্মাণ করো এবং ওই পুণ্যবান লোকদের নামে এগুলোর নামকরণ করো। তারা তা-ই করল। কিন্তু তখনও ওসব মূর্তির পূজা করা হতো না। মূর্তি স্থাপনকারী লোকেরা মারা যাওয়ার পর যখন মূর্তিগুলোর ব্যাপারে সত্যিকারের জ্ঞান বিলুপ্ত হলো, তখন লোকজন তাদের পূজা আরম্ভ করে দিলো। (সহীহ বুখারী)
উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদীস থেকে জানা যায়, নবী নূহ (আ.) এর সময়কার কতিপয় পুণ্যবান ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর লোকেরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবশত তাদের প্রতিমা তৈরি করেছিল। ইবাদতের উদ্দেশ্যে নয়; বরং প্রতীক বা স্মরণিকা হিসেবে। কালের বিবর্তনে সেই শ্রদ্ধা এক সময় চরম ভক্তিতে রূপ নিয়েছিল এবং পরবর্তী লোকেরা সেগুলোর পূজা করতে শুরু করেছিল।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ
-অতএব তোমরা মূর্তিসমূহের নোংরামি পরিহার করো এবং পরিহার করো মিথ্যা কথাবার্তা। (সূরা হাজ্জ, আয়াত-৩০)
ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদ। ইসলাম এই জায়গায় বিন্দুমাত্র আপোস করতে পারে না। ইসলামে আল্লাহ ছাড়া বা আল্লাহর সাথে মিলিয়ে অন্য কারও ইবাদত করা যায় না। এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য সায়্যিদুল মুরসালীন e দিনের আলোতে ঘাম ঝরিয়েছেন, রাতের আঁধারে ফেলেছেন চোখের পানি। এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর নবী e এর দেহ মুবারক জখম হয়েছে, শরীর থেকে রক্ত ঝরেছে। সাহাবায়ে কিরাম এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য অকাতরে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। ইসলামে সবচেয়ে সংবেদনশীল (Sensitive) বিষয় হচ্ছে তাওহীদ। শিরক করা তো বহু দূরের কথা; যে কাজের মধ্যে শিরকের নাপাক গন্ধ পাওয়া যায়, ইসলাম সেই কাজের আশেপাশেও পা মাড়াতে নিষেধ করেছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ e তাওহীদের সংরক্ষণার্থে মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক ছিলেন। আবূ ওয়াকিদ আল লাইসী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم لَمَّا خَرَجَ إِلَى خَيْبَرَ مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ ‏فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى ‏:‏ ‏”اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ” ‏وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
-যখন রাসূলুল্লাহ e খাইবারের যুদ্ধে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি একটি বৃক্ষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। মুশরিকরা ওই বৃক্ষকে ‘যাতু আনওয়াত্ব’ নামে ডাকত, যেখানে তারা তাদের যুদ্ধাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। কতিপয় সাহাবী বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, যেভাবে ওদের ‘যাতু আনওয়াত্ব’ রয়েছে, এভাবে আমাদের জন্যও একটি ‘যাতু আনওয়াত্ব’ নির্ধারণ করে দিন। রাসূলুল্লাহ e জবাবে বললেন, সুবাহানাল্লাহ! তোমাদের এ কথাটি এরকম, যেভাবে মূসা (আ.) এর কউম তাঁকে বলেছিল, আমাদের জন্য একটি উপাস্য (দেবতা) বানিয়ে দিন, যেভাবে ওদের (কাফিরদের) দেবতা রয়েছে। কসম সেই আল্লাহর, যার হাতে আমার প্রাণ। তোমরাও (এক সময়) তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের পথ অনুসরণ করবে। (তিরমিযী)
