‘আহলুল বাইত’ পরিভাষাটি ব্যবহার হয় নবী পরিবারকে বুঝাতে। ‘আহলুল বাইত’ দ্বারা উদ্দেশ্য উম্মাহাতুল মুমিনীন তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনসঙ্গীনীগণ, নবী তনয়া ফাতিমা (রা.), হযরত হাসান ও হুসাইন (রা.)। পাশাপাশি হযরত আব্বাস, হযরত আলী, হযরত জাফর ও হযরত আকিল (রা.) এবং প্রত্যেকের বংশধরও এর অন্তর্ভূক্ত। কুরআন-হাদীসে আহলুল বাইতকে সম্মান প্রদান, ভালোবাসা ও তাদেরকে অনুসরণ করার আদেশ পাওয়া যায়। তাদের বিশেষ মর্যাদার নমুনা হিসেবে যাকাত নির্দিষ্ট খাতের আওতায় পড়া সকলের জন্য বৈধ থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আহলুল বাইতের সম্মানে তাদের জন্য করেছেন নিষিদ্ধ।’1 পরিতাপের বিষয়, নবী পরিবার সম্বন্ধীয় স্পর্শকাতর এই ‘আহলুল বাইত’ শ্রেণিকে কেন্দ্র করে অতীত থেকেই দ্বন্দ্ব হয়ে আসছে। একদল মুহাব্বাতের নামে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়। তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে খুলাফায়ে রাশিদা ও অন্যান্য সাহাবীদের উপর বানোয়াট অভিযোগ আরোপিত করে। এটি অপরাধ। এই দলকে রাফেযী বলা হয়। এরা শিআ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আরেকটি গোষ্ঠী আছে, যারা আহলুল বাইতের বিশেষ সম্মান ও মুহাব্বাতকে প্রত্যাখ্যান করে। উল্টো নবীপরিবারকেই দোষী বানানোর অপচেষ্টা করে। এদেরকে বলা হয় নাসিবী সম্প্রদায়। তারা খারিজীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উভয়দল সীমালঙ্ঘনকারী। এখানে আরেকটি বিভ্রান্তি ঘটে আকীদা এবং মাযহাবে। এ দুই ফিরকাভুক্ত নয়—এমন একটি শ্রেণির ক্ষেত্রে। তারা নিজেদের আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সাথে সম্পৃক্ত করেন। কিন্তু বাস্তবে অনেকাংশে নাসিবীদের চরিত্রে উপস্থিত হন। আহলুস সুন্নাহর যারাই আহলুল বাইতের বিশেষ মর্যাদার কথা বলেন, কারবালা নিয়ে হুসাইন (রা.) এর পক্ষালম্বন করেন— তাদেরকে রাফেযীদের দিকে ঠেলে দিতে আনন্দ পান। কুরআন-সুন্নাহ থেকে আহলুল বাইতকে মুহাব্বাতের নির্দেশনা এবং তারা হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও কিংবা কারবালায় নবী পরিবারের পুরুষদের শহীদ ও মহিলাদের সাথে বেয়াদবিতে ইয়াযীদের সন্তুষ্টি ইতিহাস সাক্ষী দিলেও, এখানে যেন তারা শাস্ত্রীয় নীতিহীন এবং অনুভূতিশূন্য। অথচ আহলুল বাইতের ভালোবাসা পরিহার করে এরকম রোবটিক ও সজাগ নিদ্রা যাপনের ভূমিকা জমহুর আহলে সুন্নাতের মানহাজবিরোধি। কখনই উচিৎ নয় সীমালঙ্ঘনকারীদের রুখতে গিয়ে আহলুল বাইতের প্রতি বেইনসাফী করা। কথা ছিলো আহলুল বাইতের প্রতি এমন ভালোবাসা লালন করা, যা কুরআন-সুন্নাহ সমর্থন করে। যে মুহাব্বাত ধারণ করেছিলেন সাহাবা, তাবিঈ এবং আয়িম্মায়ে কিরাম। ইমাম শাফিঈ (র.) তার কবিতায় আহলুল বাইতের মুহাব্বাত ও আবশ্যকতা এবং এক্ষেত্রে অবাঞ্চিত প্রশ্নকারীকে তিরস্কার করে খুব সুন্দর নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। আহলুল বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে এটিই জমহুর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অবস্থান। ‘দিওয়ানে শাফিঈ’ থেকে আহলুল বাইত সম্পর্কে নির্বাচিত কিছু পঙক্তিমালা ও তার সরলানুবাদ এবং সংশ্লিষ্ট আলোচনা উপস্থাপন করছি।
