[নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন অসঙ্গতি এবং এ শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত ও ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে স্কুল ও মাদরাসার প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পাঠদানের জন্য সরবরাহকৃত নতুন পাঠ্যপুস্তকে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও আপত্তিকর নানা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ’র মুহতারাম সভাপতি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী’র নেতৃত্বে আলিম-উলামার এক প্রতিনিধিদল ১২ জানুয়ারি, ২০২৩ ইং তারিখে গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র সাথে সাক্ষাত করেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ’র মহাসচিব মাওলানা একেএম মনোওর আলী, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী, দারুন নাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আ.খ.ম আবূ বকর সিদ্দীক, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান ও বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান। এ সময় নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন অসঙ্গতি ও পাঠ্যপুস্তকে উল্লেখিত কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী ও আপত্তিকর বিষয়সমূহ তুলে ধরার পাশাপাশি পীর-মাশাইখ ও আলিম-উলামার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে দশ দফা দাবি উপস্থাপন করেন মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী। মাসিক পরওয়ানার পাঠকবৃন্দের জন্য এগুলো হুবহু নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।-সম্পাদক]
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে উপস্থাপিত বক্তব্য
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক নিবেদন এই যে, আমরা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলী ও বুযুর্গ, সিলেট তথা বাংলাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (র.) এর অনুসারী। আমাদের সংগঠন বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ এর পক্ষে আমরা বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলাম। আমাদের অন্যতম দাবি ছিলো আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা। আলহামদুলিল্লাহ, আপনি তা পূরণ করেছেন। তাছাড়া মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা, ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ, মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণ, মাদরাসায় অনার্স কোর্স চালু, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্প্রসারণসহ নানাবিধ কার্যক্রম আপনার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। জাতীয় উন্নয়ন ও ইসলামী শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতায় আপনার আন্তরিকতা ও অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আল্লাহ আপনাকে এর উত্তম বিনিময় দান করুন।
আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, ২০২৩ সাল অর্থাৎ চলতি জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যপুস্তক এসেছে। কিন্তু এ শিক্ষাক্রমে নানা অসঙ্গতি ও এর আলোকে প্রণীত পাঠ্যপুস্তকে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ও আপত্তিকর অনেক বিষয় রয়েছে, যা মানুষকে মর্মাহত করেছে। আপনার সদয় অবগতির জন্য তন্মধ্যে কিছু বিষয় নিম্নে উপস্থাপন করা হলো।
নতুন শিক্ষাক্রমের অসঙ্গতি
নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী ও শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রে আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য হলেও এতে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রণীত পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রমাণিত হয় যে, এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনগণের বিশ্বাস, আদর্শ ও জীবনাচার প্রতিফলিত হয়নি। এমনকি শিক্ষানীতি ২০১০ এ বর্ণিত মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এতে প্রতিফলিত হয়নি। এ শিক্ষাক্রমে মাদরাসার কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। মাদরাসাতে কুরআন, হাদীস, আরবী ১ম পত্র, আরবী ২য় পত্র এবং আকাইদ ও ফিকহ এ পাঁচটি বিষয়ের পাশাপাশি সাধারণ বিষয়সমূহ শিক্ষাদান করা হয়। নতুন কারিকুলামে সাধারণ নয়টি বিষয় (বাংলা, ইংরেজী, গণিত, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, জীবন ও জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শিল্প ও সংস্কৃতি) ও ধর্ম শিক্ষা একটি বিষয় রয়েছে। উক্ত নয়টি বিষয় স্কুলের পাশাপাশি মাদরাসায়ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের নয়টি বিষয় ও মাদরাসার মৌলিক পাঁচটি বিষয় মিলিয়ে মাদরাসার মোট বিষয়সংখ্যা ১৪ টিতে দাঁড়িয়েছে। যেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা ১০টি বিষয়ে ১০০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে সেখানে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ১৪০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হবে। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এটি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে মাদরাসার মৌলিক বিষয়সমূহ ঠিক রেখে সাধারণ বিষয়সমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্যও ১০০০ নম্বর নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এজন্য মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা একান্ত প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্যদিকে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে স্কুল ও মাদরাসার প্রথম, ৬ষ্ঠ, ৭ম শ্রেণির জন্য যে সকল পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে তাতে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ও সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনগণের বিশ্বাস, আদর্শ ও জীবনাচারের বিবেচনায় আপত্তিকর বহু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এগুলো যেমন মাদরাসার জন্য উপযোগী নয় তেমনি স্কুলেও পাঠদান করা সমীচীন নয়। এক কথায় বলতে গেলে বইগুলোতে কুরআন-হাদীসের কোনো আলোচনা, বাণী, শিক্ষা, মুসলিম সভ্যতা ও ইসলামী বিশ্বাসের আলোচনা নেই বললেই চলে। পক্ষান্তরে রয়েছে পুরাণের কাহিনী, গ্রীক, বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাসসহ দেব-দেবীর নাম, নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নানা মূর্তি, ভাস্কর্য, মন্দির ও বিহারের ছবি ও বর্ণনা। বিজ্ঞানের নামে নগ্ন অশ্লীল ছবি ও বয়স উপযোগী নয় এমন নির্লজ্জ বর্ণনা রয়েছে। আছে হারমোনিয়াম, তবলা, গিটারসহ গান-বাজনার শিক্ষা, যা মাদরাসার সাথে মোটেই মানানসই নয়। সর্বোপরি ‘এপ’ জাতীয় অন্য প্রাণী থেকে নাকি মানুষের সৃষ্টি কল্পিত এই মিথ্যা ও বিতর্কিত বিবর্তনবাদ রয়েছে একাধিক বইয়ে, যা সরাসরি কুরআন-সুন্নাহবিরোধী। শুধু মাদরাসা শিক্ষিত নয় বরং কোনো মুসলমান এ ধরনের পাঠ্যপুস্তক এ দেশে প্রত্যাশা করতে পারে না।
নতুন পাঠ্যপুস্তকে থাকা কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ও আপত্তিকর কিছু বিষয়
নতুন পাঠ্যপুস্তকে থাকা কুরআন-সুন্নাহবিরোধী ও আপত্তিকর যে সকল বিষয় আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে তন্মধ্যে কিছু বিষয় নিম্নে শ্রেণি ও বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপন করা হলো।
প্রথম শ্রেণির বইতে আপত্তিকর বিষয়
প্রথম শ্রেণির ইংরেজি বইতে বিভিন্ন পৃষ্ঠায় শব্দ ও বাক্যগঠন এবং চিত্র উপস্থাপনে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন, ঢাক, ঢোল, তবলা, একতারা ইত্যাদির ব্যবহার রয়েছে, যা মাদরাসার সাথে মানানসই নয়।
ষষ্ঠ শ্রেণির বইতে আপত্তিকর বিষয়
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান
ষষ্ঠ শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বিষয়ে দুটি বই রয়েছে। ১. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) ২. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন বই)। দুটি বইতে ‘বিবর্তনবাদ’ এর মিথ্যা ও বিতর্কিত তত্ত্ব রয়েছে। বইটির অনুসন্ধানী পাঠে দেখানো হয়েছে কীভাবে ‘এপ’ জাতীয় অন্য প্রাণী থেকে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘ বর্ণনার পাশাপাশি ছবি দ্বারা এ বিবর্তনকে স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে। তাছাড়া ‘লুসি’ নামক কথিত কঙ্কালকে ‘এপ’ জাতীয় প্রাণীর (বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী পক্ষান্তরে মানুষের) সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপুরুষ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই লুসির ছবিও দেওয়া হয়েছে বইয়ের মধ্যে (অনুশীলন বই, পৃষ্ঠা ১১৩)। পৃষ্ঠা ১১৪ এর মধ্যে রয়েছে বিবর্তনের চিত্র। এ চিত্রে দেখানো হয়েছে, মানুষের বিবর্তন হয়েছে বানরাকৃতির ক্ষুদ্র বা খাটো মানুষ থেকে ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ ও দীর্ঘ মানুষের দিকে।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বই (পৃষ্ঠা ১১৩) এর মধ্যে মানুষের পূর্বপুরুষ বানর নয় বলা হলেও এর অনুসন্ধানী পাঠে বলা হয়েছে ‘এপ’ জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের বিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে। অনুশীলন বইয়ের পৃষ্ঠা ১১৪ এর মধ্যে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) বই থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের মানুষ ও সমাজ কোথা থেকে এলো তা বের করে বিভিন্ন সময়ের মানুষের ছবি দেখতে এবং সময়ের সঙ্গে মানুষের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে তা বোঝার চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। এ অধ্যায়ে পৃষ্ঠা ২১ থেকে ৪৫ এর মধ্যে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, ‘‘মানুষ, শিম্পাঞ্জিসহ এপ-রা আর বানরের বিভিন্ন প্রজাতি একই ধরনের প্রাইমেট প্রজাতির প্রাণী থেকে বিকশিত হয়েছে’’ (পৃষ্ঠা ২৪)
বিভিন্ন জায়গায় আরো আছে,
‘‘মজার বিষয় হলো, এপ্দের থেকে মানুষের বিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছে’’ (পৃষ্ঠা ২৫)।
[বইয়ের ভাষায়, মানুষের পূর্বপ্রজন্মপলা সকল প্রজাতিকে একত্রে ‘এপ’ বলা হয় (পৃষ্ঠা ২৪)]
“মানুষের আগের প্রজন্মগুলোর বেশিরভাগের উৎপত্তি হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে” (পৃষ্ঠা ২৫)।
“আফ্রিকা মহাদেশ ছিল মানব বিবর্তনের প্রধান কেন্দ্র” (পৃষ্ঠা ২৮)
“আমরা তো দেখলাম, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি কীভাবে আদি অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বর্তমান মানুষে পরিবর্তন হয়েছে” (পৃষ্ঠা ২৯)।
দীর্ঘ আলোচনার সারকথা হলো, মানুষের উদ্ভব হয়েছে অন্য প্রাণী থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে। প্রথমে এর গঠন অপূর্ণাঙ্গ ছিল। সোজা হয়ে হাঁটতে পারতো না। প্রাইমেটরা দুই পায়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁঁটতো। কখনও কখনও চার পায়ে হাঁটতো। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় আধুনিক মানুষে রূপ লাভ করেছে (পৃষ্ঠা ২৫)। বইয়ের ভাষায়, মানুষের উদ্ভব হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশে, প্রথমে চার পায়া ছিল, পরে ধীরে ধীরে মানুষ হয়েছে। অর্থাৎ আফ্রিকার জঙ্গলের চারপায়া (বানর বা শিম্পাঞ্জি বা অনুরূপ) প্রাণী বিবর্তনের ধারায় মানুষ হয়েছে (নাউযুবিল্লাহ)।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) এ মিসরীয় সভ্যতা, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যবিলনীয় সভ্যতা, রোমান সভ্যতাসহ বিভিন্ন সভ্যতার আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু মুসলিম সভ্যতার কোনো বর্ণনা নেই।
মিসরীয়দের ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, “স্বল্পসময়ের জন্য একেশ্বারবাদে বিশ্বাস করলেও তারা ছিলেন মূলত বহুঈশ্বরবাদে বিশ্বিসী (পৃষ্ঠা ৫৬)।
এখানে তাদের বিভিন্ন দেব-দেবীর নাম এবং কে কোন দায়িত্বের তা তুলে ধরা হয়েছে। যেমন- প্রধান দেবতা ‘রা’ বা ‘আমন রে’, নীলনদের দেবতা ওসিরিস, মাতৃত্বের দেবী আইসিস প্রভৃতি।
তাছাড়া অপ্রয়োজনীয়ভাবে পৃষ্ঠা ৬৫ এর মধ্যে কাল্পনিক প্রাণী স্ফিংকস এর ভাস্কর্য ও এ প্রাণী সম্পর্কে মিশরীয়দের কাল্পনিক বিশ্বাস তুলে ধরা হয়েছে। পৃষ্ঠা ৬৬ এর মধ্যে রয়েছে নেফারতিতির সমাধি-মন্দিরে আঁকা চিত্র, পৃষ্ঠা ৭৩ এ রয়েছে লুক্সারের মন্দির, পৃষ্ঠা ৭৪ এ রয়েছে আবু সিম্বাল মন্দিরের ছবি এবং পৃষ্ঠা ৭৫ এ আবু সিম্বাল মন্দিরের মধ্যের আরেকটি ছোট মন্দিরের ছবি। পৃষ্ঠা ৭৬ এ ‘যদি আমি কখনো মিসর ভ্রমণে যাই’ এ শিরোনামের মধ্যে ভ্রমণের স্থানের ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সিম্বাল মন্দিরের নাম রয়েছে।
