পৃথিবীতে আল্লাহ নানা ধরনের, নানা পেশার মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সবার ভালো লাগাও সমান নয়। কারও কৃষিকাজ ভালো লাগে আবার কারও সেই কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে ভালো লাগে। কেউ ঘরবাড়ি বানানোর সরঞ্জাম তৈরি করেন আবার কেউ ঘরবাড়ি বানান। কেউ খাবার রান্না করেন আবার কেউ লাকড়ির যোগান দেন। এভাবে কত শ্রেণি-পেশার ব্যবস্থা যে আল্লাহ তাআলা রেখেছেন, তা গুণে শেষ করা যাবে না। মানুষের নানামুখী পেশার উপর ভিত্তি করেই প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সমাজব্যবস্থা টিকে আছে। এজন্য মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অত্যন্ত বেশি। যেমন কারও পৃথিবীতে জীবন কাটাতে হলে প্রথমেই তার একটি ঘর দরকার হবে। এখানে ঘর তৈরি করতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। তার খাবারেরও প্রয়োজন হবে। খাবারের মাছ-মাংসের জন্য তাকে অবশ্যই জেলে এবং রাখালের দ্বারস্থ হতে হবে। আবার ভাত অথবা রুটির জন্য কৃষকের দ্বারস্থ হতে হবে। শুধু ঘর আর খাবারেই হবে না, তার জামা-কাপড় দরকার। এজন্য তাঁতশিল্পে দক্ষ মানুষ দরকার। অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা লাগবে। তখন একজন চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
নবী-রাসূলগণ সমগ্র মানবজাতির আদর্শ। আমরা দেখতে পাই, তাঁরা সবাই নানা ধরনের পেশায় যুক্ত ছিলেন। যেমন আদম, শীস, ইউনুস ও ইয়াকূব (আ.) কৃষিকাজ করেছেন; ইবরাহীম, হুদ, সালিহ, শুআইব (আ.) পশুপালন করেছেন, দাঊদ (আ.) কামারের কাজ করেছেন, নূহ ও যাকারিয়া (আ.) কাঠ সংগ্রহের কাজ করেছেন। প্রত্যেক নবী-রাসূলই কোনো না কোনো হালাল পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। আমাদের মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শৈশবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মেষ চড়িয়েছেন। যখন তিনি পরিণত বয়সে পৌঁছেছেন, বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে বিদেশে ব্যবসায়িক সফরে গিয়েছেন। আবূ সাঈদ আল খুদরী (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে উটকে খাদ্য দিতেন, ঘর ঝাড়– দিতেন, জুতো মেরামত করতেন, কাপড়ে তালি দিতেন, ছাগলের দুধ দোহাতেন, খাদিমের সাথে খেতেন, সে ক্লান্ত হয়ে গেলে সাহায্য করতেন। বাজার থেকে পরিবারের জন্য জিনিসপত্র বয়ে আনতে তিনি লজ্জা পেতেন না। তিনি ধনী-গরীব সবার সাথে হাত মেলাতেন, আগে সালাম দিতেন, কোনো আপ্যায়ন অবজ্ঞা করতেন না, যদিও তা নি¤œমানের খেজুর দিয়েও হতো। তিনি যা পেতেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন, তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, মহানুভব চরিত্রের, তাঁর সঙ্গ ছিল আনন্দদায়ক, তাঁর মুখম-ল ছিলো উজ্জ্বল, মুচকি হাসতেন, ভ্রুকুটি ছাড়াই তিনি বিষণœ থাকতেন। তিনি ছিলেন কোনো ধরনের হীনতা ছাড়াই বিনয়ী এবং অপচয় ব্যতীত দানশীল। তাঁর হৃদয় ছিল কোমল ও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দয়ার্দ্র। তিনি কখনো পেটপুরে খাননি এবং কোনোকিছুর প্রতি লোভ নিয়ে হাত বাড়াননি।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তিনি অবলীলায় উপরোক্ত কাজগুলো করেছেন। এগুলোকে মানহানিকর বা তাঁর সুউচ্চ মর্যাদার সাথে অবমাননাকর বিবেচনা করেননি। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে যুগে যুগে মুসলিম মনীষীরা হালাল শ্রেণিপেশায় যুক্ত থেকেছেন। কোনো কাজকেই তারা ছোটো করে দেখেননি।
বর্তমান যুগে আমরা ইসলামের শিক্ষা থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছি এবং এতে আমাদের পরকালীন ক্ষতির পাশাপাশি জাগতিক ভিত্তিও নড়বড়ে হয়ে গেছে। পশুপালন, কৃষিকাজ, ছোটোখাটো ব্যবসা, দিনমজুরি- এসব বিষয়কে এখন সরকারি-বেসরকারি উচ্চ বেতনের চাকরির চেয়ে নিচু চোখে দেখা হয়। যেসব কাজ নবী-রাসূলগণ করে গেছেন, তা কি কখনও তুচ্ছ হতে পারে?
বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লামা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী র. (কায়েদ ছাহেব)। তিনি ছারছীনা দরবার শরীফের মাহফিলে প্রায়ই জুতো পালিশের দোকান দিতেন এবং নিজেই কিছু পয়সার বিনিময়ে জুতো পালিশ করতেন। অথচ তখন তিনি ছারছীনা দারুচ্ছুন্নাত আলিয়া মাদরাসারই ভাইস-প্রিন্সিপাল পদে কর্মরত ছিলেন। মাহফিলে আগত অতিথিদের মধ্যে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তিনি যে শ্রেষ্ঠতম ধনী ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপরও কোনো বৈধ পেশাকেই যে ছোট করে দেখতে নেই, সেটা বুঝানোর জন্য তিনি এমন করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত রুমের সামনে সবসময় লেখা থাকতো-
ওগো মুসলমানের ছেলে,
কাজ করিলে মান যাবে তোর
কোন কিতাবে পেলে?
আমরা এখন দেখি, একজন কিছুটা শিক্ষিত হলে এবং কিছু সার্টিফিকেট অর্জন করলেই একটি উচ্চ বেতনের চাকরি করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকেন। চাকরির পদসংখ্যা যেহেতু সীমিত, তাই চাকরিপ্রার্থীদের বেশিরভাগই আশানুরূপ চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগতে থাকেন। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করে বছরের পর বছর ধরে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যান। অথচ সুযোগ থাকার পরও তারা অন্য কোনো পেশায় নিজেকে যুক্ত করার কথা চিন্তাও করেন না। এটাকে নিতান্তই মানহানিকর এবং উচ্চশিক্ষার সাথে অসামঞ্জস্যশীল মনে করেন। অথচ পেশার সাথে একাডেমিক শিক্ষার সংযোগ যে থাকতেই হবে, তা তো নয়।
পূর্বসূরি বিখ্যাত আলিমগণ, যাদের লেখা বই পড়ে আমরা শিক্ষালাভ করি, ডিগ্রি অর্জন করি, তাদের পেশাগত বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হতে হয়। তারা জ্ঞানার্জনের সময় জ্ঞানার্জন করেছেন, ছাত্রদের শিক্ষা দিয়েছেন, কালজয়ী সব বই লিখেছেন। কিন্তু যে পেশাই সহজ মনে হয়েছে, বেছে নিয়েছেন। সেটাকে তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখেননি।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা.) নবী-রাসূলগণের পরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। আলী (রা.) কখনও কখনও দিনমজুরি করেছেন। মুহাজির সাহাবীদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী এবং আনসার সাহাবীদের অধিকাংশ কৃষক ছিলেন। বিভিন্ন সাহাবীদের জীবনী পর্যালোচনা করলে পশুপালন, কৃষিকাজ, তাঁতের কাজ তথা বুননশিল্প, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরি, খেজুর গাছের পাতা দিয়ে তোষক-বালিশ তৈরি, কাঠের আসবাবপত্র তৈরির কাজ, কসাইয়ের কাজ, কামারের কাজ (তরবারী, তির, বর্শা, হাঁড়ি-পাতিল, বর্ম-শিরস্ত্রাণ তৈরি), স্থানীয় বাজার ও দূরদেশে ব্যবসা, দোকানদারি, দিনমজুরিসহ নানামুখী পেশার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একবার প্রখ্যাত তাবিঈ ইমাম ইবন সিরীনের কাছে এক লোক আসার পর তিনি বললেন, ‘তুমি ব্যবসা করো না কেন? আবূ বকর কুরাইশদের (শ্রেষ্ঠ) ব্যবসায়ী ছিলেন।’ ইবন সিরীন (র.) এর নিজেরও ঘি-এর ব্যবসা ছিল।
যেসকল মুসলিম মনীষীর কালজয়ী গ্রন্থ আজ পুরো পৃথিবীর মানুষ পড়ে থাকে, তাঁদের নামের শেষে যুক্ত পদবি তাঁদের নানামুখী পেশাকে নির্দেশ করে। যেমন:
১. الآجري (আল আজুরী): পোড়া ইট কেনা-বেচার ব্যবসায়ী।
২. الباقلاني (আল বাকিল্লানী): মটরশুঁটির ব্যবসায়ী।
৩. التوحيدي (আত তাওহীদী): তাওহীদ জাতীয় খেজুরের ব্যবসায়ী।
৪. الجصَّاص (আল জাস্সাস): দেয়াল প্লাস্টার, চুনকাম করা ইত্যাদির শ্রমিক।