আহলুল বাইতকে ভালোবাসার আবশ্যকতা ও তাদের মর্যাদা
ইমাম শাফিঈ (র.) আহলুল বাইতে রাসূল e কে অত্যন্ত মুহাব্বাত করতেন। তাদের মর্যাদার আলোচনা করতেন। তাদের প্রতি ভালোবাসা রাখাকে বলতেন ফরয। এই ভালোবাসার আবশ্যকতা ও তাদের মর্যাদার বিষয়টি ইমাম কবিতার ভাষায় প্রকাশ করে বলেন,
یَا آلَ بَیتِ رَسولِ الله حُبُّکُمُ
فَرضٌ مِنَ الله فی القُرآنِ أنزَلَهُ
یکفیکُم مِن عظیمِ الفخر أنّکُم
مَن لَم یُصلِّ عَلَیکُم لَا صَلَاةَ لَه
-হে আহলুল বাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনাদের মুহাব্বাতের মাকাম তো এমন—
আল্লাহর নাযিলকৃত কুরআন থেকে যা ফরয সাব্যস্ত হয়েছে।
আপনাদের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় এটাই কাফী যে, আপনারা এমন শ্রেণি,
কেউ দুরূদের ভিতর আপনাদের শামিল না করলে তার দুরূদ পড়াই পূর্ণ হয় না।
প্রথম শ্লোকে বর্ণিত আবেদনের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, পবিত্র কুরআনেই আহলুল বাইতের প্রতি ভালোবাসা লালন করার নির্দেশনা ও আসল রয়েছে। সূরা শুরায় আল্লাহ তাআলা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলেন,
قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَىٰ
-(হে নবী) আপনি বলুন! আমি দ্বীন প্রচারের বিনিময়ে কোনো প্রতিদান চাই না কেবলমাত্র আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্য চাই। (সূরা শুরা, আয়াত-২৩)
তাফসীরে বাইদাভী, ইমাম ইবন জাওযীর যাদুল মাসীর, ইমাম রাযীর তাফসীরে কাবীর, ইমাম সুয়ূতীর আদ-দুররুল মানসুর—এই প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থাদিসহ আরও অনেক তাফসীরে মাওয়াদ্দাতা ফিল কুরবা দ্বারা আহলুল বাইতের কথা উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া অনেক হাদীসও রয়েছে এর স্বপক্ষে।
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা আহলুল বাইতকে কালিমা মুক্ত রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এখানে রাব্বে কারীমের আহলুল বাইতের প্রতি ভালোবাসার ধারণা পাই। যেমন, ইরশাদ হচ্ছে,
اِنَّمَا یُرِیۡدُ اللّٰهُ لِیُذۡهِبَ عَنۡکُمُ الرِّجۡسَ اَهۡلَ الۡبَیۡتِ وَ یُطَهِّرَکُمۡ تَطۡهِیۡرًا
-হে নবীর পরিবার! আল্লাহ তোমাদেরকে সর্বপ্রকার কলুষমুক্ত করে পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান। (সূরা আহযাব, আয়াত-৩৩)
সাহাবীরা আহলুল বাইতকে ভালোবাসা ও সম্মানপ্রদর্শনের নির্দেশনা দিতেন। ইমাম বুখারী (র.) বর্ণনা করেন, ইসলামের প্রথম খলীফা আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) আহলুল বাইতকে সম্মান প্রদানের আদেশ দিয়ে বলেন,
ارْقُبُوْا مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم فِيْ أَهْلِ بَيْتِهِ