লক্ষণীয় বিষয় হলো, সাহাবীরা কিন্তু ওই বৃক্ষকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করতে চাননি, চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সাহাবীরা ঈমানের ব্যাপারে ইস্পাত-দৃঢ় ছিলেন। তাঁরা কেবল এটি প্রতীক বা স্মরণিকা হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূল e এতটুকু কথার উপর এতো বেশি অসন্তুষ্ট হয়েছেন যে, তিনি বনী ইসরাইলের একটি স্পষ্ট শিরকের সাথে সাহাবীদের দাবিকে তুলনা করেছেন। যেখানেই শিরকের সামান্য সম্ভাবনা ছিল, রাসূল e সেখানে শিশাঢালা প্রাচীরের মতো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
বলার উদ্দেশ্য হলো, তথাকথিত কিছু স্কলার বলতে চান, মূর্তি ও ভাস্কর্য আলাদা জিনিস। আমরা তাদের কথা মেনে নিচ্ছি। আসলেই এ দুটি আলাদা জিনিস। উপাসনার উদ্দেশ্যে মূর্তি তৈরি করা শিরক, আর উপাসনার উদ্দেশ্য ছাড়া (মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর) ছবি, প্রতিমা বা প্রতিকৃতি তৈরি করা হারাম। আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন,
أَنَّ أُمَّ حَبِيبَةَ وَأُمَّ سَلَمَةَ ذَكَرَتَا كَنِيسَةً رَأَيْنَهَا بِالْحَبَشَةِ فِيهَا تَصَاوِيرُ فَذَكَرَتَا لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ‏إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
উম্মু হাবীবা ও উম্মু সালামাহ রাসূলুল্লাহ e এর কাছে উল্লেখ করলেন যে, তাঁরা হাবাশায় একটি গির্জা দেখেছেন, যেখানে কিছু প্রতিকৃতি ছিল। রাসূলুল্লাহ e বললেন, তাদের মধ্যে যখন কোনো পুণ্যবান লোক মারা যেত তখন তারা তাদের কবরের উপর উপাসনার জায়গা নির্মাণ করত এবং এসব প্রতিকৃতি তৈরি করে রাখত। এরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জগতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সৃষ্টি হিসেবে গন্য হবে। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবন হাজার আসকালানী বলেছেন, এই হাদীসের মধ্যে যাবতীয় প্রাণীর প্রতিকৃতি (আঁকা বা নির্মাণ করা) হারাম সাব্যস্ত হওয়ার দলীল রয়েছে। (ফাতহুল বারী, ১/৫২৫)। ইমাম নববী বলেছেন, যাবতীয় প্রাণীর ছবি/প্রতিকৃতি (আঁকা বা নির্মাণ করা) স্পষ্টত হারাম কাজ এবং কবিরাহ গুনাহ। তবে ছবি/প্রতিকৃতি যদি প্রাণীর না হয়, তাহলে তা হারাম নয়। (শারহু সহীহ মুসলিম, ১৪/৮১)
আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِي، فَلْيَخْلُقُوا حَبَّةً وَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً
-ওই ব্যক্তির চেয়ে বড় যালিম আর কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির সদৃশ কিছু সৃষ্টি করতে চায়। সামর্থ থাকলে তারা সৃষ্টি করুক একটি বীজ বা একটি অণু। (সহীহ বুখারী)
আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e বলেছেন,
إِنَّ الَّذِينَ يَصْنَعُونَ هَذِهِ الصُّوَرَ يُعَذَّبُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يُقَالُ لَهُمْ أَحْيُوا مَا خَلَقْتُمْ
-যারা চিত্র/ভাস্কর্য তৈরি করে, তারা কিয়ামতের দিন শাস্তি পাবে। তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যেগুলোকে সৃষ্টি করেছিলে, ওগুলোতে প্রাণ দাও। (সহীহ বুখারী)
আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ e বলেছেন,
إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ ‏
-কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাস্তিপ্রাপ্ত হবে চিত্রকর/ভাস্কর। (মুত্তাফাকুন আলাইহি)
উল্লেখিত হাদীসসমূহ প্রাণীর চিত্র অঙ্কন করা এবং প্রতিকৃতি নির্মাণ করাকে স্পষ্টভাবে হারাম এবং কবিরাহ গুনাহর কাজ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। তবে চিত্র বা প্রতিকৃতি যদি মানুষ বা কোনো প্রাণীর না হয়, তবে তা আঁকা ও নির্মাণ করা হারাম নয়। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) এক চিত্রকরকে বলেছিলেন,