পৃষ্ঠা-৭৯ এর মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে, প্রধান দেবতা নার্গাল, সূর্যদেবতা শামাশ, বৃষ্টি ও বায়ুর দেবতা এনলিল এবং নারীজাতির দেবতা ইশতা। পৃষ্ঠা ৮০ এর মধ্যে ব্যবিলনীয় সভ্যতার ক্ষেত্রে লেখা হয়েছে, সূর্যদেবতা মারদুক, প্রণয়ের দেবী ইশতার, বায়ুর দেবতা মারুওস। পৃষ্ঠা ৮৬ এর মধ্যে আছে, ন্যায়বিচারের দেবতা শামাশ। গ্রীক সভ্যতার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠা ৯২ এ তাদের ধর্মবিশ্বাসে তাদের দেব-দেবীর নাম পূর্বের মতো উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- আকাশের দেবতা জিউস, যুদ্ধের দেবতা আরাস, সূর্য দেবতা অ্যাপোলো, সমুদ্রের দেবতা পসিডন, জ্ঞান ও বায়ুর দেবী চিরকুমারী এথেনা। উপরন্তু পৃষ্ঠা ৯৯-১০০ এর মধ্যে অপ্রয়োজনীয়ভাবে তাদের বারো দেবতার নাম কর্ম/কর্তৃত্বসহ উল্লেখ করা হয়েছে এবং গ্রিক দেবতা ও দেবীদের দেখতে চাইলে তাদের চেহারা কেমন হবে অ্যানিমেশন বা কার্টুনের চিত্রে তা তুলে ধরা হয়েছে। জানার জন্য তাদের ভাস্কর্য দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বড় হয়ে তাদের নিয়ে তৈরি করা ভিডিও দেখার কথা বলা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৯৯-১০০)। এসবের দ্বারা পক্ষান্তরে দেব-দেবীর প্রতি আকর্ষণ তৈরি ও পৌত্তলিকতা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
রোমান সভ্যতায় রয়েছে হাজার বছরের ইসলামের ইতিহাস। কিন্তু এখানে এর কোনো উল্লেখ নেই। রোমান সভ্যতায় মুসলিমদের ইতিহাস নিয়ে Edward Gibbon এর The History of the Decline and Fall of the Roman Empire গ্রন্থে সরাসরি দাবি করা হয়েছে রোমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রাচুর্যে পূর্বের থেকেও দুর্দান্ত গতিতে এগিয়েছিল ইসলামী শাসনামলে। কিন্তু এ পাঠে এর কিছুই উল্লেখ নেই। পুরো বইয়ে বিভিন্ন সভ্যতার বর্ণনা, প্রাচীন মন্দির এবং ভাস্কর্যের ছবি থাকলেও মুসলিম সভ্যতার কোনো বর্ণনা এবং ইসলামী স্থাপত্য ও নিদর্শনের ছবি ও বর্ণনা নেই।
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন বই) এ (পৃষ্ঠা ৯০-৯৯) লোকধর্ম তথা নাস্তিকতা ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম-সংস্কৃতিকে বাংলার মৌলিক ধর্ম-সংস্কৃতি ও মূর্তিপূজাকে বাংলার ‘হাজার বছরের সংস্কৃতি’ হিসাবে উপস্থাপন করে ঢালাওভাবে ইসলামসহ অন্য সকল ধর্ম-সংস্কৃতিকে বহিরাগত ও এগুলোর অনুসারী রাজা-বাদশাহদের দখলদার, সুবিধাবাদী, তথাকথিত অভিজাত, শোষক ও ক্ষমতালিপ্সু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৯৫-৯৯)।
যেমন: বলা হয়েছে, “সম্রাট, রাজা বাদশাহ, সুলতান, নবাব উপাধিধারীরা ছিলেন তথাকথিত অভিজাত এবং নিজেদের যশ, খ্যাতি আর গৌরব প্রচারে ব্যতিব্যস্ত। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চাভিলাষী অভিজাত যোদ্ধাদের অনেকেই বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন, ভূখণ্ড ও সম্পদ দখল করেছেন এবং সাধারণ মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য না দিয়ে তাদের ভাষা-ধর্ম-রাজনীতি এখানকার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যেমন মৌর্য রাজা, গুপ্ত রাজা, সেন রাজা, খলজী রাজা, হোসেন শাহ সুলতান, নবাব মুর্শিদ কুলি খান, বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাসক (পৃষ্ঠা ৯৫)।
এমনকি বঙ্গবিজেতা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীকে উচ্চাভিলাষী ও দখলদার হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৯৮)।
যেমন, বলা হয়েছে, “১২০৪ সাধারণ অব্দে বাংলার পশ্চিম অংশে আবারো নতুন একটি রাজশক্তির উত্থান হয়। সুদূর তুরস্ক থেকে আগত একজন উচ্চাভিলাষী যোদ্ধা আমাদের বাংলা অঞ্চলের বৃহত একটি অংশ দখল করে নেন। তিনি হলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি। কয়েকটি বিহার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে নদীয়া ও গৌড় দখলকারী বখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করেন খলজি বংশ” (পৃষ্ঠা ৯৮)
বিভিন্ন স্থানে আরো আছে,