-তোমরা মুহাম্মাদ e এর পরিবার-পরিজনের প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করবে।2
কবিতার দ্বিতীয় শ্লোকে শাফিঈ (র.) আহলুল বাইতের উপর দুরূদ না পড়লে ব্যক্তির দুরূদ পরিপূর্ণ হয় না বলে উল্লেখ করেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুরূদ শরীফ পাঠের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ، وَعَلَى أَزْوَاجِهِ وَذُرِّيَّتِهِ…
-আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদের উপর শান্তি বর্ষণ করুন। শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর পত্নীগণ ও পরিবারের উপর…।3
নবীজি e এখানে আহলুল বাইত তথা নবী e এর পরিবারকে দুরূদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এজন্য ইমাম শাফিঈ ছাড়াও ফকীহগণের অনেকেই যেকোনো দুরূদ পড়ার সময় আহলুল বাইতকে দুরূদের ভিতরে অন্তর্ভুক্ত করাকে দুরূদ কবূলের জন্য জরুরি বলেছেন।
নবী পরিবারের মুহাব্বাত মুক্তির সম্বল
বিচার দিনে সবাই পেরেশান থাকবে। তখন আমলনামা ডান হাতে আসাই হবে কামিয়াবীর স্বীকৃতি। ইমাম শাফিঈ সেদিন আহলুল বাইতেই নিজের নাজাতের আশা ব্যক্ত করে বলেন,
آلُ النَّبــــیِّ ذَریــــــعَتی
وَ هُــــم إلَیهِ وَسیــــلـَتی
أرجُو بِهِــــم أُعطَی غَداً
بِیَدِ الیـــَمینِ صَحیـــفَتی
-আহলুল বাইতের মুহাব্বাতই আমার সম্বল
তারাই আমার মুক্তির ওয়াসিলা।
আশায় আছি বিচার দিনে এ মুহাব্বাতের বদলা
আমলনামা মোর ডান হাতেই প্রদান করা হবে।
সাহাবী যাইদ ইবন আরকাম (রা.) এর কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার খুতবায় উম্মতের কাছে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরার জন্য দুটি জিনিস রেখে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। প্রথমটি কুরআন এবং দ্বিতীয়টি আহলুল বাইত উল্লেখ করে বলেন,
وَأَهْلُ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي أُذَكِّرُكُمُ اللَّهَ فِي أَهْلِ بَيْتِي
-আর (দ্বিতীয়টি) আমার আহলুল বাইত। সাথে সাথে আমি তোমাদেরকে আমার আহলুল বাইতের (ইযযতের) বিষয়ে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমাদেরকে আমার আহলুল বাইতের (ইযযতের) বিষয়ে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমাদেরকে আমার আহলুল বাইতের (ইযযতের) বিষয়ে আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। (এভাবেই তিনবার বলেন)।4
নবী পরিবারের ভালোবাসায় রাফিযী অপবাদ তুচ্ছ জিনিস
ইমাম শাফিঈ (র.) এর নামে একটি অপবাদ বেশ চড়াও হয়ে গেলো। অপবাদটি তিনি শিআ রাফিযী হয়ে গেছেন। কারণ ইমাম আহলুল বাইতকে মুহাব্বাত করেন। একবার হজ্জের সময় হাজীগণ মিনার বরকতময় ‘মসজিদুল খাইফ’-এ অবস্থানে আছেন। তখন ইমাম শাফিঈ (র.) দাঁড়িয়ে আহলুল বাইতের মুহাব্বাতে তার দৃঢ়তার ঘোষণা দেন,
إن کانَ رَفضاً حُبُّ آلِ مُحمَّدٍ
فَلیَشهَدِ الثَّقَلانِ أنّی رَافضِی
-যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের মুহাব্বাত রাফিযীদের কাজ হয় (সীমালঙ্ঘন)
তাহলে জিন-ইনসান সবে জেনে রাখো! অবশ্যই আমি এমন রাফিযী!
