আগস্ট! এই সেই আগস্ট। যে মাসের ৫ তারিখ ভারতে পালিয়ে যান প্রায় দেড় যুগের দুর্দান্ত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। কোটাবিরোধী আন্দোলনে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ১-৩৬ জুলাই। মাত্র ১ মাসে অর্জিত হলো একটি ঐতিহাসিক বিপ্লব। এর জন্য ১৫৮১ জন শিক্ষার্থীকে পান করতে হয়েছে শাহাদাতের সুধা। জুলাই বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান, নতুন বাংলাদেশ যা-ই বলা হোক, দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুক্ত হলো আরেক অধ্যায়। রংপুরের আবু সাঈদ। বিশ্বকে জানান দিয়ে গেছে সাহসিকতার আরেক দৃষ্টান্ত। এই সাহস, এই বিপ্লবকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাস্তায় নামলো। তখন রাস্তায় নামা মানে বুলেটের মুখে নিজেকে এগিয়ে দেওয়া। তবুও নামলো। লাশ হয়ে ঘরে ফিরলো। পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে গেলো। জীবিতরা আরো উজ্জীবিত হলো। পিছু হঠলো না। যালিমের কারফিউর আগুন পানি করে দিলো। মৃত্যুর ভয় আনন্দ হিসেবে বরণ করলো। সরকারের পতন ছাড়া ঘরে ফিরবে না, এও তারা জানিয়ে দিলো। এতসব কেন করলো? বৈষম্যহীন একটি সমাজ নির্মাণে, ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েমে। সকল নাগরিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায়, শোষণমুক্ত দেশের প্রত্যাশায়। ফ্যাসিস্টরা খুব দ্রুত পালিয়েছে বিভিন্ন দেশে। ছাত্র জনতার প্রত্যাশা পূরণে, সর্বোপরি নতুন এক বাংলাদেশ গঠনে, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্ম। ৮ আগস্ট সরকারের যাত্রা শুরু। এ নিরিখে সরকারের বর্ষপূর্তি হয়েছে। পূর্ণ ১ বছরে জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা সরকার কতটুকু পূর্ণ করেছে? সেই বিচার বিবেচনা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবেন বিজ্ঞ মহল। আমি এখানে একটি ঘটনার বয়ান পেশ করবো। যারা ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো কায়েম করতে চান, তারা নিজেরা ইনসাফ কতটুকু লালন করেন, বাস্তবতায় প্রয়োগ করেন? তাদের দ্বারা এদেশে ইনসাফের রাষ্ট্র কায়েম হবে কি না? আমার বয়ান দ্বারা আর কিছু না হলেও, সেই পর্দা উন্মোচন হবে বলে আশাবাদী।
গত ২৬ জুন ২০২৫ইং বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের আলিম ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা শুরুর সপ্তাহ খানেক আগে আমার মাদরাসার (সিংগেরকাছ) অধ্যক্ষ মহোদয় (মাওলানা মাহবুবুল ওয়াছে) ফোনে আমাকে জানালেন– আমি বিশ্বনাথ UNO অফিসে আছি। আপনাকে বিশ্বনাথ আলিয়া মাদরাসার আলিম পরীক্ষা কেন্দ্রের হল সুপার নির্বাচিত করা হয়েছে। উত্তরে আমি বললাম, দায়িত্বটা আপনি নেন। মাদরাসা আমি চালাবো। তিনি ২০২৪ সালে কেন্দ্র সচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিধায় দায়িত্ব নেবেন না সাফ জানালেন। আমি আচমকা মেনেই নিলাম। ২০২৫ সালের দাখিল পরীক্ষা বিশ্বনাথ-২ (সৎপুর কামিল মাদরাসা) কেন্দ্রে হল সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এটা আমার মনোবল বাড়িয়ে দিলো। টুকটাক কিছুটা তো জানা আছে। ২/৩ দিন পর বিষয়টি আরো নিশ্চিত করলেন, মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং পরীক্ষার কেন্দ্র সচিব মাওলানা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন। তিনি আরো জানালেন– আপনার চিঠি UNO অফিস থেকে সংগ্রহ করবেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বনাথ এর ১৮/০৬/২০২৫ তারিখে স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ যথাসময়ে গ্রহণ করলাম। ২৬/০৬/২০২৫-০৩/০৭/২০২৫ পর্যন্ত মোট ৪ দিনে ৪টি বিষয়ের পরীক্ষা সম্পন্ন হলো। যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলাম পরীক্ষা পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা ২০২৫ এর আলোকে। UNO মহোদয় তার প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন একজন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি উপজেলা Academic supervisor জনাব আব্দুল হামিদ। পরীক্ষা শুরুর দিন আমি তাকে বলে রাখি– কোনো অনিয়ম আপনার দৃষ্টিগোচর হলে আমাকে বলবেন, আমি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। ৪ দিনের পরীক্ষায় প্রতিদিনই বলেছি– পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? কোনো অনিয়ম নযরে পড়েছে? জবাব, না সুন্দর হচ্ছে। পরীক্ষার ৪র্থ দিন ১২ ঘটিকার সময় আমাকে