উম্মতে মুহাম্মদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে অল্প আমলে অধিক সাওয়াব লাভ করার বিশেষ কিছু সুযোগ দিয়েছেন। নামায একটি ফরয ইবাদত। আর এই ফরয বিধান আদায়ের পর কিছু যিকর রয়েছে, যার মাধ্যমে অশেষ ফদীলত অর্জন করা যায়। কিন্তু এই আমলগুলোর গুরুত্ব ও ফদীলত নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক না থাকলেও, এগুলো কখন আদায় করা হবে তা নিয়ে বেশ মতভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছু ব্যক্তিবর্গকে দেখা যায়, তারা যেসব নামাযের পর সুন্নাতে মুআক্কাদাহ রয়েছে, সেসব নামাযে ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পর সংক্ষিপ্ত মুনাজাত শেষ হতেই সেই যিকরগুলো পাঠ শুরু করে দেন। যিকর, তাসবীহ শেষ করে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ আদায় করেন। আবার ভিন্ন আরেক শ্রেণিকে দেখা যায়, তারা যিকর এবং তাসবীহ পাঠে এতো মনোযোগী হন যে সালাম ফিরানোর পর ইমাম সাহেবের সাথে মুনাজাতে পর্যন্ত শরীক হন না। তারা মূলত তাসবীহ এবং যিকর আদায়ের দাওয়াত দিয়ে কৌশলে সাধারণ মানুষের কাছে ফরয নামাযের পর মুনাজাত এবং সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামায আদায় করাকে হালকা করতে চান। আর তাদের এই ধোঁকায় পড়ে অনেকে এসব গুরুত্বপূর্ণ আমল থেকে অনেক দূরে ছিঁটকে পড়েছেন। এই নিবন্ধে আমরা ফরয নামায আদায়ের পর পাঠ্য যিকরসমূহ কী কী এবং সেগুলোর ফদীলত ও আদায়ের মুস্তাহাব সময় ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানবো।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় ফরয নামায আদায়ের পর পাঠ্য অনেক যিকরের প্রমাণ রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সেগুলো তুলে ধরছি।
ফরয ও সুন্নাতের মাঝখানে কী পড়া হবে এ বিষয়ে হযরত আয়িশা (রা.) রিওয়ায়াত করেছেন। নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাম ফিরাতেন তখন তিনি বলতেন,
اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلَامُ، وَمِنْكَ السَّلَامُ، تَبَارَكْتَ يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
(সুনান আবূ দাউদ, হাদীস-১৫১২)
উল্লেখিত হাদীসের ভিত্তিতে উলামায়ে আহনাফ বলেন, সালাম ফিরানোর পর ‘আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম….’ এই দুআ পাঠ করা মুস্তাহাব এবং এই দুআ পাঠ শেষে যদি সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামায থেকে থাকে, তবে সুন্নাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়াই মুস্তাহাব।
ইমাম শরনবুলালী (র.) তাঁর বিখ্যাত কিতাব “মারাকিল ফালাহ” গ্রন্থে বলেন, ফরয নামাযের পর যে সুন্নাত নামায থাকে, সেই সুন্নাত নামায আদায়ের জন্য (ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর পর) দাঁড়িয়ে যাওয়া মুস্তাহাব। অর্থাৎ মুস্তাহাব হচ্ছে, ফরয এবং সুন্নাতের মধ্যখানে পার্থক্য করা, যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “আল্লাহুম্মা আন্তাস সালাম…” এই দুআ পাঠের সময় পরিমাণ বসার মাধ্যমে পার্থক্য করতেন। অতঃপর তিনি সুন্নাত আদায়ের জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। ইমাম কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম (র.) বলেন, আর এই দুআ-ই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত যিকর যেটা তিনি সুন্নাতের আগে পড়তেন এবং যার দ্বারা তিনি ফরয এবং সুন্নাতের মধ্যে পার্থক্য করতেন। (হাশিয়াতুত তাহতাওয়ী আলা মারাকিল ফালাহ, দারুল কুতুব আল ইলমিয়া হতে প্রকাশিত নুসখা, ৩১১-৩১২ পৃ.)
ইমাম ইবন আবিদীন আশ শামী (র.) তাঁর “হাশিয়াতু ইবন আবিদীনে” তথা ফাতওয়ায়ে শামীতে উল্লেখ করেন, (ইমাম হাসকাফী র.) বলেন, (ফরয আদায়ের পর) সুন্নাত আদায়ে ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম….’ এই দুআ পাঠের পরিমাণের চাইতে বেশি সময় দেরি করা মাকরূহ হবে।
(ইমাম ইবন আবিদীন র. বলেন) যেহেতু ইমাম মুসলিম এবং তিরমিযী (র.) হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম….” এই দুআ পাঠের পরিমাণের চাইতে বেশি সময় বসতেন না। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-২৯৮)
আর হাদীস শরীফে নামায শেষে যেসব যিকরের কথা বর্ণিত হয়েছে, তা সুন্নাতের আগে পড়তে হবে এমনটা নির্দেশ করে না। বরং সেগুলো সুন্নাতের পরে আদায়ের অর্থে বহন করা হবে। কেননা সুন্নাত হচ্ছে ফরয নামাযের সাথে সংযুক্ত, তার অনুগামী এবং তাকে পরিপূর্ণতা দানকারী বিষয়। সুতরাং সুন্নাতকে ফরয থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হবে না। আর (ফরয এবং) সুন্নাতের পরে সেই তাসবীহগুলো আদায় করার অর্থ হবে ফরযের পরেই আদায় করা (অর্থাৎ এভাবে আমল করার দ্বারা হাদীসের খিলাফ হবে না)। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, শাইখ হুসাম ফারফুর তাহকীককৃত নুসখা, ৩য় খণ্ড, ৪২৪ পৃ.)
সুতরাং দুই ইমামের ফাতওয়া থেকে আমরা জানলাম, সালাম ফিরানোর পর “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম…” এই দুআ পাঠ করা সুন্নাত এবং এই দুআ পাঠ শেষে সুন্নাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া-ই হলো সুন্নাত। আর সুন্নাতে না দাঁড়িয়ে অন্যান্য তাসবীহ পাঠে লিপ্ত হওয়া মাকরূহ।
শামসুল আইম্মা ইমাম হালাওয়ানী (র.) বলেছেন, সুন্নাতের আগে অন্যান্য তাসবীহ পড়তে কোনো আপত্তি নেই। এই কথার ব্যাখ্যায় হানাফী মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন, কেউ পড়লে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে, তবে সেই তাসবীহ এবং যিকরসমূহ সুন্নাতের পরে পড়া উত্তম। আর সুন্নাতের আগে পড়া খিলাফে আওলা, মাকরূহে তানযিহী হবে। (হাশিয়াতুত তাহতাওয়ী, ৩১২ পৃ.)
এখানে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় পেশ করছি। আমাদের উল্লেখিত দুআই হচ্ছে হাদীস। অথচ আমরা এই দুআ পাঠের সময় কিছু শব্দ বৃদ্ধি করে থাকি। যেমন- فحينا ربنا بالسلام، وأدخلنا دار السلام ইত্যাদি। এই বাক্যগুলোর অর্থ সুন্দর। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই বাক্যগুলো হাদীসের শব্দ নয়।
হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরানোর পর আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম… এই দুআ পাঠের পরিমাণ থেকে বেশি সময় বসতেন না। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সালাম ফিরানোর পর আরও কিছু দুআ প্রমাণিত আছে। প্রথমে সেগুলো তুলে ধরব, অতঃপর উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করব।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম…” এই দুআ পাঠের আগে তিনবার ইস্তিগফার পাঠ করতেন। যেমন সহীহ মুসলিম শরীফের বর্ণনা- হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁর নামায শেষ করতেন, তখন তিনবার ইস্তিগফার পাঠ করতেন এবং বলতেন,
اللَّهُمَّ أَنْتَ السَّلاَمُ وَمِنْكَ السَّلاَمُ تَبَارَكْتَ ذَا الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ
-হে আল্লাহ! আপনি শান্তিময় এবং আপনার থেকেই শান্তি। আপনি বরকতময় হে মহিমান্বিত ও সম্মানিত।
ওয়ালীদ বলেন, আমি আওযাঈকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইস্তিগফার’ কিরূপ? তিনি বললেন, আসতাগফিরুল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহ বলবে। (সহীহ মুসলিম, ৫৯১)
যেমন সহীহ মুসলিম শরীফের অন্য বর্ণনায় এসেছে, মুগীরা ইবন শুবা (রা.) মুআবিয়া (রা.) কে লিখে পাঠালেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে সালাম ফিরিয়ে বলতেন,
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ اللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ
-আল্লাহ ভিন্ন কোন মা’বুদ নেই। তিনি একক। তার কোন অংশীদার নেই। রাজত্ব তাঁরই এবং প্রশংসাও তাঁরই প্রাপ্য। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান। হে আল্লাহ! তুমি যা দিতে চাও, তা কেউই রোধ করতে পারে না এবং তুমি যা রোধ কর, তা কেউ করতে পারে না। আর কোন সম্পদশালীর সম্পদ তোমার আযাব থেকে তাকে রক্ষা করতে পারবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-৫৯৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত আরও দুআ পাওয়া যায়।
হযরত মুআয ইবন জাবাল (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে বললেন, হে মুআয! আমি তোমাকে ভালোবাসি। তখন আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিও আপনাকে ভালোবাসি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি প্রত্যেক নামাযে বলতে বাদ দেবে না,
أللهم أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ
(সুনান আবু দাউদ; সুনান আন নাসাঈ; মুসনাদে আহমদ, হাদীস-২২১১৯)
সুতরাং এসব হাদীস থেকে বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম…’ এই দুআ ছাড়াও অন্যান্য দুআ করেছেন। অথচ আয়িশা (রা.) এর বর্ণিত পূর্বের হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম….” এই দুআর বেশি পাঠ করতেন না। সুতরাং এর সমন্বয় করতে গিয়ে ইমাম তাহতাওয়ী (র.) বলেন, হযরত আয়িশা (রা.) এর হাদীস দ্বারা এটা উদ্দেশ্য নয় যে, “আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম…” নির্দিষ্ট এই দুআ পড়তেই হবে বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআ পাঠ করার সময় পরিমাণ বা অন্যান্য দুআ যা ঐ পরিমাণ সময়ে পড়া যায় সেই পরিমাণ সময় সালাম ফিরানোর পর বসতেন। সুতরাং সহীহাইনের অন্যান্য হাদীসের সাথে আয়িশা (রা.) এর হাদীসের কোনো বিরোধ নেই। (হাশিয়াতুত তাহতাওয়ী, ৩১২ পৃ.)
একই কথা ফাতওয়ায়ে শামীতেও লিখা আছে। ইমাম শামী (র.) বলেন, ইমাম হালাওয়ানী (র.) এর কথা, হাদীসে বর্ণিত আযকার সালাম ফিরানোর পর পড়তে বাধা নেই, একথার ব্যাখ্যা হচ্ছে- ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম..’ এই জাতীয় দুআর সময় পরিমাণ হাদীসে বর্ণিত অন্যান্য দুআসমূহ পড়া যাবে। যেহেতু এখানে আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম.. এই দুআকে খাস করা উদ্দেশ্য নয়। বরং এর সমপরিমাণ অন্যান্য দুআ পড়া যাবে, তবে তার চাইতে দীর্ঘ করা যাবে না। এর চাইতে দীর্ঘ করাটা মাকরূহে তানযীহি হবে। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪২৬,৪২৭)
সুতরাং ফরয নামাযের সালাম ফিরানোর পর তিনবার ইস্তিগফার পড়ার পর হাদীসে বর্ণিত দুআসমূহ থেকে যেকোনোটা পড়া সুন্নাত হবে এবং সংক্ষিপ্ত এই দুআ শেষে সুন্নাতের জন্য দাঁড়িয়ে যাওয়া মুস্তাহাব হবে।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা জরুরি। অনেক মসজিদে দেখা যায় জুমুআর নামায শেষে অনেক দীর্ঘ দুআ করা হয়, অথচ জুমুআর ফরয শেষে বা’দাল জুমুআ সুন্নাতে মুআক্কাদা নামায রয়েছে। সুতরাং জুমুআর নামায শেষে এতো দীর্ঘ দুআ করা মুনাসিব নয়। বরং তা মাকরূহ কাজ বলে গণ্য হবে। সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরয নামায শেষে দুআ করেছেন। অথচ একশ্রেণির লোক বলেন, ফরয নামাযের পর দুআর কোনো অস্তিত্ব নেই! অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! কোন সময় দুআ বেশি কবূল হয়? তিনি বললেন, শেষ রাতের মাঝভাগের এবং ফরয নামাযগুলোর পরের দুআ। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস-৩৪৯৯)
হাফিয ইবন হাজার (র.) বলেন, সালাম ফিরানোর পর দুআ নেই বলে যা দাবি করা হয়, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। কেননা মুআয (রা.) থেকে প্রমাণিত আছে, তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওসীয়ত করে বলেছেন, তুমি প্রত্যেক নামায শেষে বলতে বাদ দেবে না,
أللهم أَعِنِّي عَلَى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ
(ফাতহুল মুলহিম, যাকারিয়া বুক ডিপো, ৩ খণ্ড, ৪৫১ পৃ.)
কিছু লোক হয়তো দাবি করবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করেছেন কিন্তু হাত তুলে করেননি! এ বিষয়ে নিম্নে তুলে ধরছি।
হাত তুলে দুআ
দুআতে হাত তুলা মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তবুও ঠিক নামাযের পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত তুলে দুআ করেছেন, তা প্রমাণের জন্য আমরা একটি হাদীস উল্লেখ করব। হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) রিওয়ায়াত করেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায থেকে সালাম ফিরানোর পর কিবলাহমুখী হয়ে হাত তুললেন অতঃপর বললেন, হে আল্লাহ! আপনি ওয়ালি বিন ওয়ালিদ এবং আইয়াশ বিন রাবিয়াকে মুক্ত করে দিন। (তাফসীরে ইবন কাসীর, ১/৮২৩ পৃ.; সূরা নিসা, আয়াত-১০০)
ইমাম ওকাইলী (রা.) তাঁর الضعفاء ( ৩/৯৯) কিতাবে এই হাদীস উল্লেখ করে বলেন, এই হাদীসটি এই সনদ ছাড়াও আরো অন্যান্য উত্তম সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
সম্মিলিত দুআ
সম্মিলিত দুআও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কোনো একটি দল একত্রিত হয়ে হাত তোলে আল্লাহ তাআলার নিকট কোনো কিছু চায় তখন আল্লাহ তাআলার দায়িত্ব হয়ে যায়, যা তারা চায় তা তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া। (আল মুজামুল কাবীর লিত তাবারানী, হাদীস-৬১৪২, ইমাম হাইসামী মাজমাউয যাওয়ায়িদে হাদীসখানা উল্লেখ করে বলেন, এই হাদীসের প্রত্যেক রাবীই সহীহ হাদীসের রাবী অর্থাৎ হাদীসখানা সহীহ।)
ফরয নামায শেষে ইমামের দাঁড়ানোর সুন্নাহ পদ্ধতি
সংক্ষিপ্ত দুআ শেষে সুন্নাতে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে ইমামের জন্য আরেকটি সুন্নাত হচ্ছে, তিনি তার বামদিকে কিছুটা সরে দাঁড়াবেন। ইমাম শামী (র.) বলেন, ইমামের জন্য (ফরয আদায়ের জায়গায়) সুন্নাত আদায় করা মাকরূহে তানযিহী। বরং তিনি কিছুটা সেই জায়গা থেকে ডানে/বামে সরে দাঁড়াবেন। (ইমাম শরনবুলালী (র.), ইমামের বামদিকে সরে যাওয়া উত্তম বলেছেন)। তবে মুক্তাদী এবং একাকী নামায আদায়কারী চাইলে ফরয নামায আদায়ের স্থানেই সুন্নাত পড়তে পারবেন (এতে মাকরূহ হবে না), তবে অন্যস্থানে সুন্নাত আদায় করা উত্তম হবে। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, খণ্ড ৩, ৩২৭,৩২৮ পৃ.)
ফরয বা সুন্নাত নামাযের পর বসার পদ্ধতি
যদি ফরয নামাযের পর সুন্নাত নামায না থাকে তবে ইমাম সাহেব মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসা মুস্তাহাব। ইমাম শরনবুলালী (র.) বলেন, সুন্নাত শেষে কিবলাহমুখী হয়ে বসা মুস্তাহাব (ইমাম মুকতাদী সবার জন্য)। আর যদি ফরয নামায শেষে কোনো সুন্নাত না থাকে তবে মানুষের তথা মুক্তাদীদের দিকে ইমাম সাহেব ফিরে বসা মুস্তাহাব। যেহেতু বুখারী ও মুসলিমে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে সাহাবাদের দিকে ফিরে বসতেন। ইমাম সাহেব চাইলে তার বামদিকে ফিরে কিবলাহকে ডানদিকে রেখে বসতে পারবেন, আবার চাইলে নিজে ডানদিকে ফিরে বামদিকে কিবলাহকে রাখতে পারবেন, আর এভাবে ফিরাই উত্তম। যেহেতু মুসলিম শরীফে এসেছে, সাহাবী বলেন, আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিছনে নামায আদায় করতাম, তখন তার ডানপার্শ্বে থাকাই পছন্দ করতাম, যেন তিনি আমাদের দিকে মুখ ফিরান। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-৭০৯)
অতঃপর ইমাম ও মুকতাদী নামাযের পরের যিকর-আযকার পাঠ করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অসংখ্য যিকর প্রমাণিত আছে। সংক্ষেপে কয়েকটি উপস্থাপন করা হলো-
আয়াতুল কুরসী পাঠ
হযরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, তিনি এই মিম্বরের কাঠে দাঁড়িয়ে ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে তার বেহেশতে প্রবেশে মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। আর যে ব্যক্তি ঘুমানোর সময় তা পাঠ করবে, আল্লাহ পাক তার ঘর, তার প্রতিবেশীর ঘর এবং আশপাশের আরও কতক ঘরকে নিরাপদে রাখবেন। ইমাম বাইহাকী শুআবুল ঈমানে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, এর সনদ দুর্বল। (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস-৯৭৪)
সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পাঠ
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، قَالَ أَمَرَنِي رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ أَقْرَأَ الْمُعَوِّذَاتِ دُبُرَ كُلِّ صَلاَةٍ .