কারণ কুরআন-হাদীস থেকে আহলুল বাইতকে মুহাব্বাত করার নির্দেশনা মুতাওয়াতির পর্যায়ের। উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামা (রা.) বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আলী (রা.) এর সম্মন্ধে বলতে শুনেছি,
لَا يُبْغِضُكَ مُؤْمِنٌ وَلَا يُحِبُّكَ مُنَافِقٌ
-হে আলী! কোনো মুমিন তোমার সাথে শত্রুতা করবে না; কোনো মুনাফিক তোমাকে মুহাব্বাত করবে না।5
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমা (রা.) কে মুহাব্বাত করার ব্যাপারে বলেন,
فَاطِمَةُ بَضْعَةٌ مِنِّي، فَمَنْ أَغْضَبَهَا أَغْضَبَنِي
-ফাতিমা আমার দেহের অংশ। যে তাকে কষ্ট দিলো, সে আমাকে কষ্ট দিলো।6
একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান-হুসাইন (রা.) উভয়কে সাথে করে সাহাবীদের নিকট আসলেন। তখন প্রশ্ন করা হলো, হে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি কি তাদের ভালোবাসেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي
-যে তারা দুজন (হাসান-হুসাইন)-কে ভালোবাসলো, সে আমাকে ভালোবাসলো, আর যে তাদের (হাসান-হুসাইন) সাথে বিদ্বেষী হলো, সে আমার সাথে বিদ্বেষ করলো।7
আহলুল বাইতের প্রতি নিজের ভালোবাসার অভিব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকবার প্রকাশ করেছেন। বুখারী শরীফে লিবাস অধ্যায়ে এবং মুসলিম শরীফে ফাদাইলুস সাহাবা অধ্যায়ে উল্লেখ আছে নবীজি হাসান (রা.) এর ব্যাপারে বলেন, আমি হাসানকে ভালোবাসি, আল্লাহ তুমিও হাসানকে ভালোবাসো।
ইমাম শাফিঈ (র.) আহলুল বাইতের মুহাব্বাতকে প্রত্যাখ্যানকারীর প্রতিত্তোরে উপরোক্ত পঙক্তিটি দিয়ে নিজের অনঢ় অবস্থান বুঝিয়েছেন।
ভালোবাসা সকল সাহাবীর জন্য
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদায় খুলাফায়ে রাশিদুন উম্মতের মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ। এখানে খুলাফায়ে রাশিদুন বা আহলুল বাইত উভয়কে সম্মান দেওয়া কখনই পরস্পর বিরোধী নয়। এজন্য খলীফা আবূ বকর-উমর-উসমান (রা.) এর মর্যাদার আলোচনা করলে আহলুল বাইতের বিরোধিতা কিংবা আহলুল বাইতের মর্যাদা তুলে ধরলে সাহাবী বিদ্বেষকে আবশ্যক করে না। প্রত্যেকে আপন জায়গায় সম্মাননীয়। ইমাম শাফিঈ (র.) সে কথাই বলেন,
إِذا نَحنُ فَضَّلنا عَلِيّاً فَإِنَّنا
روافِضُ بِالتَفضيلِ عِندَ ذَوي الجَهلِ
وَفَضلُ أَبي بَكرٍ إِذا ما ذَكَرتُهُ
رُميتُ بِنَصبِ عِندَ ذِكري لِلفَضلِ
فَلا زِلتُ ذا رَفضٍ وَنَصبِ كِلاهُما
بِحِبَّيهِما حَتّى أُوَسَّدَ في الرَملِ
-আমরা আলী (রা.) কে মর্যাদা দিলে
এ বয়ানে মূর্খের কাছে হয়ে যাই রাওয়াফিয।
আবু বকর (রা.) এর ফদীলত বললে
অপবাদ আসে নাসিবী (আহলুল বাইত বিরোধী) নামে!
তাদের ভালোবাসায় আমিতো রাফিযী- নাসিবী উভয়টি হয়ে আছি;
আবূ বকর ও আলীর ভালোবাসার পরিণামে মরুর বালিতে লাশ হতে রাযি।
আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের যুগ তথা সাহাবীদের সময়কে সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ বলেছেন,
خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِي، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ
-সর্বোত্তম মানবশ্রেণি হলো আমার যুগের, অতঃপর এর পরেরটি (তাবিঈ), অতঃপর তার পরেরটি (আতবাউত তাবিঈন)।8
সেই শ্রেষ্ঠ যুগের কোনো একজন সাহাবীকে তাচ্ছিল্য করা শরীআতে বৈধতা নেই। নির্ভরযোগ্য অসংখ্য হাদীস থেকে এই নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করেন,
لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِي، فَلَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا بَلَغَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ
-তোমরা আমার সাহাবীদের গালাগাল করবে না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ ইসলামের জন্য ব্যয় করে, তবু দ্বীনের জন্য তাদের এক মুদ (কোনো কিছু দুই হাতের পাতা কব্জি পর্যন্ত একত্রিত করে যে পরিমাণ নেওয়া যায়) দ্রব্য ব্যয়ের সমমান হওয়া দূরে থাক, অর্ধেকই হবে না।9
এজন্যই ইমাম শাফিঈ (র.) এখানে কোনো প্রান্তিকতার দ্বারে নিজেকে নিয়ে যান নি। সকল সাহাবীর প্রতিই সম্মান রাখতেন। তাদের একজনকে অন্যজনের প্রতিপক্ষ বানান নি। খুলাফায়ে রাশিদুন এবং আহলুল বাইতের যে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে তা শরীআতসম্মত পন্থায়ই প্রদান করেছেন। এখানে বিরোধিতা দেখেন নি। এটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মানহাজ।
আহলুল বাইতের আলোচনা অপছন্দ কারীকে জবাব
নবী পরিবারের আলোচনাকে কেউ কেউ মেনে নিতে পারতো না। তাচ্ছিল্য করতো। বলতো এগুলোতো রাফিযীর বৈশিষ্ট্য। তাদের জবাবে ইমাম শাফিঈ খুবই সুন্দর করে বলেছেন,
قَالُوا تَرَفَّضتَ قُلتُ کَلَّا
مَا الَّرفضُ دینی وَ لا إعتِقادی
لکِن تَوَلَّیتُ غَیرَ شَکٍّ
خَیرَ إمَامٍ وَ خَیرَ هَادی
إن کَانَ حُبُّ الوَلِیِّ رَفضاً
فإنَّ رفَضِی الی العِباد
-তারা প্রশ্ন করে আপনি কি রাফিযী হয়ে গেলেন? আমি বলি কখনও না!
আমল কিংবা আকীদায় রাফিযী বৈশিষ্ট্যের কিছুই আমার কাছে নেই।
তবে আমি একজনকে প্রশ্নাতীতভাবে অভিভাবক গ্রহণ করেছি
যিনি শ্রেষ্ঠ ইমাম এবং শরীআতের শ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শক।
যদি অভিভাবকের মুহাব্বাত লালন হয়ে যায় রাফিযীর কাজ;
তবেতো এমন বান্দার কাছে আমি বেশক রাফিযী!!
এভাবে আলী (রা.) কে উম্মতের ওলী উল্লেখ করে মুসনাদে আহমদ ও তিরমিযীসহ অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে সহীহ সূত্রের হাদীস রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ
-আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা (অভিভাবক)।10
ইমাম আরেকটি পঙক্তিতে আহলুল বাইতের সায়্যিদা ফাতিমা (রা.) এর পরিবারের দিকটি তুলে বলেন,
إذا فی مجلس نذکر علیا
وسبطیه وفاطمة الزکیة
یقال۔ تجاوزوا یاقوم هذا
فهذا من حدیث الرافضیة
برٸت الی المهیمن من اناس
یرون الرفض حب الفاطیمیه
-যখনই আমরা কোনো মজলিসে আলী (রা.)
হাসান-হুসাইন; ফাতিমা যাকিয়্যার আলোচনা করি
বলা হয়- ‘হে সম্প্রদায়! দ্বীনের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছো
আহলুল বাইতের আলোচনা তো রাফিযীদের কাজ।
তাদের থেকে আমার রক্ষক (আল্লাহ) এর কাছে নিজেকে মুক্ত পেশ করেছি
যারা ফাতিমা (রা.) এর পরিবারের মুহাব্বাতকে সীমালঙ্ঘন মনে করে!
