নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানার কথা। এক হতভাগা হযরতের পবিত্র নাম নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। ফলে তার মুখটা বাঁকা হয়ে যায়। পরক্ষণে সে বুঝতে পারে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বেয়াদবী করেছি, তাই আমার এই শাস্তি ও পরিণতি। লজ্জিত অনুতপ্ত হয়ে সে নিজের দোষ স্বীকার করে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে মাফ চায়। আরজি জানায়, আমি আপনার শানে বেয়াদবী করেছি। মন্দ কথা বলেছি। অথচ এসব মন্দ কথার উপযুক্ত আমি নিজেই। আমাকে মাফ করুন। আমি অপরাধী।
মাওলানা রূমী (র.) এ প্রসঙ্গে কয়েকটি নীতিকথা ব্যক্ত করেন, যার আবেদন চিরন্তন। সত্যপথের প্রতিটি অনুসারীর জন্য শিক্ষা রয়েছে এসব নীতিবাক্যে।
گر خدا خواهد که پردۀ کس درد
میلش اندر طعنۀ پاکان کند
গর খোদা’ খা’হাদ কে পরদায় কস্ দরদ
মাইলাশ আন্দর তা-নায়ে পা’কা’ন কুনদ
যখন আল্লাহ চান, কাউকে অপমানিত করবেন
পবিত্রজনদের বদনাম রটনায় তার মন ধাবিত করেন।
সমাজে কিছু লোক আছে, তারা দেখতে ভালো মানুষ। তবে নেককার পবিত্র হৃদয়ের লোকদের অপমান করতে চায়, বদনাম রটায়। এর রহস্য উদঘাটন করে মাওলানা রূমী বলেন, আসল কারণ হচ্ছে, আল্লাহ পাক যখন কাউকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করার ইচ্ছা করেন, তখন তার মনে জাগ্রত হয় শয়তানী কুমন্ত্রণা। তখন সে ভাল লোকদের মানহানীর চেষ্টায় লেগে যায়। অর্থাৎ যারা ভালো ও পূতঃচরিত্র লোকদের বদনাম রটায়, সম্মানহানির চেষ্টা করে, তারা আসলে নিজেরাই নিজেদের কপালে আগুন দেয়। কারণ, এরূপ লোকদেরকে আল্লাহ পাক অপমানিত করেন। আল্লাহর বন্ধুদের, ওলী-আল্লাহদের সাথে যারা শত্রুতা পোষণ করে আল্লাহ নিজেই তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নেন। পক্ষান্তরে-
چون خدا خواهد که پوشد عیب کس
کم زند در عیب معیوبان نفس
চোন খোদা খা’হাদ কে পূশদ আইবে কাস
কম যানাদ দর আইবে মা-য়ুবা’ন নাফাস
যদি আল্লাহ চাহেন দোষ গোপন করবেন কারো
দোষ যাদের আছে উচ্চবাচ্য করে না, তাদের বেলায়ও।
অর্থাৎ এমন লোক দোষী লোকদের দোষচর্চা থেকেও বিরত থাকে। এর মূল কারণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা লোকটির দোষখাতা গোপন রাখতে চান। তাই তার মুখ বন্ধ রাখেন, মানুষের দোষচর্চা হতে বিরত রাখেন। এমনকি দোষী লোকদের দোষখাতা সম্পর্কেও উচ্চবাচ্য করে না। মাওলানা রূমী বলতে চান যে, যারা সৎ লোক, নেককার ও পবিত্রজনদের বদনাম রটায় তাদেরকে আল্লাহ অপমানিত করেন। আর তিনি যাদের দোষত্রুটি গোপন রাখার ইচ্ছা পোষণ করেন, তাদের মুখে ও আচরণে এমন সংযম দান করেন, যার ফলে দোষী লোকদের দোষচর্চা থেকেও তারা বিরত থাকেন।
আরেক শ্রেণির মানুষ আছে যাদেরকে আল্লাহ পাক সরাসরি সাহায্য করতে চান। কিন্তু কিভাবে অসহায় বান্দা আল্লাহর সাহায্য লাভ করতে পারবে। আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সেই যোগাযোগের মাধ্যম কী? কোন মাধ্যমে সেই সাহায্য পৌঁছবে আরশে আযীম হতে যমীনে বান্দার কাছে। মাওলানা সেই সহজ পথটি বলে দিচ্ছেন সাদামাটা ভাষায়-
چون خدا خواهد که مان یاری کند
میل ما را جانب زاری کند
চোন খোদা খা’হাদ কে মা’ন য়া’রী কুনাদ
মেইলে মা’রা’ জা’নেবে যা’রী কুনাদ
যদি আল্লাহ চান আমাদের সাহায্য করবেন
কান্নার দিকে তখন আমাদের মন ধাবিত করেন।
আল্লাহ যদি আমাদেরকে তার সাহায্য দ্বারা পুষ্ট ও শক্তি যোগাতে চান, তাহলে আমাদের মন ও ধ্যানকে তার কাছে কান্নাকাটির দিকে ধাবিত করেন। সাধারণত আমরা বুঝি কান্না দূঃখের আলামত। তাহলে কান্না কিভাবে আল্লাহর সাহায্য ও সুখ বয়ে আনবে?