-উকবা ইবন আমির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রত্যেক নামাযের পর সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়তে আদেশ করেছেন। (সুনান আন নাসাঈ, হাদীস-১৩৩৬)
তাসবীহ পাঠ
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন,
عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ سَبَّحَ اللَّهَ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلاَةٍ ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ وَحَمِدَ اللَّهَ ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ وَكَبَّرَ اللَّهَ ثَلاَثًا وَثَلاَثِينَ فَتِلْكَ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ وَقَالَ تَمَامَ الْمِائَةِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ غُفِرَتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
-রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর সুবহানাল্লাহ তেত্রিশবার, আলহামদুলিল্লাহ তেত্রিশবার ও আল্লাহু আকবার তেত্রিশবার বলবে এই হল নিরানব্বই-আর একশত পূর্ণ করার জন্য বলবে-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
তার পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মত হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-৫৯৭)
৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পড়াও প্রমাণিত আছে।
আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত , তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোন মুসলিম ব্যক্তি দুইটি অভ্যাসে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে পারলে সে নিশ্চয়ই জান্নাতে প্রবেশ করবে। জেনে রাখ! উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো আয়ত্ত করা সহজ। সে অনুসারে অনেক অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই তা আমল করে থাকে।
(এক) প্রতি ওয়াক্তের (ফরয) নামাযের পর দশবার সুবহানাল্লাহ, দশবার আলহামদুলিল্লাহ ও দশবার আল্লাহু আকবার বলবে। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি নামাযের পর স্বীয় হস্তে গণনা করতে দেখেছি। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (পাঁচ ওয়াক্তে) মুখের উচ্চারণে একশত পঞ্চাশ বার এবং দাঁড়িপাল্লায় দেড় হাজার হবে।
(দুই) আর শয্যা গ্রহণকালে তুমি ‘সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ও আলহামদু লিল্লাহ’ একশত বার বলবে, ফলে তা মীযানে এক হাজারে রূপান্তর হবে। তোমাদের মাঝে কে এক দিন ও এক রাতে দুই হাজার পাঁচশত গুনাহে লিপ্ত হয়? (অর্থাৎ এতগুলো পাপও ক্ষমাযোগ্য হবে)।
সাহাবীগণ বলেন, কোন ব্যক্তি সবসময় এরূপ একটি ইবাদাত কেন করবে না! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের কেউ নামাযে অবস্থানরত থাকাকালে তার কাছে শয়তান এসে বলতে থাকে, এটা মনে কর ওটা মনে কর। ফলে সেই নামাযী শয়তান ধোঁকাবাজির মাঝেই রত থাকা অবস্থায় নামায শেষ করে। আর উক্ত তাসবীহ আমল করার সে সুযোগ পায় না। পুনরায় তোমাদের কেউ শোয়ার জন্য শয্যা গ্রহণ করলে শয়তান তার নিকট এসে তাকে ঘুম পাড়ায় এবং সে তাসবীহ না পাঠ করেই ঘুমিয়ে পড়ে। (সুনান আত তিরমিযী, হাদীস- ৩৪১০)
দুরূদ পাঠ
হযরত ফাযালা বিন উবাইদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إَذَا صلَّى أحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِتَحْمِيدِ اللهِ والثَّناءِ عليهِ، ثُمَّ يُصَلِّي عَلَى النَّبِيِّ صلَّى اللهُ عليهِ وسَلَّمَ ثُمَّ يَدْعُوْ بِما شَاءَ
-নামায শেষে তোমরা প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করো, এরপর গুণকীর্তন করো, নবীর ওপর দুরূদ পড়ো। এরপর তোমাদের যা কিছু চাওয়ার তা তোমরা চাও। (সুনান আন নাসাঈ, হাদীস-১২৮৪)