কারবালার বিভীষিকায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তার প্রিয় নাতিদ্বয় হাসান-হুসাইন (রা.) সম্পর্কে বলেন,
الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ سَيِّدَا شَبَابِ أَهْلِ الْجَنَّةِ
-হাসান এবং হুসাইন (রা.) উভয়ে জান্নাতী যুবকদের সরদার।11
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতী যুবকদের দুই সরদারকে ভালোবাসেন এবং আল্লাহও যেন তাদেরকে ভালোবাসেন সে মর্মে হাদীস,
اللَّهُمَّ إِنِّي أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا
-হে আল্লাহ! আমি তাঁদের উভয় (হাসান ও হুসাইন)কে ভালোবাসি, আপনিও তাঁদেরকে ভালেবাসুন।12
আহলুল বাইতের সদস্য হুসাইন (রা.) এর প্রতি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসা ও হুসাইন (রা.) এর ভালোবাসা আমাদের জন্য আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম— এই সুসংবাদ উম্মতকে জানিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
حُسَيْنٌ مِنِّي وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ أَحَبَّ اللَّهُ مَنْ أَحَبَّ حُسَيْنًا حُسَيْنٌ سِبْطٌ مِنَ الأَسْبَاطِ
-হুসাইন আমার থেকে আর আমি হুসাইন থেকে। যে হুসাইনকে ভালোবাসে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন। (আমার) নাতিদের মধ্যে হুসাইন একজন।13
এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে হুসাইন (রা.) এর প্রতি ভালোবাসা রাখাকে আবশ্যক করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) কে একব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় মশা মারার হুকুম জিজ্ঞেস করলো। তিনি ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলেন। জানলেন, এ ব্যক্তি ইরাক থেকে এসেছেন। ইবন উমর (রা.) বেশ দুঃখ পেয়ে বললেন, যারা নবীর বংশধরকে শহীদ করলো, তারা মশা মারার বিধান জানতে চায়! আমি নিজ কানে শুনেছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান-হুসাইন (রা.) কে বলছেন,
هُمَا رَيْحَانَتَايَ مِنَ الدُّنْيَا
-হাসান-হুসাইন দুনিয়াতে আমার দুটো সুগন্ধি ফুল।14
এতো মর্যাদাপূর্ণ সেই আহলুল বাইতের অন্যতম জান্নাতী যুবকদের সরদার হুসাইন (রা.) কারবালায় যালিম ইয়াযিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে পরিবারসহ শহীদ হয়েছেন! এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের কেন্দ্রীয় সরকার ইয়াযিদ কোনো শাস্তি তো দেয়নি, উপরন্তু তাদের অনেকের পদোন্নতি হয়েছিল! পরবর্তী পুরো উম্মাহ এটা মেনে নেয় নি। এজন্য যুগে যুগে সাহাবী, তাবিঈ, তাবে তাবিঈ ও আয়িম্মায়ে কিরাম ইয়াযীদ বাহিনীর হাতে হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ায় হৃদয়ে তৈরি হওয়া ক্ষতের বহিঃপ্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। নিন্দা করেছেন ইয়াযীদসহ সংশ্লিষ্ট সবার। জয়গান করেছেন জান্নাতের সরদার হুসাইন (রা.) এর। উম্মতে মুহাম্মাদী e এর উজ্জ্বল নক্ষত্র ইমাম শাফিঈ (র.) তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কবিতার ভাষায় প্রকাশ করেন,
تَــــأَوَّهَ قَلبــي والفــــــــــؤادُ كَئيبُ
وأُرِّق نَومــــي فــالسُّهــــادُ عجيبُ
-আমার হৃদয় বিদীর্ণ; মনটা দুঃখ ভারাক্রান্ত
নিদ্রাহীন বিষন্নতা বলে এ যেন ঘুমের নির্বাসন!