বললেন– কেন্দ্রের বিরুদ্ধে UNO স্যারের নিকট অভিযোগ গিয়েছে। আমি বললাম, কী অভিযোগ? সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বলতে পারলেন না। আমতা আমতা স্বরে বললেন- পরীক্ষা দেরিতে শুরু হয়। বললাম, UNO স্যারের প্রতিনিধি হিসেবে ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত আপনি পরীক্ষা কেন্দ্রে স্বশরীরে হাযির থাকেন। কোনোদিন কখনো ১ মিনিটের ব্যতিক্রম ঘটেছে? সত্য বেরিয়ে এলো। তিনি বললেন, UNO স্যারের নিকট আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। মৌখিকও নেই, লিখিতও নেই। তিনি চাচ্ছেন আপনার স্থলে ছহিফাগঞ্জ মাদরাসার সুপার মাওলানা আব্দুর রউফকে আনতে। ইতোমধ্যে তাকে ডেকে এনে আলাপও হয়ে গেছে। UNO স্যার বলেছেন আপনি মনোক্ষুণ্ন হবেন না। আমি বললাম, আপনার প্রথম উক্তি– কেন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ গিয়েছে। যদি তাই সত্য হয় তবে কেন্দ্র সচিব, হল সুপার, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ৩ জনই পরিবর্তন হওয়া উচিত। একা আমাকে কেন? তিনি আবারও বললেন, UNO স্যার বলেছেন আপনি মনে কিছু নিবেন না। এখন আমার বোধের পর্দা পরিষ্কার হলো। বুঝলাম আমি অভিযোগহীন অভিযুক্ত। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা মুখ্য বিষয় নয়। বিশেষ ঘরানার লোক বসানো আসল দুরভিসন্ধি। কেন্দ্র সচিব অতি সংগোপনে যে ঘরানার লোক, ছহিফাগঞ্জের সুপারিনটেন্ডেন্ট সেই ঘরের প্রকাশ্য বাসিন্দা। সুতরাং আমি আর নড়াচড়া করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বিধায় সরে দাঁড়ানোই উত্তম। নীরবে নিভৃতে চলে আসতে পারি। এই চলে আসা বহু প্রশ্নের জন্ম দিবে। এ প্রশ্নের ছিদ্রপথও বন্ধ করে আসি। উল্লেখ্য যে, ৩ জুলাই বাদ মাগরিব ফোনে কথা বলেন বিশ্বনাথ বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী জনাব ফয়জুল ইসলাম। তিনি জানতে চাইলেন, পরিবর্তনকৃত হল সুপারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি? UNO মহোদয় জানালেন– কোনো অভিযোগ নেই। আমার স্থলে যাকে হল সুপার বানানো হলো, তিনি দাখিল মাদরাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট। MPOতে ঐ পদের স্কেল ভোগ করছেন। তার মাদরাসায় সবেমাত্র আলিম খোলা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযোগী নয়। দুটি বিষয় পরীক্ষা পরিচালনা সংক্রান্ত নীতিমালা পরিপন্থী। প্রথমত: দাখিল মাদরাসার সুপার আলিম স্তরের পরীক্ষা কেন্দ্রের হল সুপার হওয়া। দ্বিতীয়ত: বিশ্বনাথ আলিয়া মাদরাসা পরীক্ষা কেন্দ্রে তার মাদরাসার পরীক্ষার্থী নেই। মনে পড়ে প্রায় ১ যুগ আগের কথা। কবি মোহাম্মদ নওয়াব আলী এর একটি ছড়াগ্রন্থ পড়েছিলাম। নাম– সব সম্ভবের দেশ।
একটি পাবলিক পরীক্ষা। সুষ্ঠু সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য অনেক জনবল প্রয়োজন। কমপক্ষে ২০/২৫ জন লোক কাজ করেন। বিভিন্ন পদ পদবীতে। পদ পদবীগুলো সম্পূর্ণ অস্থায়ী। যেদিন পরীক্ষা শেষ, সেদিন পদ পদবীরও বিলুপ্তি। বিনা নোটিশে। সুতরাং বলা যায়, পরীক্ষা কাজে যারা নির্বাচিত হন, তাদের পদ পদবী স্থায়ী কিছু না। একটি পরীক্ষার হল সুপারের পদে যারা দলীয় দৃষ্টিকোণ বিবেচনা করলেন, political engineering করলেন, তাদের মন মানসিকতা চিন্তা চেতনা কতটুকু Liberal? আমার বুঝতে বাকি নেই। বাকিরা কী বুঝবেন? গত বছরের জুলাই মাসে দেশে একটি বিপ্লব হয়ে গেলো। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে, ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র কায়েমে। ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনা যাদের স্লোগান, ক্ষমতায় গিয়ে কোন ইনসাফের পাথর আমাদের বুকে চাপাবে? আমার সাথে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা। আমি বলবো, এটা তাদের মৌখিক ভাষ্য, রাজনৈতিক স্লোগান, ভোট বাড়ানোর অপকৌশল। আমি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের একটি মসলকের একজন সক্রিয় কর্মী। এটা আমার অপরাধ? অথচ আমাদের বুযুর্গগণই মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদা-বিশ্বাস শিক্ষা দেওয়ার জন্য। অথচ দখলবাজী সকল চলছে বেপরোয়াভাবে। আমার আবদার– আসুন, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, জুলাই বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত হই, বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গঠনে সহযোগী হই। দেশকে ভালোবাসি, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখি।