গত আগস্টের পাঁচ তারিখে স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশের কথা সকলের মুখে মুখে চর্চিত হয়েছে, তার সাথে এর আগের যে কোনো সময়ের পরিস্থিতির মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। অল্প দিনের ব্যবধানে এতো বড় ধরনের পরিবর্তন সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে যেহেতু এক দলীয় বা এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন চলছিল গণতন্ত্রের নামে, ফলে সে সময় মানুষের রাজনৈতিক অধিকারকে জঘন্য উপায়ে হরণ করা হয়েছিল। পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সরকারের এই অল্প দিনের শাসনের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি থেকে শুরু করে নানা অভিযোগ থাকতে পারে, কিন্তু জনগণের রাজনৈতিক অধিকারে যে বর্তমান সরকার মোটের উপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না, তা সকলেই স্বীকার করবেন। সাবেক স্বৈরাচারের দল ব্যতীত সকল দলমতের মানুষই তাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার অবারিত সুযোগ পাচ্ছেন।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের রাজনীতিতে ইসলামপন্থার প্রাসঙ্গিকতার আলোচনা নিশ্চয়ই মোটেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। ইসলামপন্থার প্রতি রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে ৫ আগস্টের পর সারা দেশে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক পরিসরে ইসলামপন্থী সক্রিয়তার বৃদ্ধিও ঘটেছে, এমনকি ৫ আগস্ট সেনাপ্রধান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনাকালে দেশব্যাপী তুলনামূলক অধিক সংগঠিত ইসলামপন্থী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের আমীরকেও আমন্ত্রণ করেছিলেন, যে জামায়াত কিনা তার কয়েকদিন আগে নিষিদ্ধ হয়েছিল। এসবই এই আদর্শের ধারকদের জন্য নিঃসন্দেহে আশাপ্রদ বিষয়।
তবু দিন যত গড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে ইসলামপন্থীরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ঠিকমতো ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন, স্বাধীনতাপরবর্তী এই অকল্পনীয় অনুকূল পরিবেশকেও রাজনীতির ময়দানে ইসলামপন্থার উত্থানে যথাযথরূপে কাজে লাগাতে পরছেন না। আগামীর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে এর পিছনের কারণসমূহ পর্যালোচনা অপরিহার্য।
এক্ষেত্রে সবার আগে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা আলোচনার দাবি রাখে। জামায়াতে ইসলামী সারা দেশের সর্বত্র সংগঠনের দিক থেকে অন্য ইসলামী দল থেকে এগিয়ে থাকবে, এমনকি বিগত শাসনামলে তারা যে আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন দাঁড় করিয়েছে, সেটির শক্তিমত্তাও রাজনীতি সচেতন কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না। স্বৈরাচারী সংগঠনে যোগ দিয়ে প্রকাশ্যে সেই সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে নিজেদের আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন দাঁড় করানোর বিষয়টি বেশ রোমাঞ্চকর বটে। কিন্তু ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন আর গণমানুষের সমর্থন সম্পূর্ণে ভিন্ন দুটি বিষয়। বাংলাদেশের ইসলামপন্থী তো দূরে থাক, যেকোনো আদর্শের রাজনৈতিক দলের তুলনায় জামায়াতের ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন অধিক বিস্তৃত, কিন্তু তাদের সেই সংগঠনে আলিম-উলামার অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম হওয়ায় গণমানুষের নিকট বিভিন্ন ঘরানার আলিম-উলামার যেই গ্রহণযোগ্যতা, সেটা তাদের না হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ ভিন্ন আদর্শের সংগঠনের ছদ্মবেশে নিজের সংগঠনের ক্যাডার গোছানো যতটা সহজ, সাধারণ জনগণকে নিজেদের দিকে টেনে আনা ততটা সহজ নয়, তদুপরি ধর্মভীরু বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ইসলামপন্থার জন্য আলিম-উলামাকেই নিজেদের আদর্শ মনে করে, যাদের উপস্থিতি আবার জামায়াতের সংগঠনে তুলনামূলক কম।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য আলিম-উলামার সাথে জামায়াতের প্রশিক্ষিত ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকলে সামগ্রিকভাবে একটি ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারতো। তাত্ত্বিক দিক থেকে এই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও বারবার মুখে বলাও হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, তাদের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী আলিমদের বিরুদ্ধে তারা তাদের প্রোপাগান্ডার মেশিনারি ব্যবহারে একটুও দ্বিধাবোধ করছে না। এমনকি ৫ আগস্টের পর জামায়াতের সাথে ঐক্য হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল, এমন অনেক ঘরানার আলিমদের বিরুদ্ধেও জামায়াতের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি প্রচণ্ড সক্রিয় রয়েছে। ইসলামপন্থীদের মধ্যকার বিরোধ কোন নতুন বিষয় নয়, কিন্তু মুখে সেই বিরোধ ভুলে ঐক্যের কথা বলে আবার কার্যত সেই বিরোধের কারণে ভিন্ন মতাদর্শী আলিমদের পিছনে নিজেদের প্রোপাগান্ডা মেশিনারিকে শতভাগ সক্রিয় রাখলে তাতে ঐক্যের আহ্বানের আন্তরিকতা আর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিশ্চয়ই অবান্তর নয়।