فمَنْ مُبلغٌ عنّي الحسينَ رسـالةً
وإنْ كَــــرِهَتْها أنفــسٌ وقلـــــــوبُ
-হুসাইনের জন্য আমার আঁকুতিভরা চিঠির বাহক কে হবে
যদিও বেদনাবিধুর এই বার্তা মানবপ্রাণ ধারণ করতে চায় না।
ذبيحٌ بــلا جُـــــرمٍ كـــــأنَّ قميصَهُ
صبيغٌ بمــــاءِ الأُرْجُــــوانِ خضيبُ
-এ বার্তা যে অপরাধহীন শহীদের জবাই হওয়ার বয়ান, যার জামাটিরই পরিণতি
লাল-নীল রঙের পানিতে মেখে ভীতিকর রক্তিম বর্ণীয়।
فَلِلسَّيفِ إعـــــوالٌ وللرُّمـــح رَنَّـــةٌ
وللخَيْـلِ مــن بَعد الصَّهيـلِ نحيبُ
-অতঃপর সে তরবারির জন্যই আর্তনাদ; বর্শার জন্যই এই রক্তঝর্ণা
আফসোস ঘোড়ার হ্রেষা-হাঁকে, এটা যেন গগনবিদারী ক্রন্দন।
تـزلـزلــتِ الـدُّنيــــــــا لآلِ مـحـمّـدٍ
وكــادتْ لهم صُــمُّ الجبـــالِ تذوبُ
-মুহাম্মাদ e এর পরিবারের অপমানে বিশ্বজগত প্রকম্পিত
তাদের মায়ায় কঠিন পাহাড়ও গলে পড়ে তরলপদার্থের মতো।
وغارتْ نجــومٌ واقْشَعَرّت كــواكبٌ
وهُتِّكَ أستــــــــارٌ وشُــقَّ جيـــوبُ
-তারকারাজি নুইয়ে পরে; আলোকরাশি ঝলসে যায়
এ যাতনায় যে জামা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়; পৃথক হয় গলাবন্দ।
ইমাম শাফিঈ (র.) কতই না সুন্দর করে আহলুল বাইতের জন্য ভালোবাসার আসক্তিকে মনের মাধুরি মিশিয়ে প্রকাশ করেছেন,
لئنْ كـــــانَ ذَنبَي حــــبُّ آلِ محمّدٍ
فذلكَ ذنبٌ لســـتُ عنْـــهُ أتــــــوبُ
-যদি মুহাম্মাদ e এর পরিবারের ভালোবাসা আমার অপরাধ হয়ে থাকে
এটা তো এমন অপরাধ যার মাগফিরাত চাইতে আমি তাওবাহ করবো না।
همُ شُفعائي يومَ حَشـرِي ومَوْقِفي
إذا مَــا بَدَتْ للنّاظرينَ خُطـــــــوبُ
-তারা তো আখিরাতের সে ভয়াবহতায় আমার শাফাআতকারী
যেদিন লোকেরা শুধু দেখবে, কিন্তু কথার কপাট থাকবে রুদ্ধ।
আল্লাহ যেন উম্মাতে মুহাম্মদীর প্রত্যেককে তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় আহলুল বাইতের ইযযত রক্ষায় সচেষ্ট করেন। অন্তরে তাদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা পয়দা করে দেন। আর এই আয়োজন যেন আমাদের নাজাতের ওয়াসীলা বানান। আমীন!
উৎসগ্রন্থ
দিওয়ানে ইমাম শাফিঈ (র.), তাহকীক শাইখ মুহাম্মাদ ইবরাহীম সালীম
দিওয়ানে ইমাম শাফিঈ (র.), তাহকীক শাইখ ড. ইসমাইল বাদী ইয়াকুব
তথ্যসূত্র
১. সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৪০৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৯২৬৫; সূরা শুরা, আয়াত-২৩; সূরা আহযাব, আয়াত-৩৩
২. সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৭১৩
৩. সহীহ বুখারী, হাদীস- ৬৩৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস-৪০৭
৪. সহীহ মুসলিম, হাদীস- ২৪০৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১৯২৬৫
৫. মুসনাদে আহমদ, হাদীস-২৬৫০৭; সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭১৭
৬. সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৭১৪
৭. সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস-১৪৩; মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৭৮৭৬
৮. সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৬৫১
৯. সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৬৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস-২৫৪১
১০. সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৩১; মুসনাদে আহমদ, হাদীস-৯৫০
১১. সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৬৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস-১০৯৯৯
১২. সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৭৪৭
১৩. সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৭৭৫
১৪. সহীহ বুখারী, হাদীস-৩৭৫৩