৫. الحاسب (আল হাসিব): গণিতে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব।
৬. القفَّال (আল কাফফাল): তালা তৈরি বা তালা মেরামতের শ্রমিক।
৭. الخرَّاز (আল খাররায): জুতা মেরামতকারী ও মুচি।
৮. الفرَّاء (আল ফাররা): পশুর লোমের ব্যবসায়ী।
৯. القطعي (আল কিতঈ): টুকরো কাপড়ের ব্যবসায়ী।
১০. القدوري (আল কুদুরী): হাঁড়ি-পাতিলের ব্যবসায়ী।
বিশ্বখ্যাত আলিমদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো পেশায় যুক্ত ছিলেন। এসব পেশা থেকে যে আয় হতো, সেগুলো তারা জ্ঞানার্জন ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন। ইমাম আবূ হানীফা (র.) এর নিজের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। তাঁর কারখানা থেকে এমন বহুমূল্যের কাপড় উৎপন্ন হতো, যা অন্য কোথাও পাওয়া দুর্লভ ছিল। ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি ছাত্রদের পেছনে ব্যয় করতেন। ইমাম আবূ ইউসুফ (র.) ইমাম আবূ হানীফার অর্থসাহায্যে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইসলামের খিদমতেও ইমাম আবূ হানীফা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন। ইমাম যায়িদ ইবন আলী (র.) যখন আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তিনি একাই তাকে ১২ হাজার দিরহাম পাঠিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ব্যবসা না থাকলে এমন বিপুল খিদমতের আনজাম দেওয়াটা সম্ভব হতো না।
সূফী সাধকগণ দুনিয়াবিরাগের চর্চা করতেন। কিন্তু এরপরও তাঁরা ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন, যাতে আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে যেন হাত পাততে না হয়। আবুল হুসাইন নূরী, জুনাইদ বাগদাদী, সিররি আস সাকতী, ফরীদুদ্দীন আত্তার প্রমুখের বাজারে দোকান ছিল। সায়্যিদুত তাইফা বা সূফীদের সর্দার হিসেবে প্রসিদ্ধ জুনাইদ বাগদাদী (র.) প্রতিদিন দোকানে ঢুকে পর্দা ঝুলিয়ে দিতেন এবং চারশত রাকাআত নামায পড়তেন। এরপর বাড়ি ফিরে যেতেন। এছাড়া অনেক সূফী বিভিন্ন পেশায় নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন। যেমন ইবরাহীম ইবন আদহাম (র.) আঙুরের ক্ষেত পাহারা দিতেন। আবূ হাফস আল হাদ্দাদ কামারের কাজ করতেন।
দেখা যাচ্ছে, জগদ্বিখ্যাত ইমাম ও সূফীসাধকগণ কেউই হালাল পেশা থেকে দূরে থাকেননি। কোনো কাজকে ছোটো করেও দেখেননি। তাঁরা বিপুল পরিমাণ ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এই জ্ঞানকে কখনই অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। আমাদের বর্তমান সমাজচিত্র পুরোটাই উলটে গিয়েছে। কোনো আলিম ধর্মীয় বক্তব্য রেখে, অর্থ উপার্জন করলে আমরা তাকে বিরাট বড় আলিম মনে করে সমাদর করি এবং একই আলিম যদি বাজারে একটি দোকান দিয়ে বসেন, তাকে তাচ্ছিল্য করি। অথচ শেষোক্ত কাজটিই ছিল প্রকৃত সালাফদের অনুসরণ।
বর্তমান যুগে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা অনৈক্য। এই অনৈক্যের পেছনে অন্যতম অনুঘটক হলো আর্থিক দীনতা। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের পেছনে আমরা যতই ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাই না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রাপ্তির বিষয়টি মুখ্য থাকে। তাই পেশাগত বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে আর্থিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারলে আমাদের মন-মানসিকতা যেমন উদার হবে, তেমনি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকেও আমরা অনেকাংশে মুক্ত থাকতে পারব।