وَيْحَكَ إِنْ أَبَيْتَ إِلاَّ أَنْ تَصْنَعَ فَعَلَيْكَ بِهَذَا الشَّجَرِ كُلِّ شَىْءٍ لَيْسَ فِيهِ رُوحٌ
-আফসোস! যদি তোমাকে (জীবিকা অর্জনের জন্য) চিত্র/প্রতিকৃতি তৈরি করতেই হয়, তাহলে গাছপালা বা এরকম কিছু তৈরি করো যার মধ্যে রূহ নেই। (সহীহ বুখারী)
ইসলামে প্রাণীর চিত্র, মূর্তি, প্রতিমা, প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য (যে নামেই ডাকা হোক না কেন) এ জন্য হারাম করা হয়েছে যে, এসব প্রতিকৃতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার জায়গা থেকেই তৈরি করা হয়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাড়তে বাড়তে এক সময় তা ভক্তিতে রূপ নেয়, মানুষজন এসব প্রতিকৃতিকে কুর্নিশ করতে শুরু করে। ধীরে ধীরে উদ্দেশ্যহীন কুর্নিশ উদ্দেশ্যযুক্ত উপাসনায় রূপ নেয়। এতে করে একদিকে যেমন আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে শিরক করা হয়, অপরদিকে স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহর অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যে অনধিকারচর্চা করা হয়।
যেসব তথাকথিত প্রগতিশীল ইসলামিক স্কলার ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতির পক্ষে রায় দেন, তাদের দাবি হচ্ছে, মূর্তি নির্মাণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও পূজার উদ্দেশ্য ব্যতীত প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা হারাম নয়।
তাঁদের প্রথম যুক্তি হচ্ছে, আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) পুতুল দিয়ে খেলেছেন। রাসূল e তাঁকে এমনটি করতে বারণ করেননি। এর মাধ্যমে বুঝা যায় যে, পুতুল বা প্রতিকৃতি ব্যবহার করা জায়েয। দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, নবী সুলাইমান (আ.)-এর জন্য জিনেরা প্রতিকৃতি তৈরি করেছিল। সুতরাং প্রতিকৃতি নির্মাণ করা জায়িয। তৃতীয় যুক্তি হচ্ছে, বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মিত আছে। সুতরাং ভাস্কর্য বা প্রতিকৃতি নির্মাণ করা জায়িয।
প্রথমত, একথা ঠিক যে, আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) বাল্যবয়সে পুতুল দিয়ে খেলেছেন। তিনি নিজে বর্ণনা করেছেন,
كُنْتُ أَلْعَبُ بِالْبَنَاتِ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَكَانَ لِي صَوَاحِبُ يَلْعَبْنَ مَعِي
-আমি নবী e এর ঘরে পুতুল দিয়ে খেলতাম। আমার বান্ধবীরাও আমার সাথে খেলত। (সহীহ বুখারী)
তবে তাঁর পুতুল খেলার উপর কিয়াস করে সাহাবী বা পরবর্তী কোনো ইমাম-আইম্মা প্রাণীর চিত্র অংকন এবং প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্য নির্মাণকে বৈধতা দেননি। কারণ এগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল বিদ্যমান। সিরিয়ার দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীআহ বিভাগের অধ্যাপক ড. হিন্দ আল-খাওলী ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি নির্মাণ সংক্রান্ত মতামত পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, প্রণিধানযোগ্য মত হচ্ছে সেটি, যার সমর্থনে স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান। তা হলো, রূহবিশিষ্ট প্রাণীর প্রতিকৃতি নির্মাণ করা, চাই তা দৈহিক অবয়ববিশিষ্ট হোক (ভাস্কর্য) অথবা দৈহিক অবয়বহীন (চিত্র), চাই সেটি পাথরের তৈরি হোক, কাঠের তৈরি হোক, মাটির তৈরি হোক কিংবা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি হোক, সর্বাবস্থায় এটি হারাম। ইমাম আসকালানী, ইমাম নববী, ইমাম কুরতুবী, ইমাম খাত্তাবী ও ইমাম ইবনুল আবিদীন প্রমুখের মতে, হানাফী, মালিকী, শাফিঈ ও হাম্বলী চার মাযহাবের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এটিকে হারাম করা হয়েছে। কারণ এটি হারাম হওয়ার পক্ষে রাসূল e স্পষ্ট হাদীস বিদ্যমান।