জামায়াতে ইসলামী তাদের ক্যাডারভিত্তিক সংগঠনের উপর ভর করে সাধারণ অবস্থায় দেশব্যাপী অনলাইন কিবা অফলাইনে; বিশেষত অনলাইনে নিজেদের অসাধারণ উপস্থিতি জানান দিতে সক্ষম হয়, যা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে এমন এক মনোভাব তৈরি হয়েছে যে, তাদের ধারণা এই মুহূর্তে ইসলামপন্থার একমাত্র কিংবা প্রধান প্রতিনিধি তারাই, তাদের একক আধিপত্যে অন্যান্য ইসলামপন্থীরা তাদেরকে সঙ্গ দিবেন। কিন্তু আগেই উল্লেখ করেছি, ক্যাডারভিত্তিক সাংগঠনিক শক্তিমত্তা সত্ত্বেও গণমানসের গ্রহণযোগ্যতার বিচারে তারা কোনভাবেই শীর্ষে নেই, ফলে তাদের এই একাধিপত্য কায়েমের মনোভাব ঐক্যের প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান অন্তরায়।
একক আধিপত্য যে শুধু রাজনৈতক দিক থেকে কায়িম করতে চায়, এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। আদর্শিক দিক থেকেও তাদের অবস্থান মূলত একই। এর ফলে তারা ঐক্য চায় ঠিকই, কিন্তু সেটা শতভাগ তাদের আদর্শের ভিত্তিতে। তারা ঐক্য চায়, কিন্তু যাদের সাথে ঐক্য চায় তাদের মতাদর্শ তাদের সাথে একটু তফাত দেখা দিলেই তারা আর ছাড় দিতে রাজি নয়। সর্বশক্তিতে তখন আবার সেই ভিন্নমতকে জনমানসে নেতিবাচকরূপে তুলে ধরতে সবধরনের প্রচেষ্টা শুরু করে দেয়, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের শক্তিমত্তার বদৌলতে অন্তত সামাজিক মাধ্যমে সেটা করতে আংশিক সফলও হয়।
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সঙ্গত কারণেই স্বৈরশাসনামলে কার কী ভূমিকা ছিল, তা খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এক্ষেত্রেও জামায়াতের বয়ান ও বাস্তবতার মধ্যে বিশাল তফাত। বিগত সরকারের আমলে জামায়াতের অসংখ্য নেতা-কর্মী বিভিন্ন প্রকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবং এই পরিস্থিতিতে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তারা সেই সময়ের শাসকগোষ্ঠীর সাথে নানা রকমের সমঝোতায় পৌঁছায়। কোথাও কোথাও বাণিজ্যিক অংশিদারিত্বের মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসায় রক্ষা যেমন করেছে, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় পরিচয় গোপন করে শাসক দলে যোগ দিয়ে নিজেদের কার্যক্রম নিরাপদে চালিয়ে গেছে। এতে তাদের সংগঠন ও সংগঠনের নেতাদের নিরাপত্তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হয়েছে। জানমালের নিরাপত্তার জন্য এমনটা না হয় করলো, কিন্তু মুশকিল হলো– তারা কেবল নিজেদের জানমালের হিফাযতের জন্য যা করেছে, তার বৈধতা দিলেও অপরদিকে ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বৃহত্তর স্বার্থে যে সকল ইসলামপন্থী বিগত সরকারের উপর যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং ইসলামের স্বার্থে সব সময় নিজেদের প্রভাবকে কাজে লাগাতেন, কোনো ধরনের ব্যক্তি স্বার্থের সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও তারা এসকল ইসলামপন্থীদের স্বৈরাচারেরর দোসর হিসেবে অপবাদ দিচ্ছে। নিজেদের সংগঠন ও ব্যক্তি স্বার্থে আওয়ামীঘনিষ্ঠতা বৈধ হলেও ধারাবাহিকভাবে ইসলামের পক্ষে ভূমিকার রাখার জন্য যাদের সম্পর্ক ছিল, যারা কিনা কোন ধরনের ব্যক্তি স্বার্থে সে সম্পর্ক রক্ষা করেননি, তাদের বিরুদ্ধে তাদের যত অভিযোগ। এরকম অবস্থায় তাদের সাথে বৃহত্তর ইসলামপন্থীদের ঐক্য কিংবা তাদের হাত ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলামপন্থার উত্থানের স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে মনে হয় না।
তবে অন্যান্য বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করতে এর বাইরে অন্যান্য দলের রাজনৈতিক অবস্থান ও কর্মসূচির দায়ও রয়েছে। বিশেষত প্রায় কোনো ইসলামী দলই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের জনগণের ভাষা পড়ে সে অনুযায়ী নিজেদের গোছাতে সক্রিয় হয়েছে বলে অন্তত এখনো মনে হচ্ছে না। আওয়ামীলীগের মতো একটি বড় দলের স্বৈরাচারী হিসেবে পতনের পরের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তাদের অবস্থান ঠিক কোথায়, সে বিষয়ে তাদের নিজেদেরও কোন সুনির্দিষ্ট ধারণা আছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। একটি আপাদমস্তক সেক্যুলার রাষ্ট্রে স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও সেটি শতভাগ ইসলামপন্থীদের অনুকূলে আসবে না, তা বলাই বাহুল্য। তদুপরি এ অভ্যুত্থানে ইসলামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ থাকলেও কেবল তারাই একমাত্র অংশীজন নয়, বরং এর বাইরে আরো অনেক অংশীজন আছে এবং একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রে অপরাপর অংশীজনের জন্য নিজেদের হিস্যা আদায় যতটা সহজ, ইসলামপন্থীদের জন্য ততটা সহজ হওয়ার কথা না। এই পরিস্থিতিতে যে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা প্রয়োজন তা দূরে থাক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই পরিস্থিতির বিষয়ে ইসলামপন্থীদলগুলো যথেষ্ট সচেতন কিনা, তা নিয়েই সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
সর্বেপরি বলা যায়, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামপন্থার জন্য বেশ অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হলেও বিদ্যমান প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে নিজেদের যথাযথ প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠায় ইসলামপন্থীদের প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে বলে প্রতীয়মান।