মাওলানা এ প্রশ্নের সমাধানে বলছেন,
آخر هر گریه آخر خنده ایست
مرد آخر بین مبارک بنده ایست
আ’খেরে হার গিরয়া আ’খের খান্দায়ীস্ত
মর্দে আ’খের বীন মুবা’রক বান্দায়ীস্ত
কান্নার পরে হাসি’ এ তো শাশ্বত সত্যকথা
পরিণামদর্শী বান্দাই হয় সৌভাগ্যবান বান্দা।
কান্নার পরে হাসি আসবেই। দূঃখের পরে সুখ অবশ্যম্ভাবী। এ হচ্ছে আল্লাহর সাজানো বিশ্বব্যবস্থা, শাশ্বত সত্যকথা। কাজেই যে ব্যক্তি পরিণাম চিন্তা করে কাজ করে, পরে যা আসবে তার আশায় বর্তমানকে বরণ করে, সে-ই সৌভাগ্যবান। কাজেই আল্লাহর কাছে বান্দার কান্না বৃথা যাবে না, যেতে পারে না।
هرکجا آب روان سبزه بود
هرکجا اشکی دوان رحمت شود
হারকুজা’ আ’বে রওয়া’ন সবযা’ বুয়াদ
হারকুজা’ আশকী দওয়াঁ রহমত বুয়াদ
যেখানেই পানির প্রবাহ-সেখানে সবজার বাগ
যেখানে অশ্রুর বন্যা নামে সেথা রহমত।
মরুভূমির ধু-ধু বালুচরে যেখানে ঝর্ণার পানি, সেখানে সবুজের সমারোহ দেখা দেয়, জাগে সবুজ বাগান। অনুরূপ যেখানে বান্দার অশ্রু ঝরে সেখানে নেমে আসে আল্লাহর রহমত।
সেই লোকও রহমতের নবীর দয়ার পরশ লাভে ধন্য হলো। হৃদয় নিংড়ানো আকুতি দিয়ে ক্ষমা চাইল। তাই তিনি ক্ষমা করে দিলেন। তার মুখ সোজা হয়ে গেল। আর কান্না রূপান্তরিত হলো বুকভরা হাসিতে।
মাওলানা বলছেন, তুমি যদি আল্লাহর রহমত পেতে চাও, হৃদয়ের তপ্ত মরুভূমিতে যদি সবজার বাগ জাগাতে চাও, তাহলে কাঁদো।
باش چون دولاب نالان چشم تر
تا زصحن جانت بر روید خضر
বা’শ চোন দোলা’ব না’লা’ন চশ্্ম্তর
তা’ যে চাহনে জাঁ’ত বর রূয়াদ খোযর
হও বালতির মতো ক্রন্দসি অশ্রুসিক্ত নয়ন
প্রাণের আঙ্গিনায় তোমার হবে সবুজের উদগম।
বালতি মূলে ‘দোলাব’। প্রাচীনকালে পানির কুয়া থেকে চর্কির সাহায্যে পানি তুলতে যে বালতির ব্যবহার ছিল, তার নাম দোলাব। পানি তোলার সময় যেমন দোলাব হতে পানি ঝরে, খালি বালতি নিচে নামানোর তেমনি পানি ঝরতে থাকে। কাজেই আল্লাহর রহমত পেতে হলে তোমাকে সেই দোলাবের মত ক্রন্দসি হতে হবে। তোমার দু’নয়ন থাকতে হবে সদা অশ্রুসিক্ত। হাদীস শরীফে বর্ণিত, ‘তুমি আল্লাহর কাছে কাঁদো। যদি কান্না না আসে অন্তত কান্নার ভান করো।’ কারণ কান্নাই আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোয়ার আনে। প্রশ্ন হলো, ইচ্ছা থাকলেও আমরা তো কাঁদতে পারি না। আমাদের মনের জমিন তো মরু সাহারা। চোখে দু’ফোটা অশ্রুই তো বড় দুর্লভ। কাজেই কোথায় পাবো সেই অশ্রুসিক্ত নয়ন? মাওলানা রূমী (র.) তার সমাধান দিচ্ছেন-
اشک خواهی رحم کن بر اشک بار
رحم خواهی بر ضعیفان رحم آر
আশ্ক্ খা’হী রাহ্ম কুন বর আশ্ক্বা’র
রাহম খা’হী বর যয়ীফাঁ’ রাহ্ম আ’র
অশ্রু-চাও তো রহম করো অশ্রুসিক্তের উপর
রহমত যদি চাও রহম দেখাও দুর্বলদের ওপর।
তুমি নিজের চোখে অশ্রু পেতে চাও, তাহলে তার সহজ পন্থা-যারা অশ্রুসিক্ত, দুঃখ-দুর্দশায় জীবনের ঘানি টানছে, যাদের চোখের পানি শুকায় না, যারা ইয়াতীম অসহায়, অভাবী, নিরাশ্রয়, যালিমের হাতে নিপীড়িত, তাদের প্রতি দয়া দেখাও, ইয়াতীমের মাথায় দয়ার হাত বুলাও। বিনিময়ে তুমি তোমার নয়নে অশ্রুর মহামূল্যবান সম্পদ লাভ করবে। আর যদি সরাসরি আল্লাহর রহমত পেতে চাও, তাহলে সমাজে যারা দূর্বল, তাদের প্রতি দয়া দেখাও, তাদের সাহায্য করো, তাদের ডাকে সাড়া দাও, তাহলেই আসমান থেকে রহমতের সওগাত নেমে আসবে তোমার উপর। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
الرَّاحِمونَ يَرحَمُهمُ الرَّحمنُ، ارْحَموا أهْلَ الأرضِ يَرْحَمْكم مَن في السَّماءِ
-যারা দয়া দেখায় তাদের প্রতি দয়াময় আল্লাহ দয়া দান করেন। তোমরা যমীনে যারা আছে, তাদের প্রতি দয়া দেখাও, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন। (আব্দুল্লাহ ইবন উমর বর্ণিত, আবু দাউদ)