“প্রাচীনকাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসের গোটা সময়কালে উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভারত, তুরস্ক, পারস্য (ইরান), উজবেকিস্তান এবং পরবর্তীকালে ইউরোপ ও পাকিস্তানের নাম-যশ-খ্যাতি বিস্তারে ব্যতিব্যস্ত কতিপয় উচ্চাভিলাষী অভিজাত শ্রেণী বাংলা অঞ্চলকে বারবার দখল ও আধিপত্য বিস্তার করেছে” (পৃষ্ঠা ৯৭)।
“বাংলা অঞ্চলের মানুষের উপর ভূ-মধ্যসাগরের আশে-পাশের অঞ্চল, পারস্য (ইরান) এবং অন্যান্য অঞ্চলের তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী দখলদারিত্ব এবং আধিপত্য বিস্তার করেছে। বাংলা অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য প্রায় সব সময়ই বহু দূরের ভূ-খ- হতে আগত সুবিধাবাদী তথাকথিত অভিজাত শ্রেণী নির্ধারণ করেছে। এই ভূখণ্ডের অনার্য ভাষা-সংস্কৃতির মানুষেরা বারবার শোষিত হয়েছে” (পৃষ্ঠা ৯৯)।
“ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যারা অবস্থান করেছে তারা কেবল নিজেদের নাম-যশ-খ্যাতি ও সুবিধা লাভের চিন্তায় থেকেছে বিভোর। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। ক্ষমতালিপ্সু অভিজাত সম্প্রদায় প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মকে ব্যবহার করেছে নিজেদের প্রয়োজনে” (পৃষ্ঠা ৯৯)।
এই ইতিহাস খণ্ডিত ও বিকৃত ইতিহাস। এতে মুসলিম রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
বিজ্ঞান
বিজ্ঞান (অনুশীলন বই) এ মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের কুরআন-সুন্নাহবিরোধী অলীক বিশ্বাসকে স্থান দেওয়া হয়েছে (পৃষ্ঠা ৯)। পাশাপাশি পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে কালপুরুষের ছবি এবং কালপুরুষ সম্পর্কে পৌরাণিক বিশ্বাস তুলে ধরা হয়েছে (পৃষ্ঠা ১১)। চন্দ্রগ্রহণের আলোচনা করতে গিয়ে এক জার্মান জ্যোতির্বিদের তৈরি পঞ্জিকার উপর নির্ভর করে কলম্বাসের একটি প্রতারণার গল্প আনা হয়েছে, যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘অভিশপ্ত চাঁদ’ (পৃষ্ঠা ৮৮)। এখানে চাঁদকে ‘অভিশপ্ত’রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
অনুরূপভাবে বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহ বিরোধী বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে এবং পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে কালপুরুষের ছবি তুলে ধরা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৬২, ৬৫)। অথচ কুরআনের বৈজ্ঞানিক নিদর্শনের কোনো উল্লেখ পুরো বইতে নেই।
বইটিতে ১১ জন উলঙ্গ নারী-পুরুষের ছবি দিয়ে তাদের লজ্জাস্থানের পরিচয় দেওয়া হয়েছে (পৃষ্ঠা ১১৭) এবং ছেলে-মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গের খোলামেলা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে (পৃষ্ঠা ১১৮-১২১)। এটি ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে বয়স উপযোগী নয় বলে আমরা মনে করি। এ ধরনের খোলামেলা বর্ণনার দ্বারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নির্লজ্জ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ইংরেজি
‘ইংরেজি’ বইয়ে একটি গল্পে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান এ চার ধর্মের চারজন বন্ধু’র পরস্পর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে খুবই আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ এবং হিন্দুদের দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ করে অন্য ধর্মাবলম্বীরা পূর্বে দেখেননি এমন সুন্দর দৃশ্য অবলোকনের উল্লেখসহ সর্বশেষ সকলে একত্রে নাচের মাধ্যমে আনন্দ উদযাপনের বর্ণনা রয়েছে (পৃষ্ঠা ১৩৫-১৫২)। এতে হিন্দুদের পূজায় অংশগ্রহণের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যা মুসলমান ও হিন্দু উভয়েরই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ ও বিশ্বাস থেকে আপত্তিকর।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা
‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বইয়ে ছেলে মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক, মানসিক ও আচরণগত পরিবর্তন সম্পর্কে নির্লজ্জ বর্ণনা রয়েছে, যা ষষ্ঠ শ্রেণিতে অত্যন্ত বেমানান এবং ছাত্র-ছাত্রীদের যৌথ ক্লাসে বেহায়াপনা শিক্ষাদানের শামিল। তাছাড়া ছেলে মেয়েদের পারস্পরিক আগ্রহ, সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় সংযমের শিক্ষা ব্যতীত উল্লেখ করে ফ্র্রি-মিক্সিং ও অবাধ যৌনতার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যা সমাজ ও দেশে নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হবে। উক্ত বইয়ে ‘বয়ঃসন্ধিকালে মনের যত্ন’ অনুচ্ছেদে রাগ নিয়ন্ত্রণে ইসলাম নির্দেশিত সুন্দর পদ্ধতি পরিকল্পিতভাবে পাশ কাটিয়ে ৫০ থেকে ১ পর্যন্ত উল্টো গণনার মতো অবৈজ্ঞানিক কল্পিত পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৫০)।
বাংলা
‘বাংলা’ বইয়ে কাল্পনিক ও অবাস্তব ছড়ার পাশাপাশি গান গাওয়া ও বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন, হারমোনিয়াম, বাঁশি, তবলা, ঢোল ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ১০৬)। ষষ্ঠ শ্রেণির আগের বাংলা বইতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে একটি কবিতা থাকলেও নতুন বইতে তা রাখা হয়নি কিংবা তাঁর সম্পর্কিত নতুন কোনো প্রবন্ধ, কবিতা কিংবা ছড়া অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।
জীবন ও জীবিকা
‘জীবন ও জীবিকা’ বইয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের জীবনাচার অনুপস্থিত। এতে গান শোনা, নাচ, বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি যন্ত্র ব্যবহার করে ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা মাদরাসার ক্ষেত্রে মোটেই মানানসই নয়।
শিল্প ও সংস্কৃতি
‘শিল্প ও সংস্কৃতি’ বইয়ে মুসলিম কৃষ্টি-কালচার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পুরো বইটির মূল উপজীব্য বিষয় সংগীত, নৃত্য, অভিনয় এবং এর তাল, লয়, রস, মুদ্রা ইত্যাদি। এগুলোর বহু বিষয় ইসলামী শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। বইটির প্রচ্ছদও ঢোল, তবলা ও মূর্তির ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে। বইটিতে যাত্রাপালা, সার্কাস, বাউল গান, লোকনাটক, পুতুলনাচ ও গানের অনুষ্ঠানকে আমাদের ‘সংস্কৃতির অমূল্য অংশ’ এবং ‘জাতীয় সংস্কৃতির শিকড়’ বলা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, যাত্রাপালা, সার্কাস, বাদ্যযন্ত্রসহ গান ইত্যাদি কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। উল্লেখিত অনেক বিষয় মুসলিম সংস্কৃতির অংশই নয়। যা দেশের সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিক মুসলমানদের সংস্কৃতির অংশই নয় তা দেশের ‘সংস্কৃতির অমূল্য অংশ’ ও ‘জাতীয় সংস্কৃতির শিকড়’ হিসেবে উপস্থাপন করা কতটুকু সমীচীন? এ বইটি মাদরাসাতে মোটেই প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া স্কুলে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ট শিক্ষার্থী মুসলমান সেখানে কেন এটি স্কুলেও বাধ্যতামূলক করা অযৌক্তিক বলে আমরা মনে করি।
৬ষ্ঠ শ্রেণির সকল বইতে মেয়েদের ওড়না বা হিজাববিহীন ছবি, ছেলে মেয়েদের যৌথ ছবি এবং আপত্তিকর বহু ছবি রয়েছে, যা মাদরাসার জন্য মানানসই নয়।
৭ম শ্রেণির বইতে আপত্তিকর বিষয়
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন বই)
মুসলিম রাজা-বাদশাহদের যুদ্ধবাজ ও দখলদার হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী সম্পর্কে বিকৃত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ০১-০৩)। সর্বোপরি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষরূপে সকল মুসলিম নবাব, সুলতান ও রাজা-বাদশাহদের লোভী হিসাবে দেখানো হয়েছে (পৃষ্ঠা ০১)। মুঘল শাসকদের আগ্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ০৪)। এখানে যেমন ইতিহাসের বিকৃতি রয়েছে, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে খণ্ডিত ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়েছে। মুসলিম রাজা-বাদশাহ, নবাব ও সুলতানদের প্রতি বিষোদগার করা হয়েছে। তাদের সকল কৃতিত্ব ও অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। এমনকি বাংলায় সুলতানি আমল, মুঘল আমল, মুসলিম শাসন আমলকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ০৩-০৪)।
বইটিতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি আগমনে সংস্কারমুক্ত মানুষের উত্থান ঘটে উল্লেখ করে পক্ষান্তরে এর পূর্ব সময়কে গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের সময় বলে উপস্থাপন করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ০৫)। অথচ এ সময় ছিল মুসলমানদের সময়কাল। এখানে সুকৌশলে মুসলমানদের গোঁড়া ও কুসংস্কারপূর্ণ বলা হয়েছে। এটি মুসলিম বিদ্বেষেরই প্রমাণ।