আয়িশা (রা.)-এর পুতুল খেলার ব্যাখ্যায় উলামায়ে কিরামের দুটি মতামত বিদ্যমান। প্রথম মতটি হলো, এই হাদীস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শিশুকন্যাদের খেলার জন্য পুতুল রাখা জায়িয। এটি চিত্র/ভাস্কর্য হারাম হওয়ার সাধারণ হুকুমের মধ্য থেকে বিশেষভাবে আলাদা করা হয়েছে।
অর্থাৎ, প্রাণীর চিত্র, প্রতিকৃতি ইত্যাদি তৈরি ও সংরক্ষণ করা সাধারণভাবে হারাম। তবে শিশুদের খেলার জন্য তা ব্যবহার করা জায়িয। দ্বিতীয় মতটি হলো, আয়িশা (রা.)-এর জন্য পুতুল খেলার সুযোগ ছিল হারাম হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।
অর্থাৎ, তিনি যখন পুতুল খেলেছিলেন, তখন পর্যন্ত এটি হারাম ছিল না। বেশিরভাগ উলামায়ে কিরাম প্রথমোক্ত মতটি সমর্থন করেছেন। অর্থাৎ, শিশুদের জন্য পুতুল খেলা জায়িয, তবে সাধারণভাবে প্রাণীর অবয়ববিশিষ্ট চিত্র বা প্রতিকৃতি তৈরি ও ব্যবহার করা হারাম।
দ্বিতীয়ত, এ কথা ঠিক যে, জিনরা সুলাইমান (আ.)-এর জন্য ভাস্কর্য তৈরি করত। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاء مِن مَّحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَّاسِيَات
-তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। (সূরা সাবা, আয়াত-১৩)
যদি ধরেও নিই যে, ভাস্কর্যগুলো প্রাণীর অবয়ববিশিষ্ট ছিল, তবুও তাতে আমাদের জন্য প্রাণীর চিত্র বা ভাস্কর্য নির্মাণ করা বৈধ হয় না। কারণ এটি সুলাইমান (আ.)-এর শরীআতে হয়তো বৈধ ছিল; কিন্তু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ e এর শরীআতে বৈধ নয়। রাসূল e নিজে এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন। এমন অনেক কাজ রয়েছে, যা এক নবীর যুগে বৈধ ছিল, অন্য নবীর শরীআতে এসে নিষিদ্ধ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ নবী ইয়াকূব (আ.) একসাথে দুজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন, যারা পরস্পর সহোদরা ছিল। কিন্তু মুহাম্মদ e এর শরীআতে এটি নিষিদ্ধ। নবী ইউসুফ (আ.)-এর ভাইয়েরা তাঁকে সিজদা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের নবীর শরীআতে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করা, চাই ইবাদতের জন্য হোক কিংবা সম্মান প্রদর্শনের জন্য, স্পষ্টত হারাম। তাই সুলাইমান (আ.)-এর সময়কার ভাস্কর্য নির্মাণ করাকে আজকের যুগে ভাস্কর্য নির্মাণ করার দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, যেহেতু রাসূল e স্পষ্টভাবে এটিকে নিষেধ করেছেন।
তৃতীয়ত, এটি ঠিক যে, বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মিত আছে। আমি নিজেই দেখেছি। কিন্তু বিভিন্ন মুসলিম দেশ ইসলামী শরীআতের দলিল নয়, সেসব রাষ্ট্র শয়ীআহ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছেও না। অপরদিকে আল্লাহ বলেন,
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
-রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করো। আর তিনি তোমাদেরকে যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো। (সূরা হাশর, আয়াত-৭)
তাই উপরিউক্ত তিনটি যুক্তি দিয়ে প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করার বৈধতা দেওয়া যায় না। সুতরাং আলিম-উলামার উচিত হচ্ছে, নির্দ্বিধায় মানুষের কাছে, এমনকি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছে কুরআন-সুন্নাহর দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া এবং নিঃসংকোচে বাতিলের বিরুদ্ধে হকের আওয়াজ উঁচু করা। এটি না করলে নাহী আনিল মুনকারের হক সঠিকভাবে আদায় হবে না।

ফেইসবুকে আমরা...