সৃষ্টিগতভাবে ছেলে ও মেয়েদের চেহারা, আচরণ, কাজ বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের স্বত:সিদ্ধ নিয়ম রয়েছে। কিন্তু বইতে কোনো স্বত:সিদ্ধ নিয়ম নেই বলে সৃষ্টিগত প্রকৃতিকে অস্বীকার করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ৫৫-৫৬)। তাছাড়া লিঙ্গভেদে মানুষ হয়তো পুরুষ নয়তো নারী অথবা হিজড়া। বইতে ‘শরীর ছেলেদের মতো হলেও একজন মনে মনে মেয়ে’ এবং অন্যজন ‘শরীর মেয়েদের মতো হলেও মনে মনে ছেলে’ উল্লেখ করে তাদের ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে (পৃষ্ঠা ৫১-৫২)। এটি তথ্য বিকৃতি। কারণ ট্রান্সজেন্ডার হলো এক লিঙ্গ থেকে অন্য লিঙ্গে রূপান্তরিত হওয়া। এখানে সৃষ্টিগত প্রকৃতির বিরোধিতার পাশাপাশি লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
‘অবরোধবাসিনী’র পাঁচটি কাহিনীতে পর্দাপ্রথা ও বোরকাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। পুরো বইয়ে মুসলিম সভ্যতা ও ইসলামের ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া প্রকৃত কোনো ইতিহাস নেই। (পৃষ্ঠা ১২০-১২১)
ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ)
এ বইয়ে হরপ্পা, মোহেনজোদারো, সিন্ধু অববাহিকার সভ্যতা ও অন্যান্য বসতির দীর্ঘ আলোচনা এবং মৌর্য, গুপ্তসম্রাজ্য, খড়্গ, চন্দ্র, দেবসহ বিভিন্ন রাজবংশের আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের মতো এখানেও ইসলামী সভ্যতার কোনো বর্ণনা নেই। উপরন্তু বিভিন্ন সভ্যতার বিভিন্ন মূর্তির ছবি তুলে ধরা হয়েছে (পৃষ্ঠা ২২- ১০৯; বিভিন্ন পৃষ্ঠায়)। কোনো প্রসঙ্গ ছাড়া ‘বেদ’ এর পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এমনকি বেদকে সমাজ, সাহিত্য, রাজনীতি-অর্থনীতির এক ঐতিহাসিক দলীল হিসেবেও বিবেচনা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পবিত্র কুরআনের কোনো বর্ণনা পুরো বইতে নেই। বইটি মূলত ইতিহাসের নামে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস, মূর্তি, মন্দির ও ভাস্কর্যে পরিপূর্ণ।
তাছাড়া এতে মুসলিম রাজা-বাদশাহদের বহিরাগত বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বিজেতা হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে তারা নিজেদেরকে বিজেতা মনে করতেন (পৃষ্ঠা ১১৫)। এটি ইতিহাসের বিকৃতি।
সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান (অনুশীলন বই) এ বাংলায় সুলতানী আমলকে অস্বীকার করলেও এখানে সুলতানী আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু অন্য সভ্যতা ও শাসনামলের তুলনায় এ আলোচনা নিতান্তই কম। অন্যান্য সভ্যতার ক্ষেত্রে মন্দির, মূর্তি, ভাস্কর্য দ্বারা বইয়ের বিভিন্ন পাতা পরিপূর্ণ থাকলেও সুলতানী আমলের বর্ণনায় মাত্র তিনটি মসজিদের ছবি আনা হয়েছে।
বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ)
এ বইয়ে বিবর্তনবাদের এমন সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়েছে যা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক (পৃষ্ঠা ০৩)।
ডিজিটাল প্রযুক্তি
এ বইয়ে সিনেমা দেখার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, যা মাদরাসার আদর্শ ও সংস্কৃতি পরিপন্থি (পৃষ্ঠা ৩২)।
বাংলা
বাংলা বইয়ে গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম, তবলা, একতারা, তানপুরা, গিটার ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে (পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭), যা মাদরাসার আদর্শ ও সংস্কৃতি পরিপন্থি। তাছাড়া বইটিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কোনো প্রবন্ধ/কবিতা/ছড়া অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।
শিল্প ও সংস্কৃতি
শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ে মুসলিম কৃষ্টি-কালচার সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। পুরো বইটির মূল উপজীব্য বিষয় সংগীত, নৃত্য, অভিনয় এবং এর তাল, লয়, রস, মুদ্রা ইত্যাদি। এগুলোর বহু বিষয় ইসলামী শিক্ষার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
আমাদের দাবি
নতুন শিক্ষাক্রমের গতি-প্রকৃতি ও পাঠ্যপুস্তক পর্যালোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, নতুন এ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকসমূহে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের বিশ্বাস, আদর্শ ও জীবনাচার প্রতিফিলিত হয়নি। এটি আমাদের শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার পরিবর্তে অনৈতিকতা এবং মুসলিমদের ধার্মিকতার পরিবর্তে পৌত্তলিকতা শিক্ষা দিবে। এর মাধ্যমে একটি পৌত্তলিক সমাজ গড়ে ওঠবে, যা কোনো মুসলমান কখনো মেনে নিতে পারে না। সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন ব্যতিরেকে এ পাঠ্যপুস্তক মাদরাসায় তো বটে এমনকি স্কুলেও পাঠযোগ্য নয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমাদের দাবি হলো:
১. বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, এনসিটিবি ও বিশেষজ্ঞ আলিম-উলামার সমন্বয়ে মাদরাসার জন্য অবশ্যই স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। অনতিবিলম্বে একটি সমন্বিত কমিটি গঠন করে এ কাজ শুরু করা প্রয়োজন। প্রতিটি পুস্তক রচনায় মাদরাসা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞ আলিম-উলামাকে কমিটিতে রাখা এবং বিষয় নির্বাচন ও কন্টেন্ট তৈরিতে তাদের অভিমতকে প্রাধান্য দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
২. মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত গত বছরের পাঠ্যপুস্তক পাঠদানের অনুমতি প্রদান করা।
৩. মাদরাসা শিক্ষার জন্য মাদরাসার মূল পাঁচটি বিষয় (কুরআন, হাদীস, আরবী ১ম পত্র, আরবী ২য় পত্র এবং আকাইদ ও ফিকহ) ঠিক রেখে সাধারণ বিষয়সমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ১০টি বিষয়ে ১০০০ নম্বর নির্ধারণ করা। উল্লেখ্য, সাধারণ শিক্ষায়ও দশটি বিষয়ে ১০০০ নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
৪. দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম তথা স্কুলের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও পরিমার্জন করা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ আলিম-উলামার সমন্বয়ে উক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করা, যাতে ইসলামী বিশ্বাস ও আদর্শবিরোধী এবং সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের জীবনাচারের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না হয়।
৫. স্কুল ও মাদরাসার পাঠ্যপুস্তক থেকে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বিবর্তনবাদসহ বিতর্কিত ও আপত্তিকর সকল বিষয় বাদ দেওয়া।
৬. ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের নতুন বইগুলো বাদ দিয়ে বিজ্ঞ আলিম-উলামা ও ইসলামী চিন্তাবিদ সমন্বয়ে পুনর্লিখন করে প্রকাশ করা। যেহেতু দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ মুসলমান সেহেতু মুসলিম সভ্যতা ও ইসলামী আদর্শের বর্ণনাকে এক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন সভ্যতার দেব-দেবীরা কে কোন কর্মের তা বইয়ে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম শিক্ষার্থীর মন-মানসকে বিভ্রান্ত করবে। তাই এগুলো বাদ দেওয়া প্রয়োজন।
৭. শিক্ষার্থী মূল্যায়নে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিবর্তে পূর্বের পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রাখা। কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি উপযোগী নয়।
৮. জাতীয় শিক্ষাক্রমে ১০টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্মশিক্ষাকে ধারাবাহিক মূল্যায়নে রাখা হয়েছে। ইসলামী শিক্ষা মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য ফরয, যা কোন অবস্থাতেই গুরুত্বহীন করা যায় না। তাই স্কুলের ইসলাম শিক্ষা বিষয়কে বোর্ড পরীক্ষায় স্থান দেওয়া জরুরি।
৯. মাদরাসার ইবতেদায়ী স্তরে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ সমাধান করা।
১০. জনবল কাঠামোতে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ দূরীকরণের ব্যবস্থা করা।
উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা আন্তরিক বিবেচনায় নিয়ে এদেশের মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের আশা-আকাঙক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।